নিঃসঙ্গ সম্রাজ্ঞী

অরিজিৎ গুহ

 

১৯৩৩ সালের ভ্যালেন্টাইন ডে-র দিনে যখন মমতাজ জাহান বেগম জন্মান, এক জ্যোতিষী, যাকে কাশ্মীরওয়ালে বাবা নামে ডাকা হত, তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ‘এই মেয়ে বড় হয়ে অনেক নাম কামাবে, অনেক বিত্ত ও যশের অধিকারী হবে’। তবে… বলে একটু থেমে আবার বলেছিলেন, ‘বয়সের অনেক আগেই এর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়ে যাবে।’
রক্ষণশীল পাঠান আতাউল্লা খান ছিলেন পেশোয়ারে ‘ইম্পেরিয়াল টোবাক্যো কোম্পানি’র ড্রাইভার। বরাবরই ডাকাবুকো ও স্বাধীনচেতা মানুষটি কোনওদিনও কারও চোখ রাঙানি সহ্য করেননি। তাই একটা তুচ্ছ কারণে কোম্পানির সাথে ঝগড়া করে পনেরো বছরের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পরিবার নিয়ে চলে এলেন দিল্লিতে। এখানেই তার তৃতীয় সন্তান মমতাজ বেগমের জন্ম। দিল্লিতে ভাগ্য ফেরানোর আশায় এলেও এই শহরে তার ভাগ্য তার দিকে মুখ তুলে তাকায় না। বাধ্য হয়ে আবার তাকে স্থানান্তরিত হতে হয়। এবার গন্তব্য বম্বে। বম্বেতে থিতু হওয়ার পর চলছে অপরিসীম দারিদ্রের সাথে লড়াই। এক বীভৎস অগ্নিকাণ্ডে বম্বেতে তাদের থাকার ছোট্ট ঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর স্থান হয় আতাউল্লা খানের এক বন্ধুর বাড়িতে। এরকম ভাগ্যবিপর্যয় ঘটায় আতাউল্লা খান ঠিক করেন তার পরমাসুন্দরী তৃতীয় কন্যাকে সিনেমায় নামাবেন। এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না পরিবারের ভরণপোষণের। সেই সময়ে প্রায় প্রতিদিন দাদারের স্টুডিওর সামনে একটা ছোট্ট মেয়েকে তার বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত, যদি কোনও পরিচালকের নজরে পরে সেই আশায়। অবশেষে পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর ফিল্ম ‘বসন্ত’-এ ৯ বছর বয়সে বেবি মুমতাজ হিসেবে প্রথম রোল। সিমেমায় দুটি গানও ছিল তার গলায়। এরপর ১৯৪৪ সালে কেদার শর্মার ‘মুমতাজ মহল’ এ অভিনয়ের পরই শিশু অভিনেতা থেকে আস্তে আস্তে তার হিরোইন হওয়ার দিকে যাত্রা শুরু। এরপর কেদার শর্মার আরও চারটে সিনেমা, ১৯৪৫ এ ‘ধন্য ভগত’ আর ১৯৪৬ এ ‘ফুলওয়ারি’, ‘পূজারি’ আর ‘রাজপুতানি’ সিনেমায় অভিনয়ের পরই ১৯৪৬-এ প্রথম নায়িকার রোলে। সিনেমার নাম ‘নীল কমল’। নায়ক আরেক নবাগত রাজ কাপুর।

কেদার শর্মার কথায় ‘তার সৌন্দর্য, তার ট্যালেন্ট এগুলো কোনও কিছুই আমাকে আকৃষ্ট করেনি। যেটা আমাকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করেছিল সেটা হচ্ছে ওর কাজের প্রতি নিষ্ঠা। যেন একটা মেশিনের মতো কাজ করত। প্রত্যেকদিন মালাড থেকে দাদারে ভিড়ে ঠাসা কামরায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে আসত, তাও একদিনও লেট বা কামাই করত না। বেশিরভাগ দিনই দুপুরের খাওয়াটা হত না, এতকিছুর পরও নিজের বাবার প্রতি দায়িত্বটা ভুলত না। ছোট ছোট ভাই বোনগুলো যে ওর দিকে তাকিয়েই বসে আছে সেটা সব সময় মাথায় থাকত। নিষ্ঠার সাথে সেই দায়িত্বটাও পালন করত।’
কেদার শর্মার এই কথার বাস্তব প্রমাণ রয়ে গেছে একটা গল্পে। ১৯৪৮ সালের এক সকাল। আগের দিন থেকে সারাদিন সারারাত ধরে বৃষ্টিতে বোম্বে প্রায় ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থায়। গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ। লোকজনও রাস্তায় কেউ নেই। ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই নেই আর রাস্তায় জায়গায় জায়গায় গাছ পড়ে বিধ্বংসী অবস্থা বলা যায়। ঠিক সেই সময়ে স্টুডিওতে একজন সিকিউরটি গার্ড সেটের জিনিসপত্র যাতে ভেসে না যায়, সেটা আগলাতে ব্যাস্ত। জল উঠতে শুরু করেছে সেটের মধ্যে। হঠাতই সে অবাক হয়ে লক্ষ করল একটা মেয়ে যেই সময়ে শুটিং শিডিউল ছিল ঠিক সেই সময়ে স্টুডিওতে এসে হাজির হয়েছে। বলাই বাহুল্য, কোনও অভিনেতা পরিচালক কেউই আসতে পারেনি। কী করে সে এল, কত রাতে বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়েছিল কেউ জানে না। মেয়েটা শুধু জানত ওর শুটিং শিডিউল যেই টাইমে আছে তার মধ্যে ওকে পৌঁছাতে হবে। এই ছিল মুমতাজ জাহানের কাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা।

রাজ কাপুরের সাথে ‘নীল কমল’-এর পরও আরও তিনটে ছবিতে মুমতাজ বেগমের অভিনয় দর্শকদের মন জিতে নেয়। ‘চিত্তর বিজয়’, ‘দিল কি রানী’ আর ‘অমরপ্রেম’। দিলীপ কুমার, যিনি মুমতাজের থেকে দশ বছরের বড় ছিলেন, তিনি তার স্মৃতিচারণায় বলছেন, ‘বম্বে টকিজে কাজ করার সময়ে দেখতাম গোল মুখের বাচ্চা মেয়েটা সব সময় খেলে বেড়াচ্ছে। আমার মেক আপ রুমের বাইরে একটা মুখ উঁকি মেরেই পালিয়ে যেত। মুখে কি যেন একটা রহস্য খেলা করে বেড়াত ওর। তবে অভিনয়ের সহজাত প্রতিভা আর প্যাশনটা বরাবরই ছিল লক্ষ করার মতো। এই সময়েই শুভানুধ্যায়ী দেবিকা রাণী ‘মধুর মত মিষ্টি আর ছোট্ট মেয়েটির’ সঠিক নাম রাখেন মধুবালা।

‘বসন্ত’ ছবিতে প্রথম আগমনের পর সিনেমায় মধুবালা হিসেবে পুনর্জন্ম হয় মুমতাজ জাহানের ‘মহল’ সিনেমায়। হিমাংশু রায় আর দেবিকা রাণীর বম্বে টকিজের প্রযোজনায় এই সিনেমা ছিল ১৯৪৯ সালে রিলিজ হওয়া সব থেকে হিট সিনেমা। অতৃপ্ত প্রেম এক জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবাহিত হওয়ার এই গল্পে মধুবালার চরিত্র ছিল এক রহস্যময়ী নারীর। যে চরিত্র হয়ত দিলীপ কুমারের ভাষায় ‘মধুবালার মুখের রহস্যময়তা’র সাথে পরিপূর্ণ রূপে খাপ খেয়ে গেছিল। তাই এখানে প্রাণ ঢেলে অভিনয় করে গেছে। এই সিনেমার সাথে জড়িয়ে থাকা ‘আয়েগা আনেওয়ালা আয়েগা’ গানটাও যেন সিনেমার মূল থ্রিল আর রহস্যময় ভাবটাকে খুব সুন্দরভাবে ধরতে পেরেছিল আর সেটাই আরেকজনকে খ্যাতির সীমায় নিয়ে গেছিল। তিনি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। সেই সময়কার সুপারস্টার অশোক কুমারের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় এবং সেখানে নিজের ছাপ রেখে যাওয়া মুখের কথা ছিল না। অশোক কুমার নিজেই পরে বলেছিলেন মধুবালা ‘মহলের’ শুটিং-এ রিটেকের পর রিটেক নিয়ে গেছে যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে সন্তুষ্ট হচ্ছে। এখনকার পার্ফেকশনিস্ট অভিনেতাদের কাছে রোল মডেল হতে পারে মধুবালা।

১৯৫১-তে রিলিজ হল রাম দারিয়ানির নির্দেশনায় ‘তারানা’। এই ছবিতে মধুবালার সাথে প্রথমবার হিরো হিসেবে এল দেবিকা রাণীর আরেক আবিষ্কার দিলীপ কুমার। সেই দিলীপ কুমার, যাকে ‘জোয়ার ভাটা’র সেটে প্রথমবার ১১ বছর বয়সে মেক আপ রুমের বাইরে থেকে একঝলক দেখেই ছুটে পালিয়ে যেত মধুবালা। প্রথমবার এই জুটি কেড়ে নিল আপামর চলচ্চিত্রপ্রেমী ভারতীয় দর্শকের হৃদয়। সাংবাদিক কে রাজদান তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন ‘এই জুটির প্রতি মানুষের এত চরম উন্মাদনা ছিল, আমার মনে আছে ‘ইন্সানিয়ত’ ছবির প্রিমিয়ারে রক্সি সিনেমায় যখন দুজনে মিলে ঢুকছে, তখন দর্শকদের চিৎকার যেন সমুদ্রের গর্জনকেও হার মানায়। সেই চিৎকার এখনও আমার কানে বাজে’। আর এই উন্মাদনাই জন্ম দিল পর্দার পিছনে আরেকটি অফ স্ক্রিন প্রেমের গল্পের। প্রথম সিনেমায় অভিনয় করার পর থেকেই রিয়েল লাইফে মধুবালা মজে গেল দিলীপ কুমারের প্রেমে। মধুবালা তার বোন শাহিদা কে বলছে ‘দিলীপজির চোখের উজ্জ্বল ভাস্বরতায় যেন হাজার মোতি খেলা করে বেড়ায়।’ এখান থেকে শুরু হল মধুবালার জীবনের একটা বাঁক। কথায় বলে না, সুখ আর দুঃখ সব সময় হাত ধরাধরি করে আসে। মধুবালার জীবনের এই বাঁকের থেকেই সুখ আর দুঃখ হাত ধরাধরি করেই এল। দিলীপ কুমারকে ভালোবেসে যে স্বর্গীয় অনুভূতি হয়েছিল মধুবালার, সেরকম এই ভালোবাসাই আবার তার জীবনে নিয়ে এল চরমতম দুঃখ। চারটে সিনেমা একসাথে তারা অভিনয় করেছিল। তারানার পর ‘সঙ্গ দিল’ ভালো চললেও ‘অমর’ বলে সিনেমাটা বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। অথচ সেটি ছিল একটি অসাধারণ সিনেমা। হয়ত সিনেমাটা সময়ের অনেক আগে তৈরি হয়ে গেছিল তাই দর্শকরা সেটিকে নিতে পারেননি।

১৯৫২-তে মধুবালা লম্বা রোগা পাতলা একটা নতুন ছেলের সাথে ‘জীবন জ্যোতি’ সিনেমায় অভিনয় করল। ছেলেটা অবশ্য ফিল্ম দুনিয়ায় একেবারে নতুন ছিল না। সে ছিল বিখ্যাত কাপুর পরিবারের ছেলে। তারপর আরও কয়েকটা সিনেমায় এই জুটি অভিনয় করার পর ছেলেটি মধুবালাকে প্রেম নিবেদন করল। কিন্তু মধুবালা তখন দিলীপ কুমারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই শাম্মী নামে নতুন ছেলেটিকে প্রত্যাখ্যান করল। শাম্মী কাপুর অবশ্য আজীবন মধুবালাকে শ্রদ্ধা করে গেছে। তার কথায় ‘এইরকম ব্যক্তিত্ব সচরাচর চোখে পড়ে না। আমি আজ অব্দি তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখি। আমি যে ওনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলাম সেটা আমার স্ত্রী গীতাও জানত আর আমার বর্তমান স্ত্রীকেও জানিয়েছি।’

এরকম সময়েই মধুবালা একটা অভূতপূর্ব অফার পেল। ভারতে একটা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন অস্কার বিজেতা পরিচালক ফ্রানক কাপ্রা। উনি মধুবালাকে হলিউডে অভিনয়ের অফার দিলেন। কিন্তু তার রক্ষণশীল বাবা আতাউল্লা খান রাজি না হওয়াতে এই সুবর্ণ সুযোগ হারায় মধুবালা। তবে আমেরিকার পত্রিকা ‘থিয়েটার আর্টস’ তার প্রতি যা লিখেছিল সেটা একজন অভিনেতার পরম পাওনা বলে ধরাই যায়। লিখেছিল ‘পৃথিবীর সব থেকে বড় অভিনেতা, কিন্তু তিনি বেভারলি হিলস-এর নন।

‘৫৫ সালে একটা কমেডি ছবি মিঃ অ্যান্ড মিসেস ৫৫-এ কমিক রোলে অভিনয়ের সময় তার একটু জড়তা ছিল। কমেডি রোলে কী ভাবে মানুষ তাকে নেবে তা নিয়ে একটু চিন্তা ছিল। তবে কদিনের মধ্যেই সেটা আয়ত্ত হয়ে যায় আর বেশ রসিয়ে রসিয়েই অভিনয় করতে থাকে। সেই সময়ে ফিল্ম ক্রিটিক বিক্রম সিং মধুবালা সম্পর্কে একটা দুর্দান্ত মন্তব্য করেন। উনি বলেন ‘এই মুখের প্রতি যে ক্যামেরা সুবিচার করবে না, তার কাজকে একটা ক্রাইম বলে ধরা হবে।’

ফিরে আসি দিলীপ কুমারের সাথে সম্পর্কের অধ্যায়তে। আগেই বলেছি ১৯৫১ সালে ‘জোয়ার ভাটা’র সেটে মধুবালা ১১ বছর বয়সে প্রথম দেখে দিলীপ কুমারকে। সেখানেই মধুবালা তার হেয়ার ড্রেসারকে দিয়ে দিলীপ কুমারকে উর্দুতে একটা চিরকুট লিখে তার সাথে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে প্রথম প্রোপোজ করে পাঠান। প্রথমবার সেটা পেয়ে দিলীপ কুমার বেশ একটু মজাই পেয়েছিলেন। খুব একটা সিরিয়াসলি এই ব্যাপারটাকে নেননি। তবে যত দিন যায়, ওদের দুজনের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসাথে চারটে সিনেমা করার পর সম্পর্কটা অন্য মাত্রা পায়। দুজনের কেউই অবশ্য লোকের সামনে তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে কোনও কথাই বলত না। দুজনেই তাদের প্রেমপর্ব চালাত লোকচক্ষুর অন্তরালে। হয়ত শুটিং-এর পর দুজনে ড্রাইভ করে চলে যেত অনেক দূর। কখনও কখনও মধুবালা গাড়ি নিয়ে দিলীপ কুমারের বাড়ির সামনে এসে হর্ণ বাজাত, স্টুডিওতে যাওয়ার পথে তুলে নিয়ে যেত। তবে কেউ কোনওদিনও কারও বাড়িতে ঢুকত না। প্রায় ন’ বছর তাদের এই প্রেমপর্ব চলেছিল। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সবাই জানত যে তাদের দুজনের একদিন বিয়ে হবে। সেই একদিনটা আর কোনওদিনই আসেনি। কেন ভেঙে গেল সম্পর্কটা? দিলীপ কুমার এই নিয়ে কোনওদিন কারও কাছে কিছু বলেননি। এমনকি উনি মধুবালাকে নিয়ে কোনও কিছু কারও কাছে বলতেও অস্বস্তিবোধ করতেন। খাতিজা আকবর যখন মধুবালাকে নিয়ে বই লিখবেন বলে ঠিক করেন সেই সময়ে বইটা লেখার জন্য দিলীপ কুমারের কাছে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট উনি চান। চেনাশোনা যারা ছিল সবাই বলে ওঠে দিলীপ কুমার কিছুতেই রাজি হবেন না এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য। কিন্তু দিলীপজির ভাই এহসান খানের সাহায্যে যদিও বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেল কিন্তু উনি শর্ত রাখলেন দশ মিনিটের বেশি আমি থাকতে পারব না, আর কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে না। পরে যদিও সেই আলাপচারিতা এক ঘণ্টায় দাঁড়ায়, এবং সেখানে উনি শুধুই ‘মধু’র সম্পর্কেই বলে যান। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে একটাও কথা বলেন না। একদম শেষে যখন দিলীপ কুমারকে জিজ্ঞাসা করা হয় তার সব থেকে প্রিয় অভিনেত্রী কে, বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর উনি বলে ওঠেন, ‘মীনা আর মধু’।

আসলে মধুবালার বড় পরিবারের সবাই নির্ভরশীল ছিল মধুবালার রোজগারের ওপর। আতাউল্লা খান দিলীপ কুমারের সাথে সম্পর্কটা সবই জানতেন, কিন্তু কোনওদিনও মন থেকে চাননি সম্পর্কটা পূর্ণতা পাক। কারণ বিয়ে করে মধুবালা চলে গেলে ওদের পরিবার পুরো অসহায় হয়ে পড়বে। দিলীপ কুমারও সেটা জানতেন। তার সব সময় মনে হত যেন মধুর সঙ্গলাভের পুরো সময়টা আতাউল্লা খানের চোখ দুটো তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। একদিন সেটে ওম প্রকাশের সামনে দিলীপ কুমার ডেকে পাঠালেন মধুবালাকে। মধুবালা ঢুকতেই ওম প্রকাশ উঠে পড়তে চাইলেন, দিলীপ কুমার বাধা দিয়ে বললেন, ‘আপনাকে সাক্ষী মেনে আমি আজ একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাই।’ কি সিদ্ধান্ত? মধুবালার প্রশ্নের উত্তরে দিলীপ কুমার বললেন, ‘আজ এই মুহূর্তে আমি তোমাকে বিয়ে করব। তবে এই মুহূর্তের পর থেকে তুমি তোমার বাড়ির সাথে কোনও সম্পর্ক রাখতে পারবে না। আর কোনওদিনও তোমার বাবার সাথে দেখা করতে পারবে না।’

মধুবালা কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। যতই স্বনির্ভর হোক না কেন, মধুবালার পুরোটা জীবন ছিল বাবার ছায়ায় ঢাকা। বারেবারে দিলীপ কুমারের প্রশ্নের উত্তরে মৌন থেকে মধুবালা তার অসম্মতি বুঝিয়ে দিয়েছিল। সেদিন থেকেই দুজনেই হয়ত বুঝতে পেরেছিল যে এই সম্পর্ক টিকবে না আর। অবশেষে সম্পর্কের এই টানাপোড়েন তীব্র হয়ে ওঠে ‘বি আর চোপরা’র ফিল্ম ‘নয়া দৌড়’কে সামনে রেখে। ইনডোর শুটিং-এর পর ওই সিনেমার একটা বড় আউটডোর শুটিং ছিল ভূপালে। আতাউল্লা খান কিছুতেই রাজি নন মেয়েকে অতদিনের জন্য আউটডোরে ছাড়তে। তার মাথায় তখন ঘুরছে, যতদিনের আউটডোর, ততদিনই দিলীপ কুমারের কাছাকাছি থাকা। এই নিয়ে প্রযোজকের সাথে মনোমালিন্য চরমে উঠল। এর কয়েকদিন আগেই মধুবালার হার্টের সমস্যা ধরা পড়েছে। যখন কোর্টে এই নিয়ে কেস উঠল, আতাউল্লা খান কারণ দেখালেন তার মেয়ের এরকম শারীরিক অবস্থায় অত দূরে তাকে ছাড়া সম্ভব নয়। ডাক্তারের বারণ আছে নাকি। দিলীপ কুমার এখানে প্রযোজকের পাশে দাঁড়ালেন। কোর্টে মধুবালার বিরূদ্ধে জোরালো সাক্ষ্য দিলেন। অনেকে সেই সময় তাকে বারণ করেছিল, কিন্তু দিলীপ কুমারের জেদ চেপে গেছিল তখন। রাগটা আরও বেশি ছিল আতাউল্লা খানের ওপর। মধুবালাও এতে অনেক বিরক্ত হয়ে পরে এবং একসময় কোর্টে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, ‘আমার ভাবতে লজ্জা হচ্ছে যে এই লোকটাকে আমি একসময় ভালোবেসে ছিলাম।’ এতটাই আঘাত পেয়েছিল যে এই কথা বলতে বলতেই কোর্টে কেঁদে ওঠে মধুবালা।
আতাউল্লা খান কোনওদিনও মধুবালাকে দিলীপ কুমারকে বিয়ে করার অনুমতি দেয়নি। সেই সময় এই নিয়ে দিলীপ কুমারের ক্ষোভ থাকলেও অনেক দিন পর উনি বলেন, ‘মধু আসলে ছিল বাবার খুব বাধ্য মেয়ে যে নিজের সব নাম যশ সত্ত্বেও বাবার অধীনতা সারা জীবনের জন্য মেনে চলত।’

যদিও ছোট বোন শাহিদা এই কথা মানতে চায় না। তার কথায় ‘আমাদের বাবা কোনওদিনও ভাইজানের (দিলীপ কুমারকে ভাইজান বলে ডাকত সব বোনেরা) সাথে বিয়েতে আপত্তি করেনি। সে সময়ে আমাদের কাছে অনেক টাকা ছিল। আপা(মধুবালা)র বিয়ে হয়ে গেলেও আমরা ঠিকঠাক মতই নিজেদের চালিয়ে নিতে পারতাম। তাও কেন ভাইজান এরকম করল জানি না।’ আসলে জানতে পারি না আমরা কেউই যে সম্পর্কের রসায়ন কিরকম হয়। হয়ত কেউই দোষী নয়, বা আবার হয়ত সবাই দোষী। কোর্ট কেসের পরেও বেশ কয়েকদিন অব্দি দুজনের ফোনে কথা হত। দিলীপ কুমার বলত তুমি বাবাকে ছেড়ে চলে এসো, আমি তোমাকে বিয়ে করছি, আর মধুবালা বলত তুমি আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে স্যরি বলে যাও। কেউই কারও জেদের জায়গা থেকে সরতে রাজী ছিল না। অবশেষে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটল ১৯৬০-এ। কে আসিফের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সিনেমা ভারতবর্ষের আপামর লোকে যখন পর্দায় দেখছে, সেই সময়েই পর্দার অন্তরালে লিড রোলের দুজনেই এক অপরিসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে চলেছে। যখন ‘মুঘল এ আজম’-এর কাস্টিং করছেন কে আসিফ, সেই সময় উনি নিজেও চিন্তিত কী করে অন স্ক্রিন কেমিস্ট্রিটা দিলীপ কুমার আর মধুবালা স্ক্রিনে ফুটিয়ে তুলবে। কারণ সেই সময় পুরো ইন্ডাস্ট্রি জেনে গেছে দুজনের সম্পর্কের পরিণতির ব্যাপারে। তাও, তাও এতটাই পেশাদারিত্ব ছিল দুজনের, যে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে দূরে ঠেলে রেখে অবলীলায় স্ক্রিনে সেলিম আনারকলির আড়ালে প্রেমের অভিনয় করে গেছে একদম আগের মতো করে। নাহ, ভুল হল। আগের মতো করে নয়, বরঞ্চ এই সিনেমায় তারা আগের সব কিছুকেই ছাপিয়ে গেছিল। আজও লোকে প্রেমের উদাহরণ দিতে গেলে ইতিহাসের সেলিম আনারকলি নয়, দিলীপ কুমার মধুবালার সেলিম আনারকলির উদাহরণ দেয়। পাখির পালক নিয়ে দৃশ্যটাকে এখনও হিন্দি সিনেমার সব থেকে রোমান্টিক দৃশ্য বলে ধরা হয়।

‘মুঘল এ আজম’ যখন শুট করা হচ্ছে, কে আসিফ তখনও জানেন না মধুবালার শারীরিক অসুস্থতার কথা। একটানা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেই কষ্ট হত, তার মধ্যে আসল ভারী শেকল নিয়ে যখন গলায় ঝুলিয়ে হাঁটত, দম বেরিয়ে যেত। তাও একটাও কথা না বলে দৃশ্যের পর দৃশ্য শুট করে গেছে ওরকম অমানুষিক শারীরিক কষ্ট নিয়ে। শুটিং শেষ হওয়ার পর দেখা যেত মধুবালার চামড়া ফেটে নীল হয়ে গেছে।

দিলীপ কুমারের সাথে সম্পর্ক শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই জেদ করে কিশোর কুমারকে বিয়ে করে। দিলীপ কুমারকে এটা দেখানোর তাগিদ ছিল যে, দেখো, তুমি ছেড়ে গেলেও আমি ঠিক কাউকে পেয়ে গেছি। কিন্তু জেদের জোরে নেওয়া সিদ্ধান্ত জীবনে শান্তি দেয়নি। লীনা চন্দ্রভারকারের কথায়, ‘মধুবালা আসলে এমন একজনকে বিয়ে করেছিল যাকে সে ঠিক মতো চিনত না পর্যন্ত। শুধুমাত্র দিলীপ কুমারের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই উনি বিয়েটা করেছিলেন।’

‘চলতি কা নাম গাড়ি’র সেটে কিশোর কুমারের সাথে আলাপ। ১৯৫৮-র এই সিনেমা একটা রোমান্টিক কমেডি। প্রথমদিকে অবশ্য কিশোর কুমারের সাথে সেরকম বন্ধুত্ব কিছু হয়নি, কিন্তু কিশোর কুমারের জীবন থেকে যখন রুমা গুহঠাকুরতা চলে গেলেন, সেই সময়ে কিশোর কুমার অনেক রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন। দিনের পর দিন মা গৌরীদেবীর কোলে মাথা রেখে কেঁদে গেছেন। ঠিক এরকম সময়েই মধুবালার জীবন থেকে দিলীপ কুমারের প্রস্থান। সেই ঘাটতি পূরণ করার জন্য কিশোর কুমারকে বিয়ের প্রস্তাব। কিশোর কুমারও একাকীত্বের মধ্যে কাটাতে কাটাতেই মধুবালার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। অভিনেত্রী নাদিরা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল মধুবালাকে, শেষ অব্দি কিশোর কুমারের মতো একজন পাগলা লোককে তোমার পছন্দ হল! জবাবে মধুবালা বলে, ‘নাদিরাজি, কিশোর কুমারই একমাত্র লোক যিনি আমাকে সব সময় হাসাতে পারেন।’

এই বিয়েটা যদিও কিশোর কুমারের বাড়ি থেকে তার মা বাবা কেউই মেনে নিতে পারেননি। বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর তারা দুজনেই কিশোর কুমারের বাড়ি গৌরীকুঞ্জ থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। যদিও মধুবালা চেয়েছিল কিশোর কুমারের বাড়িতে থেকেই সংসার করবে, কিন্তু যেহেতু মধুবালা গৌরীকুঞ্জে থাকলে তার মা বাবা দেশে চলে যাবে, সেই কারণে মধুবালা সিদ্ধান্ত নিল সে নিজের বাড়িতেই থাকবে। বিয়ের কদিনের মধ্যেই নতুন বউকে নিজের বাড়িতে ফেরত চলে আসতে হয়। বাড়ি ফেরার পথে কি মধুবালার মনে হয়েছিল কিশোর কুমারের সাথে বিয়ের সিদ্ধান্তটা ভুল হয়ে গেছে? হ্যাঁ মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল তার পুরোটা জীবনই ভুলে ঢাকা। সুখ কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না আর জীবনে। বিয়ের কিছু পরই মধুবালাকে নিয়ে লন্ডনে চিকিৎসা করাতে যান কিশোর কুমার। কারণ শারীরিক অবস্থার সেই সময়ে আরও অবনতি হচ্ছে। লন্ডনে থাকতে থাকতেই কিশোর কুমার জানতে পারলেন যে মধুবালার আয়ু আর বেশি দিন নেই। বড়জোর দু বছর। মধুবালা যেদিন জানতে পারল সেদিন কিশোর কুমারের বুকে মুখ গুঁজে তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে গেছিল। মা হওয়ার খুব শখ ছিল যে জীবনে।

ভারতে ফেরার পর মধুবালা চেয়েছিল কিশোর কুমারের সাথেই বাকি যে কটা দিন আছে সে কটা দিন একসাথে থাকতে। অভিনয় জীবন যে শেষ সেটা মোটামুটি বুঝে গেছে। কিন্তু মাতৃভক্ত কিশোর কুমার মাকে ছেড়ে গৌরীকুঞ্জ ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে রাজি ছিল না আর গৌরীকুঞ্জে মধুবালারও ঢোকার অনুমতি নেই। তাই আবারও বাধ্য হল পালি হিলসে তার নিজের বাড়িতে থাকতে। ঠিক হল প্রতিদিন কিশোর কুমার এসে দেখা করে যাবে তার সাথে। সেইমতই প্রতিদিন রাতে কাজ থেকে ফেরার পর কিশোর কুমার দেখা করে যেত। কিন্তু জীবনীশক্তি যতই ফুরিয়ে আসছিল ততই খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে শেষদিন অব্দি একটাই কথা বলে যেত, ‘মুঝে জিন্দা রেহনা হ্যায়, মুঝে মরনা নেহি হ্যায়, ডক্টর কব নিকলেগা ইসকা ইলাজ।’ জীবনের প্রতি এতটাই টান ছিল মধুবালার। এরপর আস্তে আস্তে কিশোর কুমারের সাথে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার সাথে সাথেই কিশোর কুমারও আসা যাওয়া কমাতে কমাতে প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলেন। বোন শাহিদার কথায় শেষ দিনগুলোতে দিদিকে আর চোখে দেখা যেত না। শুধু হাড় আর চামড়া, আর কিছু নেই। ফুসফুসের সমস্যার জন্য সব সময় কেশে চলেছে আর ৪-৫ ঘন্টা অন্তর অন্তর অক্সিজেন না দিলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে। ‘জুয়েল থিফ’ এর ‘রুলাকে গ্যায়া সপ্না মেরা’ গানটা ছিল সেই সময়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী।

১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি, বোন শাহিদা তখন চিকেন পক্সে আক্রান্ত। দিদির কাছে যাওয়া ছিল একেবারেই মানা। তাও মাঝে মাঝে ছুটে আসত সে দিদির কাছে। আসলে মধুবালা তো শুধুই দিদি ছিল না, শাহিদার কাছে, বা শাহিদা কেন, পুরো পরিবারের কাছে ছিল অন্নদাতা ভগবান। সে দিনও মধুবালাকে ডাক্তার দেখতে এসেছে, হঠাৎ শুনল ডাক্তার চিৎকার করে বলছে শ্বাসকষ্ট উঠেছে। ছুটতে ছুটতে শাহিদা এসে দেখে দিদি ততক্ষণে আর নেই। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে কাশ্মীরওয়ালা বাবার ভবিষ্যৎবাণী সফল করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলিউডের মেরিলিন মনরো মুমতাজ জাহান বেগম ওরফে মধুবালা। জানা যায় মারা যাওয়ার আগের দিন নাকি ইউসুফ সাব কে দেখতে পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল মধুবালা। কারণ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই একটা লোককেই মনের মধ্যে ধরে রেখেছিল। অনেক পুরুষ তার জীবনে আসতে চাইলেও, ইউসুফ সাবের জায়গাটি ছিল পাকা। যদিও দিলীপ কুমার সেই সময়ে মাদ্রাজে শুটিং-এ থাকার জন্য আসতে পারেননি, তবে উনি নাকি নিয়ম করে প্রতিদিন মধুবালার কবরে ফুল রেখে আসতেন।

ফিল্মফেয়ার পত্রিকা তার মারা যাওয়ার পর লিখেছিল ‘in the dimmed starlight, she was a bird whose wings have been clipped, a child robbed of its enchantment. lonely and alone…’

 

 

(ছবি: ইন্টারনেট)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...