আজকের বাংলা কবিতা

আজকের বাংলা কবিতা -- জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ

 

 ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’— এই কথাটা হয়তো একটা দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে বলা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর অনুসারী কবিবৃন্দ এবং তাঁর সমসাময়িক কবিদের লেখা কবিতা এই পর্যায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যাই হোক, বর্তমান নিবন্ধে, আমি পর্যায়টাকে ছোট সীমার মধ্যে রেখেছি এবং তার মধ্যে সেইসব বাংলা আধুনিক কবিতাকেই আলোচনার মধ্যে এনেছি, যেগুলো কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এমন কিছু বৈচিত্র্যময় স্বরকে যথাযথভাবে নির্মাণ করেছে, যেগুলো রবীন্দ্রনাথের স্বর থেকে স্পষ্টতই ভিন্ন বলে দাবী করতে পারে। আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের মত মহান লেখক যে এখন কেউ নেই এবং সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে হবেও না—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতৎসত্ত্বেও, রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বিশিষ্ট কবিরা— যারা সবাই বেঁচে আছে এবং যদিও তাদের মধ্যে কয়েকজন লিখছে না— তারা আমাদের কবিতার জগতে একটা সুস্থ পরিবর্তন ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মৃত্যুর এক দশক আগেও, যখন প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে লিখে যাচ্ছেন, তখনও এই পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িকদের এই বিচারের মধ্যে প্রায় আনা যায় না। তাঁর থেকে বয়সে ছোট এবং তাঁর অনুগামী যারা তাদেরকে রবীন্দ্রনাথের বাণী ও দর্শন চামচে করে গেলানো হয়েছিল। যদিও তাদের মধ্যে দু’ একজন—উল্লেখযোগ্যভাবে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কবিতাশৈলীকে এক নিখুঁত মাত্রা দিয়েছিলেন, যার ভিত্তি ছিল পুরনো ভারতীয় কাব্য এবং কিছু বিদেশী মডেল, কিন্তু তাঁর কবিতার বিষয় এত বেশী গতানুগতিক যে, যেসব পাঠকদের বিচার-বিশ্লেষণ করার মত বোধশক্তি আছে তাদের চোখে তাঁর কাব্যশৈলীও সন্দেহজনক হয়ে উঠল। আমরা পরে অনুভব করলাম— সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের আঙ্গিকে যত না সূক্ষ্মতা আছে তার চেয়ে বেশী আছে অনুরণন, তাঁর এই সৃষ্টি যত না সত্যিকারের সমালোচনামূলক বা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান। গভীর ও উদাহরণস্বরূপ হয়ে ওঠার জন্য তাঁর কবিতাতে আরও অনেক বেশী বিশুদ্ধতার দরকার ছিল। এইসব রবীন্দ্র-অনুসারী কবিদের সঙ্গে আরও কিছু কবি ছিল যারা এটা-ওটা, বা রবীন্দ্রনাথের অন্য কোনও ভাবনা অথবা আরও প্রাচীন কোনও কবির ভাবনা নিয়েই মূলত কাজ করেছিল, এবং তা সত্ত্বেও নিজস্ব পৃথক চিন্তাধারা তারা তৈরি করতে শুরু করেছিল। কিন্তু তারা বেশীদূর এগোতে পারেনি, এবং তাদের সবাই এখনও বেঁচে আছে আর তাদেরই একজন এখনও প্রচুর পরিমাণে কবিতা লিখে যাওয়ার কাজের কথাটা ভুলে যাননি; এরা বাংলার অনুভবী কবিতা পাঠকদের উপর এদের প্রভাব ধরে রাখতে পারেনি বলেই মনে হয়। এবং বোধহয় এই ধরণের পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে।

তুলনামূলক বিচারে, এরকম মনে হয় যে, চিরায়ত সাহিত্য বা শাশ্বত মূল্যের কবিতা বলে একটা বিষয় আছে। এই মূল্য খুঁজে পাওয়া যায়, খুব সম্ভব, অতীতের ও সদ্য অতীতের চিরন্তন সাহিত্যের মধ্যে। এর প্রচুর উদাহরণ আমরা পাই রবীন্দ্র-সাহিত্যে। কিন্ত, এটা কোনও কারণ নয় যার জন্য রবীন্দ্রনাথের যুগ শেষ হবে না এমন একটা পথের বাঁকে এসে, যেখানে সুদূরপ্রসারী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন, বর্তমান যুগের কাছে দাবী করছে, সে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, প্রাণ খুলে একথাটা স্বীকার করুক যে নতুন সাহিত্য প্রয়োজন এবং তার সাথে সাথে এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ দাবী নয় যে সাহিত্যের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও প্রয়োজন।

সাহিত্যের প্রতি-কবিতার প্রতি, বাংলার আধুনিক পাঠকদের প্রায় একটা গোটা প্রজন্মর একাংশের, এই যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তার কতখানি, কম-বেশী সহজাত গুণসম্পন্ন নতুন গোষ্ঠীর কবিদের (যাদের নাম আমি এই নিবন্ধে লিখছি না) প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে ও লালিত হয়েছে এবং কতখানিই বা এই নতুন যুগের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে– সেটা নিয়ে নিঃসন্দেহে একটা কৌতূহলোদ্দীপক সমীক্ষা চালানো যেতে পারে। মনে হয়, এই দুই ধরণের প্রভাবই একসঙ্গে কাজ করার ফলে কবিতায় রবীন্দ্রনাথের যুগ প্রতিস্থাপিত হয়ে আরেকটা নতুন যুগ শুরু হয়েছে, যে যুগ এখনও কোনও কবির নামে নামাঙ্কিত হতে পারেনি, যে যুগ গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক কবিদের সবার বৈশিষ্ট্য ধারণ করেই পূর্ণতা পেয়েছে।

যদিও একই স্থান ও কালের বিশিষ্টতা এই কবিদের লেখায় একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে, তবুও নানাভাবেই এদের বিভিন্নতা চোখে পড়ে। এদের মধ্যে কারও কারও ধারণা তারা রোম্যান্টিক ধারা থেকে বিমুক্ত হয়ে যুক্তিবাদী হয়ে উঠেছে; কিন্তু তারা যুক্তি ও কল্পনার সামঞ্জস্য বজায় রেখে কবিতা লেখার বদলে এমনভাবে কবিতা লিখেছে যা ধীরে ও কার্যকরীভাবে পাঠকের মনে বিশেষ একটা মত গড়ে তুলতে পারে। এই লেখকরা তাদের কিছু পরীক্ষামূলক লেখায়, দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের কাব্যিক সাফল্য লাভের প্রয়াস নিয়েছিল, এবং সেটা পেরেছিল বলেই হয়তো বা তারা মনে করে। যাইহোক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তারা আমাদেরকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্রূপাত্মক কবিতা দিয়েছে এবং অন্যান্য কিছু কিছু উচ্চাঙ্গের কবিতাও দিয়েছে যেগুলো সমসাময়িক সামাজিক চেতনার সাথে সম্পর্কিত।

রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা যখন মনকে সংস্কারে আবদ্ধ করেনি, তখন তা সৃষ্টির ব্যাপক স্ফূরণে সাফল্য দিয়েছে– বিশেষত ওই সব কবির কিছু প্রেমের কবিতায় এবং তাদের যেসব কবিতা প্রকাশ্য সামাজিক রাজনৈতিক সমস্যার ঘোষণায় জর্জরিত সেগুলোর ক্ষতিপূরণ করতে পেরেছে ওরকম কিছু প্রেমের কবিতা। এটা বলাই বাহুল্য এইসব কবিরা এবং তাদের প্রধান পাঠকরা কবিতায় কোনও ধর্মীয় সন্তোষ বা অতীন্দ্রিয়বাদ খোঁজে না। এটা আমার মনে হয় বেশী নির্ভর করে কবির মানসিকতার ওপর, অন্য কোনও কারণের উপর নয়, যদি না অবশ্য আমরা ধরে নিই যে প্রকৃতির ও মানুষের সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে এবং আমাদের তখন একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা যা জানি সেটা ঠিকঠাক গুছিয়ে ফেলা।

একথা সত্যি যে একজন মানুষের সহজাত শিল্পদক্ষতার সঙ্গে একটা যুক্তিপূর্ণ ও সুসমঞ্জস মন থাকলে সে খুব সুবিধাজনক একটা জায়গা থেকে শুরু করতে পারে, যার অভাব থাকে একজন প্রধানত আবেগপ্রবণ কবি বা লেখকের ক্ষেত্রে। কিন্তু, কবির যেটুকু বুনিয়াদি বিজ্ঞান ও যৌক্তিকতা থাকা প্রয়োজন তা কি তাঁকে এতটা আবিষ্ট করবে, যাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি তার সাহিত্য সৃষ্টি করবেন, নতুবা তাকে বিজ্ঞানের ভৃত্যে (সেটাকে মনের বৈজ্ঞানিক অভ্যাস বা যাই বলা হোক না কেন) পরিণত হতে হবে কিংবা মার্কসবাদের মত কোনও আধুনিক দর্শনের দাসে পরিণত হতে হবে? এখানে আমি ওইসব কবিদের যে সমস্ত কবিতা মাথায় রেখে বলছি, সেগুলোতে আমি দেখেছি, সংকট সমাধানের সঠিক পথে যাওয়ার প্রচেষ্টা না নিয়ে কবি যেন, সংকটের মধ্যেই স্বস্তি খুঁজে নিয়েছে। এখানে যাদের কথা আমি উল্লেখ করলাম, তাদের সমসাময়িক অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বাংলা আধুনিক কবিরা, কেউ কিন্তু তাদের শিল্পকলার তত্ত্বে ও প্রয়োগে যৌক্তিকজ্ঞানকে একটুও কম সমর্থন করে না। মনে হয়, তারা ধর্ম ভাবনাকে ব্যবহার করায় আরও বেশি বোধসম্পন্ন, সে ধর্ম ভাবনা যতই আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক হোক না কেন। একজন কবি কেবল একটা ধর্ম ভাবনা আবিষ্কার করতে পারে এবং তার দ্বারা নিজে আলোকিত হতে পারে, কিন্তু কখনওই সে ধর্ম ভাবনাকে ঘাড়ে চেপে বসতে দিয়ে সেটাকে কতকগুলো দার্শনিক যুক্তিতে পরিণত হতে দিতে পারে না। কবির কবিতাগুলো, যেগুলো কতকগুলো সর্বজনবিদিত দাবী পূরণ করার জন্য তৈরী, সেগুলোর বিষয়ক্ষেত্রকে যদি কোনও ধর্ম ভাবনা, এমনকি যদি কোনও বৈজ্ঞানিক ধর্ম ভাবনাও সবলে দখল করে তাহলে কবিতাগুলো শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের এই উদভ্রান্ত যুগে, যখন নানারকম ধর্ম ভাবনা ও তত্ত্ব নানাসময়ে গ্রহণ করা হচ্ছে এবং ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন এগুলোর খুব উচ্চ মূল্য কবিরা দেয় না, তারা মজ্জায় মজ্জায় উপরোক্ত প্রয়োজনীয় শিক্ষা অনুভব করে। অন্যান্য যুগের তুলনায় আমাদের যুগে, যে অসংখ্য সন্দেহজনক শুশ্রূষা কেন্দ্রগুলো থেকে অর্থনৈতিক, শিল্পায়নমুখী, সামাজিক ও অন্যান্য নানা বৈষয়িক গুরুভার তত্ত্বাবলী নিঃসৃত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে থেকে একটা পথ খুঁজে নেওয়া যে কারও পক্ষেই খুব কঠিন। যাই হোক, একজন পরিণত শিল্পী তার চারপাশের প্রহেলিকাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রস্তাব দেয় না। সে গড়ে তলে তার নিজস্ব দর্শন, গড়ে তলে তার নিজের জগত, যে জগত অবশ্যই বাস্তব জগতকে নস্যাত করে নয়; এটা বাস্তবের সেই একই জীবন্ত জগত, যেটাকে বিশেষ ভাবে পাঠ করার মধ্যে দিয়ে, বিশিষ্ট কবি, আরও সত্যভাবে এবং পরিমিতভাবে গড়ে তুলেছে।

কিছু আধুনিক বাংলা কবিদের এইসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান রয়েছে এবং তারা তাদের কবিতায়, তার পরিচয় আমাদের দেখিয়েছে; সময়বিশেষে তারা বিসদৃশ স্বাধীনতা গ্রহণ করেছে, কিন্তু কী দিয়ে সত্যিকারের কবিতা গড়ে ওঠে এবং কীভাবে তা লিখতে হয় এ বিষয়ে তারা প্রকৃতই সচেতন। আমার বিশ্বাস, তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায় মহৎ কবিতাও লিখেছে। তারা এখনও লিখছে, এবং আমার মনে হয়, যখন এই কবিদের যুগ শেষ হয়ে যাবে, তখন বাংলা সাহিত্যে আবিষ্কারের, প্রচেষ্টার ও সাফল্য অর্জনের একটা অনন্য যুগও শেষ হয়ে যাবে। এটা আশা করা যায় যে, এর আগের যুগে রবীন্দ্রনাথ একক কৃতিত্বে যা করে গিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে আজকের যুগের কবিদের অবদান তার থেকে কিছু কম মহান নয় (কারও কারও মতে হয়তো বেশী কিছু)।

[Bengali Poetry Today, The Sunday Statesman, 6 November 1949 by Jibanananda Das থেকে অনুবাদ করেছেন তমাল ভৌমিক]

 

“দূরত্ব” পত্রিকার শীত ২০১৪ সংকলনে প্রকাশিত। শ্রী বিপ্লব চৌধুরীর সৌজন্যে প্রাপ্ত।

 

ছবিঋণ – শিল্পী মনজিৎ বাওয়ার আঁকা ছবি। ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. বাহ! জীবনানন্দ দাশের লেখা দিয়ে পত্রিকার চলাচল শুরু হচ্ছে, এ তো দারুণ ব্যাপার!

আপনার মতামত...