অজয়, ইলিশ, ইত্যাদি

মানস নাথ

 

তো আমরা কয়েকজন নদী দেখতে গিয়েছিলাম। অজয় নদী। তবে অজয়কে নদী বলা ঠিক ব্যাকরণসম্মত নয়। অজয় হল নদ, মানে পুং। তা কেন গিয়েছিলাম? ওই যে জর্জ ম্যালোরি, যে প্রথম এভারেস্টে উঠেছিল, কিন্তু আর নামতে পারেনি তাকে একজন জিজ্ঞাসা করেছিল না… আপনি হঠাৎ এভারেস্টে উঠতে চাইছেন কেন? তা জবাবে তিনি বলেছিলেন, ওটা ওখানে আছে, তাই! এই গল্পটা অবশ্য স্যার এডমন্ড হিলারিকে নিয়েও চলে। এক্ষেত্রেও, নদীটা আছে আর তাই তাকে দেখতে যাওয়া, এটাই একমাত্র উত্তর হতে পারে!

তো অজয় নদের চর ধরে হেঁটে হেঁটে নদীর কাছে পৌঁছানো তো গেল। পশ্চিমবঙ্গের দু’টি জেলা বর্ধমান আর বীরভূমের সীমানা নির্ধারণ করে এই নদীটি। বর্ধমানের দিকে ভাঙ্গছে আর বীরভূমের দিকে ক্রমাগত চর ফেলছে এই অজয় নদ। কোনও কোনও জায়গায় নদীর মাঝেই লম্বা চর, সেখানে ধানচাষ হচ্ছে। দু’পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। বর্ধমান নিয়েছে বালি আর বীরভূম নিয়েছে মাটি। অজয় নদের বালি খুব বিখ্যাত। লালচে মোটা দানার ফুলকোর্স বালি। আপনার সাধের একটেরে বাড়িই হোক বা রাজারহাটের দিকে গেলে চোখে পড়ে যে আকাশছোঁয়া ইমারত, সবখানেই এই অজয় নদের বালি। ইলামবাজার হয়ে প্রতিদিন সারি সারি লরি বালি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

শীতকালে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় এসে দেখেছিলাম, লালচে হলুদ বালি নিয়ে গা ছড়িয়ে পড়ে আছে। বিশাল নদীখাত জুড়ে একটেরে সুতোর মতো জল বয়ে চলেছে। সেই চরের উপরেই সারি সারি বাউল ফকিরদের অস্থায়ী আখড়া। গান চলছে… সার দিয়ে বসে পাত পেড়ে অন্নভোগ চলছে। রাতে খড় বিছিয়ে ওখানেই ঘুম।

এই বর্ষাকালে সেই নদীর অন্যরকম রূপ। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম ইলামবাজারের কাছাকাছি দ্বারোন্দা গ্রামের পাশে। ওপারে বর্ধমানের দিকে ডাঁই করে বালি তুলে ঢিবি করা। এপারের চরে সবুজ লকলকে ধানগাছ হাওয়ায় দুলছে। টানা জাল পেতে নদীর ধারে ত্রিপলের তাঁবু খাটিয়ে ক’জন বসে আছে। কথা হচ্ছিল তাদের সাথে। বলছিল, বালি তুলে একদিক থেকে লাভই হয়েছে। না হলে প্রতি বর্ষায় অজয় নদ কাঁদিয়ে ছাড়ত আগে। চরের পাড়েই তাদের সবার বাড়ি। ঢাকা ফরিদপুরের লোক সব। বিশ্বাস, দাস, মণ্ডল। স্বাধীনতার পর একে একে চলে এসেছে। অজয়ের চরে বসত করেছে। নতুন গজানো চরে ধান রুয়েছে। এখন বর্ষাকালে মাছ ধরছে। গেল দু-তিন বছর খুব মাছ আসছে বলল। তারপরে যেটা বলল সেটা প্রথমে আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি। তিন চারজনকে জিজ্ঞাসা করলাম! প্রত্যেকেই একই কথা বলল যে, হ্যাঁ গতবছরেও কিছু জালে পড়েছিল, এবারেও পড়েছে– মাছের রাজা ইলিশ! এ তো বড় তাজ্জব কি বাত! কেন এত অবাক হচ্ছি সেটা একটু বলি।

আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই দ্বারোন্দা গ্রাম থেকে আরও উজিয়ে গিয়ে কাটোয়ার কাছে অজয় নদ গঙ্গায় মিশেছে। মানে আমরা ভারতীয়রা গঙ্গা বলে দেগে দিলেও আসলে সেটা হুগলী বা ভাগীরথী নদী। মানতে চাইছেন না তো? আচ্ছা একটু গুগুল ইমেজে গিয়ে দেখে নিন দয়া করে। ফরাক্কায় বাঁধ দিয়ে কীভাবে কৃত্রিমভাবে গঙ্গানদীর মূলস্রোতকে ভাগীরথীতে চালান করা হয়েছে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। কলকাতা বন্দর বেঁচেছে কি বাঁচেনি, সেটা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু গঙ্গার মূল ধারা আসলে পদ্মার বিশাল নদীখাত– স্যাটেলাইট ইমেজে সেটা পরিষ্কার দেখতে পাবেন। সাধে কি আর বিহার আর বাংলাদেশ একযোগে ফরাক্কা বাঁধ ভেঁঙ্গে ফেলার রব তুলছে দীর্ঘদিন ধরে! মালদা মুর্শিদাবাদের তলিয়ে যাওয়া গ্রামের লোকেরাও তাতে খুব একটা দ্বিমত হবে বলে মনে হয় না!

 

তো ধান ভাঙ্গতে শিবের গাজন করে লাভ নেই, হচ্ছিল ইলিশের কথা। অজয় নদে ইলিশ ধরা পড়ছে! বন্ধুদের জন্য ইলিশ উৎসবের জোগাড়যন্ত্র করতে কয়েক বছর ধরেই যেতে হয় কাকদ্বীপে। সেখানে সুন্দরবন মৎস্যজীবী এবং ট্রলার শ্রমিকদের কর্মকর্তা সতীনাথদার কাছ থেকে ইলিশের স্বভাব আর স্বাদ নিয়ে কিছু ধ্রুববাক্য শুনেছিলাম আর কী! তা হল যে ইলিশ হচ্ছে সমুদ্রের বুনো মাছ। পেটে ডিম এলে সে সমুদ্র ছেড়ে ঢুকে পড়বে নদীতে মিষ্টি জলের দিকে। এবার যত সে নদীতে স্রোতের উজানে সাঁতরাতে থাকবে তত তার শরীরে জমে থাকা স্যাচুরেটেড ফ্যাট ভেঙ্গে ফ্যাটি এ্যাসিড বা পুফায় বদলে যাবে। ইলিশের স্বাদের অন্যতম প্রধান কারণ হল এই পুফা। যা আমরা ইলিশের তেল বলে জানি। যত এই তেল বাড়বে তত ইলিশের পেশি শিথিল হবে, স্বাদ বাড়বে। এবার দীঘার মোহনা বা কাকদ্বীপ ডায়মন্ড হারবারে সদ্য সমুদ্র থেকে নদীতে ঢোকা ইলিশের থেকে নিঃসন্দেহে বাগবাজার ঘাটে বা হাওড়া ব্রিজের নিচে জগন্নাথ ঘাটে ধরা মাছের স্বাদ অনেক ভাল হবে। একই ভাবে আরও উজিয়ে কোলাঘাটে যে ইলিশ ধরা পড়ে তার স্বাদ পদ্মার ইলিশের সাথে টেক্কা দেয়। তবে সমুদ্র থেকে কত দূরে পদ্মার ইলিশটি ধরা পড়েছে সেটাও দেখতে হবে। এইবার বুঝতে পারছেন যে অজয় নদে ইলিশ ধরা পড়াতে কেন এত অবাক হয়েছিলাম আর সন্দেহ নিরসন করতে জনে জনে জিজ্ঞাসা করছিলাম! কতটা সাঁতার দিয়ে সে ইলিশ সমুদ্র থেকে অজয় নদে পৌছেছে তা আবার একবার গুগুল স্যাটেলাইট ইমেজে গিয়ে দেখে নিন! আর কল্পনা করে নিন তার স্বাদ কেমন হতে পারে!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...