দ্বিতীয় পক্ষ

সৌনক দাশগুপ্ত

রূপকের ঘামের গন্ধটা ভীষণ প্রিয় অলির। নেশাতুর লাগে অথবা অতিরিক্ত ঘন। মাঝে মাঝেই রূপকের খুলে রাখা জামা শুঁকলেই খিলখিলে হাসিটা অলিকে ভরিয়ে তোলে, বিশেষ করে স্যান্ডো গেঞ্জি। রূপক অবশ্য এগুলোকে আদিখ্যেতা বলে। রূপক এখন অলির ঘাড়ে, কানের ঠিক নিচের তিলটা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত। অলি টের পাচ্ছে রূপকের ঘনিয়ে আসা নিঃশ্বাসের তাপ ওর প্রতিটা রোমকূপকে নতুন করে জন্ম দিচ্ছে। ইনকিউবেটরে রাখা লালচে দেহগুলোর মতোই লাল হয়ে উঠেছে ওর ফর্সা গাল দুটো।

“রূপক, এই রূপক..”

“উমম….”

“সেই দিনটাও ছিল ২২শে শ্রাবণ তাই না?”

“উমম…”

“কোন দিনটা??”

“কোন দিনটা অলি?? এই চার বছরে তো চারটে ২২শে শ্রাবণ কাটিয়েছি আমরা!!”

“ধ্যেত্ কিচ্ছু মনে থাকে না তোমার। আমায় প্রোপোজ করার দিন পনের পরে। তুমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সেদিন অবন হলে এসেছিলে, আমার স্কুলের প্রোগ্রাম দেখতে। যখন বেরোলাম হল থেকে, তখন বাইরে ইলশেগুঁড়ি। তুমি বললে চলো লেকে যাই অলি। ছাতা খুলিনি। দিব্বি বৃষ্টি মেখেই বসেছিলাম আমরা, জলের বুকে বৃষ্টির আঁচড় কাটা দেখছিলাম। ঠিক তখনই তুমি হঠাৎ করে…”

“কী?? কী করেছিলাম বলো তো??” রূপকের গলায় আদর-আব্দার খেলা করছে।

“আমার ঠোঁটদু’টোকে পুরো গিলে ফেলেছিলে বদমাশ ছেলে!”

“আর তুমি পুরো লজ্জা আপেল হয়ে আমার বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিলে।”

“উমম সেই প্রথম তোমার ঘামের গন্ধ…”

“আমি কিন্তু এখনও ওরম করে ঠোঁট গিলে নিতে পারি! দেখবে…”

অলির ঠোঁট কেঁপে উঠল, ঠিক পায়রার বুকের মতোই। দু’জোড়া ঠোঁটের ফাঁকে জিভের লুকোচুরি; অলির ঠোঁটের বিদেশি লিপস্টিকও লজ্জায় বিবর্ণ হয়ে গেল!

প্রেসিডেন্সি থেকে ইংরাজিতে অনার্স, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স। আর তার পরেই কলকাতার নামি ইংরেজি মিডিয়ামে ভালো চাকরি। ঝকঝকে কেরিয়ার। ভরতনাট্যমের মুদ্রায় দেহের প্রতিটি বিভঙ্গ সুলালিত, অলির দ্বিতীয় প্রেম। রূপকের সাথে পরিচয়ও এই নাচের সূত্রেই। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রক্তকরবী করিয়েছিল স্কুলের কচিগুলোকে নিয়ে। তো সেই দলে রূপকের ভাইঝি আঁচলও ছিল। সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে রূপক গ্রিনরুমে এসেছিল। একরাশ মুগ্ধতা ঠিক যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব ততটা তাড়াতাড়িই প্রেমে পরিণতি পেয়েছিল। তার পরে বছর দু’য়েক চুটিয়ে প্রেম। এবং রূপকের টোকিওতে পোস্টিং। যাওয়ার আগেই অবশ্য রূপক দুই বাড়িতেই ওদের ব্যাপারটা বলে দেয়। কোনও রকম আপত্তি ওঠেনি। অপেক্ষা ছিল রূপক ফিরে আসার।

রূপকের বাড়ির লোকজন অলিকে বেশ পছন্দ করে। রূপকের বাবা মা একটু প্রাচীনপন্থী হলেও ওদের এই মেলামেশাতে আপত্তি করেননি। রূপক যে দেড় বছর ছিল না তখনও অলি যেত ওদের বাড়ি। রূপকের বৌদিই বারবার ফোন করে ডেকে নিত। অলি ও বাড়িতে গিয়ে ভালোই সময় কাটাত। তবে অলি ভাল থাকত রূপকের ছেড়ে যাওয়া স্পর্শ নিয়ে, গন্ধ নিয়ে।

দেখা হবার মাস ছয়েক পরেই রূপক একদিন বলল দু’দিনের জন্য ঘুরতে যাবার কথা। অলির স্কুলের এক্সকার্শন আর রূপকের ক্লায়েন্ট ভিজিট মিলে মন্দারমণির সমুদ্দুরে বোতলবন্দি প্রেম ভাসিয়ে দিল। সেই প্রথম অলি রূপকের গন্ধ পেল, সারা শরীর জুড়ে। কপালের টিপের লাল রঙ অলির ধমনী জুড়ে খুব দ্রুত নেমে এসেছিল। রূপক যখন ওর ব্লাউজের এক একটা হুক খুলছিল, অলির মনে হচ্ছিল শতাব্দী জুড়ে দমকে থাকা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসছে। রূপক যখন শিশুর মতো ওর দু’টো বুকের মাঝে লুকিয়ে পড়েছে, তখন অলি হিসেব করছে কত আলোকবর্ষ পেরিয়ে ওর শরীরের প্রতিটি আগল খুলে ভালোবাসা বেরিয়ে আসছে, রূপক হয়ে। এর পরে ওরা মাঝে মাঝেই বাহানা দিয়ে তাজপুর, বকখালি, পুরী, ঝাড়গ্রাম, গালুদি ঘুরে এসেছে। প্রতিবার অলির কাছে রূপকের গন্ধ আরও আরও গাঢ় হয়েছে।

দেড় বছর পরে ফিরে এসেছে রূপক। মাস খানেক হল। ওদের বাড়ির লোকেরাও আর দেরি করেনি। আসছে অগ্রহায়ণে ওদের বিয়ে। তার আগেই রূপকের বায়না ওদের সেই প্রথম দিকের স্মৃতির শতরঞ্চি মন্দারমণি ঘুরে আসা হোক একবার, গোপন অভিসারে। আর আসা মাত্রই অলি টের পেয়েছে হড়কা বানের মতোই তার অলিতে গলিতে ঢুকে পড়েছে রূপক।

“এই অলি, তুমি এখনও ওই বডি লোশনটাই মাখো তাই না? উমম তোমার বুক জুড়ে সেই গন্ধ…”

“ফাজিল একটা!! খুব জ্বালাতন করো তুমি রূপক বুঝলে!”

“আচ্ছা তাই না?? তাহলে এবারে সত্যি জ্বালাতন করি!” কাঁচের গায়ে আদরমাখা বৃষ্টির ফোঁটার মতোই রূপক অলির চিবুক স্পর্শ করে নাভি ছুঁয়ে নিচে নামতে লাগল।

“এই শয়তান ছেলে থামো এবার। এত ভালোবাসা, এত আদর, ভয় করে রূপক…”

“কীসের ভয় অলি! তোমার জন্যে আমি চিরকালীন।”

“এরকমই থেকো রূপক। আবহমান সত্য।”

“ডিভোর্স, প্রবীর, আ্যবরশন এগুলো তোমার গতজন্ম অলি। আমি তো সমুদ্দুরকে কথা দিয়েছি, পরেরবার তোমার কোলে করে কোনও মিঠাই বা রোদ্দুরকে নিয়ে আসব আমরা এখানে।”

জল নেমেছে, অলির চিবুক বেয়ে, বাইরের সমুদ্রটার মতোই নোনতা। অথবা খুব মিষ্টি, রূপকের গন্ধের মতো, ঢেউ ভাঙছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...