আবেগের আগুনে আত্মমূল্যায়ন– ক্ষমতার দহন

জসিন্তা কেরকেট্টা

 

রাঁচির জসিন্তা কেরকেট্টা হিন্দীভাষার নতুন প্রজন্মের আদিবাসী কবিদের মধ্যে এক চর্চিত নাম। ২০১৬ সালে ওঁর কবিতাসংগ্রহ ‘অঙ্গোর’ হিন্দী ছাড়াও ইংরেজী ও জার্মানে প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানির বহু শহরে একক কবিতাপাঠ করেছেন জসিন্তা। দেশের প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাতেই ওঁর কবিতা প্রকাশিত হয়ে থাকে।

অত্যন্ত অল্প বয়সেই হিন্দী সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন জসিন্তা। ‘প্রভাত খবর’-এর ‘অপরাজিতা সম্মান’ ও বেনারস হিন্দী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রবিশঙ্কর উপাধ্যায় পুরস্কার’ পাওয়া ছাড়াও এশিয়া ইন্ডিজেনাস পীপলস প্যাক্ট বা এ.আই.পি.পি থাইল্যান্ড ও ভয়েসেস অফ এশিয়া নেটওয়ার্কের দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন বহু আঞ্চলিক সম্মানও। বর্তমানে জসিন্তা গ্রামে ভাষা-সংস্কৃতিকর্মী হিসাবে আর আদিবাসী মেয়েদের উন্নতিকল্পে কাজ করছেন। সঙ্গে চলছে ফ্রিল্যান্স লেখার কাজ।

 

অনেক রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাজ্য ঝাড়খণ্ড। ছোটনাগপুরের ইতিহাস দেখায়, আদিবাসী সমাজের বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য কোনও সরকারই তেমন সচেষ্ট হননি। এই কারণেই মনে হয়, এই রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে পাগলা গারদ তৈরী হয়েছে। এই রাজ্যের ভাষা-সংস্কৃতিকে মজবুত করার চেষ্টা কখনওই হয়নি। মাতৃভাষায় শিক্ষা নিয়ে মানুষ এখানে লাগাতার দাবী উঠিয়েছেন, কিন্তু সেদিকে ইতিবাচক কোনও পদক্ষেপই কখনও নেওয়া হয়নি।

পদ্মশ্রী ড. রামদয়াল মুন্ডা অ্যামেরিকা থেকে ভারতে এলে ওঁরই চেষ্টায় ঝাড়খণ্ডের ন’টি ভাষায় উচ্চশিক্ষার জন্য রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনজাতীয় এবং ক্ষেত্রীয় ভাষা বিভাগের স্থাপনা হয়। এই বিভাগ তৈরী হলে লোকের মনে একটা প্রশ্নও দেখা দেয়– নতুন প্রজন্ম যখন নিজের ভাষাই শিখছে না, তখন উপজাতীয় ও আঞ্চলিক ভাষায় উচ্চশিক্ষা নিতে কতজন এগিয়ে আসবে? ড. রামদয়াল মুন্ডার বক্তব্য ছিল– পরিবর্তনের বাতাস বইবে উপর থেকে নীচে। ভাষা যাঁর আয়ত্ত, তিনি প্রথমে উচ্চশিক্ষা হাসিল করবেন, নিজের ভিতকে মজবুত করবেন, এবং তবেই নতুন প্রজন্মকে নিজের ভাষার জন্য তৈরী করবেন। এমন কর্মনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী চলে যাবার পর এই বিভাগের অবস্থা হয়েছে করুণ। জীবনভর সমাজের জন্য কাজ করবার পরেও ওঁর মনে একটা দুঃখ থেকেই গেল। নতুন প্রজন্মের বৌদ্ধিক উন্নতি উনি ঘটিয়ে যেতে পারলেন না।

এমতাবস্থায় আজকের ছবিটা দেখে নেওয়া যাক। আমাদের চারপাশের সমাজের দিকে নজর রেখে লিখছেন, আদিবাসী লেখকদের মধ্যে এমন মানুষ খুবই কম। যাঁরা নিজের লেখার জোরে দেশ-দুনিয়ায় পরিচয় তৈরী করেছেন, আর আদিবাসী সাহিত্য, দর্শন, জমিসমস্যা ইত্যাদির ওপর সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এমন সময় কিছু লেখাপড়া-জানা আদিবাসী ও অনাদিবাসীর আপত্তির কারণে একজন যুবা আদিবাসী লেখকের বই পোড়ানো, আর সরকারের জন্য সেই বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা লাগানোর রাস্তা তৈরী করা কতটা যুক্তিযুক্ত? তাও আবার এমন এক সরকারের দিকে তাকিয়ে, যে সরকার ২০১৪ সালে সারনা ধরম কোডের দাবীকে মান্যতা দেবার অঙ্গীকার করে ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী সমাজের ভোট হাসিল করে, এবং ভোটে জিতে আদিবাসীদের হিন্দু প্রমাণের চেষ্টা করে আর সারনা কোডের দাবীকে অগ্রাহ্য করে।

সাহিত্য অকাদমী যুবা পুরস্কারপ্রাপ্ত সাঁওতালী ইংরাজী কাহিনীকার হাঁসদা সৌবেন্দ্র শেখরের বই ‘আদিবাসী উইল নট ডান্স’-এর ওপর সরকার সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ওঁর চাকরিও সঙ্কটের মুখে। এই বইতে হাঁসদা সৌবেন্দ্র শেখর দশটি গল্প লিখেছেন। কোনও কোনও গোষ্ঠী মনে করছেন– এই বইতে সাঁওতাল রমণীদের অশ্লীল ছবি আঁকা হয়েছে। রোজগারহীনতা, দারিদ্র্য, পালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানান প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ কারণ মিশে তৈরী হওয়া সাঁওতাল মেয়েদের অসহায়তার কথা লেখক যে ভাষায় চিত্রিত করেছেন, আদিবাসী সমাজ তার দ্বারা আহত হয়েছেন, এমন দাবী করছেন। বিশেষ করে এই বইয়ের হিন্দী অনুবাদ পড়ে। কিছু শব্দকে যদি বাদ রাখা যায়, তবে এই গল্পগুলির রূঢ় বাস্তবতা আদিবাসী সমাজের মহিলাদের করুণ অবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।

গোহত্যা ও গোমাংস-বিষয়ক ব্যাপারগুলিকে আদিবাসী সমাজ কোন নজরে দেখছে, এবং শহরে অনাদিবাসীদের মধ্যে বসবাসকারী একজন আদিবাসী এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা কিভাবে ব্যক্ত করছে– এহেন বিষয়কে আশ্রয় করে গল্প লিখতে সাহস করবার জন্য লেখকের বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য। একজন আদিবাসী মহিলাকে একজন অনাদিবাসী পুরুষ কোন নজরে দেখে তা অত্যন্ত বাস্তব চেহারায় নিজের কাহিনীতে লেখক দেখিয়েছেন। সাঁওতাল পরগণায় ঘটে চলা খননের প্রতিবাদেও তিনি কলম ধরেছেন। বলেছেন, আদিবাসী আর নাচবে না। কারুর ইশারায় নাচতে অস্বীকার করা এক ধরণের প্রতিরোধ, আর এই প্রতিরোধের শাস্তি হাঁসদা সৌবেন্দ্র শেখর পেয়েছেন। ওঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে– সরকারী চাকুরে হয়েও এমন কাহিনী লেখার জন্য উনি সরকারের অনুমতি নেননি কেন? কোনও গল্পকার কিভাবে ভাববেন, সরকার সেটাও ঠিক করে দিতে চান। সরকারী চাকুরেদের আত্মাটুকুও কী সরকারের কাছে বন্ধক রেখে দিতে হবে? সাঁওতালী আদিবাসী সমাজের একটি অংশ সাঁওতালী ভাষার রোমান লিপিকে উৎসাহ দেয়– এটি দ্বিতীয় ও আসল কারণ। এই অবস্থায় সাহিত্য অকাদমী যুবা পুরষ্কার পাওয়া সাঁওতাল লেখকের সাঁওতালী ভাষার লিপি অলচিকিকে উৎসাহদানও লেখকের প্রতি এই বিরোধের অন্যতম কারণ। অলচিকি লিপির সৌজন্যে অষ্টম অনুসূচীতে সাঁওতালী ভাষা স্থান পেয়েছে, এবং অলচিকির ব্যবহার নিয়ে সাঁওতালী সমাজের মধ্যে বিরোধও আছে যথেষ্ট। বিরোধের গোপন কারণগুলোকে অশ্লীলতার জামা পরিয়ে কিছু অনাদিবাসী গোষ্ঠী আদিবাসী সমাজকে প্ররোচিত করবার কাজটা করেছে।

তবে, সৌবেন্দ্রের গল্পে সাঁওতাল মেয়েকে দেখে অনাদিবাসী পুরুষের ভাষাই লেখকের ভাষা হয়ে উঠেছে, আমার মতে এটা দুর্ভাগ্যজনক। সাহিত্য কী লেখকের চিত্রণ, না কী সমাজের দর্পণ? এ বইয়ের কোন সেই মূল বিষয়, যা নিয়ে এই সমাজ উদ্বেলিত হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত। আদিবাসী মহিলাদের অনাদিবাসী পুরুষের সঙ্গে স্বেচ্ছামিলন? না কি মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে রাজী হওয়ার কারণে, না কী সেইসব শব্দের ব্যবহারের কারণে যাদের অশ্লীল বলা হয়েছে? এখানে সবথেকে বড় প্রশ্ন– অনাদিবাসীদের দ্বারা আদিবাসী মেয়েদের শোষণ। আদিবাসী মেয়েরা গ্রাম ছেড়ে দিল্লী, মুম্বাই, গুজরাত যাচ্ছে, আর গর্ভবতী হয়ে ফিরে আসছে আপন গ্রামে। এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে খাটো করে দেখা যায় কী? ওখানে এই মেয়েদের জোর করে গর্ভবতী করা হচ্ছে, আর এই সমাজ তাদের বাঁচাতে অসমর্থ ও অসহায়। শহরে আদিবাসী মেয়েরা অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছলতার লোভে অনাদিবাসীদের বিয়ে করে সংসার পাতে। এটা বাস্তব। একে অস্বীকার করা যায় কী? হাঁসদা সৌবেন্দ্র শেখরের কাহিনীগুলি যেসব পরিস্থিতি আর ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তাকে এই সমাজ উড়িয়ে দিতে পারে না। এমন সময়ে মানুষ নিজের মেয়ের করুণ অবস্থা দেখে ক্রুদ্ধ হয় না, উদ্বেলিত হয় না, সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে না। কিন্তু যখন এইসব ঘটনা গল্পের মোড়কে সামনে আসে, তখন এই মানুষেরা মেয়েদের নয় ‘সমাজ’কে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাঁসদা সৌবেন্দ্র শেখরের বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমাজ বাঁচানোর এই চেষ্টার পরিণাম।

আরেক দিক থেকেও একে দেখা যায়। নিজের ঘরের মেয়েকে সুস্থ আবহাওয়া দিতে অপারগ মানুষটা এইসব বিষয়কে নিজের পরিবারের ব্যাপার, গোষ্ঠীর ব্যাপার, রাজ্যের ব্যাপার, ধর্মের ব্যাপার বলে নিজের গণ্ডীর ভেতরে মেয়ের আরও সর্বনাশ ঘটায়। মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তনে ব্যর্থ হয়ে এইসবের আড়ালে নিজের-নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য লড়াই করে। চারদিকে বাজারে ঘেরা আদিবাসী সমাজও এই মানসিকতার থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। সাংস্কৃতিক আক্রমণের ঠেলায় এই সমাজও নিজের প্রজ্ঞা জলাঞ্জলি দিয়েছে। অন্যের ইশারায় নেচে উঠেছে আদিবাসী সমাজ। এ কথাও সত্য যে আদিবাসী সমাজের ভিতরেও মেয়েদের অবস্থা খুব ভালো নয়, এবং পুরুষ তাদের দুর্গতির জন্য দায়ী। অর্ধেকের বেশী আদিবাসী পরিবারে মেয়েরা হিংসার শিকার। নিজের ঘর ছেড়ে রুটিরুজির জন্য শহরের দিকে পাড়ি জমানোর এও এক কারণ। কিন্তু আদিবাসী সমাজের পুরুষের এমন মানসিকতার নিন্দা এই সমাজ কখনও করে না।

এই পুরো বিষয়ে আবেগের আগুনে হাঁসদা সৌবেন্দ্র শেখরের বইই শুধু পোড়েনি। আত্মমূল্যায়ন করবার, সমস্যার সমাধান বের করবার আর সত্যিকে চিনে নেবার আদিবাসী ক্ষমতারও দহন হয়েছে। তবুও, আদিবাসীদের যে অংশ এখনও সদাজাগ্রত, তাদের নবপ্রজন্মকে সামাজিক পরিস্থিতিকে জেনেবুঝে আত্মমূল্যায়নের পথে চলতেই হবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4656 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...