সিংহবাহিনী

তথাগত দাশমজুমদার

এক

ক্ষেতে যাওয়ার আগে ধনুকটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল বের্ণা, আজ অনেক ভোরে বেরোতে হচ্ছে, গম কাটা শুরু হবে যে।
সাতমাইল দূরের ক্ষেতে সময়মত পৌঁছতে গেলে যে অন্ধকার থাকতে থাকতে বেরতে হবে। ঝুড়িতে কয়েকটা আখরোট, পেস্তা, শুকনো মাংস আর যবের রুটি আগের সন্ধ্যাতেই ভরে রেখেছিল সে, সকালে যাতে বেরোবার সময় এসব কাজে সময় নষ্ট না হয়। এসব সময়ে কসকুনের কথা খুব মনে পড়ে, পাঁচটা গম কাটার মরসুম পেরিয়ে গেছে লোকটা নেই। তারুর তরফ থেকে অবশ্য ভালবাসায় খামতি নেই, কিন্তু কসকুনকে মনের কোনায় আজও রেখে দিয়েছে বের্না।

আজও ঘটনাটা চোখের সামনে ভাসে।
বের্ণা তখন আসন্নপ্রসবা। এরকমই এক গম কাটার দিনে মই বেয়ে ঘর থেকে বেরোনর সময় , দেওয়ালে ঝোলানো ষাঁড়ের মাথার দিকে আঙুল দেখিয়ে কসকুন বলেছিল
-দেখ, আমাদের ছেলে ঠিক ওইরকম হবে।
-হ্যাঁ, তোমার মতই গোঁয়ার আরকি। কিন্তু যদি মেয়ে হয়?
-তোমার মতই সাহসী হবে

সেই শেষবার তাকে জীবিত দেখেছিল বের্ণা।
খবরটা এসেছিল দুপুরবেলা, বের্ণা তখন সবে স্যান্ধ্যভোজন তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। রুটি তৈরির উনুনের ধোঁয়া যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়, তার মধ্যে দিয়ে উঁকি মারল আইগুলের অশ্রুসজল মুখ।
– কি হয়েছে রে?
– – একবার বাইরে আসবে?
– – এখন? সবে রান্না বসিয়েছি
– – এসনা খুব দরকার
– – উফ, এই অবস্থায় আমাকে হাঁটাবি?
– – এসনা
গর্ভিনী বের্ণা কোনওমতে মই বেয়ে উঠে বেরিয়ে এল ছাদে।
শেষ দুপুরের রোদ্দুরটা বড্ড চড়া, চোখে ধাঁধাঁ লেগে গেল বের্ণার। কাকে যেন শোয়ানো আছে একটু দূরে গায়ে কামিসের চাদর জড়িয়ে?
– কে রে? বোগাদের দলটা কি আবার কারো রক্ত নিল? বোগাবাবার পূজোতে নিশ্চয় কোন ত্রুটি হয়েছিল আমাদের।
আইগুল ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
-কসকুন অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বোগার সাথে পেরে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত, নিজের জীবন দিয়ে গমের ক্ষেত রক্ষা করেছে।
বের্ণা পাথরের মত স্থির হয়ে গেছিল,তারপরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে “আর কত রক্ত নেবে বোগাবাবা? এর কি কোন শেষ নেই?”, ঠিক তখনই প্রসববেদনা ওঠে বের্ণার।
না, বাচ্চাটা বাঁচেনি শেষপর্যন্ত। প্রসবের কদিন পরেই জ্বর হয়ে মারা যায়।
নব্য কৃষিজীবী এই সমাজ গোপালন শেখেনি। বন্য ষাঁড়ের দল মাঝে মাঝেই হানা দেয় তাদের ফসলের ক্ষেতে, প্রাচীন এই তৃণভূমির আদি বাসিন্দা তারা।ষাঁড়েরা ভয় পায় একমাত্র সিংহকে, মানুষগুলোকে তো একবার গুঁতোলেই পালায়।

দুই

দুই পাহাড়ের পাশ দিয় বয়ে চলা নদীতীরের এই সমতলভূমিতে আসার পর থেকেই ষাঁড়েদের দলের সাথে তাদের শত্রুতা। উন্মুক্ত তৃণভূমির বিশালতায় মানুষ বেঁধেছে ঘর, সঙ্কুচিত হয়েছে ষাঁড়ের দলের বিচরণক্ষেত্র। যব ও গমের লোভে ষাঁড়েরা বারবার হানা দিত মানুষের আস্তানায়, ফলত সংঘর্ষ ও রক্তপাত, দুপক্ষেই।
– কিছু একটা করতেই হবে, এভাবে আর চলতে পারেনা।
– পাথরের ছুরিতে শান দিতে দিতে তারু বলল
– – কি করবি রে নেরিক?
– – জানিনা, প্রতিবছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, রক্ত না দিয়ে ফসল ঘরে ওঠেনা। কিছু একটা করতেই হবে।
– – কি করবি? শিকার করে এ সমস্যার সমাধান হবেনা, আমরা সবাই তো বড় হবার পরীক্ষার সময় ষাঁড় শিকার করি, কিন্তু প্রতিবছর এরা ফিরে আসে।
– – অন্য কোন উপায় ভাবতে হবে, রাহিপের কাছে গিয়ে দেখি চল।
– – হুম, বের্ণার অবস্থা দেখেছিস? একে তো কসকুন চলে গেল, তার ওপরে বাচ্চাটাও, মেয়েটা প্রায় পাগল হয়ে উঠেছে।
– – হ্যাঁ, ও পণ করেছে যে ষাঁড়েদের বংশ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত আর সঙ্গীনির্বাচণ করবেনা।
– – রাহিপ মানল? রাহিপ তো বলে যে আদিমাতা হানাহানার নির্দেশ আছে যে কেউ সঙ্গীহীন থাকতে পারবেনা, মেয়েরা তো নয়ই, থাকলে ফসল দেবেনা হানাহানা।
– – রাহিপ এখনো কিছু বলেনি। সদ্য সন্তান প্রসব করেছে, বের্ণার ঋতু শুরু হতে এখনো দেরী আছে, তাই এখুনি সঙ্গীনির্বাচনের চাপটা নেই।
– – তাও বাঁচোয়া, তবে আইগুলকে বলব যে ওর কাছে যেতে, যদি একটু স্বান্ত্বনা দিতে পারে।
– – বলে দেখ
– -হুম, ছুরিটা শান দিতে দিতে তারুর মনে হল, নেরিক ঠিকই বলছে, কিছু একটা করতে হবেই। তবে শুধু ষাঁড়েদের শিকার করলে কাজ হবেনা, সে তো সিংহরাও করে। তা সত্ত্বেও এই ষাঁড়েরা দমেনা, সুযোগ পেলেই সিংহের পেট ফেঁড়ে দেয় শিং দিয়ে। কিন্তু অন্য কিছু কি বা করা যেতে পারে?
– শান দেওয়া হয়ে যেতে তারু উঠে দাঁড়াল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে, এখুনি পাঁচটা ভেড়াকে খোঁয়াড় থেকে নিয়ে আসতে হবে, আজ পুজো যে, বোগাবাবাকে অর্ঘ্য দিতে হবেনা? এবারের বলির দায়িত্ব তার, বলির পরে পুজোর সমাপ্তি হলে পূর্বপুরুষদের আত্মার সাথে কথা বলে রাহিপ তার জন্য সঙ্গিনী চিহ্নিত করবে।
– বেছে বেছে পাঁচটা ভেড়াকে খোঁয়াড় থেকে বের করে আনল তারু। গ্রামের ছাদ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে, সেপথ ধরে এগোলে একেবারে মাঝখানে গেলে পড়বে মন্দির, সেখানে বিরাজ করেন হানাহানা ও বোগাবাবা।
– আশ্চর্য মনে হলেও এই অঞ্চলের মানুষ ষাঁড়েদেরকে মনে করে তাদের পূর্বপুরুষের আত্মার মূর্ত রূপ, পূর্বপুরুষরা কোনভাবে রুষ্ট হলে ষাঁড়ের দল তাদের ক্ষেত আক্রমণ করে। তাই কসকুনের মৃত্যুর পরে পূর্বপুরুষের সাথে সাথে কসকুনের আত্মার সন্তুষ্টির জন্যও আজকের এই পুজো।
– মন্দিরের চারপাশে মই বেয়ে উঠে নেমে বাচ্চারা দৌড়োদৌড়ি করছে, নানা ঘর থেকে মই বোয়ে নারীরপুরুষ বেরিয়ে আসছে, কারো হাতে পুজোর জন্য রুটি, কেউ এনেছে ডুমুর, কেউবা সদ্যকাটা গমের শীষ। শুধু একজন মন্দিরের কোণে বসে আছে শূণ্যদৃষ্টি নিয়ে। এলোচুল, রক্তবর্ণ চোখ, বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে দুধের ধারা। পাশে বসে আছে কসকুনের বাবা ও মা।
– তারু চমকে উঠল বের্ণাকে দেখে, হানাহানা যেন মনুষ্যরূপ নিয়ে নেমে এসেছেন বের্ণার মধ্যে, সেই হাঁটুমুড়ে বসার ভঙ্গী, ভারী স্তন থেকে বয়ে চলা দুগ্ধধারা, বুকের ওপরে হাত।
– রাহিপ তখন কসকুনের মুন্ডহীন দেহ নিয়ে এসেছে মন্দিরে, রাহিপের পরণে শকুনের পোষাক, যেন আত্মাদের জগত থেকে স্বর্গীয় শকুন এসেছে কসকুনকে মৃত্যুলোকে নিয়ে যেতে।

তিন

কসকুনের সমাধির পর প্রায় দশমাস কেটে গেছে। বের্ণা অনেকটাই সামলে উঠেছে এতদিনে, সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্ষেতে কাজ করার সময় বের্নাকে দেখে কে বলবে যে একবছর আগে তার জীবনে একটা এতবড় ঘটনা ঘটে গেছে। তারুর সাথে তার সম্পর্কটাও ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছে বলেই চারিদিকে ফিসফাস। বের্না আর তারুর বিবাহবন্ধনের শুভক্ষণ উপস্থিত হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র বলেই সবার মত। কিন্তু যে দুজনকে নিয়ে এত আলাপ আলোচনা, তারা কি সত্যিই সেটা ভাবছিল?
– কসকুনের মুখমন্ডল প্রস্তুত করে আত্মাজগতের প্রবেশপত্র তৈরি করতে আর মাত্র দুটো চাঁদ বাকি, এখনও তো কোন উপায় হলনা।
– খড়ের গোছা বাঁধতে বাঁধতে বের্না বলল তারুকে।
– – হুম
– – কি হুম? মনে আছে তো কি বলেছিলে আমাকে?
– – মনে তো আছে, কিন্তু গত দশমাস ধরে ষাঁড়েদের দলপতি আমাদের ফাঁকি দিয়ে আসছে। মুখোমুখি লড়াইতে সঙ্গীসাথী নিয়ে সহজেই কাবু করা যেত, কিন্তু তা তো হবার উপায় নেই। লুকিয়ে এ কাজ করতে হবে বলেই তো এতদিনেও সফল হতে পারলামনা।
– – শোননা, শুনেছি যে গোবেকলি টিপিতে একজন গুণিন থাকেন যিনি নাকি সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। একবার গেলে হয়না?
– – গোবেকলি টিপি? সে তো অনেক দূর, তার ওপর ফসল কাটার মরসুম চলছে, এসময় দুজোড়া হাত কম হলে পুরো গোষ্ঠীর মুশকিল।
– – কসকুন একাই দুজোড়া হাত ছিল, সে চলে যাওয়ার পরেও তো ফসল কাটা থেমে থাকেনি।
– – তোমার সাথে কথায় পারা মুশকিল
– – শোন, তোমার প্রস্তাবে আমি একটাই কারণে রাজি হয়েছি, শর্ত ছিল, ষাঁড়েদের দলপতিকে হত্যা করতে হবে, যেটা তুমি এখনো করতে পারোনি।
– – না পারিনি, কেন পারিনি সেটাও তুমি জান নিশ্চয়? বাআলের বাহন বোগাবাবাকে হত্যা করা যায়না যদিনা ওরা নিজেরা আক্রমণ না করে।
– – সে তো দলের বাকি পুরুষেরাও বলেছিল, যাদের অনেকেই কৃষিজীবি, তোমার মত ভেড়া শুওরের নোংরা ঘাঁটেনা।
– – আমি যদি বলি আমি ভেড়া শুওরের নোংরা ঘাঁটি বলেই আমার প্রস্তাব তুমি গ্রহণ করেছিলে। তোমার মনে হয়েছিল যে আমি যেহেতু পশুদের মন বুঝি তাই লুকিয়ে হত্যা করতে একমাত্র আমিই তোমাকে সাহায্য করতে পারব।
– – বেশ করেছি
– – তা করেছ, এবারে একটা কাজের কথা বলি শোন। একটা জিনিস খেয়াল করেছ কখনো? ষাঁড়েদের আকার কেমন ছোট হয়ে যাচ্ছে না দিনকে দিন?
– – কি বলতে চাইছ বলতো?
– – শুওরপালন কিভাবে শুরু হয়েছিল জানত?
– – শুয়োর শিকার করতে মানুষের কষ্ট হত দেখে বাআল ওদের আকার ছোট করে দিয়ে পালনের উপযোগী করে তুলেছিল……
– তুমি কি ইঙ্গিত করছ?
– – কিছুনা, চল রাহিপের কাছে যাই গোবেকলি টিপিতে যাওয়ার অনুমতি নিতে।

চার

সিংহীটাকে প্রথমে দেখতে পায়নি ওরা, বড় ঘাসের আড়ালে গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে অনেকটা কাছে চলে আসার পরে রাহিপ তার তীক্ষ্ণ অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারে যে কোন একটা বিপদ আছে আশেপাশে। সবাইকে থেমে যেতে বলে সে।
– বল্লমটা শক্ত করে ধর, আমরা বেশি সময় পাবনা।
আইগুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু অথচ দৃঢস্বরে বলল রাহিপ। বের্ণার হাতের ধনুকে ততক্ষণে তীরসংযোগ হয়ে গেছে। তারুও বল্লমটা উঁচিয়ে ধরে রেখেছে।
সেসময়েই সিংহীটা লাফ দিল আইগুলের গলা লক্ষ্য করে। পলকের মধ্যেই বের্ণার তীর বাতাস কেটে ঢুকে গেল সিংহীর চোখে। প্রায় একই সাথে রাহিপের বল্লম বিঁধে গেল সিংহীর বুকে।
– দুজনেরই ক্ষিপ্রতা দেখার মত
হঠাৎ করে অচেনা স্বর শুনে চমকে উঠল ওরা। পিছন ফিরে দেখল যে রাহিপের মতই ঢোলা পোশাক পরা এক নারী। পার্থক্য হল এই নারী এখনো তরুণী।
– এই অঞ্চলে আরেকটু সাবধানী হতে হবে যে, তোমাদের দেখে তো কৃষিজীবি বলেই মনে হচ্ছে, ফসল কাটার সময় তো হয়ে এল প্রায়, এখন এইপথে কি করছ? এসব অঞ্চল তো আমাদের মত শিকারী পশুপালক যাযাবরদের আস্তানা।রাহিপ বলল,
– – আমরা আসলে গোবেকলি টিপিতে তীর্থে যাচ্ছি, ষাঁড়েদের উপদ্রব থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে।
– – তোমরা কৃষিজীবিরা তো ষাঁড়েদেরকে বামন বানিয়ে দিলে, ওরাও এখন তোমাদের ক্ষেতের আশেপাশেই ঘোরে। এদিকে আবার নিজেদের বীরত্ব বোঝাতে বড় শিংএর ষাঁড়ের খোঁজ কর তোমরা। বড়গুলো তো এভাবেই মরে গেছে সব। বীর সাজার জন্য বড় শিঙালের খোঁজ পেতে তোমাদের কত দূরে দূরে যেতে হয় আজকাল।যে শিঙাল দলপতির নেতৃত্বে ষাঁড়েরা তোমাদের ক্ষেতে আক্রমণ করে, সে মনে হয় গোটা অঞ্চলের শেষ শিঙাল। খাদ্যসংগ্রহ ছাড়া অন্য কারণে পশুশিকারে যে কি বীরত্ব কে জানে।
বের্ণার দৃষ্টি তখন তারুর দিকে, তারুর মুখে একটা বাঁকা হাসি।
– তোমার নামটা জানতে পারি যাযাবর?
প্রশ্ন করল রাহিপ
– আমি গিল যাযাবরদের গুণিন ইনা। তোমাকে দেখেও তো গুণিন বলেই মনে হচ্ছে। একটা কথা বলি শোন। শুধু তোমাকেই বলব, বাকিরা দূরে সরে যাক।
কিছু দূরে চলে গেল দুই নারী, কিসব আলোচনার পর রাহিপ এসে বলল, আমরা বড়ই সৌভাগ্যবান। গুণিন ইনাই বর্তমানে গোবেকলি টিপির নির্বাচিত প্রধান। গোবেকলি টিপি পৌঁছানোর আগেই দেখা হয়ে গেল। আর দূরে গিয়ে লাভ আছে?
– এতদূর এসে একবার চোখে দেখবনা?আর তো দুদিনের মোটে পথ।
– আইগুল বলে উঠল
– – সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ, গোবেকলি টিপি তো শুধু মন্দির নয়, এই অঞ্চলের বাজারও বলা যায় তাকে। অনেক কিছু শিখতেও পারব হয়ত।

দিনদুয়েক পরে বিকেলের দিকে চারজনের এই এই ছোট্ট দলটা গোবেকলি টিপিতে পৌঁছে চমকে গেছিল বললে মনে হয় কম বলা হবে। তাদের গ্রামকে আসেপাশের গোষ্ঠীরা আর গ্রাম বলেনা, বলে শহর। কিন্তু শহরের বাসিন্দা হয়েও গোবেকলি টিপি দেখে তারা চমকে গেল। একটা গোলাকৃতি জায়গায় চারপাশে বড় বড় পাথরের স্তম্ভ, স্তম্ভেগুলোর মাথায় আবার আরেকটা করে পাথর আড়াআড়ি শোয়ানো। স্তম্ভের গায়ে নানান মকশা কাটা, কোথাও ফুটিয় তোলা হয়েছে শিকারের জন্য তৈরি চিতাবাঘকে, কোথাও বা বাঁদরের অবয়ব। বের্ণারা বাড়ি বানায় ইঁট দিয়ে, যদিও শুনেছে যে বহুদূরে জেরিকো গ্রামকেও নাকি শহর আখ্যা দেওয়া হয়েছে, আর সেটা নাকি পাথর দিয়ে বানানো। কিন্তু গোবেকলি টিপির ওই এত্ত বড় বড় পাথরের স্তম্ভগুলো বানালো কে? এত্তবড় পাথরই বা কে আনল? এগুলো তুললোই বা কে? এসব প্রশ্ন চারজনেরই মাথায় ঘুরছিল।
অন্যদিকে বসেছে বাজার, বহুদূর থেকে কেউ এনেছে কালো কাচ, কেউবা সমুদ্রের গহ্বর থেকে তুলে এনেছে ঝিনুক। নীল পাথরের গয়না দেখে আইগুল খুবই উত্তেজিত, কিন্তু কেনার উপায় নেই। বিনিময় করার মত কিছু আনেনি যে তারা।

পাঁচ

– ওই দেখ মৃতুদেব শরীর থেকে আত্মা নিয়ে যাচ্ছেন।
একটা স্তম্ভের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল আইগুল। মানবমস্তকের মধ্যে থাকা আত্মাকে মৃত্যুদেব শকুনের রূপে নিয়ে যাচ্ছেন দেবলোকে। এরকম ছবি তো তারা নিজেদের বাসস্থানেও আঁকে, কিন্তু পাথর খোদাই করে বানানো এই চিত্র যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
– খুক, খুক, কেমন লাগছে?
নারীকন্ঠ শুনে চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখল ইনার হাস্যময় মুখ।
– দেখা হল? তোমাদের শহরের সাথে মিলগুলো লক্ষ্য করেছে?
– – হ্যাঁ, কি অদ্ভুত না?
– – আশ্চর্য হবার কিছু নেই, তোমাদের পূর্বপুরুষরাই এই মন্দির বানিয়েছিলেন, যখন বাআল প্রথম শস্যবীজ দেন মানুষকে। ষাঁড়ের পিঠে এক বস্তায় করে নিয়ে এসেছিলেন শস্যবীজ।
– – ষাঁড়ের পিঠে? কিন্তু তারা তো আমাদের শত্রু
– – শত্রুই যদি হবে, তাহলে বছরের একটা বিশেষ সময় ছাড়া শত্রুনিধনের অধিকার নেই কেন? ষাঁড়ের পিঠে করেই শস্যবীজ এনেছিলেন বাআল, এটা মনে রেখ। মানুষই ষাঁড়েদের দূরে ঠেলে দিয়েছে।
– ইনা এবার বের্নার দিকে তাকিয়ে বলল
– – শোন, প্রতিশোধ নিতে চাও ভাল কথা, কিন্তু প্রতিশোধের আগুনে জীবনের আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত কোরনা, তাহলে প্রতিশোধ নেওয়ার পরে নিজেকে দেখবে সম্পূর্ণ একা। ভেব এ ব্যাপারে, তারুর চোখে তোমার জন্য যে ভালবাসা দেখেছি তা কিন্তু বহুমূল্য, ক্ষ্যাপার মত ছুঁড়ে ফেলনা। আমাকে এবারে যেতে হবে, মনে রেখ ষাঁড়েদের কিন্তু মানুষই দূরে ঠেলে দিয়েছে। এই বর্শার ফলাটা রাখ, তোমার প্রতিশোধস্পৃহার নিবৃত্তি করতে পারবে হয়ত এটা। আরে রাখ এই অঙ্গুরীয়, গোবেকলি টিপির পুরোহিতদের জ্ঞান সঞ্চিত আছে এতে।
এই বলে তাদের চারজনের আরো কিছু কথা গোপনে বলল ইনা। কথা শেষ হওয়ার পর হতভম্ব চারজন মানুষকে পেছনে ফেলে পা চালাল ইনা, গোধূলীর আলোয় ইনার পিঠে বাঁধা অস্ত্রশস্ত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কোন দেবীর অসংখ্য হাত। মনে মনে সবাই কুর্নিশ জানাল এই প্রাজ্ঞ নারীকে।

ছয়

– ইনার কথা মনে আছে? কি বলেছিল, ষাঁড়েরা আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু তাদের থেকে মৈত্রী কিকরে আদায় করা যায় সেটা ইনা বলেনি। তারুর থেকে মানুষ কিভাবে শুওর ও ভেড়াপালন শেখে সে ব্যাপারে জেনেছিলাম, ইনা আর তারুর কথাতেই যদি মেলাই, তাহলে একটা বিশেষ জিনিস মাথায় আসে, শক্তিশালী শত্রুকে যদি নিকেশ না করে মিত্র করে তোলা যায়, তাহলে যে আদতে লাভই হয়, সেটা মনে হয় স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। গোবেকলি টিপির প্রধান আমাকে এই অস্ত্র দিয়ে গেছেন, পাথর গলিয়ে তৈরি হয়েছে এই বর্শার ফলা। এই অস্ত্রের সাহায্যেই দলপতিকে হত্যা করব আমি।
বের্না নিজের হাতের বর্শাটা উঁচিয়ে ধরল, সূর্যালোকে চকচক করে উঠল তামার ফলা। মানুষ তখনও ধাতুর ব্যবহার প্রায় শেখেইনি, তাই এত চকচকে অস্ত্রকে দৈবি বলে মেনে নিতে অসুবিধাই হলনা কারুরই।
রাহিপের নির্দেশানুসারেই এই জমায়েত, ষাঁড়েদের সাথে শেষ বোঝাপড়ার দিন নাকি সমাগত।। সেজন্যই কিছু স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন, আর সেজন্যই আজকের জমায়েত।
রাহিপ বলল
– স্বেচ্ছাসেবক হতে কারা কারা রাজি জানাও
জনাকুড়ি হাত উঠল। রাহিপ বলল
– মাত্র কুড়িজন? এত ভয় তোমাদের? আমরা জোর করতে পারবনা যদিও, কিন্তু আরো উৎসাহ আশা করেছিলাম, তোমাদের জীবন ও জীবিকাকে চিরকালের মত রক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তো। যাই হোক, কুড়িজনই যথেষ্ট। কাল থেকেই কাজ শুরু হবে।
চ্যাতালহোয়ুক শহর গড়ার পরে এতবড় আয়োজন এই অঞ্চলের মানুষরা আগে দেখেনি। শহরের পাশে জড়ো করা হয়েছে বেশ কিছু গম ও যব। তার পাশে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে একটা খোঁয়াড়ের মত জিনিস।
পূর্ণিমার রাতগুলোতেই ষাঁড়েরা গমের জন্য হানা দেয়, তার আগে শেষ করতেই হবে, হাতে মাত্র দশদিন সময়। তারু, আইগুল আর বের্নার দম ফেলার সুযোগ নেই, পুরো কাজটার দেখাশোনা তো তাদেরই দায়িত্ব, পরিকল্পনার দায়িত্বে আছে রাহিপ।

সাত

অনেকরকম বাধা সত্ত্বেও কাজটা শেষ হয়েছে পূর্ণিমার ঠিক আগেরদিন, এবারে শুধু প্রতীক্ষা। রাতেরবেলা সবাই নিজের জায়গায় অপেক্ষারত, কখন আসবে ষাঁড়ের দল।
দূর থেকে শোনা গেল কিছু ক্ষুরের শব্দ
– ওই তো, ওই তো
চেঁচিয়ে উঠল তারু
– আইগুল, খোঁয়াড়ের দরজাটার কাছে ওই ঝোপটায় চলে যা, সময়মত আমাকে বলবি, আমি দরজা বন্ধ করে দেব।
– বের্না, তুমি এখানটাতেই থাক, ষাঁড়ের দলকে এখান দিয়ে যেতেই হবে, তখন দলপতি তোমার।
যে যার পূর্বনির্ধারিত জায়গায় চলে গিয়ে দমবন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকল।
ষাঁড়ের দল যেখানে গম রাখা আছে, সেদিকে এগোতেই ঘটল দুর্ঘটনা। দূর পাহাড়ের চুড়ায় প্রবল শব্দ, সবাই তাকিয়ে দেখল আগুনবর্ষণ শুরু করেছে পাহাড়। এ কি অনাসৃষ্টি, পাহাড়দেবতা কি রাগ করেছেন? ভয়ে কুঁচকে গেল সবাই। শুধু তারু, বের্না আর আইগুলের মধ্যে কোন পরিবর্তন নেই, তারা দেখল এই তো সুযোগ। অগ্নুৎপাত ষাঁড়ের দলে একটা আলোড়নের সৃষ্টি করেছে, দলপতিকে অণুসরন করার বদলে তারা ছত্রভঙ্গ।
আইগুলের হাতে জ্বলে উঠল মশাল, তা দেখে বাকিদের হাতেও জ্বলল মশাল, সবার মুখে উল্লুলুলুলু আওয়াজ। এই দুই অস্ত্র ষাঁড়ের দলের কিছু অংশের ঠেলে দিল খোঁয়াড়ের দিকে, খোঁয়াড়ে ঢুকতেই তারু বন্ধ করে দিল দরজা।
অন্যদিকে ষাঁড়দের দলপতির মুখোমুখি তখন বের্না, বের্নার মুখে অগ্নুৎপাতের আলো এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্যের সৃষ্টি করেছে, ষাঁড়েদের দলপতির কৃষ্ণবর্ণ শরীরে সেই আলো এমন অদ্ভুত রঙবৈচিত্রের সৃষ্টি করেছে, যে দেখে মনে হচ্ছে পাতাললোক থেকে উঠে আসা কোন দানব। বের্না বেশি দেরী করলনা, হাতের বর্শাটাকে শক্ত করে ধরে অপেক্ষা করল দলপতি কখন ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছয়।
দলপতি বের্নাকে দেখে হয়ত ভাবল দলের আধিপত্যে আঘাত বানাতে চায় নাকি এই মানুষটা? ওঁকে শিক্ষা দিতে হবে। খুরে ধুলো উড়িয়ে দৌড়ে এল সে বের্নার দিকে, ঠিক সেইসময়েই বের্নার হাতের বর্শার শাণিত ফলা ভেদ করল তার কন্ঠনালী, চতুর্দিক লাল আভায় ভরে উঠতে উঠতে দলপতি দেখল তার দল বন্দী। তারপর, শুধুই অন্ধকার।

পুনশ্চ

বন্দী করা ষাঁড়েরা এই কবছরে অনেকটাই পোষ মেনেছে, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিকাজে। বন্দীদশা তাদের আকারেও ছোট করে দিয়েছে, চ্যাতালহোয়ুকের মানুষরা এদের নাম দিয়েছে গরু।

আর বের্না আইগুলের বীরত্ব ও ইনার জ্ঞান তাদেরকে প্রায় দেবত্ব দান করেছে, হানাহানার মূর্তি আর একা নেই। দেবী এখন সিংহবাহিনী, তিনি বসে আছেন সিংহাসনে, তাঁর দুপাশে দুটি সিংহী, সিংহীদের থেকে এদের বিক্রম তো মোটেই কম ছিলনা।
আর সেদিনের ঘটনাকে স্মরণ করে তারা এঁকেছে চ্যাতালহোয়ুক শহরের ছবি, অগ্নুৎপাত, ষাঁড়ের দলের বিপদ সব তুচ্ছ করে যে শহর মানুষের জয়যাত্রার অন্যতম নিদর্শন হয়ে যা আজও প্রত্নতত্ত্ববিদদের অবাক করে দেয়।

তিনটি ক্ল্যারিফিকেশন:-

চ্যাতালহোয়ুকের অবস্থান দক্ষিণপূর্ব তুরস্কে।

গল্পে যে কালো কাচের উল্লেখ আছে, তা আদতে অবসিডিয়ান, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আগ্নেয় কাচ।

ষাঁড় বলতে এখানে ওরকস (Aurocks) বোঝানো হয়েছে, এদের থেকে গরু এসেছে ডোমেস্টিকেশনের পরে।

– [ ]

1 Comment

  1. অসাধারণ গল্প৷ ষষ্ঠীর সকালে প্রাসঙ্গিকও বটে৷ চ্যাতালহোয়ুকের সিংংহবাহিনী দেবীর সঙ্গে দুর্গার যোগ কতটা, ষাঁঁড় দলপতিই মহিষাসুর কি না সে প্রশ্ন না উঠে পারে না৷ আর এই জনগোষ্ঠীই আর্যরূপে ভারতভূমিতে প্রবেশ করেছিল কি না এসেছিল কি না সে কথাও উঠবে৷ তবে অত কথা না ভাবলেও স্রেফ গল্প পড়ার জন্যেই এটা বারবার পড়া যায়৷

আপনার মতামত...