কার্বি ভাষা ও সাহিত্য

লংকাম তেরন

 

 

সাত বছর আগে প্রয়াত লেখক কার্বি ভাষার এক অগ্রগণ্য কর্মী, কবি ও সাহিত্যিক। কার্বি লাম্মেত আমেই – কার্বি ভাষার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। জীবদ্দশায় কার্বি আংলঙের রাজনীতির সনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।

 

 

আসাম বহু আদিবাসী এবং সম্প্রদায়ের বাসভূমি। এবং সেই সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ই ইংরাজির পাশাপাশি তাদের নিজেদের ভাষাতে তাদের মতামত এবং আবেগ ব্যক্ত করে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই সাহিত্যিক সৃষ্টিগুলির অপ্রতুলতার দরুণ, এবং আবশ্যিক ব্যাকরণ জ্ঞানের অভাবের দরুণ আমরা এগুলিকে সাহিত্যের মর্যাদা দিই না। তাদের ভাষাকেও ‘ডায়ালেক্ট’ বলে দাগিয়ে দিই।

সাধারণভাবে আমরা যখন অসমীয়া বলি, তখন আমরা বিভিন্ন আদিবাসী এবং সম্প্রদায়ের একটি মিশ্র জনগোষ্ঠী বুঝিয়ে থাকি। পরিসংখ্যান বলছে, আসামে ৬৬টি আদিবাসী সম্প্রদায় এবং উপ-সম্প্রদায় রয়েছে। কার্বিরা, যারা আগে মিকির নামে পরিচিত ছিল, তারাও তাদের মধ্যে একটি। অন্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলির মতোই কার্বিদেরও নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে বর্তমানে আসামে কার্বি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ৩,৭৯,০০০। বর্তমান নিবন্ধে কার্বি ভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং বর্তমান ধারার কথা বলতে চেষ্টা করা হচ্ছে।

কার্বিরা আসামের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে রয়েছেন। এটা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কার্বিরা যতদিন না নিজস্ব প্রশাসন পেয়েছেন, ততদিন তারা নিজেদের ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ তো পানইনি, এমনকি তারা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। যাই হোক, ১৯৫১ সালে কার্বি আংলং জেলা গঠিত হল, এবং তার সাথে কার্বিরা আসামের অন্য জেলাগুলিতেও ছড়িয়ে থাকতে থাকলেন। যেমন কাছাড়, নগাঁও, মোরিগাঁও, কামরূপ, শোণিতপুর, দারাং, লখিমপুর, শিবসাগর…। এর সাথেই নাগাল্যান্ডের উত্তর অংশে, মেঘালয়ের নাংপোতে এবং বাংলাদেশের সিলেটে। কার্বি ভাষা এবং তার বিস্তার সম্পর্কে মিকির ভাষার একটি অভিধান-এর লেখক জি ডি ওয়াকার ১৯২৪ সালে বলেছিলেন:

…আসাম সীমান্তের বহু জাতির মধ্যে মিকিররাও একটি, এবং… তারা একটা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন। গোলাঘাট থেকে কামরূপ এবং গৌহাটি ছাড়িয়ে খাসি পাহাড় পর্যন্ত, শিলচরের কাছে কাছাড় সমতল থেকে দারাং-এ বিশ্বনাথের উত্তরের বনাঞ্চল পর্যন্ত। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের ভাষা কিন্তু বস্তুত একটাই এবং সর্বত্র একই।

কার্বিদের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই তাদের শ্রুতি সাহিত্যের কথা মাথায় রাখতে হবে। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কার্বিদের কোনও লিখিত সাহিত্য ছিল না। মেজর জন বাটলার তার আসাম সফর-এ লিখেছেন:

মিকিরদের কোনও নির্দিষ্ট ধর্মমত নেই, বা নিজেদের কোনও লিখিত ভাষাও নেই। কিন্তু তবু তাদের ভাষা এই রাজ্যের বাকি সব আদিবাসীদের ভাষার থেকে ভিন্ন। তারা কোন সময়ে আসলেন এবং কোন জাতি থেকে তাদের উদ্ভব, সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণাই নেই।

সামাজিক রীতিনীতি, কিংবদন্তি, ঐতিহাসিক কাহিনী, প্রেম-বিরহের গাথা, রাম-রাবণের লোকগান, প্রেমের গান, উপকথা, পূজার স্তোত্র, প্রবাদপ্রবচন জাতীয় লোকসংস্কৃতির সমস্ত উপাদানগুলিই শ্রুতি সাহিত্য হিসেবেই বেঁচে রয়েছে।

কার্বি ভাষায় লিখিত রচনার মধ্যে ১৮৭৫ সালে শিবসাগরে খ্রিস্টান মিশনারি প্রেস থেকে প্রকাশিত একটি প্রচার পত্র কার্বি ক্যাটেচিজম-কেই প্রথম ধরা যায়। তারপর ১৮৯৮ সালে প্রাথমিক স্কুলের জন্য প্লিপলি এবং কলাখা বলে দুটি টেক্সটবুক প্রকাশিত হয়। রোমান হরফে লিখিত বই দুটি প্রকাশ করেন রেভারেন্ড পি ই মুর, স্যার জে এম কারওয়েল এবং রেভারেন্ড ডব্লিউ আর হাটন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই বইদুটিই প্রাথমিক স্কুলের টেক্সটবুক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী কালে এই বই দুটি আক্সামিয়া হরফেও প্রকাশিত হয়। কার্বিদের মধ্যে প্রথম ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী স্যামসনসিং ইংতি এবং বাসাপি ইংতির উদ্যোগেই বইগুলি আক্সামিয়া হরফে পুনর্মুদ্রিত হয়, এবং সেগুলিও আরও চার বছর ধরে স্কুলে পড়ানো হতে থাকে।

কার্বিদের মধ্যে অক্ষরপরিচয় এবং শিক্ষা আনার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারা শুধু যে উপরে উল্লিখিত টেক্সটবুকগুলি ছাপিয়েছিলেন তাই নয়, মিকির ভাষার অভিধান, তোমো পুরু, আরলেং আলুন আথুই, মিকির থার্ড রিডার, বিতুসো আকিতাপ, নিং আরজান, পিলগ্রিম’স প্রোগ্রেস অ্যান্ড কার্বি-ইংলিশ ভোকাবুলারি-র মতো বইগুলিও প্রকাশ করেন। রেভারেন্ড হাটন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বিরতা নামে একটি কার্বি জার্নাল সম্পাদনা করেছেন। তিনি কার্বি ভাষায় অনেক ধর্মপুস্তকও রচনা করেন।

কার্বি ভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশকে স্বাধীনতা-পূর্ব এবং উত্তর এই দুই পর্যায়ে ভাগ করা যায়। স্বাধীনতার পরে আমরা অনেক কার্বি লেখককে পেয়েছি, যাদের মধ্যে বংলং তেরাং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯৩৭ সালে তেরাং কার্বি ভাষায় তিনখানি বই প্রকাশ করেন: হা-ই, রুকাসেন এবং আদম-আসারআদম-আসার প্রচলিত বিবাহ সঙ্গীতের একটি সংকলন। রুকাসেন একটি কার্বি গ্রামের প্রধানের কাজকর্মের বর্ণনা। কার্বিরা কেমন করে গ্রামপত্তন করেন সেই বর্ণনাও আমরা এই বইতে পাই, এবং তার সাথে ধান এবং লঙ্কা চাষ সংক্রান্ত কিছু লোকসঙ্গীতও। হা-ই এক তরুণ প্রেমিকযুগলের চিরন্তন ভালোবাসার গাথা। কার্বি আংলং জেলা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তেরাং কার্বি কাপুসান, দিনমির, সার লামসাম, সের হাংথাম, রাংলিন এবং আরান আতেং প্রকাশ করেন। এই সময়কার আরেকজন উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন রঘুনাথ থেরন। ইনি আসাম সমতল অঞ্চলের একজন কার্বি এবং এর লেখা বই কার্বি পো

কার্বি আংলং জেলা গঠিত হওয়ার পর কিছু সচেতন মানুষ নিজেদের ভাষায় লিখতে এবং প্রকাশ করতে শুরু করেন। কার্বিদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনও কার্বিতে তাদের প্রচারপত্রগুলি প্রকাশ করা শুরু করে। পাশাপাশি, ক্যাথলিক মিশনারিরাও তাদের অবদান রাখছিল। তারা যে শুধু তাদের মাসিকপত্র  সামফ্রি আতুর প্রকাশ করতে থাক তাই নয়, বাইবেল কাংথির এবং কার্বি আত্মচিন্তা-র মতো বইগুলিও প্রকাশ করেছে। যদিও সংখ্যায় খুব বেশি নয়, তবুও কিছু কার্বি সাময়িক পত্রপত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন, ওয়ে কিমি, কার্বি, ক্লিরডাপ, তোয়ার কিমি, নাকওয়ে, মঞ্জির, লামডে, লোটি, আতুর কিমি, লংসার, লোকিম, উওজারু ইত্যাদি। কার্বি সাহিত্যের বিকাশের জন্য যে সমস্ত লেখকেরা নিয়মিতভাবে তাদের বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে অবদান রেখে চলেছেন তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম–  লুনচে তিমুং, বিদারসিং ক্রো, সাবরাসি তিমুং, লংবিরাম ইংতি কাথার, বিদারসিং রাংপি, সুরেন ক্রামসা, বিদ্যাসিং রাংপি, খয়াসিং হানসে, বাপুরাম টেরন, আনন্দ রাংফার, জিৎ কুমার রাংপি, পারি রাংপি, গান্ধী টাকবি, সার্কলিম টারো, লাংকামার তিমুং, দেবেন তিমুং, রংবং তেরাং, অরুণ টেরন, জারসিং বে, মন্দালসিং বে, সারক্রাট হানসে, সিং ক্রো, লগকাম টেরন, সামসিং টেরন, খিরলা টেরনপি, রূপলান ইংতিপি, সাধনা রাংপিপি, রিনা পাতারপি, রুহিনি টেরনপি প্রমুখ।

১৯৬৬ সালে কার্বি সাহিত্যের বিকাশ এবং বিস্তারের জন্য আসাম সাহিত্য সভার অনুকরণে কার্বি লাম্মেত আমেই বা কার্বি সাহিত্য সভা গঠিত হয়। লংকাম তেরনকে সভাপতি এবং পদ্মশ্রী রংবং তেরাংকে  সম্পাদক করা হয়। কার্বি লাম্মেত আমেই যে সব বই প্রকাশ করেছে তার মধ্যে আছে লাম্মেত এসাং, সামফ্রি আপুনসির, কাসানঘাং-এর মতো ছোট গল্পের সংকলন; সেংউই আমির সিকিদুপুপে, ডাম্পিজুক সিংদি, রূপটাইনে, জেংজেরি, কুংরিসো মিরদান-এর মতো কবিতা সংকলন; তোমো পুরু-র মতো উপকথা সংকলন; খেই আহারসি, জুটাং আমুং, রংথিয়াং আংটাং, সের লাংসার, লামজির আফার, লামজির কাংডাক-এর মতো প্রবন্ধ সংগ্রহ; পেংসোমির, দিমির আলুন-এর মতো লোকগানের সংকলন; লাংরি আমেলুর-এর মতো জীবনী সংকলন; আকেমি কার্বি লামথে আমারজাং-এর মতো অভিধান; ইত্যাদি।

তবে এটা বেশ দুঃখজনক যে কার্বিদের জন্য আলাদা জেলা গঠিত হওয়ার পর অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও কার্বি ভাষা এবং সাহিত্যের বিকাশ কিন্তু আশানুরূপ নয়। এর মূল কারণ, কার্বি আংলং জেলার স্বশাসিত কাউন্সিল এই লক্ষ্যে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি। তবে এটা একটা ভালো ব্যাপার যে, ১৯৯৮ থেকে ভারত সরকার এবং বিশ্বব্যাঙ্কের অনুদান পেয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প কার্বি আংলংকে তার আওতায় এনেছে। এই প্রকল্পের অধীনে কার্বি ভাষা এবং সাহিত্যের অগ্রগতির জন্য একটা আলাদা পলিসি তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কার্বি আংলং জেলা স্বশাসিত কাউন্সিল কার্বি ভাষা বিকাশ সংস্থা বানিয়েছে, এবং সেটা শেষ হওয়ার পর এই প্রকল্পের অধীনে অনেক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩-এ সরকার কার্বি ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে এবং সরকারি স্কুলগুলিতে এই ভাষার ২০০ জন পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগ করা হবে বলেও জানিয়েছে। এই পদক্ষেপ স্বাগত, এবং কার্বি ভাষা এবং সাহিত্য যাতে তার পূর্ণ ক্ষমতায় বিকশিত হতে পারে তার জন্য আরও দায়িত্বশীল এবং অর্থবহ পলিসির প্রয়োজন।

(প্রবন্ধটি মিউজ ইন্ডিয়ার ১৭ নং সংখ্যা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ২০০৮-এ প্রকাশিত)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...