ক্ষিতি

সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

যুধিষ্ঠির নাম রেখেছিল তার মেজদাদু। বড়দাদুরই রাখার কথা ছিল হিসেব মতো, কিন্তু মাত্র ৮৭ বছরে (ওদের বাবার দিকে সবাই দীর্ঘজীবী, মোটামুটি নব্বই না হলে কাউকে বয়স্ক হিসেবে ধরাই হয় না) আচমকাই ওপরের ডাক এসে যাওয়ায় তার আদরের ছোট খোকার বড় ছেলের নামকরণ করে যাবার সুবিধা তার হয়নি।

তা সে নাই হোক, তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি। এদিকে যুধিষ্ঠির যুধি হল, যা স্কুলের ছেলেদের মুখে যুধু এবং পরবর্তীকালে শহরের সহপাঠীদের মুখে অন্য কোনও চ-আক্রান্ত শব্দরূপ নেবে। তা সেও এখনও প্রায় সওয়া দশক দূরে। এই মুহূর্তে মেজদাদু মন দিয়ে তাকে কুরুক্ষেত্র বোঝাচ্ছিল। ওই যে সেই জায়গাটা, যেখানে দ্রোণের প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠির বলছে অশ্বত্থামা হত, তারপর অস্ফুট স্বরে ইতি গজ। বলতেই যুধিষ্ঠিরের রথ, যা তিন আঙ্গুল ওপর দিয়ে চলত অবশেষে মাটি ছুঁল। অবাক হয়ে যায় ও, সত্যি বলার এত তেজ! অবাকভাবটা বয়ে বেড়াল পরেও। তাই প্রথমবার স্কুলে যেদিন বড় দাদারা অঙ্ক পরীক্ষায় নাম লেখার পাতা বাদ দিয়ে বাকি ১১টা সাদা পাতার সদগতি না হবার ক্ষোভে, স্কুলের ফুলবাগান মুড়িয়ে দিয়েছিল, হেডসারের ‘কে করেছে জানো’ প্রশ্নে ওর ক্লাসের সবাই একবাক্যে নীরবতা পালন করলেও কোনও মহাভারতীয় আত্মা তার জিহ্বাগ্র অধিকার করে! ফলাফল হিসেবে এর পর তার সাইকেলের চাকার হাওয়া খোলা পাওয়া যায়, ফুটবল মাঠে খালি গায়ে খেলার সময় কে বা কারা তার সাদা জামা দিয়ে পুকুরের পাঁক পরিষ্কার করার চেষ্টা করে এবং ফাউ হিসেবে গুলতি থেকে ছোঁড়া একট অব্যর্থ ঢিল তার চাঁদিতে একটা প্রমাণ সাইজের মার্বেল গজিয়ে তোলে। যাই হোক, এইসব ছোটখাটো জাগতিক ব্যাপার তাকে দমাতে পারেনি। শুধু অনেক রাতে পাশে শুয়ে যখন মা আর বাকি ভাইবোনেরা গভীর ঘুমে, সে তখন চাঁদিতে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে চুপিসারে বাইরে এসে দাওয়া ভেসে যাওয়া জ্যোত্স্নায় নিজের পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দেখত আর হিসেব করার চেষ্টা করত সত্যি তার পা মাটি থেকে অল্প ওপরে উঠেছে কিনা। শেষ পর্যন্ত একটা পাজী ডেঁও পিঁপড়ে নিজের প্রাইভেসি বিঘ্নিত হওয়ার বিরক্তিতে বুড়ো আঙ্গুলে পুটুস করে কামড়ে দিতে তার সম্বিত ফেরে। এই ভাবেই চলছিল, ওর সত্যি বলার ব্যারাম সবাই ধীরে ধীরে জেনে গেছিল। তাই, যে কোনও জটিল বিষয়, যেমন বনভোজনে নুরুল মিয়ার মুরগী চুরি, আরেকটু সাবালক হবার সাথে ঘোষবাড়ির নেংটিকে পালা করে লভ লেটার বা বাড়ি ফাঁকা পেলে শিক্ষামূলক সিনেমা দেখা ইত্যাদি রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা তার সিলেবাসের বাইরেই থেকে যায়। তাতে ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যুধি। তার ঘামের-গন্ধ-বাসিত চেহারায় যেন অদৃশ্য বিজ্ঞপ্তি টাঙানো থাকত যে, যেখানে যাই হোক না কেন, যেই কেস খাক না কেন যুধি কখনও মিথ্যে কথা বলে না। কথিত আছে, একবার মাধ্যমিকের সিট পড়েছিল যে স্কুলে, সেখানে এক ক্লাসে গার্ডের অনুপস্থিতিতে যে ব্যাপক কপিকার্য সম্পাদিত হয় তাতেও যুধি ছিল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। নিজের খাতা কাউকে দেখায়ওনি, দেখেওনি। দুর্জনে বলে ক্লাসে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে মধ্যশিক্ষার বনিয়াদ মজবুত করার পিছনে তার এহেন অধ্যবসায়ই দায়ী। ইতিমধ্যে মেজদাদুও শেষ পর্যন্ত এই নামকরণ করে বিব্রত হয়ে এ ধরাধাম ত্যাগ করেছে। একান্নবর্তী সংসারের বাঁধন ভেঙে যে যার মতো ছড়িয়ে পড়েছে এ নবীন মহাভারতে।

এর পর স্কুলের শিক্ষকদের তাকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের প্রতিশ্রুতি অনেক কষ্টে অগ্রাহ্য করে স্কুল পেরিয়ে কলেজ, এবং সেখানেও একই খেল। একদিন ক্লাসে নোট দেবেন স্যার, সেই নোট আছে কম্পুটারে। কিছু ছেলের ইচ্ছে নোট কপি করে কেটে পড়ার। কিন্তু যুধির হাতে সেই যে কম্পুটারের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন স্যার, কাউকে হাত পর্যন্ত সে লাগাতে দেবে না। এ নিয়ে প্রচুর বাকবিতণ্ডা, নোট কপি না করতে দিলে তার মা বোনের সাথে বন্ধুদের মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে তোলার গণপ্রতিশ্রুতি, কিছুই তাকে টলাতে পারেনি।

এর বেশি ডিটেলস দিয়ে বোর না করে স্টেপ জাম্প করে বলে দেওয়া যায় জীবনের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক কষতে কষতে এবং পায়ের বুড়ো আঙুলটাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত এক আধাসরকারি সংস্থার মেটিরিয়ালস ডিপার্টমেন্টে এসে নৌকা ভিড়ল যুধির। গ্রাম থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ট্রেনজার্নির চাপ না নিয়ে ছলছলে পেছল বাড়ির রাস্তা হয়ে সে শিয়ালদায় মেস নিল। একা মানুষের পক্ষে আদর্শ। মেসেও তার স্বভাবগুণে টুকটাক এদিক ওদিক ঝামেলা লাগত বটে, কিন্তু মোটের ওপর বেশ মজাতেই কাটত। শুক্রবার রাতের ট্রেন ধরে বাড়ি গিয়ে আবার সোমবার ভোর ভোর বেরিয়ে অফিস হয়ে মেস, এই ঘূর্ণাবর্তে জীবনের প্রায় সাড়ে সাতশো দিন ঘুরে গেছে তার।

তার অফিসের কাজ মূলত টেন্ডার নিয়ে। ফলে এদিক সেদিক থেকে বাঁ হাতের ব্যায়াম ভালই হয় বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের। নগদের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই তাই, অর্ডার সিজন এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী মেয়ের বিয়েতে মাটন বা চিংড়ির দায়িত্ব থেকে লা ওপালার ডিনার সেট ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসের আদানপ্রদান হয়েই থাকে। কিন্তু ঝামেলা বাঁধাল যুধি। তার বক্তব্য, কাজ করার জন্য মাইনে তো পাচ্ছিই, সাপ্লায়ারের থেকে টাকা নেওয়াটা অধর্ম হবে। সহকর্মীরা পড়ল মহা ফাঁপড়ে। কারণ যে তোমার সাথে নেই, সেই তোমার বিরুদ্ধে– এই আপ্তবাক্য সব জায়গাতেই সমান সত্যি। বয়স্থ কেরানি সরখেলবাবু পর্যন্ত বললেন, ‘ওহে যুধি, এই তো বয়স। যা কামাবার কামিয়ে নাও। সরকারি চাকরি নিয়েছ কেন নইলে!’ তবুও যুধি অনড় অচল। এর ফলে যা হয় তাই হল, অফিসে সেরকম হৃদ্যতা কারও সাথে তৈরি হওয়ার আগেই বিকর্ষণের সম্পর্ক তৈরি হল।

বেশ চলছিল তার এই কেরানিকাল জীবন, কিন্তু ঘটনার ঘনঘটা তার জীবনে কখনওই বাড়ন্ত নয়। একদিন বড় সাহেবের ঘরে একটা গড়পড়তা ফাইল সই করাতে এসেছিল, এমন সময় সেখানে আরেক সহকর্মিনীর আবির্ভাব। বোঝা গেল বড় সাহেব ডেকেছেন অন্য কোনও কাজে। যুধি ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে, সাহেব তাকে যেন দেখতেই পেলেন না। পরের দশ মিনিট সহকর্মিনীর কোনও ফাইলে অন্যমনস্ক ভুল নিয়ে ভালো কড়কানি চলল। এর পরে তিনি যখন মেঘজর্জর চোখে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন, যুধি তখনও ফাইল হাতে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে।

এর জের অবশ্য গড়াল আরও বেশি। কিছুদিন বাদেই ইউনিয়ন ইলেকশন, বিশেষ কোনও ইস্যু না পেয়ে তাদের নজর পড়ল এই ঘটনায়। অধস্তন মহিলার প্রতি অফিসারের এহেন কঠোর ব্যবহারের প্রতিবাদে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া নিয়ে পোস্টারে পোস্টারে সংস্থার পাঁচিল তার নগ্নতা ঢাকল স্বচ্ছন্দে কিন্তু বিরক্তিতে।

ইউনিয়নের চাপে ঘটনার বিচার করার জন্য ডোমেস্টিক এনকোয়ারি বসল অবশেষে। সেখানে একমাত্র নিরপেক্ষ সাক্ষী হিসেবে ডাক পড়ল যুধির। ইউনিয়ন থেকে ওকে পই পই করে শেখানো হয়েছিল, কী বলতে হবে, কতটা বলতে হবে এবং আধিকারিককে ঢিট দেওয়া শ্রমিকশ্রেণীর কতটা আবশ্যিক সংগ্রামী কর্তব্য। কিন্তু, সেই কাকস্য পরিবেদনা। এনকোয়ারিতে সাহেবকৃত ধাতানি সে অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরল, কিন্তু তার সাক্ষ্যে এ কথাই উঠে এল যে, যা হয়েছিল পুরোটাই অফিসের কাজে ভুলের প্রসঙ্গে। ইউনিয়নের শিখিয়ে দেওয়া ব্যক্তিগত আক্রোশজনিত উত্তেজক দিকের কোনও উল্লেখই পাওয়া গেল না। অফিসার বেকসুর ছাড় পেলেন, ইউনিয়ন খার খেল আরও বেশি।

এর পর যুধি অফিসে আরও একা হয়ে গেল। এমনিতেও লোকে ওকে পছন্দ করত না, এখন প্রায় একঘরে করে দিল। যুধির অবশ্য এসবে অভ্যাস ছিলই, তবে সারাদিন অফিসে একা একা কারও সাথে কথা না বলে কাঁহাতক সময় কাটানো যায়। মোবাইলের স্বর্ণযুগ শুরু হতে তখনও বছর ছয় সাত বাকি। অতএব, সে এখন জানালার ধারে বসে চুপচাপ গঙ্গা দেখে যায়, কাগজ গোল্লা পাকিয়ে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে নিউটনের সূত্র ভাবে আর মাঝেমাঝে চুপিসারে বাথরুমে গিয়ে তাকিয়ে থাকে নিজের পায়ের দিকে, কতটা মাটি থেকে উঠল!

এর মধ্যে অফিসে একজন নতুন আগন্তুকের আবির্ভাব হয়েছে। জুনিয়র ক্লার্ক (পার্ট টাইম) হিসেবে জয়েন করেছে চান্দ্রেয়ী পাল। তার গমক, চমক সবই আলাদা। সবথেকে যেটা আকর্ষণীয়, সেটা হল গোটা অফিসে একমাত্র মহিলা যে টি শার্ট এবং জিন্স পরে। অতএব, অফিসের প্রোডাকটিভিটি প্রায় চরমে। সবাই-ই তাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ শেখাতে চায়। মহিলারা নিজেদের দাঁত কিড়মিড় করে, অফিসের পরে ওকে কার কার সাথে দেখা গেছে সে নিয়ে যুগপৎ হিংসা আর হতাশার ফুলকি ওড়ে ফাইল ভর্তি টেবিলের ভিড়ে। অসীম দাক্ষিণ্য সহকারে সে মিষ্টি হেসে বৌদির গ্যাসের খবর নেয়, কারও বাতের ব্যথার উপশম বাতলে দেয়, অবিবাহিতদের চটপট বিয়ে করে নেওয়ার উপদেশ দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। রিটায়ার করতে পাঁচ মাস বাকি থাকা বড়বাবুও নিজের টাক আঁচড়ে অফিসে আসেন। পুরনো ধূলিধূসর কড়িবর্গাও অনভ্যস্ত উল্লাসে গতরে চিড় ধরিয়ে ফেলে।

এসব আনন্দের তরঙ্গভঙ্গ যুধিকে খুব একটা স্পর্শ করত না বললে ভুল হবে। কিন্ত ছোটবেলা থেকে তার মেয়েদের সম্পর্কে আড়ষ্টতা বেশি, এখানে এসে সেটা আরও বেড়েছে। তবুও, চান্দ্রেয়ী যখন উচ্চৈস্বরে ‘ও যুধুদা, পেয়াঁজমুড়ি খাবে এসোও’ বলে ডাকে, তখন তার হাতছানি উপেক্ষা করা তার কাছে খুবই অসম্ভব হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে, ওর গা দিয়ে বেরোনো একটা মিষ্টি ভিজে গন্ধ, চোখেমুখে কথা বলা যুধির দিব্য লাগে। কিন্তু চিরকালীন মুখচোরা সে, নিজের বাড়িতেও চুপচাপ থেকে অভ্যস্ত। তাই এই পড়ে পাওয়া দৃষ্টিসুখের বাইরে এক ইঞ্চি এগোনোর সাহসও তার নেই। অতএব, নিজের কোটরে সেঁধিয়ে পেন চিবোনোকেই সে কর্তব্য করে নিতে চায়। কিন্তু চান্দ্রেয়ী থামবার পাত্রী নয়, সেই তীক্ষ্ন আদুরে ডাকে তাকে অবশ্যম্ভাবী সিটছাড়া করিয়ে সে নিজের হাতে ঝালমুড়ি তুলে দেবে সবার ঈর্ষাতুর চোখের সামনে। হাতটা কী নরম ওর! যুধির সেদিন আর ওই হাতে ফাইল ছুঁতে ইচ্ছে করে না।

এর পর একদিন ঘুম থেকে উঠে সকালে অনেকদিন বাদে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের দিকে না তাকিয়ে মুখের দিকে তাকাল যুধি। তার মেসমেট নন্দীদা এখন ঘুমোতে ঘুমোতে কোনও একটা জটিল হিসেব কষছেন নাকের মধ্যে। সুযোগ পেয়ে গভীর দৃষ্টিতে নিজেকে কাটাছেঁড়া করল যুধি। যেন প্রায় আয়নার ভিতরে ঢুকে যায় যায়। মাথায় বেশ কয়েকটা নাইলনের মতো চুল চকচক করছে, পিছিয়ে গিয়েছে তৃণভূমি। চোখটা গুহার মধ্যে ঢুকেছে বেশ কিছুটা, কিন্তু তবুও সে ফিট আছে। এমন সময় মনে পড়ল পুজোয় বানানো জামা একটা এখনও ভাঙা হয়নি। অতএব, সেটার ফিতে কাটল। ডিওর দুটো স্প্রে বেশি মারল আজ বগলে। অফিসে পৌছে দু-একবার চোরা চাউনি মারল চান্দ্রেয়ীর দিকে। নেহাত সম্রাজ্ঞীর মতো তাকে আজ পাত্তাই দিল না চান্দ্রেয়ী। অফিসের বাকিরা সঞ্চিতার নতুন ভাগ্নীর ছবি নিয়ে আদিখ্যেতাতেই ব্যস্ত।

আজ অফিস শেষ হতে কোনওদিন যা করে না তাই করল যুধি। দু-তিনটে ফাইলের কাজ সেরে রাখবে বলে অফিস শেষ হতেও রয়ে গেল সে। তারপর সবাই বেরিয়ে গেলে, এমনকি অফিসপাড়ার শেষ ট্রামটাও যখন ঘষটাতে ঘষটাতে শ্রবণসীমার বাইরে চলে গেল, তখন চান্দ্রেয়ীর সিটের ওখানে একটু ঘুরে বেড়াল। এখানে বাতাসে মেয়েলি সেন্টের গন্ধ, এ চেয়ার পাক দিয়েই অফিসে প্রতিদিন উড়ে বেড়ায় মিস চান্দ্রেয়ী পাল।

সেদিন রাতে যুধি স্বপ্ন দেখল, চান্দ্রেয়ীকে সে দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু কোথা থেকে চান্দ্রেয়ীর ডাক শুনতে পাচ্ছে-– ও যুধি দা, তুমি নেমে এসো না… বড্ড উঁচুতে উঠে গেছ তো… তোমায় দেখতে পাচ্ছি না কেন? ঝটপট করে ‘এই তো আমি আসছি’ বলে তাড়াহুড়ো করতেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও বিছানা থাবড়ে সে কিছুক্ষণ চান্দ্রেয়ীর শরীর খোঁজার চেষ্টা করে হুব্বা হয়ে গেল। তারপর ঘণ্টাদুয়েক কেমন একটা যেন গেল, দাড়ি কাটতে গিয়ে চান্দ্রেয়ীর কথা মনে আসছে, আপনমনেই হেসে ফেলছে, নিজের শখ করে কেনা আতর আজ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বেশিই ঢেলে দিচ্ছে অফিসের জামায়। নিজেকে হঠাত করে ছয় বছরের ছোট ছোটভাইয়ের বয়সী মনে হচ্ছিল।

বাসে কন্ডাকটারের কাছ থেকে পাওনা দু’টাকা নিয়ে টানটান হয়ে থাকে রোজ, ভিড়ের মধ্যে কন্ডাকটার ঢুকে গেলেই টেনশনে থাকে যে নিজের স্টপেজে নেমে গেলে ওই ভিড় ঠেলে টাকা ফেরত পাবে না। সেই জন্যে মাঝেমাঝে পুরো খুচরো দিয়ে দেয় বাস লোকবোঝাই থাকলে। আজ একটা রাজকীয় উদাসীনতায় খুচরো ফেরত চাইল না পর্যন্ত। আর অফিসে যেন উড়তে উড়তে পৌছাল যুধি। আজ চান্দ্রেয়ী কী পরে এসেছে অফিসে? সেই নীলচে শাড়িটাই কি?

লিফটে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তেরোতলায় ডিপার্টমেন্টে ঢুকে দেখে আজ থমথমে পরিবেশ। সবার গুজুরগুজুর ফিসফাস ব্যবচ্ছেদ করে অবশেষে বোঝা গেল কে যেন চান্দ্রেয়ীর টেবিলে একটা ভাঁজ করা চিঠি রেখে গেছে, তাতে গোটা গোটা টাইপ করা, তোমায় ভালবাসি–- বিয়ে করবে আমাকে? চিঠিটা চান্দ্রেয়ী দেখিয়েছে পাশের টেবিলে সুদেষ্ণাদিকে, তারপর ছবিদি এবং তারপর এইভাবে বাকিরা। কে এই সাহসী নাবিক? ভাবতেই একটা প্রবল হিংসের তেতো ঢেঁকুর উঠে এল তার শরীর গুলিয়ে।

আজ অফিসে বড়বাবু আসেননি, লোকের হাতে সময় এবং এনার্জি স্বভাবতই অন্যদিনের তুলনায় বেশি। সুতরাং ফিসফিসানি অচিরেই সরবতার রূপ নিল। বীথিদি এ অফিসের সবচেয়ে পুরনো লোক, রিটায়ারমেন্ট সামনেই। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি পেয়েছিলেন, সারা জীবন সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে মাকে দেখেশুনে রাখতে গিয়ে ছোট দুই বোনের বিয়ে দিয়ে নিজের বিয়ে করার সময় আর হয়ে ওঠেনি। তাই নিয়ে একটা প্রছন্ন অহংকার এবং নিজের সংসার না পাওয়ার ব্যথা মাঝেমাঝেই তাঁর কথাবার্তায় আলপনা কেটে যায়। তিনিই এই অদৃষ্টপূর্ব ঘটনায় সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। অতএব আজকালকার বেহায়া ছেলেদের জন্য যে ভদ্র ঘরের মেয়েদের কাজ করতে আসা কতটা অসুবিধের তাই নিয়ে তাঁর নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা সবাই মন দিয়ে শুনল ও একমত হল। যুধিও এই ব্যাপারে কোনও দ্বিমত প্রকাশ করার জায়গা পেল না। সুশান্ত এর মধ্যে ফিসফিস করে কিছু একটা আলোচনা করছিল কর্মচারী সংঘের সহ-উপদেষ্টা বা ওইরকম কিছু একটা পদবীর সঙ্গে, কিছুক্ষণ বাদে আরও অনেকে একসাথে ফিসফিস শুরু করে সেটাকে সশব্দ করে দিল। যেখান থেকে মর্মার্থ বেরিয়ে এল, বীথিদির ওজস্বিনী বক্তৃতা অনেককেই উদ্বুদ্ধ করে তুলেছে এবং চান্দ্রেয়ীর টেবিলে পাওয়া চিঠিটি কার লেখা সেটা বের করার ব্যাপারে ইউনিয়ন তার সহজাত সদর্থক ভূমিকা নেবে। সুশান্ত এইসব ঘটনার মধ্যেই দু-একবার গভীর দৃষ্টি দেয় চান্দ্রেয়ীর দিকে। এর পর থেকেই ঘটনার গতি দ্রুত ছুটতে থাকল। ইউনিয়ন রুমে পুরুষ কর্মচারীদের ডাকা হতে থাকল, যুধিরও ডাক পড়ল একটু পরেই।

ইউনিয়ন রুমের টেবিলের ওপারে বসে ছিল অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়া এক হর্তাকর্তা। বাকি তিনজন এদিক ওদিক স্বাস্থ্যরক্ষার্থে পদচারণ করছিল। কর্তা ওকে ভারিক্কি হেসে বসতে বলল সামনের চেয়ারে। তারপর বলল, ‘চা হবে নাকি ভায়া?’ একটু রহস্যময়ভাবে হেসে ঘনিষ্ঠ স্বরে বলল, ‘আরে এখানে তো এই আমরা কজনই আছি। তা বলো, চিঠিটা কখন টাইপ করলে? আরে আমরা কি তোমার শত্রু? আমাদের বললে আমরাই কি একটা সেটিং করে দিতাম না? এখন বেকার অফিসে সবাই জানাজানি হয়ে একটা কেমন বিচ্ছিরি ব্যাপার হল দেখো! তো যাগ্গে, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এ নিয়ে আর বেশি ফেনিয়ে লাভ নেই। একটা বরঞ্চ কনফেশন লিখে দাও, নিজেদের মধ্যেই মিটিয়ে নিই ব্যাপারটা। বেকার এই সব ব্যাপারে কাল থেকে অফিসাররা ঢুকে যাবে। আমরা বুঝলে কিনা, হলাম ওয়ার্কার ক্লাস। আমাদের সবসময় একজোট থাকতে হবে।’ এ পর্যন্ত শুনেই যুধি একটু উসখুস করতে লাগল। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে কর্তামশাই পরের লাইনটা আরেকটু উঁচু পিচে শুরু করার আগেই নিজের গলা পরিষ্কার করে যুধি বলে উঠল, ‘কিন্তু করালীদা আমি তো এ ব্যাপারে সত্যি কিছু জানি না।’ করালী হেসে বলল, ‘আচ্ছা এত লজ্জা পেতে হবে না। আমরা কি আর জানি না যে তুমি কাল অত রাত্তিরেও অফিসে ছিলে, তাও আবার ওরই ডেস্কের পাশে ঘোরাঘুরি করছিলে। না মামণি সত্যিই খুব ভালো, বয়সের ব্যাপার এসব তো আমরা বুঝি। কিন্তু, বুঝলেই তো একটা অর্গানাইজেশনের ব্যাপার, ডিসিপ্লিনের ব্যাপার…!’ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল যুধি, ভাবল একবার জিজ্ঞেস করে, তবে এই যে সেদিন ভরা প্রোডাকশন টার্গেটের বাজারে হঠাত ইনসেনটিভের বকেয়া দাবি তুলে তিন ঘণ্টার কাজ বিরতি ঘোষণা করা হল, তখন করালীই টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে সবচেয়ে বেশি চেল্লাচ্ছিল কেন? কিন্তু করল না। বরং নির্বিকারভাবে করালীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখটার সাথে কৃষ্ণের মুখের মিল খুঁজতে লাগল। ‘ইতি গজ’ বলার পরামর্শটা দেওয়ার সময়ে কি এরকমই হয়েছিল মুখটা? ওর এই নির্বিকারভাব করালীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাল। এতক্ষণ চালিয়ে যাওয়া মুখোমিষ্টিটা ছেড়ে সে অধৈর্য স্বরে বলে উঠল, ‘দেখো এই সারাদিন তোমাকে নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। একটা হেস্তনেস্ত তো করতেই হবে। আমরা থাকতে অফিসে মহিলা কর্মচারীদের হ্যারাস করা হবে, তা তো চলতে পারে না। সামনেই আবার ইলেকশন আসছে। চটপট স্বীকার করে ফেললে আমাদের সবারই সুবিধা।’ যুধি এবার স্পষ্টই অস্বস্তিতে পড়ল। শেষ বারের মতো একটা ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘আমি মিথ্যে কথা বলি না করালীদা!’ বলে একটু মিনতির সুরে আবার যোগ করল, ‘আমি এ ব্যাপারে সত্যি কিছু জানি না।’ এবারে টেবিলের উল্টোদিকে একটা বিস্ফোরণ হল যেন, ‘উমমম… আমি মিথ্যে কথা বলি না! রাজা হরিশ্চন্দ! ও ইনি তো আবার যুদিষ্টির!’ তারপর আবার ভেঙিয়ে বললে, ‘ভেবেছ কী তুমি? ইউনিয়নের কোনও কথাই শুনবে না? দেখব কে বাঁচায় তোমাকে! আমার নাম করালী মাজি, মনে রেখো! তোমার ওই ব্যাঁকা ঘাড় আমি সিধে করে দেবই।’ ইউনিয়ন রুমের বাইরে যে এই চেঁচামেচির আওয়াজ গেছে তা স্পষ্ট, কারণ বাইরে অনেক লোক ভিড় করে আছে। সেই ভিড়ে চান্দ্রেয়ীও ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে যেন অভিযোগের আঙুল উঁচিয়ে রেখেছে তার দিকে।

এই অফিসে কোনও খবরই চাপা থাকে না, ফলে কিছুক্ষণ বাদেই জানা গেল চান্দ্রেয়ী ইউনিয়নে নির্দিষ্ট অভিযোগ জানিয়েছে যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে। ওকে আগেই যুধিষ্ঠির একদিন প্রোপোজ করেছিল, সে না বলার পরেও ওকে বিরক্ত করেছে আরও দু-তিনবার। শেষ পর্যন্ত সবার সামনে ওকে হেনস্থা করার জন্যেই এই টাইপ করা চিঠি রেখে গেছে বলে তার সন্দেহ।

বহু দিন আগে একটা লোককে রেলে কাটা পড়তে দেখেছিল যুধি। ট্রেন চলে গেছে, লোকটার নীচের অংশটা কেটে গেছে অথচ লোকটা যেন বুঝতেই পারছে না। হাত উঁচু করে প্ল্যাটফর্মের লোকেদের ওকে তুলে ধরতে বলছিল। এমন সময় একজন ওর মুখে এক গ্লাস জল ঢেলে দিতেই লোকটার শরীর যেন নিম্নাঙ্গের অভাব বুঝতে পেরে ঢলে পড়ে গেল লাইনে। লোকটার কথা এখন হঠাত মনে পড়ল কেন কে জানে, শুধু বুঝল আশেপাশের কোনও কথাবার্তা, শব্দ তাকে আর স্পর্শ করছে না। যুধিষ্ঠিরের সামনে কিরম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র …

স্মরণকালের মধ্যে যুধি মিথ্যে কথা বলল প্রথমবার। সিনিয়র ক্লার্ক সঞ্জীবদাকে বলল, আমার শরীরটা ভালো লাগছে না একদম। বাড়ী চলে যাচ্ছি আজ। অফিসে একমাত্র তাকে কিছুটা সহানুভূতির চোখে দেখে এই মানুষটাই। তার দিকে একবার আবছা চেয়ে একটা বিড়ি ধরাল সঞ্জীব।

মেসে ফিরে খেতে ইচ্ছে করল না তার, কিরম গা গোলাচ্ছে। নন্দীদা ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে দিনপাঁচেকের জন্য ভাইঝির বিয়েতে। গোটা ঘরটায় একা আজ সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দু’বার দেখল, নিজের পায়ের দিকে আরেকটু বেশী করে। মাটি কি অল্প অল্প খসে যাচ্ছে তার পায়ের ভারে?

পরের দিন সকাল ন’টা বেজে গেছে, নিচে যুধিকে না দেখে, ম্যানেজার অবাক হলেন। অফিস যাবে না নাকি লোকটা? কাল থেকেই কিরম গুমরে আছে। অবধারিত নিয়ম অনুযায়ী এখানেও একজন ছোটু আছে, যে উল্টোদিকের চায়ের দোকান থেকে সকালে ছ’টা থেকে আটটা অব্ধি চা নিয়ে হুলস্থূল চক্কর কাটে। পৃথুল ম্যানেজার নড়বড়ে ভাঙা বয়স্ক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠার রিস্ক বিগত দশকের পরে আর নেননি। অগত্যা ছোটুরই ডাক পড়ে বাবুকে ডেকে দেওয়ার। ওপরের বারান্দায় কিছুক্ষণ ‘ও দাদা, ও দাদা’র পুনরাবৃত্তির একটু পরেই একটা তীব্র আর্তনাদের অভিঘাতে বিদ্ধ হয়ে বংশানুক্রমিক বাসিন্দা পায়রাকুল উড়ে গেল কার্নিশ থেকে।

বাকিরা তাড়াতাড়ি (মানে ওই কাঠামোর ওপরে যতটা সম্ভব) দৌড়ে ওপরে যেতেই ব্যাপারটা বোঝা গেল। ঘরে সাড়া না পাওয়ায় ছোটু দরজা ধাক্কা দেয়। আর বেশি কষ্ট করতে হয়নি, প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকতেই তার মাথা গিয়ে বেমক্কা ধাক্কা খায় একটা লোকের হাঁটুতে। এদ্দিন বাদে, প্রথম এবং শেষবারের মতো যুধির পা মাটি থেকে দু’আঙুল নয়, প্রায় হাতদুয়েক ওপরে দোল খাচ্ছে। আর তার এই উন্নতিতে বিস্ময়ে মাটি আঁকড়ে শূন্যতা মাপছে কালই ম্যানেজারের ঘর থেকে চেয়ে নিয়ে আসা টুলটা।

 

(ছবি-সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...