রাজশেখরের গীতাভাষ্য : সংশয়বাদ ও অভিজাততন্ত্র

রাজশেখরের গীতাভাষ্য : সংশয়বাদ ও অভিজাততন্ত্র -- আশীষ লাহিড়ী

আশীষ লাহিড়ী

 

রচনাটি  ‘জলার্ক’ পত্রিকার সৌজন্যে এবং মানব চক্রবর্তীর দাক্ষিণ্যে প্রাপ্ত

 

গীতা নিয়ে হিন্দু বাঙালিদের উচ্ছাস যেমন প্রবল, তেমনি গীতা নিয়ে বাঙালি ভাবুকদের অস্বস্তির ইতিহাসও কিছু কম দীর্ঘ নয়। সুদূর ১৮৮৩ সালে অক্ষয় দত্ত লিখেছিলেন, ‘ঐ প্রবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য কি জান? জীবাত্মার ধ্বংস হয় না, অতএব যত ইচ্ছে নরহত্যা কর, তাহাতে বিন্দুমাত্র পাতক নাই।’(১) গীতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি এতখানিই যে ১৯০৯ সালে অজিত চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: ‘আমাকে লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে আমি আজ পর্যন্ত গীতা ভাল করে তলিয়ে পড়ি নি– দুতিনবার আরম্ভ করেছিলুম কিন্তু বাধা পেয়ে শেষ করতে পারিনি’ অস্বস্তির কারণ ব্যাখ্যা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘গীতার মধ্যে কোনও একটা বিশেষ সময়ের বিশেষ প্রয়োজনের সুর আছে, তাই ওর নিত্য অংশের সঙ্গে ক্ষণিক অংশ জড়িয়ে গিয়ে কিছু যেন বিরোধ বাধিয়ে দিয়েছে– কোনও একজন মহাপুরুষের বাক্যকে কোনও একটা সংকীর্ণ ব্যবহারে লাগাবার চেষ্টা করলে যেরকমটি হয় গীতায় সেরকম একটি টানাটানি আছে। অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করবার জন্যে আত্মার অনশ্বরত্ব সমন্ধে যে উপদেশ আছে তার মধ্যেও বিশুদ্ধ সত্যের সরলতা নেই।’(২)

১৯৪৮ সালে গিরীন্দ্রশেখর বসু ‘গীতার অষ্টম অধ্যায়ের উত্তরায়ণে ও দক্ষিণায়ণে মৃত্যুর ফলবিভেদ সম্বন্ধে’ লেখেন যে ‘যুক্তিবাদীর পক্ষে শ্লোকটির (৮৷২৪-২৫) অর্থ বুঝিতে পারিলাম না বলাই সংগত।’(৩) একেবারে হালে অমর্ত্য সেন এইসব প্রশ্নগুলোকে আবার একটু খুঁচিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘তার্কিক ভারতীয়’ বইতে। অমর্ত্য লিখেছেন: ‘ভগবদগীতাতে আমরা দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত নৈতিক অবস্থানের সংঘাত দেখতে পাই। একদিকে কৃষ্ণ জোর দিচ্ছেন নির্ধারিত কর্তব্য পালনের ওপর, অন্যদিকে অর্জুন তুলে ধরছেন অশুভ এড়ানোর (ও শুভ ফলের জন্ম দেওয়ার) যুক্তিকে।…অর্জুন প্রশ্ন তোলেন, শুধুমাত্র একটি ন্যায়পূর্ণ আদর্শকে তুলে ধরার কর্তব্য সম্পর্কে যত্নবান হয়ে, সেই যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে সৃষ্ট আত্মীয়দের দুঃখ ও হত্যালীলা সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকাটা উচিত কি না।’ বিপরীতে কৃষ্ণ অর্জুনকে ‘জোর দিয়ে বলছেন, ফল সম্পর্কে নিস্পৃহ থেকে কর্তব্যে অবিচল থাকতে। কারণ এটি একটি ন্যায্য সংগ্রাম, এবং একজন ক্ষত্রিয় ও সেনাপতি হিসেবে অর্জুন তাঁর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।’ সচরাচর ধরে নেওয়া হয়, অর্জুন যে কৃষ্ণের অভিভাবন মেনে নিয়েছিলেন, সেটা উচিত কাজই হয়েছিল। বস্তুত সেটাই গীতার সবচেয়ে বড় মাহাত্ম্য বলে সাধারণভাবে কীর্তিত। কিন্ত অমর্ত্য প্রশ্ন তোলেন: ‘প্রকৃতপক্ষে, লড়াই ও বিরাট ধ্বংসলীলার পর যে ভয়াবহ জনশূন্যতা মহাভারতের শেষ দিকে, বিশেষত গাঙ্গেয় উপত্যকা এলাকাটিকে গ্রাস করেছিল, তাকে তো যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের সুগভীর দ্বিধার যথার্থতা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। অর্জুন যে বিপরীত যুক্তিটি দিয়েছিলেন, সেটি বাস্তবিকই খণ্ডিত হয়নি।’(৪) অর্থাৎ কৃষ্ণ নয়, অর্জুনের যুক্তিই জয়ী।

এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজশেখর বসুর গীতাভাষ্য নিয়ে একটু আলোচনা করলে মন্দ হয় না। কারণ রাজশেখর মোটের ওপর সংশয়বাদী দৃষ্টিকোণেরই লোক। তিনি যে বাঁধা গতে গীতা ব্যাখ্যা করবেন না, সেটা ধরেই নেওয়া যেতে পারে। তাঁর গীতার অনুবাদটি ১৯৪৮ সালের আগে রচিত হয়েছিল, ঠিক কোন সালে জানতে পারিনি (জানবার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি বললে অবশ্য মিথ্যে বলা হবে)। হরপ্রসাদ মিত্র সম্পাদিত ‘রাজশেখর গ্রন্থাবলী’ প্রথম খণ্ডে (এম সি সরকার, ‘জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ’, অর্থাৎ ১৯৮০ সালে প্রকাশিত) গীতার অনুবাদ সন্নিবিষ্ট আছে, কিন্তু সম্পাদক মহাশয় এর রচনা-কালটি উল্লেখ করেননি। তবে তাঁর লেখা ভূমিকার একটি পরোক্ষ মন্তব্য থেকে অনুমান করতে পারছি, অনুবাদটি অন্তত ১৯৪৮-এর আগে করা হয়েছিল। হরপ্রসাদ জানিয়েছেন, সহোদর গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘ভগবদ গীতা’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ১৩৫৫, অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৪৮ সালে এবং ‘গিরীন্দ্রশেখর রাজশেখরের অনুবাদ থেকে অনেক সাহায্য পান।’(৫)

সুতরাং এ অনুমান সঙ্গত যে রাজশেখর অনুবাদটি অন্তত ১৯৪৮ সালের আগে করেছিলেন, কিন্তু জীবদ্দশায় সেটি প্রকাশ করেননি। যাই হোক, এসব আনুষঙ্গিক জল্পনা মাত্র, মূল আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক কম।

ইতর সাধারণের আদর্শ-বিপর্যয়

রাজশেখর বসু গীতাকে প্রধানত ব্যবহারিক জীবনের পথ-প্রদর্শক বলেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এর দার্শনিক গুরুত্ব তাঁর কাছে তুলনামূলকভাবে কম। ভূমিকায় লিখেছেন:

গীতাতে দার্শনিক তত্ত্ব বিস্তর আছে, তথাপি এতে মুখ্যত ব্যবহারিক বিদ্যাই কথিত হয়েছে। [গীতাকারের] প্রধান উদ্দেশ্য– ঐ সকল তত্ত্ব অনুসারে জীবনযাত্রার পদ্ধতি নির্ধারণ।

তবে কি গীতা তাঁর কাছে নিছকই এথিকস, শুধুই পরিকল্পিত নীতিশাস্ত্র? না, তাও নয়।–

গীতা কেবল নীতিশাস্ত্র বা ethics নয়। নীতিশাস্ত্র বলে– এই কাজ ভালো, এই কাজ মন্দ, বড় জোর বলে– এইজন্য ভালো, ওইজন্য মন্দ। কিন্তু গীতাকার অধিকন্তু বলেন– এইরূপে জীবন নিরূপিত কর, তবেই যা শ্রেয় তাতে মন বসবে, যা হেয় তাতে বিরাগ জন্মাবে।

(হরপ্রসাদ মিত্র সম্পাদিত রাজশেখর গ্রন্থাবলী, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৯৫-১৯৬)

তাঁর বক্তব্য, গীতায় কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, তা তো বলা হয়েছেই, উপরন্তু কার্যক্ষেত্রে কিভাবে জীবন নির্বাহ করলে ভালো হবে, সে ব্যাপারেও পালনযোগ্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু জীবন নির্বাহ করার পদ্ধতির কথা বললেই প্রশ্ন উঠবে: কার জীবন? শুদ্রের না ব্রাহ্মণের, বৈশ্যের না ক্ষত্রিয়ের? সবার জীবন তো এক খাতে বইবে না, কারও কারও মধ্যে তো খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। রাজশেখর ব্যাপারটা নিয়ে সচেতন ছিলেন, তা বোঝা যায়। নইলে একথা কেন বলবেন যে ‘গীতা সর্বসাধারণের জন্য রচিত হয়নি’? আত্মপক্ষ সমর্থনে গীতার একটি বিখ্যাত শ্লোক উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন–

এই গীতোক্ত ধর্ম কদাচ তপস্যাহীনকে বক্তব্য নয়, অভক্তকে নয়, অশ্রবণেচ্ছুকে নয়, যে আমাকে [= কৃষ্ণকে] অসুয়া করে তাকেও নয়। কাম্য কর্মে আসক্ত বিষয়সেবী অজ্ঞ-লোকের বুদ্ধিভেদ করতে গীতাকার নিষেধ করেছেন।

(ঐ, ২০৯)

তাঁর মনে এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে গীতার শিক্ষা সমাজের সর্বজনের জন্যে নয়, বাছাই করা কিছু লোকের জন্যে:

গীতার উপদেশ– জ্ঞানী ব্যক্তি নিজ আচরণ দ্বারা সামাজিক আদর্শ রক্ষা করবেন, যাতে জনসাধারণ একটা সুনির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ সুগম মার্গ অনুসরণ করতে পারে।

(ঐ, ২০৯)

সমাজে একদল জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন। তাঁরা নিজ আচরণ দ্বারা একটা আদর্শ রক্ষা করবেন। আর সেই আদর্শ নির্বিবাদে মেনে চলবেন সমাজের বাকি অংশ– জনসাধারণ। শুধু মেনে চলবেন নয়, সেই চলার মার্গটি নির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ, এদিক ওদিক হবার জো নেই। সে-পথ সুগম করে তলাই জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের কাজ। যে-পথ দেখানো হবে তা থেকে বিচলনের, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না, হয়তো বিচলন শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং গীতা খুব সচেতনভাবেই সমাজ-পরিচালকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে রচিত, এই হল রাজশেখরের মত।

শুধু স্বার্থ রক্ষাই নয়, কেউ বিদ্রোহ করলে তাকে নিরস্ত করার প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য নিহিত ছিল গীতার মধ্যে, সে-বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।–

বিষয়াসক্ত অজ্ঞলোকের বুদ্ধিভেদ করলে কুতার্কিক সমাজদ্রোহীর উদ্ভব হবে এই আশঙ্কা গীতাকারের ছিল।

()

কোন সমাজদ্রোহ সুতর্ক-ভিত্তিক, আর কোনটা কুতর্ক-ভিত্তিক, সে-বিচার কে করবে, এ প্রশ্ন অবশ্য রাজশেখর তোলেননি। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা জানি, যেকোনও সমাজেই যেসব তর্ক সমাজপ্রভুদের কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেইগুলোই কুতর্ক বলে বিবেচিত হয়। তিনি ধরেই নিয়েছেন, সেইসব কুতর্ক কীভাবে নিরস্ত করতে হবে, তার পথনির্দেশই গীতার মর্মবস্তু। কোনওরকম সমাজদ্রোহকে প্রশ্রয় না-দেওয়ার দর্শনই গীতার দর্শন। নীতিশাস্ত্র বলতে এখানে পরিষ্কারভাবেই সেই নীতিশাস্ত্র বোঝানো হচ্ছে, যা সমাজ-শাসকদের অনুকূল। সমাজের সকল মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গল আদৌ তার বিবেচ্য নয়। কিংবা বলা চলে যে সমাজ বলতে এখানে সমাজ-পরিচালকদের গোষ্ঠীকেই বোঝানো হচ্ছে, যেমন প্রাচীন গ্রীসে গণতন্ত্র বলতে দাস-মালিকদের বোঝানো হত।

কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে গীতার বাংলা অনুবাদ করে তার বাণী সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ কি অভিপ্রেত? এইখানে রাজশেখরের দোটানা ধরা পড়ে যায়। প্রথমত তিনি স্বীকার করেন:

বর্তমান কালে [অন্তত ১৯৪৮ সালে] গীতা সম্বন্ধে এই সতর্কতা অবলম্বন করা অসম্ভব।

()

তার অর্থ হল, সেই সতর্কতা পূর্বকালে অবলম্বন করা সম্ভব ছিল এবং সেটাই করা উচিত ছিল। গীতার প্রচার সীমাবদ্ধ ছিল পরিচালক মহলেই। কারণ, গীতার বহু যুক্তিই শাঁখের করাত, তা দুদিকেই কাটে। যারা পরিচালিত, তাঁরা যদি গীতার যুক্তিতে বলীয়ান হয়ে পরিচালকদের মারতে আরম্ভ করে, এবং বলে যে আত্মা তো মরে না, সুতরাং তোমাদের মারলে কোনও অন্যায় নেই, তাহলে সেটা গীতাকারের মতে ঠিক নয়। যুক্তি যা কিছু সব এক পক্ষেই থাকুক, এই তাঁর বাসনা। তাই ঐ ‘সতর্কতা’। কিন্তু গণতান্ত্রিক যুগে, যখন স্বাধীন চিন্তার সর্বজনীন অধিকার ব্যপকভাবে স্বীকৃত, অন্তত মুখে স্বীকৃত, তখন সেই সতর্কতা আর তো অবলম্বন করা সম্ভব নয়। রাজশেখর তাই বাধ্য হয়েই মেনে নেন যে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন সকলেই ইচ্ছে করলেই আজ গীতা পড়তে পারে। কিন্তু তাই বলে তিনি যে স্বাধীন চিন্তার সর্বজনীন অধিকারের মস্ত প্রবক্তা তা মনে করার কোনও কারণ নেই। কারণ উদ্ধৃত অংশটির ঠিক পরের কটি শব্দ এইরকম:

কিন্তু একথা স্বীকার করতে হবে যে, আপামর জনগণকে গীতা মুখস্থ করিয়ে কোনও লাভ নেই।

()

কেন লাভ নেই? কারণ, জনসাধারণ ওর মর্ম উদ্ধার করতে পারবে না। ওখানে যেসব মূল্যবোধ ও উপদেশ ব্যক্ত হয়েছে, তা সম্যক বুঝতে পারবে না। বোঝবার খুব প্রয়োজন আছে বলেও তিনি মনে করেন না।

এইখানে তাঁর চিন্তার দোদুল্যমানতা। একদিকে তিনি বলছেন, গীতা শুধু ভালোমন্দ-নির্দেশক নীতিশাস্ত্রই নয়, সেই নীতিকে জীবনে সদর্থকভাবে প্রয়োগ করার উপায়-নির্দেশকও বটে; অন্যদিকে বলছেন, সেই পথ জনগণকে শিখিয়ে কোনও লাভ নেই! তার অর্থ কি তাহলে এই দাঁড়ালো না যে, সমাজের ভালোমন্দ, নিজের ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামানো আপামর জনগণের কাজ নয়, তাদের কাজ কেবল নির্বিচারে জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা মেনে চলা? জ্ঞানী ব্যক্তিরা ভুল করলে তা নিয়ে প্রশ্ন করা বারণ, কেননা সেটা কুতর্ক এবং সমাজদ্রোহ বলে গণ্য হবে। এখানে গণতান্ত্রিক সমাজের একটি একেবারে বনিয়াদি ভাবনার বিরোধিতা করছেন রাজশেখর।

গীতাকারের কেজো বিচক্ষণতার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন:

তৎকালপ্রচলিত বৈদিক ক্রিয়াকলাপের উপর গীতাকারের শ্রদ্ধা নেই, কিন্তু নিম্ন অধিকারীর পক্ষে এসকল কর্ম তিনি হিতকর বলেই মনে করেন। শ্রেষ্ঠ সাধকের পক্ষেও যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান বর্জনীয় বলা হয়নি, কারণ তাতে ইতর সাধারণের আদর্শ-বিপর্যয়ের সম্ভাবনা।

()

তার মানে, ইতর-সাধারণের আদর্শ-বিপর্যয় রুখবার জন্য গীতাকার স্বয়ং নিজের বিশ্বাস-বিরুদ্ধ কথা প্রচার করছেন। সত্যের অনুসন্ধান বা অনুসরণ তাঁর লক্ষ্য নয়, স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কৌশল অবলম্বনই তাঁর অন্বিষ্ট। কথাটি ভালো করে বোঝা দরকার। সমাজের মাথারা যেসব অনুষ্ঠানাদি পালন করে, সেগুলো যে মিথ্যা, প্রতারণামূলক, সে-কথাটা ইতর সাধারণ একবার বুঝতে পারলে তারা প্রথমত ঐসব অনুষ্ঠানাদি পালন করবে না, দ্বিতীয়ত সমাজপ্রভুদের অভ্রান্ত বলে মানবে না, তৃতীয়ত নিজেদের মানবিক অধিকার দাবী করে বসে সমাজের স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করবে। সুতরাং গীতাকারের কাছে সত্য-মিথ্যার আলাদা কোনও তাৎপর্য নেই, কোন কথাটা সমাজ-পরিচালকদের স্বার্থ-সহায়ক, সেটুকুই বিচার্য। গীতার সংকীর্ণ, কেজো উপযোগিতাকে এইভাবে অনুমোদন দিয়ে রাজশেখর কার্যত ঐ জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থের দার্শনিক মর্যাদা অনেকখানিই কেড়ে নিলেন। অমর্ত্য সেনের মতো তিনি কিন্তু গীতার এই ভুমিকার সমালোচনা করছেন না, বরং এই ভূমিকাটিকেই কাম্য বলে সমর্থন করছেন।

 

সূত্রনির্দেশঃ

১) অক্ষয়কুমার দত্ত, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়, দ্বিতীয় খণ্ড (১৮৮৩), করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ২৫৪

২) প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, আনন্দ, কলকাতা, ৬ঃ১২-১৩

৩) হরপ্রসাদ মিত্র, রাজশেখর গ্রন্থাবলী, প্রথম খণ্ড, জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, ভূমিকা, পৃষ্ঠা ১৫

৪) Amartya Sen, The Argumentative Indian, pp. 3-5, Allen Lane, Penguin, London, 2005

৫) হরপ্রসাদ, ঐ

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আশীষ বাবুর লেখা নিয়ে, নতুন করে বলার কিছু নেই। বিশেষ করে ওনার “এ কোন অন্য সাধনার ফল” বইটি পড়ার পর থেকে অনার প্রতি প্রতাশা বেড়েই চলেছে। সেই জায়াগা থেকে এই লেখাটি পড়লাম ও প্রীত হলাম।

Leave a Reply to সোমনাথ দত্ত Cancel reply