দিব্যি জ্যান্ত মর্মপাখি

লিয়াকত আলি

সুমিত দাস

 

মহুয়াদিন হোক বা আচমকা পালানো, অজয়পারের বাদাড়ে বা আখড়ায় হারাতেন শক্তি চাটুজ্জে। সঙ্গে স্যাঙাত লিয়াকত। সদ্য তিনিও বিদায় নিলেন। সত্তরের অভিমান শেষে চৈতন্য আর লালনের পথে জীবন খোঁজা লোককবি লিয়াকত আলিকে খুঁজলেন সুমিত দাস।

লিয়াকত আলি। জন্ম – ২৫ মার্চ ১৯৫২। মৃত্যু – ১২ নভেম্বর ২০১৭।

দুপুর থেকেই সন্ধে নামার তাড়া ছিল সেদিন। ঘোর শ্রাবণে অপেক্ষা ছিল কবির। স্বাভাবিক সন্ধে নামতেই ঘুটঘুটে হল অজয়ের উপত্যকা। সন্ধ্যার আখড়ায় সবে বন্দনা শুরু করেছেন ভূমিপুত্র তারক দাস। সহসা অজয়ের সরকারী বাঁধে চিল চিৎকারে আটকে গেল বালি তোলার ‘ড্রেসিং’, — পাঁচ–ছয় জনের আসরে তারক দাসের গলা পাল্লা দিল ‘ড্রেসিং–এর’ আওয়াজের সঙ্গে। “এই জন্যই জয়দেবে আসি না” — বলে উঠলেন লিয়াকত। বছর তিনেক আগের সে শ্রাবণ পার করে পরের বর্ষা আসার আগে, কেন্দুলি ঘাটের দু পাশের বালি বেবাক হাওয়া। লিয়া শুধু জানতেন, শ্রাবণ পার করে, শরৎ ডিঙিয়ে ক্রমেই গেরুয়া হয় অজয়ের বালিয়াড়ি। পথচলতি কথকতায়, চেনা ছকের রামগেরুয়ার সামনে সটান ছবি হয় লিয়াকতের গেরুয়া অজয়। জয়দেব, নীলকন্ঠদাসের সে মোকামে কারা পা রাখেন আজকাল? লিয়া জানতেন সে মর্মকথা।

লিয়াকতের আলুথালু হাঁটাচলা, থমকনো গভীর রাত বা ভোর জানে জ্যান্ত আর মরা মানুষের গল্প। ওই যে -– “যে মানুষ জ্যান্তে মরে, মরে না সে মরার পরে, প্রেমে প্রেমে প্রেম সে ধরে, রূপে অরূপ দেখাবে।” কিন্তু লিয়া, এত জগৎ সংসারের বিষয়, জয়দেব-কেন্দুলির মোকামেও কি তাই? — আলবাৎ, আসা-যাওয়া নথিবদ্ধ হওয়া এত সহজ নয়। এলেও আসা হয় না।

পরের বছর কেন্দুলির মেলা এল। এ আখড়া সে আখড়া ঘোরাঘুরির মাঝে আগাম নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন লিয়াদা। সুবোধ দাসের বাড়ি থেকে ভক্তিভবন আসার পথে স্পিকটি-নট লিয়াদা শ্মশানে এসে থমকালেন। অজয়ের বালিয়ারিতে হাজারো মাইকের দাপাদাপি। শ্মশানের গায়ে সদ্য লেখা পোস্টারে জনৈক উত্তরের সাধুর নাম। রামগেরুয়া সে সাধু বাউল-বৈষ্ণবদের জমি কিনে — কবর থেকে কঙ্কাল জমির বাইরে বের করে নয়াগেরুয়ার সহবত শেখাচ্ছেন রোজ। সে কথা তুলতেই — মগ্ন লিয়া বললেন, — “আজ থাক। আজ অন্যদিন।”

অন্যদিন বলে অন্যদিন! ৫০ বছর ধরে যারা জয়দেবের মেলায় যান তাদের ফি বছর সম্বর্ধনা দেয় ভক্তিভবন। মাঝপথে গায়ক অনাথবন্ধু ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে ভক্তিভবন ঢুকতেই আগল ভাঙলেন লিয়া। জনা কুড়ি সমবয়সী কবি বীরভূম-বর্ধমানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হয়েছেন ভবনে। শুরুতে গান গাইবেন অনাথদা। শেষমেষ লিয়া গোপন রাখলেও আয়োজকদের ঘোষণায় জানা গেল নাম।

সম্ভবত ৬৫ সাল নাগাদ কেন্দুলির মেলায় যাতায়াত শুরু করেন শক্তি চাটুজ্জে। মৃত্যুর আগে সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশকের আগাগোড়া শক্তিদার সঙ্গ নিত কলেজস্ট্রিট বা কফিহাউস। আর শান্তিনিকেতনে পড়ানোর উদোমদিনগুলিতে শক্তির গোপন বা আপন আড্ডায় জুড়ে যেত রাঢ়ের তরুণ কবিরা। সে বার যেন এতকাল পর শক্তি স্বয়ং উপলক্ষ। লিয়াকতদাই চিনতেন, কোন পথে কার সাকিনে তাঁর সঙ্গে পৌঁছে যেতেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সেই নিমন্ত্রণ করেছে বাকিদের। সেই দুপুরের নামঠিকানা সবই ছিলেন শক্তিদা। লিয়ার সাজানো আখড়ায় সেদিন গীতগোবিন্দম ধরলেন অনাথদা। আর আচমকা হেসে লুটোপুটি লিয়া বলে উঠলেন, — “শাল্লা, দেখেছ কত শক্তি! চিনতাম না, তাই হাড়কাটাগলি ফেরতা শক্তি চাটুজ্জের সঙ্গে ঝগড়ার পর কফিহাউসে লিকলিকে হাতে চেয়ার ছুঁড়তে গিয়েছিলাম।” তখনও জানতেন না, অজয়ের গেরুয়া তীরে সময় ছড়িয়ে রেখে যান চুলোয় যাওয়া কবি। সেই বালিয়ারির আশেপাশের বাদামবনে বা কোনও মহুয়াদুপুরে মুর্শেদের খোঁজ চালাতেন শক্তি আর লিয়া।

খোঁজ নাকি মিলত! লিয়া বলতেন, সবই গুছিয়ে নিতে হত। সময়ে ছড়ানো ছেটানো টুকরোটাকড়া জুড়তে পারলে মুর্শেদ আখড়া সাজিয়েও দেন! এই যেমন, — ৬৫-র পৌষ, ৮৫-র বসন্ত, ৮৯-র বৈশাখ বা ২০১৫-র জয়দেব মেলা,  ঠিকঠাক জুড়ে গেলেই — শক্তি হাজির।

এদিনের আগে ও পরে অজস্র মোলাকাত। দুবরাজপুর, ফকিরডাঙা, কলেজস্ট্রিট, পাণ্ডবেশ্বরে ছড়ানোছেটানো লিয়াকতের স্মৃতিচারণ। সত্তরের দিন আচমকা আঘাত করত পেটে। কবিতার পাতা ভুলে পেট চালাতে দোকানে হিসেবের খাতা লিখছেন তখন। রাজ্যের রাজনীতিতে পালাবদলের পর বন্ধ হল রাজনৈতিক বন্দির ভাতা। তাঁর শিশু মনসুরও স্কুল টপকে কলেজে যাওয়ার পথে। অগত্যা সংসার চালানোর তাগিদ। কিন্তু লিয়া ফকির — এ সংসার সাজালে কেমনে! উত্তর আসত -– “সে আরেক গল্প।”

জরুরি অবস্থার সময় একদিন কমরেডদের বনবাদারের পথ দেখিয়ে নিজে পুলিশের সামনে দাঁড়াল কিশোর। পরের গন্তব্য সোজা প্রেসিডেন্সি জেল। জেলার হারুন অল রসিদ বকাঝকা দিয়ে বললেন, — ‘মেধাবী ছেলে পড়তে যাও। সই করো কাগজে।’ রসিদ সাহেবের কথা শুনেছিলেন লিয়াকত আলি। এরপর একরোখা হয়ে সিউড়ি কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে বিড়লা স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে পড়তে ফের কলকাতা। এরপর বিড়লার চাকরি হল। বেশ কিছুকাল নিপাট ভদ্দরজন। তারপর হাওয়া। পশ্চিমের সঙ্গিনীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন এখানে ওখানে। নকশাল লিয়াকতের সুফিযাত্রা। বলতেন -– “পথ আর দৃশ্য যেমনই হোক, আসল বিষয় মানুষ। আমারই মতো। এই যে পেট ও পেটের নিচে যা আছে — তার চাওয়া সীমিত। যত ইচ্ছা তত খাওয়া সম্ভব না। আর যা যতজনের সঙ্গে করতে চাই, তাও দুরূহ। আসল খাওয়া অন্য। মস্তিষ্ক যখন খাদ্য চেনে — তখন খাবার অফুরান। এ যাত্রা শরীর থেকে মস্তিষ্কে বদলের যাত্রা।”

বদল এল খোঁজের ধরনে, আখড়ায় আখড়ায় এলোমেলো হাঁটার শেষে দুবরাজপুরের লিয়াকতের নিয়মিত গন্তব্য হল ফকিরডাঙায় জালাল শাহ ফকিরের আখড়া। একদিন ফকিরকন্যার সঙ্গে বিয়ে হল। বহু পথ পেরনো লিয়া বলতেন -– “আসলে একজনের সঙ্গে দুটো সম্পর্কই একসম্পর্ক। তোমার আমার একই সঙ্গ — অন্তরঙ্গ আর বহিরঙ্গ। এবার যেখানে যেমন গতায়াত! তবে ‘ভালবাসা’ বললে হিসেব রেখে আসতে হবে বাছা। আর তা হবে একমুখী। যে ভালবাসে, ভালবাসা তাঁর। যন্ত্রণা তাঁর ধন।” লাজুক প্রবীণ এরপর বলেই ফেললেন -– “ফকিরকন্যার সঙ্গে বাঁচা আর বাঁচতে চাওয়া নাকি অদ্ভুত।”

রাজ্যে পালাবদলের পর রাজনৈতিক বন্দিদের সরকারি সাহায্য বন্ধ হল। দোকানে কাজ নিলেন লিয়া। ততদিনে গান লেখার তাড়না নতুন ভাবে হাজির। নীলকণ্ঠ গোঁসাইয়ের চলাচলের পথঘাটে শিল্পী বাড়ে, বাউলের পোষাকে উদয় হয় ভাবহীন, সাধনাহীন গাইয়ের দল। গান কোথায়?

একদিন কবিতা আচমকা গীতিকবিতায় বদলে গেল। ফকিরডাঙার রাজা সিনহা এক আড্ডায় সুর জুড়লেন। চমৎকার সে গান। এই লোকগানের একচেটিয়া সস্তাবাজারে রাজা সিনহা হয়ে অজয়ের দক্ষিণপারের উত্তম দাস, মুর্শিদাবাদের নিমাই দাস, জয়দেবের লক্ষণ দাসরা দিতে থাকলেন সুর। শহুরে পরিচালকদের কয়েকজন, তাঁর চিন্তা সিনেমায় নিয়ে এসেছিলেন। প্রয়োগ নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত লিয়ার গান নিয়ে সংশয় ততটা ছিল না। কারণ গাইয়েরা তাঁর সাধনা পথের সঙ্গী।

গান ফের বাধ্য করল কলেজস্ট্রিটে আসতে। সদ্য গীতিকাব্যের সংকলন “পাখি আমার মর্ম পাখি”-র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পেয়েছে। ২০১২ থেকে লিয়াকত-দার বন্ধুরা সহজিয়ার দেব চৌধুরীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভাতার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন। আশ্চর্য, ১২ নভেম্বর লিয়াদা প্রয়াত হওয়ার দু’দিন আগে তাঁর নামে গ্রামীণ লোককবির ভাতার কাগজপত্রও পৌঁছেছে।

বহু গানে এখনও সুর করা বাকি। বহু লেখা এখনও গান হয়ে উঠল না। সব ছেড়েছুড়ে পালাতে চাওয়া লিয়া শুধু জানতেন — জ্যান্তে মরা আর মরে জ্যান্ত থাকার ফারাক। ও লিয়াকতদা, তোমায় মারার ক্ষ্যামতা আছে কার? আমাদের শুধু বাকি গল্প জানা হল না, যে গল্পে লালনিশানের স্বপ্নে সত্যি মেশে বহুত্বের পথ। শতধারার সে মোড়ে মুর্শেদ হয়ে যান লালনমুখী অজয়ের সন্তান।

লিয়াকত আলির গান, শিল্পী রাজা সিনহা ও তারক দাস বাউল

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...