বস্তারের দেবদেবীরা, শেষ পর্ব

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

চতুর্থ উপকথা, পর্ব — দুই এখানে

 

রাওঘাট পাহাড়ে ‘বিকাশ’-এর তাণ্ডব ও তজ্জনিত দুর্দশা

রাওঘাট পাহাড়ের মাথা মুড়িয়ে আজ রেলরাস্তা হচ্ছে। আর হচ্ছে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের লোহার খাই মেটানোর অভিপ্রায়ে নির্মীয়মাণ রাওঘাট লৌহ-খনি। আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে ঐ একই ‘নবরত্ন’-মুকুটিত স্তালিন-নেহরু সন্ধি-প্রসূত প্ল্যান্টের লোহাখাই মেটাতে বস্তারের উত্তরদিকে অধুনা বালোদ জেলার অংশ রাজা রাও-এর থানা ‘রাজারা’ ও তার পার্শ্বস্থ দল্লি নামের দুটো আদিবাসী গ্রাম উজার হয়ে আজ মাইন-টাউন বসেছে। রাজা রাও পরিণত হয়েছেন ‘রাজারা-বাবা’-র মন্দির-এ। মন্দিরের কাছেপিঠেই গোশালা উদ্বোধন করছেন বালোদ জেলার কালেক্টর, গোশালা ও তার পাশে আরেকটা পাহাড়ের চুড়োয় গোণ্ড গুড়ির উপর মন্দির বানানোর অভিপ্রায় নিয়ত হোম-হবনে উদ্যত হচ্ছে ‘গায়েত্রী-পরিবার’-পুষ্ট গেরুয়াধারী সম্প্রদায়বাদী বাবাজীকুল।

বস্তার সহ সমগ্র ছত্তিসগড় রাজ্য, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও ওড়িশা রাজ্যের আদিবাসী অধ্যুষিত সমস্ত অঞ্চলে, সেই ১৯৭৭ সালের পর থেকেই, ক্রমাগত ফিল্ড-ওয়ার্ক করে করে শোষণের মানব ও বাস্তব জমিন তৈরিও অচিরে হাত করেছে সংঘ পরিবার। তাই রাওঘাট পাহাড়ে, মেণ্ডকী নদীতীরে গাছগাছালির নরম ছায়ায় যেইখানে রাজা রাওয়ের একটা অনেক দিনের পুরনো থান আছে, সেইখানেও আশ্রম গেড়েছে গায়ত্রী পরিবার, ইট-কংক্রিট-সিমেন্ট-টাইলে পোক্ত মন্দির বানাচ্ছে, ‘শক্তিপীঠ’ চিহ্ন দিয়ে। এইটা আরেকটা তাজ্জব ব্যপার। রাজা রাও এবং রাওদেবী বলতে একই দৈবসত্তাকে কনোট করে গোণ্ড ঈশ্বরচেতনা, এবং আলোচ্য এই থানকে চিহ্নিত করে রাওদেবীর গুড়ি হিসেবেই। আদিযুগের মাতৃ-সাধনায় জেণ্ডার আয়ডেন্টিটিরা ফ্লুইড ও বহমান – এতটাই যে বর্ণবাদী হিন্দুধর্ম, যা মানুষ ও ঈশ্বরকে নারী, পুরুষ, অর্ধনারীশ্বর ইত্যাদি অর্গ্যান-ওরিএন্টেড নজরে বিচার করে, যে সেই আইডেন্টিটির জায়গায় ‘শক্তি’ বা অন্যান্য কোনও মাতৃ-উপাসনার চলতি হিন্দু শব্দ চাপিয়েই কাজ সারবে। রেল-মাইন-এর চক্করে ক্রমশ অপসৃয়মাণ অরণ্য, চারিদিকে আবার কিলবিল করছে সরকারপক্ষের ফৌজি ক্যাম্প। এরই মধ্যে আজও সম্বৎসর তিন দিন তিন রাত ধরে রাজা রাওয়ের মেলা বসে গ্রীষ্মকালে। তবে, মেলা প্রাঙ্গন ও তার আশেপাশের এলাকা চিহ্নিত হয়েছে আসন্ন ও ফৌজি-প্রহরায় নির্মীয়মাণ বি-এস-পি রাওঘাট আয়রন ওর মাইনস-এর খাস ‘কোর-এরিয়া’র ভিতর।

গোণ্ড প্যান্থিয়ন বিপুল। তাতে যেমন রয়েছে রাও, জটবা-র মতো প্রাকৃত পুরাকথার বীরোপাসনা, তেমনই রয়েছে বুঢ়া-দেও-র মতো দর্শন, আবার তেমনই রয়েছে ‘সঞ্জৌরী-বিদোরী’-র মতো গুহ্য মাতৃসাধনার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত -– সমগ্র তন্ত্রের মতোই, যার মূলেও, রয়েছে প্রকৃতি-পুজো বা ন্যাচারালিজম -– সঞ্জৌরী-বিদোরীর সাথে সাথে ভিম্মা, খেরা, মেঘরাজা-দের পুজো করলে নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় বৃষ্টি হয়, আবহাওয়া ভালো থাকে, সেই ইন্দ্রাবতীর গল্পের কালাহাণ্ডির মতো আকাল যাতে করে না আসে দেশে। টোটেমিজম মাত্রেই ন্যাচারালিজম।

কীরকম হয় গোণ্ড আদিবাসীদের থানগুলো?

এই যে সব দেবদেবীদের গুড়িগুলো, এইসব জায়গায় বিভিন্ন গোণ্ড আদিবাসী সাধনার রীতিপ্রথা যদিও বিভিন্ন হিন্দু আচরণের অর্বাচীন উপদ্রবদুষ্ট, তবু, মোটমাট বোঝা যায় এই প্রকৃতিবাদের নজিরগুলো। মন্দির বা মূর্তিপুজোর প্রচলন নেই গোণ্ড ধর্মে। গুড়ি বা থান বলতে যে সব সেক্রেড কমোন-স চিহ্নিত হয়েছে টোটেমসমাজে, সেগুলো, দুনিয়ার সর্বত্রই, গোটা গোটা পাহাড় বা সমতল বা বনখণ্ড বা নদী বা নালা বা ঝর্ণা অথবা অন্য কোনও প্রাকৃতচিহ্ন -– কোনও পোক্ত দেউল-দালান নয়। গ্রামের বিভিন্ন বাউন্ডারির বিভিন্ন পাহাড়দের, নালাদের পুজো করে করে আর সেই পুজোর থানগুলোকেই গ্রামের পারম্পরিক সীমারেখা মেনে নেওয়ার ‘বূমকাল’ প্রথা ধরে রেখেছে এই থানের সেক্রেড কমোনস হিসেবে গ্রামগুলোর বিভিন্ন বাউন্ডারি-বর্ডার-সীমারেখা জ্ঞাপক প্রাকৃতচিহ্নদের -– সহজ যাপনের উদ্দেশ্যে। আবার সেই প্রাকৃতচিহ্নের ধারা বজায় রাখছে টোটেমপ্রথা —

বিভিন্ন টোটেমে চিহ্নিত গাছপালা পশুপাখিরাই পুজো পায়। উপকরণের মধ্যে বিভিন্ন কাঠ-খোদাই ‘আঙ্গা’ (দক্ষিণ বস্তারে যে বস্তুটির নাম ‘কুরুং-তুল্লা’) -– চারজন কাঁধে বইতে পারে এইরকম কিছু স্ট্রাকচার যার মধ্যে কোনও বিগ্রহ বসানো হয় না, তাছাড়া, বাঁশ বা কাঠের পোলে টাঙানো রঙবেরঙের কাপড়ের পতাকা যা বিভিন্ন টোটেমকে নির্দিষ্ট করছে -– আর বেসিক স্থানীয় ফুল ফল লতা পাতা দিয়েই পুজোপাঠ সারে এরা। দিনক্ষণ ইত্যাদি ঠিক করে দেয় গ্রামের বিচক্ষণ জ্যেষ্ঠরা। তাদের মধ্যে আবার কারও কারও উপর ঐশীশক্তি ভর করে বলে লোকবিশ্বাস প্রচলিত। তাদের নাম হয় ‘সিরহা’। আবার গ্রামেরই কেউ কেউ অলৌকিক শক্তির ভরে আসন্ন ঝড়-বৃষ্টি-খরতাপের প্রেডিকশান করে দিচ্ছে, তাদের নাম হচ্ছে ‘গুণিয়া’। ম্যাজিক হিলিং সম্পন্ন করছে ‘বৈগা’-রা, যারা আবার জায়গাবিশেষে গোণ্ড এবং মুণ্ডা সমাজের অংশ হয়ে গেলেও, আলাদা করেও নিজেদের ট্রাইবাল আইডেন্টিটি বজায় রেখেছে।

তবে, দুনিয়ার তামাম টোটেমধারী আদিবাসীদের মতোই, সমস্ত আর্যধর্মের থেকেই বহু যোজনের ফারাক। হিন্দুধর্ম অথবা যে কোনও এব্রাহামিক ধর্মেই একদল মানুষ থাকে যারা হয় পুরুত বা ক্লার্জি। কারা এমন হবে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই বংশ, বর্ণ ইত্যাদি দ্বারা নির্ধারিত হয়। হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে যেমন বংশ এবং বর্ণের হিসেবে ব্রাহ্মণ এই কাজ করছে। আদিবাসীদের বিভিন্ন দেবদেবীদের পুজোয় বিভিন্ন টোটেম-ধারীরা ঠাঁই পাচ্ছে। গোণ্ড আদিবাসীদের যেরকম ৭৫০টা টোটেমের প্রত্যেকেরই পূজ্য কোনও না কোনও প্রধান দেবদেবী রয়েছে -– যে টোটেম এবং স্থান অনুসারে আলাদা আলাদা হয়। যেমন, রাও-পুজোয় প্রধান হচ্ছে নুরুটি টোটেম তথা পদবীধারী গোণ্ড আদিবাসীরা, আবার হিংলাজ-পুজোয় প্রাধান্য পাচ্ছে পোয়া/পোয়াম টোটেম-পদবী-ধারীরা। মোদ্দা কথা, মধ্যযুগ অবধিও মধ্যভারতের আদিবাসীদের যেমন স্বশাসিত প্রণালীতে ভূখণ্ডের মালিকানা নির্ধারিত হত টোটেম টু টোটেম, স্থান থেকে স্থানান্তরে, রোটেশানাল পদ্ধতিতে, তেমনই, বস্তার তথা গোণ্ডওয়ানার বারো মাসে একশতত্রিশাধিক পার্বনেও পালা করে সেই ৭৫০টা টোটেমের মধ্যে থেকেই সবাই তাদের স্ব-স্ব টোটেম ও স্থানের প্রাকৃত দেবদেবাদির পূজাপাঠের উপর পুরুতগিরি করবার মোক্ষম সুযোগগুলো পেতে থাকে।

ভাঙারাম দেবীর থানে দেবদেবীদের বিচারসভা

আবার গোণ্ড প্যান্থিয়নে যে এত প্রাকৃত দেবদেবাদি, এদের মধ্যে যাতে সামঞ্জস্য বজায় রাখা যায়, গাঁয়ের বিভিন্ন সেক্রেড কমোনস-এর তত্ত্বাবধান যাদের উপর, বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন টোটেমের সেইসব গাইতারাও যাতে সেই সব বিষয়ে বিবাদে ম্লান না হন, সেই সব কারণে রয়েছে গোণ্ডি বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতাদের একত্র করে তাদের মধ্যে বিচার-বিবেচনা-বিবাদ-নিষ্পত্তির প্রচলন। বিচারসভা হয় ভাঙারাম দেবীর থানে।

কোনও পথিক যদি উত্তর থেকে দক্ষিণে এন এইচ ৩০ ধরে বস্তারে প্রবেশ করেন, তাহলে, এক দুই ঘণ্টার মোটরপথে কাঙ্কের শহর অতিক্রম করে তিনি চড়ে যাবেন কেশকাল ঘাটি-র টঙে। এই কেশকাল থেকে এইবার বাঁ দিকে মোড় নিয়ে কয়েক হাত হাটলেই, বিভিন্ন গাছপালার ছায়াঢাকা সমতল-পথে কিছুদূর এগোলে দেখবেন, সামনে অনেক নীচে আর অনেক দূরে প্রসারিত হয়েছে। সামনের কাছে-দূরের পাহাড়ের ঢল অজস্র গাছে ঢাকা, ভোরের দিকে উনোন জ্বালানো ধোঁয়া দেখে দূরে দূরে কিছুকিছু জনপদও ঠাউর করতে পারবেন; উত্তর-পুবের দিকটায় প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরের মহানদীর উপর দুধাওয়া বাঁধটা রুপোর ফিতের মতো চকচক করছে। যেইখান থেকে দাঁড়িয়ে এই মনোরম দৃশ্য আপনি দেখছেন, সেই গ্রামটার নাম, টাটা-মাঢ়ি। ‘মাঢ়’ বা ‘মাঢ়ি’ গোণ্ড ভাষায় পাহাড়কেই বলে। এই পাহাড়ের নাম টাটা-পাহাড় হয়ে গিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মোটমাট দশক তিন এইখানে বক্সাইট মাইন করে গ্যাছে টাটা-কোম্পানি। সেকালে রায়পুর থেকে মিটার-গেজ পথে স্টিম এঞ্জিন পৌঁছে যেত এই পাহাড়টার নীচ অবধি। রায়পুর থেকে ধমতরী অবধি সেই মিটার গেজ লাইন সন ২০১৬ অবধি সচল ছিল, তবে ধমতরী থেকে এই টাটা-মাঢ়ি-কেশকালের আশেপাশে অবধি প্রায় কিলোমিটার চল্লিশেক সেই পঞ্চাশের দশকের পরে ব্যবহার বন্ধ হয়, ক্রমে অরণ্য এসে নিয়ে নিয়েছে তাকে।

এই টাটা-পাহাড়ের প্রসঙ্গ আনা হল কারণ এইখানেই আর কিছুদূর পুবদিক ধরে এগোলে এক দেড় ক্রোশ পথ অতিক্রান্ত হতে না হতে পথিক পৌঁছে যাবেন ভাঙারাম দেবীর গুড়িতে। সেইখানে সমবৎসর বর্ষার আগের সিজনের অন্যান্য দেবদেবীদের মেলা-গুলো শেষ হয়ে গেলে, সেইখানে দেবদেবীদের বিচারসভা বসে। একে ব্যাখ্যা করবার সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ‘দেওতাও কি পঞ্চায়ৎ’ শব্দবন্ধনী ইস্তেমাল করেছে বিভিন্ন সময়ে। তবে, শুধু পঞ্চায়েতি বা সালিশীর মতো ‘অল্টার্নেটিভ ডিস্পিউট রেসলিউশান’-এর প্রক্রিয়াবলিই নয়, এইখানে দেবদেবীদের সমাজ-দ্বারা-অ্যালেজ্‌ড কৃতকর্মাদির জন্য শুনানি, শাস্তিবিধান ও শাস্তিপালনও হয়ে থাকে। কোনও দেব-দেবীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলে সেই এক্সিকিউশান প্রসেসটাও সেই থানের আশেপাশেই সংঘটিত হয়ে থাকে। চিহ্নরা পরে থাকে বাকি বছর -– কাপড়ের আর রুপো-তামা-রাংতার পোড়া-আধপোড়া টুকরোটাকরা, কিছু ছোটখাটো ‘পরসা’-কুড়ুল, মরচে ধরা ত্রিশূল-ছুরি, তোবড়ানো নাক-কান-ভাঙা পোড়ামাটি আর পাথরের আঁকিবুঁকি চিহ্ন, কখনও আবছা খোদাই মানুষ-অবয়ব, সরোষে উৎক্ষিপ্ত বেল-মেটালের ঘোড়ার প্রমাণ সাইজ ভাস্কর্য -– এইসব। অনেক টোটেম-এর অনেক ‘আঙ্গা’ আদৃত ‘পেন’ -– হয়তো আঙ্গা-সমেতই, এই থানেই যুগ যুগান্ত ধরে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে মানুষের ভরে, অর্থাৎ মানুষকে মিডিয়াম করে রিচুয়াল মারফৎ ফি বছর হয়ে চলা দৈববাণীদের দাপটে।

যাই হোক, দেবদেবীদের গল্প হল, ফিরে যাব আবার উপকথায়।

 

এরপর পঞ্চম উপকথা, পর্ব — এক

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...