ডায়েরি থেকে

জয়দেব বসু

 

[এই সময়ের বাংলা কবিতার অন্যতম প্রতিভাদীপ্ত কবি ছিলেন জয়দেব বসু (১৯৬২-২০১২)। কবিতার পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর অকপট রাজনৈতিক জীবন ও ভাষ্য। কবির অকালমৃত্যুর পর বঙ্গলিপির খাতায় তাঁর লেখা একটি দিনলিপি আবিষ্কৃত হয়, যেখানে ধরা আছে ১৯৮৬-২০০৫ সাল পর্যন্ত লেখা তাঁর রোজনামচা। সেই অকপট রোজনামচা, ‘ডায়েরি থেকে’-র অংশবিশেষ পুনর্মুদ্রণের অনুমতি দিয়ে প্রকাশক সপ্তর্ষি প্রকাশন (প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৬) চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-কে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন।]

 

সকাল ১০.১ মিনিট/২৯।৩।৮৭

নির্বাচন হয়ে গেছে। বামফ্রন্ট ফিরে এসেছে আবার। অনেক বেশী সমর্থন নিয়ে। কংগ্রেসের আসন কমেছে। আমার পার্টেও ভোট বেড়েছে, জিতেছে বামফ্রন্ট, যদিও আসনটায় হেরেছে।

বামফ্রন্ট জিতেছে। মানুষই জিতিয়েছে। মানুষ মানুষ — শব্দটার অনেক অপব্যবহার হোলো এতদিন। আর নয়। স্নান, নিরাময়, লড়াই, শান্তি।

আজ বিজয় সমাবেশ ব্রিগেডে।

আমরা কমিউনিস্ট, আমাদের গোটা দেশে বিপ্লব করতে হবে, একথা যেন ভুলে না যাই।

আমি — আপাদমস্তক একজন ব্যর্থ মানুষ; আমাকেও কমিউনিস্ট হয়ে উঠতে হবে। তবেই বিপ্লব সম্ভব।

সকাল ১০.১২ মিনিট/২৯।৩।৮৭

***

২৩।২।৮৯/রাত ১২.০০

কয়েকটা জরুরী অভিজ্ঞতা:

গতকাল রাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত ঘুম ও কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে টানা পড়ে শেষ করলাম আলেক্স হেলি[১]-র ‘রুটস্'[২]। বইটা আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। বইটা আমাকে ভাবাচ্ছে। বহুদিন পরে একটা বই পড়ে এমন অনুভূতি। আসলে মূলটা নয়, পড়লাম বাংলা অনুবাদ। না হলে তো পুরোনো বই। টানা ইংরেজি পড়ার ধৈর্য নেই বলে এতদিন পড়া হয়নি। ভূমিকায় অম্লান দত্ত[৩] বইটাকে বলেছেন ‘মহাকাব্য’। অতটা আমার মনে না হলেও, মহাকাব্যের কাছাকাছি তো বটেই। কিনে ফেলবার মত বই। শেষ করার পর আচমকা একটা লাইন জন্ম নিল মাথায় — “আমাদের ইতিহাস দীর্ঘ দীর্ঘতম বিষণ্ণতার ইতিহাস।” হেলিকে ধন্যবাদ।

দ্বিতীয়ত, সন্ধ্যায় কলেজপাড়ায় ল্যাডলিদা বলল, বিপ্লব[৫] অসুস্থ, হয়তো মরণাপন্নও। মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ভর্তি করেনি। শেষে শিয়ালদার এক অখ্যাত হোটেলে রাখা হয়েছে। ল্যাডলিদার সঙ্গে বিপ্লবকে দেখতে গেলাম।

বিপ্লব — ছেলেটির পদবী আমার মনে নেই — অচ্যুত[৬], বিশ্বজিৎ[৭], অভীক[৮]দের বন্ধু। গদ্য লেখে। ‘গদ্য নির্মাণ করে’ বলা ভালো। কেমন লেখে সে প্রশ্ন অবান্তর, আমার এখনো ততকিছু উল্লেখ্য মনে হয়নি, তবে ওর বন্ধুরা তো ওর লেখা নিয়ে যথেষ্টই লাফঝাঁপ করছে। আমার সঙ্গে এ যাবৎকাল মৌখিক আলাপই রয়েছে।

তো, সেই বিপ্লব, কলেজপাড়ায় যে সাম্প্রতিক গদ্যের উদ্ভট ও আধুনিকতম পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যাপৃত, এবং বয়স যার এখনো চব্বিশ হয়নি, সে যে অনিবার্যভাবেই নেশায় আশ্রয় নেবে বলাই বাহুল্য। ওর অসুস্থতাও সেই নেশাসঞ্জাত। বেশ কয়েকদিন, প্রায় না খাওয়া অবস্থায়, প্রচুর নেশা করার ফলে ওর বুকে ও পেটে একরকম তীব্র ব্যথা হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য কাশি যাতে কখনো কখনো রক্তের ছিটে। ঘুপচি একটা হোটেলের ঘরে পড়ে আছে অর্ধচেতন অবস্থায়, পাশে বসে আছেন ওর এক পিসি। তিনি ওকে তাঁর বাড়ি নিয়ে যেতে চান, কিন্তু বিপ্লব যেতে রাজি নয়। রাজি নয় বাড়িতে ফিরতেও। এবং বন্ধুরা, যারা কল্পনার রোমাঞ্চ পেলে আর কিছুই প্রায় চায় না, ধরেই নিয়েছে বিপ্লবের আয়ু শেষ। এই অবস্থায় আজ বিপ্লবকে দেখলাম। আমার অবশ্য মনে হচ্ছে না ও মুমূর্ষু, তবে জোর দিয়ে বলা যায় না কিছুই। আবার এটাও ঠিক, মেডিকেল কলেজ ওকে ভর্তি করেনি, কারণ, ডাক্তাররা মনে করছেন শারীরিকভাবে তত কিছু অসুস্থ নয় ও। ওর অসুখটা মনের। ফলে, ওর প্রয়োজন বিশ্রাম, আহার ও মানসিক চিকিৎসা। ধরে নেওয়া যাক, ডাক্তাররা এ ব্যাপারটা আমার থেকে ভালো বোঝেন। যার যেটা পেশা। ওঁদেরও তো খেটেখুটে ডাক্তারিটা পাশ করতে হয়েছে।

বিপ্লব — কফি হাউসেই যার সঙ্গে আমার বেশিরভাগ দেখা — একটি সুশ্রী, রোগা ও কঠোর মুখের ছেলে। কখনো তার পাতলা গোঁফ থাকে, কখনো সেটা সে কামিয়ে ফেলে। কখনো রাখে হনু পর্যন্ত পুরোনো ইংরেজি কায়দায় জুলফি, হায়, কম বয়সের কারণে তাও পাতলাই। মা মারা গেছেন, আত্মহত্যা বা কোনো দুর্ঘটনায়।

বাবার সঙ্গে সম্পর্ক জটিল, কেন বা কিরকম জানি না। শুনলাম, অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বুদ্ধিমান, বিবেচনাহীন, তীব্র সংবেদনশীল এবং এইসব কারণেই বিকারগ্রস্ত। ওর গদ্য পড়লেই, যে বোঝার সে এসব বুঝে নিতে পারবে। সেই বিপ্লব এখন কাতরাচ্ছে। বাবার প্রতি ঘৃণায়, মা-র প্রতি অভিমানে, তুচ্ছ অহং-এর প্রতি বিশ্বস্ততায়, নেশার দাসত্বে — এখন, বিপ্লব কাতরাচ্ছে। এবং, আমি লিখছি। এই পথ বিপ্লব বেছে নিয়েছে, হয়তো স্বেচ্ছায় নয়, কিংবা — কী কারণে আমি জানি না — কিন্তু, কোনো কোনো সময়ে মানুষের আর কিছু করার থাকে না। বিপ্লবেরও না, আমারও না।

এবার পুরো শীতটাই আমি বিপ্লবকে দেখেছি বেঢপ একটা পুরোনো কালো কোট গায়ে দিয়ে ঘুরতে। যেন বেশ একটা ফ্যাশান হোলো। আসলে দারিদ্র‍্যের কারণে, দারিদ্র‍্যকে ঢাকতে। যা কিনা, পৃথিবীর সব দেশের অল্পবয়সী দুঃখী লেখক-কবি-শিল্পীরা করে আসছেন। বহু যুগ যাবৎই। বোদল্যের[৯] থেকে গীন্সবার্গ[১০] পর্যন্ত। মায়াকভস্কি[১১] থেকে নেরুদা[১২] পর্যন্ত। হায়, তাঁরা ভাবতেন, বুঝি ঢাকতে পারছেন নিজের অবস্থা। আসলে সবাই বুঝত। কিন্তু, কিছু করার নেই। মানুষের সভ্যতাকে অন্যরকম করে ফেলতে না পারলে সত্যিই কিছু করার নেই।

আমরা কি আগামী বিপ্লবদের এমন একটা সময় উপহার দিতে পারব, যেখানে তার মা আত্মহত্যা করবে না? যেখানে বাবার সঙ্গে সম্পর্ক হবে সহজ ও স্বাভাবিক? যেখানে সে অহং ছাড়িয়ে উঠতে পারবে? ‘কু'[১৩] নামে আমার একটি লেখাকে এই বিপ্লবই বলেছে ‘ভালগার’। তবু বিপ্লবদের জন্যই আমার এই সময়সাধনা। এ ছাড়া এই অভিজ্ঞতার আর কোনো মর‍্যাল নেই। বিপ্লব বেঁচে থাকুক। স্বাস্থ্যকরভাবে বেঁচে থাকুক।

রাত ১২.৫২ মিনিট/২৩।২।৮৯

***

রাত ১১.১৭ মিনিট/১০।৪।৯১

অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটা ঘটনা যে — আমি একটা চাকরি পেয়েছি। একটা স্কুলে। নিমতা হাইস্কুল। মোটামুটি ভালো। আজই প্রথম কাজে যোগ দিলাম।

১৯৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি প্রথম সল্টলেকের একটা স্কুলে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেছিলাম। তার ঠিক দু দিন আগে আমার এম এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেই চাকরিটা পাইনি। তারপর, একটার পর একটা… পাইনি, পাইনি আর পাইনি। অবশেষে, চার বছর চৌদ্দ দিন পর — সেই স্কুলেই চাকরি। অন্য একটা পর্ব শুরু হল তবে।

এই চার বছর বেকার থাকার পর্বটাও খুব জরুরি। জীবনে কখনো, কোনো অবস্থাতেও যেন এই অভিজ্ঞতাটা না ভুলি। এই চার বছর জীবন আমাকে পায়ের নীচে মাড়িয়ে যেভাবে দলে-পিষে-চটকে ফেলেছে, এবং সেই সঙ্গে নামিয়ে এনেছে আমারই দেশের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সমতলে, সেই অভিজ্ঞতাটা ভুলে যাওয়া কৃতঘ্নতা হবে।

অবশেষে সামান্য একটু অবকাশ। ভাবার জন্য, লেখার জন্য, বাঁচার জন্য। অথবা, তাও হয়তো নয়। যাই হোক, এর আর অন্য মানে নেই। নিজের ভাত নিজে উপার্জন করা ছাড়া।

রাত ১১.৩০ মিনিট/১০।৪।৯১

পুনশ্চ: আজ সন্ধ্যায় গোর্কি সদনে তারকোভস্কির[১৪] ‘স্যাক্রিফাইস'[১৫] দেখলাম। অসামান্য।

***

রাত ১২.১৫ মিনিট/৩।৩।৯২

বিলম্বিত হলেও জরুরী একটা কথা:

গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি পার্টি থেকে আমাকে ছয় মাসের জন্য সাসপেণ্ড করা হয়েছে। কারণ? ঘোষিত কারণ হল, নিষেধ অমান্য করে ‘দেশ'[১৬] পত্রিকায় লেখা। আর, আসল কারণটা নোংরা। সত্যি বলছি, পার্টির প্রতি অবশিষ্ট শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্য সহকারেই বলছি — এরকম নোংরা খেলা যে হয়, সেটা আগে শুধু শুনেইছি, এবার অভিজ্ঞতাও হল।

তাতে অবশ্য কুছ্ পরোয়া নেই। আগেকার মত দুবলা মানসিকতার ছেলে আর নই আমি। লড়াই জারি আছে। শেষ পর্যন্ত জারি থাকবে। পার্টি আমি ছাড়ছি না। অন্তত আগামী দু বছরের মধ্যে তো নয়ই। এর মধ্যে আমাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে, কিন্তু স্বেচ্ছায় আমি ছাড়ছি না।

চাকরিটা প্রায় ধাতস্থ হয়ে এসেছে। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত যদি চাকরিটা থাকে, তবেই। ওই যে বললাম, নোংরা খেলা চলছে…। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, পার্টিতে আমি নিঃসঙ্গ নই, এটাই আশার। এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে আরো একটা সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে। এতেও খুব বদনাম হবে শীঘ্রই। তাতেও পরোয়া নেই, লড়াই জারি আছে।

লেখাফেখা বিশেষ হচ্ছে না, যা হচ্ছে তাও অপাঠ্য। সেই ক্লিশে কথাটাই বলতে হচ্ছে আবার — লেখা আমার দ্বারা হবে না। তবে ছেড়েও দেব না এক্ষুনি। শেষ চেষ্টা করতেই হবে। লড়াই জারি আছে।

আমি বোধহয় অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছি। এটাই দুশ্চিন্তার। কারণ, এর বিরুদ্ধে যে লড়াই জারি আছে বিশেষ, এমনটা নয়।

রাত ১২.২৪ মিনিট/‎৩।৩।৯২

***

১০।১২।৯২

দেশজোড়া আগুন এখনো নেভেনি। কারফিউ জারি আছে এখানেও। গত রবিবার যখন বাবরি মসজিদ[১৭] ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, তখন আমি ছিলাম শান্তিনিকেতনে। গতকাল ফিরেছি। ফিরতে পেরেছি, কারণ গুজবে কান দিইনি মোটেই। পার্টি অফিসে যেতে পারছি না। কারণ যানবাহন নেই। ফলে একটু নিজের কথা লেখা যাক।

সাসপেনশন উঠে গিয়ে সগৌরবে পার্টিতে ফিরেছি, সে কবে?… অগাস্ট মাসে বোধহয়। তার আগে একটা বে-আইনী শনি-মন্দির বানানো রুখতে গিয়ে আমাকে একটু বেশি রকমই মার খেতে হয়। তখনো আমি সাসপেণ্ডেড। তাতে কিছু আটকায়নি। পার্টির প্রতিক্রিয়া হয় দ্রুত এবং দুভাবে। লোকাল পার্টি (নিচু মহল) আমায় যারা মেরেছিল, তাদের আগলাবার প্রাণপণ চেষ্টা চালায় এবং রাজ্য পার্টি অপরাধীদের দেয় শাস্তি। স্থানীয় মাতব্বরেরা জিততে পারেনি শেষাবধি। তারপর আমাকেই এলাকার ‘দাদা’ করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আমি যে তা হতে পারিনি, সেটাকে নিজেরই অক্ষমতা বলতে হবে।

ও হ্যাঁ, খোদা জব্ দেতা… সূত্র অনু্যায়ী গত ২৩শে নভেম্বর দমদম মতিঝিল কলেজে আমি অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছি। এবং, গণশক্তি এবং নন্দন দুটো কাগজেই কবিতা দেখার দায়িত্ব।

এবং আরো একটি ঘটনা — যা প্রার্থিত সম্পর্কে পৌঁছলে, বলতে নেই দুশ্চিন্তাতেই পড়ে যাবো আমি। একটা মানুষ যা চেয়েছে, সবই পেয়ে গেলে সেটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয় না?

খুব যে দুশ্চিন্তা হবে এমন নয়। কেননা, এত বছর চেষ্টা সত্ত্বেও লেখা আমার দ্বারা হচ্ছে না। এই আগুনের মধ্যে বসেও যদি লিখতে না পারি, তবে আর কবে পারব?

বিজেপি ক্ষমতায় আসছে। নিশ্চিতভাবে আজ আমি লিখে রাখছি — ক্ষমতায় আসছে অবিলম্বেই। তারপর পাঁচ অথবা দশ বছর শাসনের পর মানুষ তাদের নির্বাসন দেবে অন্তত পঞ্চাশ বছরের জন্য। কিন্তু, তার মধ্যেই, তাদের শাসনকালেই হয় আমি খুন বা পঙ্গু হব। নয়তো ওদের সঙ্গে আপস করব ভয়ে।

অর্থাৎ, দুটো ক্ষেত্রেই, আমার সর্বনাশই হচ্ছে।

এবং, এই সর্বনাশ হচ্ছে লালকৃষ্ণ আডবানিদেরই[১৮] কৃপায়।

হাইল্, আডবানি।

হাইল্ হিন্দু জনগণ, তোমাদের পরবর্তী দশটি প্রজন্ম যেন তোমাদের ঘেন্না ছাড়া কিছু না করে।

***

৮।৭।০৩

গতকাল মধ্যরাতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মারা গেছেন।

বাঙালীর কবিতার ইতিহাস কোনদিনই সম্যক বুঝবে না সে কী হারাল। তাতে খেদ নেই, লজ্জা তো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের না, লজ্জা বাঙালীর।

কিন্তু এই মৃত্যু থেকে আমরা কী শিখলাম? এই নির্বিত্ত অসহায় উপেক্ষিত মত্যু থেকে? শুধু কবিতা লিখতে হবে বলেও শেষ জীবনে এইসব ভোগ করে যেতে হবে? এইভাবে জীবন কাটাতে হবে?

হয়ত হ্যাঁ। হয়ত না। আমি নিশ্চিত নই। তবে এবার একটা সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়ার সময় এল।

সি পি আই (এম) নিশ্চয়ই এই মৃত্যু নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাবে না। সি পি আই (এম) ভয়ংকর দল। মৃত শত্রুও তার কাছে সহনীয় নয়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কিছু রেষারেষি ছিল। গোপনে। একেবারে নিজের মনের মধ্যে। একলব্যের মতো। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সে কথা জানতেনও না কোনোদিন। অনেকটা ‘গুরু গুড় চেলা চিনি’ ধরনের ব্যাপার। প্রায় আঠার বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এক বিকেলে আমি স্যারকে বলেছিলাম — যতই যা হোক, সুভাষ মুখোপাধ্যায় পার্টি ছেড়ে ভুল করেছিলেন। তাঁর মাটি কামড়ে পড়ে থাকা উচিত ছিল। আমি অন্তত সে ভুল করব না।

করিনি। মাটি কামড়েই পড়ে থেকেছি। পার্টি ছাড়িনি। কিন্তু, এখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই যখন নেই, তখন এসব কিছুই কেমন অর্থহীন লাগছে।

২০০২-এর ৮ ডিসেম্বর, রবিবার, আমার মা[১৯]-ও মারা গেছে। এক অর্থে বেঁচে গেছে বলা যায়। বড্ড একা হয়ে গিয়েছিল।

শুধু স্যার বাকি। তারপর আমি সর্বার্থে অনাথ।

সকাল ৮.২৫ মিনিট/৮।৭।০৩

***

২৬।৩।০৫

অনিলদা[২০] মারা গেলেন। বোধহয় আগের দু’-একদিন আগেই গিয়েছিলেন।

আমার জীবনের ১০/১২ বছর শেষ করে দিয়েছিলেন এই লোকটি।

তবুও, সেরা নেতা। ভারতের লেনিন না হোন, ভারতের মাও ৎসে তুং[২১] না হোন, ভারতের গ্রামশি[২২] না হোন… আর, সত্যি বলতে হবেনই বা কেন? আমাদের রাজনীতি আমাদের। সেই রাজনীতির কার্ল হাইনরিখ মার্কস্[২৩] অনিল বিশ্বাস-এর মৃত্যুসংবাদ একটু আগে স্বীকার করে নেওয়া হল।

এই সেই অনিল বিশ্বাস, যিনি আমাকে অকারণ — সত্যিই অকারণ — শাস্তিতে আমার জীবনের দশ-দশটা বছর শেষ করে দিয়েছিলেন।

তবে, আমারও কথা — কে হে অনিল বিশ্বাস? আমি যদি লিখব ঠিক করি — তবে, সে কে? ঠিক। ঠিক। অনিলদা-ও কেউ না। তাই আজ ব্যক্তিগত কথা বলব না। আদৌ বলব কিনা পরে ঠিক হবে। কিন্তু অনিলদা, যে কী ছিলেন…

আমি কি একটু আগে ওঁকে — মার্কস বলেছিলাম… বোকা-বোকা কথা… বলেছিলাম।

কিন্তু, ঠিক-ঠিক কথা বলতে গেলে —

অনিলদা-অনিলদা। টম-ডিক-হ্যারি, মাও-লেনিন-গ্রামশি — ও সব বললে — ভাবলে হবে না।

ঠিক কী — তা বলবে চার কন্যা — অজন্তা[২৪], দুদু[২৫], হিয়া[২৬], উষসী[২৭]

সর্বজ্ঞানী দেবু[২৮] তো জ্ঞান দেবেই।

একটু নিজেকে সামলাতে পারত।

সন্ধ্যা ৭.২৫ মিনিট/২৬।৩।০৫

আরে, আমাদের যে একটা ছেলে হয়েছে — সেটাও তো কখনো লিখিনি। আজ রবিবার। ওকে প্রথম চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছিলাম। ও — জুরা[২৯]

***

টীকা:-

Alexander Murray Plamer Haley (১৯২১-১৯৯২)। আমেরিকান সাহিত্যিক। ‘Roots: The Saga of an American Family’ তাঁর বিখ্যাত বই।

১৯৭৬ সালে প্রকাশিত Alex Haley-র একটি বিখ্যাত উপন্যাস। কুণ্টা কিণ্টে (Kunta Kinite) নামে নিজেরই এক পূর্বপুরুষের জীবন অবলম্বনে রচিত উপন্যাসটি। ১৯৭৭ সালে বইটির জন্য বিশেষ পুলিৎজার পেয়েছিলেন।

অম্লান দত্ত (১৯২৪-২০১০)। অর্থনীতি ও শিক্ষাবিদ। মার্কসিস্ট কমিউনিজমের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকগুলির পুনঃপাঠের মাধ্যমে নানা ব্যাখ্যা তুলে ধরেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের একাধিক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান করেছেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের রচয়িতা। পেয়েছেন দেশিকোত্তম, জগত্তারিণী ও আনন্দ পুরস্কার।

ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়। তথ্যচিত্র নির্মাতা। এক সময়ের জনপ্রিয় বইয়ের দোকান ‘কাগজের বাঘ’-এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

বিপ্লব — বিপ্লব মুখোপাধ্যায়। অবিপ্লব না মুখোপাধ্যায় এই নাম নিয়ে ‘গৃহযুদ্ধ’ নামে কবিতার বই লেখেন।

অচ্যুত মণ্ডল। জয়দেব বসুর ছাত্রজীবনের ও পরবর্তীতে দীর্ঘদিনের বন্ধু, কবি ও অধ্যাপক। জয়দেব-এর প্রয়াণের মাত্র কিছুদিন আগেই আত্মহননের পথ বেছে নেন।

জয়দেব বসু-র বন্ধু ও কবি।

অভীক মজুমদার। জয়দেব বসু-র বন্ধু ও কবি।

Charles Baudelaire (১৮২১-১৮৬৭)। বিখ্যাত ফরাসি কবি। অসংখ্য প্রবন্ধও রচনা করেছেন। তাঁর গদ্য-কবিতা রচনা পদ্ধতি কবিদের এক গোটা প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত ‘La fleur du mal’ বোদলেয়ার-এর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি ‘Les Paradis artificiels’, ‘Fusees’ ইত্যাদি বহু কাব্যগ্রন্থ ও শিল্পসমালোচনামূলক বই লিখেছিলেন।

১০ Allen Ginesberg (১৯২৬-১৯৯৭)। গত শতকের পাঁচের দশকের বিট নৈরাজ্যবাদী প্রজন্মের মার্কিন কবি। তাঁর মহাকাব্যিক ‘Howl’ কবিতাটির জন্য তিনি বিখ্যাত। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও আমেরিকায় মাদক বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে গিন্সবার্গের গভীর যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশি রিফিউজিদের নিয়ে লেখা তাঁর ‘September on Jessore Road’ কবিতাটি সেই যোগাযোগের সাক্ষী। গিন্সবার্গ তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘Cosmopolitan গ্রেএতিংস’-এর জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন।

১১ Vladimir Mayakovsky (১৮৯৩-১৯৩০)। বিখ্যাত রাশিয়ান কবি, নাটককার, ও অভিনেতা। প্রথম জীবনে রুশ ফিউচারিজমে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মূলত সেই কারণেই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতাগুচ্ছ ‘Night and Morning’-এর জন্য ১৯১৪ সালে মস্কো আর্টস স্কুল থেকে নির্বাসিত হন। অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি ন্যারেটিভের দিকে আকৃষ্ট হন। তাঁর কবিতায় সমাজতন্ত্র তথা প্রথম বিশ্বযুদ্ধও গভীর প্রভাব বিস্তার করে। রাশিয়ান কবিতায় তাঁর প্রভাব অনস্বীকার্য।

১২ Pablo Neruda (১৯০৪-১৯৭৩)। চিলির বিখ্যাত কবি, কূটনীতিক ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। আসল নাম নেফটেল রিকার্তো রেত্রস বাসেয়ালটো (Neftanl Ricardo Reyes Basqlto)। দীর্ঘদিন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন। চিলিতে কমিউনিজম নিষিদ্ধ হওয়ার পর নেরুদা দীর্ঘ সময় আত্মগোপনে ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাসিতের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। স্পেনের গৃহযুদ্ধ তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্মে গভীর ছাপ ফেলেছিল। নেরুদার ‘Book of twilight’, ‘Twenty poems of love and a song of despair’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ তাঁকে অমর করে রেখেছে। ১৯৭১ সালে নেরুদা সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কার পান।

১৩ কু — লেখকের রচনা। শব্দটির অর্থ সহিংস ও বেআইনি পদ্ধতিতে কোনও সরকারকে হঠিয়ে শাসনক্ষমতা দখল। 

১৪ Andrei Arsenyevich Tarkovsky (১৯৩২-১৯৮৬)। সোভিয়েত চিত্র পরিচালক। লেখক ও অপেরা পরিচালকও। পরিচালিত ছবি ৮টি। অন্যতম: Ivan’s Childhood, Solaris, Mirror, Nostalgia, The Sacrifice।

১৫ ১৯৮৬-তে মুক্তিপ্রাপ্ত। পরিচালক Tarkovsky। সাংবাদিক আলেকজান্ডার ও তার স্ত্রী-মেয়ে-কে নিয়ে জটিল জীবনদর্শনের গল্প। প্রকৃতপক্ষে আত্মিক উপলব্ধির ছবি।

১৬ ‘দেশ’ পত্রিকাটি আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর পক্ষে প্রকাশিত আধুনিক বাঙালি সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা। প্রথম প্রকাশ ১৯৩৩। বিশিষ্ট সম্পাদক ছিলেন সাগরময় ঘোষ। বর্তমান সম্পাদক হর্ষ দত্ত।

১৭ উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার ফৈজাবাদে বাবর ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একাংশের বিশ্বাসে রামজন্মভূমি। যেটি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর করসেবকদের হাতে ধ্বংস হয়।

১৮ ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থানের অন্যতম নায়ক। উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০০০ সালে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত।

১৯ বেলা বসু রুশ ভাষায় দক্ষ ছিলেন। Mikhail Bakhtin-Vladimir Mayakovsky-র নাটক অনুবাদ করেছেন মূল ভাষা থেকে। অহমিয়া ভাষা থেকেও মামণি রইসম গোস্বামীর উপন্যাসের অনুবাদ উল্লেখযোগ্য।

২০ অনিল বিশ্বাসের জন্ম ১৯৪৪, মৃত্যু ২০০৬। আমৃত্যু সি পি আই এম-এর রাজ্য সম্পাদক। ‘মার্কসবাদী পথ’-এর সম্পাদক।

২১ Mao-Zedong (১৮৯৬-১৯৭৬)। চিনের মার্কসবাদী বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক নেতা। ১৯৪৯ সালে সমাজতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমৃত্যু শাসনকর্তা হিসেবে আসীন ছিলেন। তাঁর তাত্ত্বিক পথ বর্তমানে ‘মাওবাদ’ নামে পরিচিত।

২২ Antonio Gramsci (১৮৯১-১৯৩৭)। ইতালিয়ান লেখক এই ব্যক্তি একাধারে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও ভাষাবিদ। ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা।

২৩ Karl Heinrich Marx (১৮১৮-১৮৮৩)। সারা পৃথিবীতে প্রভাবশালী জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক। মৃত্যুর পরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শ হয়ে ওঠেন। কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে মার্কসের লেখা ‘Das Capital’ অপরিহার্য গ্রন্থ। 

২৪ অজন্তা বিশ্বাস অনিল বিশ্বাসের কন্যা। বর্তমানে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক।

২৫ সুচেতনা ভট্টাচার্যের ডাকনাম। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কন্যা। সমাজকর্মী।

২৬ হিয়া মুখোপাধ্যায়। কবি ও বামফ্রন্টের প্রাক্তন মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা।

২৭ উষসী চক্রবর্তী। সিটু (শ্রমিক ইউনিয়ন) প্রধান শ্যামল চক্রবর্তীর কন্যা। অভিনেত্রী ও সাংবাদিক।

২৮ দেবাশিস চক্রবর্তী। সি পি আই এম রাজ্য কমিটির সদস্য। ‘গণশক্তি’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।

২৯ জয়দেব-সেবন্তীর একমাত্র পুত্র।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...