মাঝারি মানুষ

দেবাশিস মৈত্র

মার্চ মাসের এক অকালবৃষ্টির সন্ধ্যায় প্রকাশবাবু আত্মদর্শন লাভ করলেন।

প্রকাশ মণ্ডল মাঝবয়সী লোক। তাঁর উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাঝারি, স্বাস্থ্য-বুদ্ধি-শিক্ষা-সাহস সবই মাঝারি মাপের। কসবার এক এঁদো গলির মধ্যে এক স্যাঁতসেঁতে ভাড়াবাড়িতে তাঁর বাস। সারাজীবনে বলার মতো কাজ তিনি করেছেন মাত্র দু’টি। এক, দুই দাঁড়ির বি. কম. ডিগ্রি সম্বল করে এক প্রাইভেট কোম্পানিতে একটি কেরানির চাকরি জোগাড় করেছেন। আর দুই, কম্পিউটারের ক-টুকু না শিখেও সেই চাকরি বজায় রাখতে পেরেছেন প্রায় তিন দশক ধরে।

প্রকাশের স্ত্রী নীলিমা বাংলা সিনেমার নরমপন্থী গৃহবধূদের ছাঁচে-ঢালা চরিত্র। শাড়ি-গয়নার চাহিদা বিশেষ নেই, শপিং মলে বাজার করা অথবা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাবার বায়নাও নেই। নেশা বলতে শুধু তিনশো জর্দা দিয়ে সারাদিনে গুটিকয়েক পান খাওয়া আর সন্ধ্যায় আরাম করে বসে সিরিয়ালের জগতে বিচরণ। প্রকাশের ছেলের ক্লাস নাইন, মেয়ের পাশ কোর্সের সেকেণ্ড ইয়ার। মেয়ে নাচ জানে না, ছবি আঁকতে পারে না, জনাসাতেক গানের মাস্টার বিভিন্ন সময়ে তার গলায় সুর ফোটাতে গিয়ে নিজেরা গান ভুলেছেন। ছেলে বছর তিনেক গজুদার ক্রিকেট কোচিং-এ বৃথা রগড়ানোর পর সৌরভ গাঙ্গুলি হওয়ার চেষ্টায় দাঁড়ি টেনে এখন ভজুদার মাধ্যমিক কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। প্রকাশের নিজের জীবনে যেমন খুব উচ্চাশা কখনই ছিল না, তেমনি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তেমন দুশ্চিন্তাও নেই। মেয়ের বিয়ে? সময় আসুক, দেখা যাবে। ছেলের চাকরি? বাপের যখন জুটেছে, ছেলেরও একটা কিছু জুটে যাবে নিশ্চয়ই।

প্রকাশ মণ্ডলের জীবন তাই মোটের ওপর নির্ঝঞ্ঝাট, নিশ্চিন্ত। অন্তত এতদিন তা-ই ছিল। মাঝারি মানুষ প্রকাশ তাঁর মাঝারিয়ানা নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। চায়ের নেশাটুকু ছাড়া তাঁর আর কোনও নেশা নেই, শখ-আহ্লাদও নেই তেমন। মাসের প্রথম দিকে এক-আধবার মাংসের ঝোল ভাত খেয়ে অমৃতের স্বাদ লাভ করেন। শনি-রবির দুপুরে দিবানিদ্রার মধ্যে স্বর্গসুখ খুঁজে পান। রাতে ঘুম আসার আগে কিছুক্ষণ টিভির সামনে বসে অবিরাম চ্যানেল পাল্টান। এসবের পাশাপাশি চলছে নতুন কেনা স্মার্টফোনটিকে পোষ মানানোর চেষ্টা। কখনও-সখনও পুরনো বন্ধুদের তাসের আড্ডায় বেফাঁস কল দিয়ে ফেলে বিস্তর গালাগাল খেয়ে হাসেন। প্রকাশ খুব আবছাভাবে বোঝেন, তাঁর চরিত্রে আদৌ কোনও বিশেষত্ব যদি থাকে, তবে তা এই যে, তাঁর কোনও বিশেষত্ব নেই।

এভাবেই এতদিন চলছিল জীবনটা, কিন্তু ইদানিং পরিস্থিতি পালটেছে। প্রকাশের চরিত্রে হঠাৎই এমন এক গুণের আবির্ভাব ঘটেছে যা পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির রয়েছে বলে জানা নেই।

প্রকাশ মণ্ডল এখন দিব্যদৃষ্টির অধিকারী।

ত্রিকালজ্ঞ মুনি-ঋষিদের মতো সর্বত্রগামী দিব্যদৃষ্টি অবশ্য নয়, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান তাঁর নখদর্পণে ধরা দেয় না। প্রকাশ তাঁর দিব্যদৃষ্টির দৌলতে শুধু মানুষের ভিতরের চেহারাটা দেখতে পান। সব মানুষের নয়, কিছু মানুষের; সব সময়ে নয়, কখনও-সখনও। দিব্যদৃষ্টি প্রকাশের আজ্ঞাধীন নয়। বেয়াড়া বেড়ালের মতো সেটি আশেপাশে ঘুরঘুর করে, কিন্তু পোষ মানে না। হঠাৎ কখনও জাগ্রত হয়ে ওঠে, আর চেনা বা অচেনা কোনও লোকের আসল চেহারাটা প্রকাশের চোখের সামনে তুলে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে আবার।

বিচিত্র এই ক্ষমতাটি নেহাতই পড়ে-পাওয়া। বছরখানেক আগে এক আকস্মিক দিব্যদর্শনের আগে পর্যন্ত নিজের মধ্যে এই অলৌকিক গুণের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। দিনক্ষণ লিখে রাখা হয়নি, কিন্তু ঘটনাটা ছবির মতো মনে রয়েছে। অফিসে বসে বসে মেজসাহেবের হুকুমমাফিক একটা কম্প্যারেটিভ স্টেটমেন্ট বানাচ্ছিলেন প্রকাশ। কাজটা কঠিন নয়, কিন্তু অন্যমনস্ক হলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা। জটিল সব স্পেসিফিকেশন মাথার মধ্যে কেবলই জট পাকাতে থাকায় একটু জিরিয়ে নেবার প্রয়োজন হয়েছিল। আয়েস করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই উল্টোদিকের টেবিলের জগন্ময়ের সঙ্গে চোখাচোখি। সামনে খোলা টিফিন-বক্স, লুচি-তরকারি মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে অন্যমনস্কভাবে প্রকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে সে।

কিন্তু এ কী কাণ্ড! জগন্ময়ের মুখটা অমন পালটে গেল কী করে? পরিষ্কার দেখলেন প্রকাশ, বিশাল সাইজের একটি নেংটি ইঁদুর জুলজুল করে তাঁকে দেখছে আর কুটকুট করে খাবার কাটছে দাঁতে।

প্রকাশ হাঁ করে চেয়ে রয়েছেন ইঁদুরের দিকে আর ইঁদুর জিজ্ঞাসা করছে তাঁকে, ‘কী দাদা, মাল নামাতে পারলেন না এখনও?’

জগন্ময়কে আদপেই পছন্দ করেন না প্রকাশ। বড় ত্যাঁদড় ছেলে। মাঝে মাঝে তার বেয়াড়া সব রসিকতা শুনে প্রকাশের দুই ভুরু ধনুকের আকার নেয়। কিন্তু আজ ভুরু জোড়া পটাং করে কপালে উঠে গেল। কতক্ষণ যে ওইভাবে চেয়েছিলেন প্রকাশ কে জানে! স্বম্বিত ফিরল জগন্ময়ের কথায়। ইঁদুররূপী জগন্ময় বলছে, ‘কী হল দাদা? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?’

ইঁদুর ভ্যানিশ! জগন্ময় ফিরে এসেছে।

বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে এলেন প্রকাশ। ততক্ষণে জগন্ময় টিফিন সাবাড় করে ফাইলে মন দিয়েছে। শ্যামলা রং, গাবদা-গোবদা চেহারা, মাথার চুলে সামান্য পাক ধরেছে। মুখখানা তাঁর একটু ছুঁচোলো বটে, খোঁচা খোঁচা গোঁফও রয়েছে। তাই বলে নেংটি ইঁদুরের সাথে তাকে গুলিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই।

অফিস ছুটির আগে সেদিন আরও অনেকবার জগন্ময়ের দিকে চোরাগোপ্তা নজর হেনেছিলেন প্রকাশ। না, সেই ধেড়ে ইঁদুর আর দেখা যায়নি।

সেদিন রাতে ঘুম আর আসতে চায় না। বিছানায় ছটফট করতে করতে কার্য-কারণ সূত্র খুঁজছেন প্রকাশ। মা রে, একী দৃশ্য দেখালি মা? কেনই বা দেখালি?

শেষপর্যন্ত তাঁর মাঝারি বুদ্ধিটুকু খাটিয়ে তিনি মায়ের এই লীলাখেলার একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বার করলেন।

রীতিমতো ঘোড়েল ছেলে জগন্ময়। রকমারি কাঁদুনি গেয়ে এর-তার থেকে প্রায়ই টাকা ধার নেয়, ফেরত দেওয়ার নামও করে না। সিগারেট খায়, কিন্তু কেনে না, লোকের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে খায়। হাতটানও রয়েছে বিলক্ষণ। অফিসে এর ডায়রি, তার ডটপেন, মাঝেমাঝেই গায়েব হয়ে যায়। এই তো সেদিন চ্যাটার্জীদার মোবাইল ফোনটা স্রেফ উধাও হয়ে গেল। অন্য অনেকের মতো প্রকাশেরও ধারণা, এসব কীর্তি জগন্ময়ের।

নেংটি ইঁদুরের স্বভাবও তো বোধহয় এমনই। টুকটাক গেঁড়িয়ে চলেছে সারাদিন!

ঘুম আসার আগে প্রকাশ ভাবলেন, তবে কি জগন্ময়ের স্বরূপ ঈশ্বর আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন?

কম্প্যারেটিভ স্টেটমেন্টে তিনটে ভুল থাকায় পরদিন সকালে মেজসাহেবের কাছে বিস্তর ধমক খেলেন প্রকাশ। অনেকক্ষণ সহ্য করার পর মেজাজ চড়ল। প্রকাশ রাজনীতি বোঝেন না, কিন্তু ইউনিয়নের মিটিঙে নিয়মিত হাজিরা দেন, এক কোণে বসে ঝিমোন, আর ঝিমোনোর ফাঁকে ফাঁকে কর্মচারীদের অধিকার সম্পর্কিত কিছু তেজস্বী বাণী তাঁর মস্তিষ্কের ভল্টে জমা হয়ে যায়। হাঁটুর বয়সী মেজসাহেবের হম্বিতম্বি শুনতে শুনতে একসময় প্রকাশ ভাবলেন, সেইসব বাণীর দু’একটা টুকরো এবার বোধহয় তাঁর ছাড়া দরকার। সাহেবের দিকে মুখ তুলে একটা জোরালো বক্তব্য শুরু করতে গিয়ে হঠাৎই প্রকাশ স্ট্যাচু হয়ে গেলেন।

কোথায় মেজসাহেব? হিংস্র এক নেকড়ে রক্ত-জল করা দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। বাণীগুলো গিলে ফেললেন প্রকাশ।

সেই শুরু হল। পরপর দু’দিন অফিসের দু’টি লোকের আসল চেহারা দেখে ফেললেন প্রকাশ। অন্য কারও কাছে এই তাজ্জব ব্যাপারের গপ্পো করে একটু হালকা হওয়ার জো নেই। আলাভোলা মানুষ বলে প্রকাশকে অফিসের লোকজন যে একটু তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দ্যাখে, নিজের মাঝারি বুদ্ধি দিয়েও প্রকাশ তা বেশ টের পান। লোকের কাছে হাসির খোরাক হয়ে লাভ কী? হঠাৎ-পাওয়া দিব্যদৃষ্টিরর কথা প্রকাশ নিজের মনেই চেপে রাখলেন।

তারপর থেকে ব্যাপারটা চলছে। মাঝে মাঝেই চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে যায় আর চেনা-অচেনা মানুষকে নতুন চেহারায় দেখতে পান প্রকাশ। বড় সাহেবের সুন্দরী পি-এ স্বপ্নার নামে বিস্তর কেচ্ছা বাজারে চালু রয়েছে। দিব্যদৃষ্টির দৌলতে প্রকাশ এখন জেনে গেছেন, ওগুলো দুর্জনের রটনা ছাড়া কিছু নয়। এই সেদিন তিনি দেখেছেন স্বপ্নাকে, বড় সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের টেবিলের দিকে হেঁটে চলেছে। আহা, ধবধবে সাদা একটি পায়রা, যেন নাচের তালে দুলকি চালে এগোচ্ছে। কোথাও কোনও মালিন্য নেই। ইউনিয়নের দুঁদে সেক্রেটারি বিপুল মুখার্জি — যার গলাবাজির জোরে মালিকপক্ষকে সদাই কম্পমান বলে ভাবতেন প্রকাশ — তারও আসল চেহারা আর গোপন নেই। ক্যান্টিনে বসে চা খেতে খেতে দূরের টেবিলে স্বপার্ষদ বিপুলকে তিনি দেখেছেন একদিন। যেন বাছুর পরিবৃত নিরীহ এক গরু, বসে বসে জাবর কাটছে। বড়বাবু নির্মল পাকড়াশিকে চিরদিন ভেবে এসেছেন খুব বন্ধুবৎসল লোক, অথচ তার চেহারাটি দেখা গেল একেবারেই অন্যরকম। ধূর্ত শেয়াল একটি, লম্বা জিভ বার করে এদিক ওদিক চাইছে, লালা ঝরছে মুখ থেকে।

মাঝারি মানুষদের জীবনে গোপন করার মতো কিছু বড় একটা থাকে না। কিন্তু প্রকাশের এই দিব্য মহিমার কথা বাড়িতে অপ্রকাশ্য রয়েছে এবং থাকবে। স্ত্রী নীলিমার কাছে একদমই মুখ খোলেননি। পঁচিশ বছরের জীবনসঙ্গিনীর মধ্যে অকস্মাৎ যে রাসভনন্দিনীর দেখা পেয়েছেন, কোন ভরসায় সে কথা জানাবেন প্রকাশ?

গত একবছরে বহুবার দিব্যদর্শন হয়েছে, বহু লোকের আদত চরিত্র জানা হয়ে গেছে, শুধু নিজেকেই প্রকাশ ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। আত্মদর্শনের সুযোগ হয়নি তাঁর। অনেক সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন — অন্যরকম কোনও ছায়া ভেসে উঠছে কি? কিন্তু বৃথা চেষ্টা, তেমন দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য ঘটেনি আজও। আসলে দিব্যদৃষ্টি প্রকাশের ইচ্ছাধীন নয়, চেষ্টা করে তাকে জাগিয়ে তোলা যায় না। সে আসে-যায় নিজের ইচ্ছামতো, অকারণেই মানুষজনের অচেনা চেহারা চোখে আঙুল দিয়ে প্রকাশকে দেখিয়ে দিয়ে যায়। সবই মায়ের ইচ্ছা! মায়ের অপার করুণা দিব্যশক্তির চেহারা নিয়ে ঝরে পড়ছে প্রকাশের মাথায়, কিন্তু মা বোধহয় চান না যে প্রকাশ নিজেকে চিনে ফেলুন।

অনেক টালবাহানার পর মার্চ মাসের সেই অকালবৃষ্টির সন্ধ্যায় শেষ পর্যন্ত প্রকাশের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল। আত্মদর্শন হল তার।

অবশ্য তার আগেও একদিন পাড়ার বেয়াদব বখাটে ছেলে শঙ্কুর দৌলতে সেই ক্লাইম্যাক্সের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটুর জন্য ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি।

মাঝারি মানুষদের অনেক হ্যাপা। কলজে আর কব্জির একটু জোর থাকলে হয়তো প্রকাশ তাঁর অলৌকিক শক্তিকে অর্থশক্তিতে রূপান্তরের একটা উপায় খুঁজে বার করতে পারতেন। দুনিয়ায় কত বাবাজীবনই তো লোকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিব্যি করে-কম্মে খাচ্ছে। কিন্তু মাঝারি বুদ্ধির প্রকাশ যে তাঁর চারিপাশের জগৎটার তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জীবনে কোনওদিন ঘুষ নেননি, কখনও ঘুষ দিতে বাধ্য হলে অনুশোচনায় ভুগেছেন, কোনও ভিখারি এসে হাত পেতে দাঁড়ালে তাকে খেটে খাওয়ার উপদেশ না-দিয়ে টাকাটা-আধুলিটা দিয়ে এসেছেন, রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুর-বিড়ালকে সাধ্যমতো খাবার জোগানোর চেষ্টা করেছেন বরাবর। মায়ের দেওয়া মহাজাগতিক শক্তি তাই স্রেফ জলে গেল, জাগতিক কোনও কাজে লাগল না আর।

কিন্তু সেখানেই তো শেষ নয়, উলটে এই অলৌকিক ক্ষমতা ইদানীং বিলক্ষণ প্রকাশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তাঘাটে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় — এই বুঝি দিব্যশক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে আশেপাশের মানুষজনের ভিতরের চেহারা প্রকাশকে দেখাতে শুরু করে! অফিস যাওয়ার পথে পাশের সিটে এক অচেনা সহযাত্রীর মধ্যে ভয়ঙ্কর সাদা এক ভাল্লুককে আবিষ্কার করে প্রকাশ ভয়ে বাস থেকে নেমে গিয়েছিলেন একদিন। রাস্তার ধারে এক দোকানে খেয়ে পয়সা না দিয়েই পালিয়ে গিয়েছিলেন; না পালিয়ে উপায় ছিল না, দোকানদারের আসনে বসে এক বুড়ো শকুনের ডানা ঝাপটানো দেখে যে বেজায় ভয় পেয়েছিলেন তিনি। আর সেবার সপরিবারে এক মারকাটারি হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়ে তো প্রায় গৃহযুদ্ধের বাধার উপক্রম! ইন্ট্যারভ্যালের সময় বাথরুমে যাবার নাম করে হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন প্রকাশ, আর শো ভাঙার অপেক্ষায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিলেন প্রায় দু’ঘণ্টা। বাড়ি ফিরে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার যাবতীয় তিরষ্কার শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন, কিছুতেই বলতে পারেননি যে পর্দায় একজোড়া সীল মাছের প্রেমপর্ব হজম করার মতো নার্ভের জোর তাঁর নেই।

দিব্য ক্ষমতার আরও অনেক হ্যাপা রয়েছে। পথেঘাটে অচেনা তরুণীদের নিয়ে বড় সমস্যা! সুন্দরী মেয়েদের দিকে আড়চোখে একটু তাকানোর অভ্যাস আছে প্রকাশের। মাঝারি মানুষের নির্দোষ দৃষ্টি। তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া নয়, শুধু সৌন্দর্যের একটু তারিফ করা। কিন্তু ইদানীং এই সামান্য দৃষ্টিসুখ থেকেও প্রকাশ বঞ্চিত। কোনও কোনও তন্বীকে দেখে হৃষ্টপুষ্ট গাভীটি, কাউকে মেনি বেড়াল, কাউকে বা থপথপে কচ্ছপ। ঝগড়ুটে শালিকের চেহারা তো আকছার দেখছেন!

দিব্যদৃষ্টি যে এভাবে দৃশ্যদূষণ ঘটাবে তা কে জানত!

ইদানীং সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রকাশ চিন্তিত। গয়ংগচ্ছ ভাব নিয়ে আর বেশিদিন বোধহয় চলবে না। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর থেকে মেয়ের ডানা গজিয়েছে। প্রায়ই রাত করে ফেরে। কোথায় যায়, কী করে, কে জানে!

সেদিন সন্ধ্যায় গিন্নির পাশে বসে একটু সিরিয়াল দেখছিলেন প্রকাশ। নামজাদা টিভি-স্টারটিকে অবিকল রামছাগলের মতো দেখানোয় বিশেষ মন দিতে পারছিলেন না। মেয়ে ঘরে ঢুকতে অন্যমনস্কভাবে তার দিকে চেয়ে হঠাৎই দেখলেন মেয়ের এক অন্য রূপ। নিপাট একটি ঘুঘু যেন ঝুঁটি দুলিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে আর আড়চোখে দেখছে তাঁকে।

না, এ লক্ষণ ভালো নয়। দিনকাল বড় খারাপ। মেয়ে যে কোন ঘাটে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে কে জানে! ভুবন জুড়ে ফাঁদ তো ছড়ানোই রয়েছে, কোথায় ঘুঘুমণি ফাঁসবে তা কে বলতে পারে?

ছেলেকে নিয়েও চিন্তা কম নয়। কষ্ট করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে এমন দুরাশা তাঁর নেই, কিন্তু ভবিষ্যতে অন্তত টাই ঝুলিয়ে ফেরিওয়ালার কাজ করে বেঁচে-বর্তে থাকতে পারবে। কিন্তু তার আগেই যদি বিপথে যায়? সে-লক্ষণ তো স্পষ্ট। রাস্তার ক্রিকেটের আসরে সেদিন শ্রীমানকে দেখলেন — প্রাচীরের উপর পা ঝুলিয়ে বসে হ্যা-হ্যা করে হাসছে। অবিকল মুখপোড়া বাঁদর, ডালে বসে দাঁত খিঁচোচ্ছে যেন! পাশাপাশি দেখলেন ওবাড়ির বাবলুকেও — রান নেওয়ার জন্য ছুটছে। আহা, টগবগে টাট্টু ঘোড়াটি যেন! ও-ছেলে জীবনের পথেও অনেকদূর দৌড়বে। আর তাঁর নিজেরটি? নির্ঘাত মুখ থুবড়ে পড়বে মাঝরাস্তায়।

এতদিন শুধুই চিন্তা ছিল, এবার দুশ্চিন্তা। রবিবার সকালে বাজারে হঠাৎ দেখা অবিনাশের সঙ্গে। পুরনো প্রতিবেশী, এতদিন সুসম্পর্কই ছিল দু’জনের। কিন্তু অবিনাশের মধ্যে একদিন ধূর্ত খ্যাঁকশিয়ালের ছায়া দেখার পর থেকে প্রকাশ তাকে এড়িয়ে চলেন। বাজারের মধ্যে মুখোমুখি পড়ে যাওয়ায় এড়ানোর উপায় আর রইল না। রাস্তার এক ধারে প্রকাশকে টেনে নিয়ে গিয়ে সিগারেট খাওয়াল অবিনাশ, ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথাই বলল, ধান ভাঙতে সে বিস্তর শিবের গীত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন অবিনাশ আসল কথাটা পাড়ল, তখন প্রকাশ একদম স্পিকটি নট।

শঙ্কু? বিজন ঘোষের বখাটে ছেলেটা? সে তো পাখোয়াজ ছোকরা! থিয়েটারে নাকি একটিং করে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স হল, একটা চাকরি জোটানোর মুরোদ নেই, নিজেকে ভাবে বুঝি বোম্বের হিরো! দিনরাত বাইকে করে চক্কর মারছে। অষ্টপ্রহর তার কানে সেলফোন আর হাতে সিগারেট। প্রকাশকে দেখলে এখনও সিগারেট লুকোয় বটে। কিন্তু ছোকরাকে তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। নাটক-ফাটক বিশেষ দেখেন না প্রকাশ, কিন্তু নিজের মাঝারি জ্ঞানগম্মি দিয়ে তিনি বোঝেন যে, মোদো-মাতাল আর লক্কা পায়রা ছাড়া আর কেউ ও-লাইনে যায় না।

এহেন শঙ্কু মাস্তানের বাইকের পিছনে প্রিয়াঙ্কা? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল প্রকাশের। মুখের ভাব দেখে সেকথা বুঝে নিয়ে অবিনাশ নিস্পৃহ সুরে বলল, ‘নিজের চোখে না-দেখলে কথাটা তোমায় বলতাম না। মেয়েকে একটু চোখে চোখে রেখো।’

মনে বড় অশান্তি। বেচারি ঘুঘুমণি এ কোন ফাঁদে পা দিল?

অবশ্য বিজন ঘোষের ছেলে শঙ্কু পাত্র হিসাবে ফ্যালনা নয়। বিজন ঘোষের পয়সা আছে, নিজেদের দোতলা বাড়ি, একটিই মাত্র ছেলে। দেখতে-শুনতে যে খুব খারাপ তা-ও বলা যাবে না। এমন ছেলেকে জামাই করতে পারলে অনেক মেয়ের বাপই হয়তো বর্তে যেত। কিন্তু প্রকাশ মণ্ডল পিছিয়ে পড়া লোক। শঙ্কু ঘোষের মতো থিয়েটারওয়ালাকে জামাই আর বিজন ঘোষের মতো রেডিও-টিভির দোকানদারকে বেয়াই হিসেবে কল্পনা করতেও তাঁর হৃৎকম্প হয়।

সেদিন রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে আড়চোখে মেয়েকে লক্ষ করছিলেন প্রকাশ। বারকয়েক চোখাচোখি হওয়ার পর মেয়ে হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘কী দেখছ বলো তো বাবা? আমি কি চিড়িয়াখানার জন্তু?’

অপ্রস্তুত হয়ে প্রকাশ বললেন, ‘আহা, রাগ করিস কেন?’

আর মনে মনে বললেন, ‘না, তুমি একটি বাস্তুঘুঘু। যার জমিতে ধান খাচ্ছ, চিড়িয়াখানার জন্তু হল সে। যেমন-তেমন জন্তু নয়, আপাদমস্তক একটি উল্লুক!’

নানান সূত্র থেকে আরও খবর আসছে। শঙ্কুর সাথে প্রিয়াঙ্কাকে দেখেছে আরও কেউ কেউ; বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায়।

শঙ্কিত প্রকাশ ভাবলেন, ‘এবার গিন্নির কানে কথাটা তোলা দরকার।’

‘শুনছ, মেয়ে কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে সে খবর রাখো?’

‘কেন, কী হল?’

‘পাড়ার একটা বখাটে ছেলের সঙ্গে নাকি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার কানে কিছু আসেনি?’

ঝাঁঝিয়ে উঠে গিন্নি বললেন, ‘এসব খবর কে রটাচ্ছে? তাসের আড্ডার বন্ধুরা বুঝি?’

ঘাবড়ে গিয়ে প্রকাশ বললেন, ‘আহা, চটো কেন? মেয়ে বড় হয়েছে, চিন্তা হবে না একটু?’

‘থাক, এত বছর তো চিন্তা করে উল্টে দিয়েছ! এখন আর চিন্তা না-করলেও চলবে।’

গিন্নি এখন রাগী বিড়ালী। বেশি ঘাঁটালে আঁচড়ে-কামড়ে দিতে পারে। প্রকাশ রণে ভঙ্গ দিলেন।

মন অশান্ত, মেজাজ সারাদিন টং। দিব্যদর্শনের হাত থেকে তবু রেহাই নেই। আজকাল যত লোকের কাছাকাছি আসছেন প্রকাশ, প্রায় সবার মধ্য থেকে তাদের আত্মার বিচিত্র রূপ ফুটে বেরোচ্ছে। রাস্তা, বাড়ি, অফিস — সর্বত্র নাজেহাল। মনকে বোঝাতে চাইছেন, সব মানুষেরই অন্তরে ঈশ্বরের বাস। অথচ সে-ঈশ্বর হরবখত নানান হিংস্র জন্তুর চেহারায় সামনে এসে হাজির! বাসের কন্ডাক্টরকে দেখছেন বুলডগ, অফিসের অর্ডার-সাপ্লায়ারটি হায়না, এমনকি পানের দোকানের আপাত-নিরীহ ছোকরাটি যেন কেউটে সাপের চেহারা নিয়ে ছোবল মারতে আসছে। হা-ক্লান্ত প্রকাশ ক্ষণে ক্ষণে প্রার্থনা জানাচ্ছেন, ‘মা, জগতের এমন রূপ আর দেখাস নে মা!’ মা নির্বিকার। প্রিয়াঙ্কার মায়ের মতো তাঁরও দুই কানে তুলো।

এমন দিশেহারা অবস্থার মধ্যেই এল সেই শনিবার, যেদিন আত্মদর্শন হলেও হতে পারত। শরীরটা তেমন জুত না-থাকায় তাসের আড্ডা থেকে সেদিন একটু আগেই উঠে পড়েছিলেন প্রকাশ। বাড়ি ফিরে দেখলেন, ড্রয়িংরুম আলোকিত করে বসে রয়েছে স্বয়ং শঙ্কু। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে নবাবি স্টাইলে সোফায় বসে লেকচার ঝাড়ছে। মা আর মেয়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে মহাপ্রভুর আগমনে দু’জনেই কৃতার্থ!

একটি কথাও না-বলে শোওয়ার ঘরে ঢুকলেন প্রকাশ। শার্ট-প্যান্ট খুলে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেললেন। লুঙ্গিখানা টেনে নিলেন আলনা থেকে।

পাশের ঘরে লেকচার বন্ধ হয়েছে। এখন ফিসফিসানির পালা।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রকাশ।

কার বাড়ি? কার সংসার? একনিষ্ঠ বলদের মতো এই সংসারের জোয়াল ঠেলে চলেছে কে? আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালেন প্রকাশ। কিছু কি বলবেন তিনি? জানতে চাইবেন, কোন সাহসে এই পরিবারের লোকজন তাঁর অগোচরে ষড়যন্ত্র পাকায়?

নিজেকে দেখছেন প্রকাশ। রাগী সিংহের মতো দেখতে লাগছে কি তাঁকে?

না, তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা হোক, এই মুহূর্তে একটা ভয়ঙ্কর প্রতিবাদ রাখাটা খুব জরুরি।

হঠাৎই ঘর থেকে ছিটকে বেরোলেন প্রকাশ। মা-মেয়ে আর হবু জামাই চমকে ফিরে তাকিয়েছে তাঁর দিকে। প্রকাশের দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, দু’চোখে আগুন, পরনে আন্ডারওয়্যার আর স্যান্ডো গেঞ্জি।

ফেটে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে প্রকাশ হঠাৎ ভিজে তুবড়ির মতো নিভে গেলেন। দ্বিগুণ বেগে ফিরে এলেন শোওয়ার ঘরে। হাঁপাচ্ছেন।

কোথায় শঙ্কু? সোফায় বসে রয়েছে একটি ডালকুত্তা, জিঘাংসার চোখে তাঁর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। লাফিয়ে পড়ে টুঁটি চেপে ধরার জন্য তৈরি।

কপাল থেকে ঘাম মুছে প্রকাশ ভাবলেন, ‘ওঃ, জোর ফাঁড়া কেটে গেছে!’

আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবার দেখলেন প্রকাশ। নাঃ, সেই একই ছবি। প্রকাশ প্রকাশই আছেন, সেই মাঝারি মধ্যবিত্ত। কল্পনার চোখে দেখলেন, তাঁর গায়ের রংটি যেন সাদায়-কালোয় মেশানো, ছোট ছোট দুটি শিং টাকের দু’দিক থেকে উঁচিয়ে রয়েছে, দু’চোখে করুণ দৃষ্টি।

মনে মনে বললেন, ‘ছাগল। ওহে প্রকাশ মণ্ডল, তুমি একটা রামছাগল।’

কয়েকটা দিন বড় মনমরা হয়ে কাটালেন প্রকাশ।

অফিস যাওয়ার পথে একদিন নায়ক-নায়িকাকে একসাথে দেখেছেন। বাইকে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে শঙ্কু, ঘুঘুমণি গর্বিত ভঙ্গিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

গড়াত না, এতদূর জল গড়াত না, শুধু যদি ঠিক সময়ে নিজের স্বরূপটি দেখতে পেতেন। সিংহরূপে সংস্থিত হয়ে ঘাড় ধরে তাড়াতেন ওই ছোকরাকে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় দিব্যদর্শনের টেকনোলজি ফেল পড়ে গেল যে!

অফিসের সৌম্য বেশ পণ্ডিত ছেলে, প্রচুর পড়াশোনা করে। একদিন তাকেই জিজ্ঞাসা করলেন প্রকাশ, ‘আচ্ছা, পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী প্রাণী কে? সিংহ?’

সৌম্য বলল, ‘দূর, সিংহ তো কুঁড়ের হদ্দ! দিনের মধ্যে কুড়ি ঘণ্টা পড়ে পড়ে ঘুমায়। সিংহীরা শিকার করে, তাদের কাছ থেকে কেড়েকুড়ে লায়নস শেয়ারটুকু বুঝে নেয়।’

প্রকাশ জানতে চাইলেন, ‘তাহলে সাহসী লোকদের লায়নহার্টেড বলে কেন?’

ঠোঁট বাঁকিয়ে সৌম্য বলল, ‘আরে, ওরকম কত অদ্ভুত কথা বাজারে চালু আছে! সত্যিকারের সাহসী প্রাণী কে জানেন? সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। কিংবা ধরুন, আমাজনের গোরিলা। এদের কাছে সিংহ? ফুঃ, নস্যি!’

প্রকাশ একটু আশ্বস্ত হলেন। ভুলটা তাহলে তাঁরই। ভবিষ্যতে সেরকম পরিস্থিতি এলে — সিংহ না — রয়্যাল বেঙ্গলের চেহারাটাই খোঁজার চেষ্টা করবেন নিজের প্রতিবিম্বের মধ্যে।

কিন্তু রবাহুত অতিথির মতো তেমন পরিস্থিতি যখন সত্যিই এসে হাজির হল, তখন প্রকাশের হাতের কাছে নিজের শ্রীমুখ দর্শনের উপযোগী কোনও আয়না নেই।

তাসের আসর থেকে বেরিয়ে ফিনফিনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরছিলেন প্রকাশ। রাত প্রায় ন’টা। জোড়ামন্দিরের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

কী হচ্ছে ওখানে? আবার কোনও সিরিয়ালের শুটিং বুঝি?

অনেকটা শঙ্কুরই মতো দেখতে এক ছোকরা। একা নয়, সাথে জনাচারেক সাগরেদ। সালোয়ার-কামিজ পরা এক তরুণী। ছোকরা তার হাত টেনে ধরে রেখেছে। মেয়েটির ওড়না মাটিতে লুটোচ্ছে, পোশাক জলে-কাদায় মাখামাখি। মুখে কোনও শব্দ নেই, প্রাণপণে হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করছে শুধু। চার সাগরেদ হাসছে। হ্যালোজেনের রঙিন আলোয় প্রকাশ দেখছেন, জনকয়েক লোক ছড়িয়ে রয়েছে দূরে। এরা পথচারী, এরা দর্শক। এরা নিরাপদ দূরত্বে।

সবাই যখন স্থাণু, একলা প্রকাশ এগিয়ে গেলেন। থমকেও গেলেন বাঁধা পেয়ে। কে যেন হাত বাড়িয়ে তাঁর পথ আটকেছে। হাতের মালিক জিজ্ঞাসা করছে, ‘কোথায় যাচ্ছেন, কাকু?’

প্রকাশের গলা শুকিয়ে কাঠ, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, বুকের ভিতর হাতুড়ির ঘা। চেষ্টা করে বললেন, ‘কী হচ্ছে এখানে?’

নায়ক বলল, ‘আমাদের পাসসোনাল ব্যাপার। আপনি যান, কেটে পড়ুন।’

হ্যাঁ, কেটে পড়াই নিয়ম এখানে। অনেক উঁচু মাপের মানুষও তা-ই করত। কিন্তু মাঝারি মানুষ প্রকাশ যে তা পারছেন না! হ্যালোজেনের রঙিন আলোয় দেখছেন মেয়েটিকে। তার মুখ জলে মাখামাখি। চোখের জল? বৃষ্টির জল?

আরও এক পা এগিয়ে গেলেন প্রকাশ। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে বলো তো মা?’

এক হাত ছেলেটির মুঠোয় ধরা, সেই অবস্থাতেই শরীরটা মুচড়ে প্রকাশের পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল মেয়েটি। এই প্রথম শব্দ বেরোল তার গলা থেকে। কাঁদতে কাঁদতে সে বলছে, ‘আমাকে বাঁচান।’

হয়তো এসময়ে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে রয়্যাল বেঙ্গলের লক্ষণ খোঁজা উচিত ছিল প্রকাশের, তাহলে মনে বল আসত। কিন্তু দিব্যদৃষ্টির কথা তাঁর এখন মনে নেই। তিনি শুধু মেয়েটিকে দেখছেন। কে এই মেয়ে? প্রিয়াঙ্কা? না কি প্রিয়াঙ্কার মতো দেখতে অন্য কেউ?

প্রকাশ নীচু হয়ে মেয়েটিকে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই নায়ক মেয়েটির হাত ছেড়ে দিয়ে প্রকাশের কলার চেপে ধরল। প্রকাশ সোজা হলেন, এক ঝলক তাকিয়ে দেখলেন গণ্ডারের মতো তার মুখখানার দিকে। তারপর হঠাৎই ঝাঁপিয়ে পড়ে অনভ্যস্ত হাতে একটি ঘুষি ছুঁড়লেন। মাঝারি মাপের ঘুষি, গণ্ডার বোধহয় টেরও পেল না। পরক্ষণেই কয়েক মণ ওজনের একটা পাথর যেন প্রকাশের নাকের উপর এসে আছড়ে পড়ল। রাস্তার উপর ছিটকে পড়েছেন প্রকাশ। কারা যেন চিৎকার করছে দূরে। ছুটে আসছে কারা যেন। ভিজে কালো এসফল্টে মুখ গোঁজার আগে প্রকাশ দু’বার বিড়বিড় করে বললেন, ‘রয়্যাল বেঙ্গল, রয়্যাল বেঙ্গল।’

জ্ঞান ফেরার পর প্রকাশ দেখলেন, ঘরের মধ্যে অনেক লোকের ভিড়। তাঁর পায়ের কাছে খাটের উপর বসে রয়েছে কালো-ঝুঁটি লাল-গালের অপরূপা এক বুলবুল। এই বুঝি সেই মেয়ে, প্রিয়াঙ্কার মতো যাকে দেখতে? ওই তো প্রিয়াঙ্কা-বুলবুলের পাশে ঘুঘুমণি — কী চমৎকার জুটি বেঁধেছে দুটিতে। আর ওই যে ঘুঘুমণির মা — মাঝবয়সী রাজহংসীটি যেন! লম্বা-গলা এক জিরাফ খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলছে, ‘আপনি না-থাকলে আমার মেয়েটা আজ শেষ হয়ে যেত। আপনাকে দেখেই তো সাহস পেয়ে বাকি সবাই…।’ মস্ত শিঙের ফাঁকে বিকটদর্শন ক্যামেরা গুঁজে এক হরিণ কোত্থেকে এসে উদয় হল। পাশেই এক ভোঁদড়, হাতে নোট-বই, পেনসিল। ভোঁদড় বলছে, ‘চ্যানেল থেকে আসছি স্যার, একটা ইন্টারভিউ…’

ভালোবাসার যাবতীয় অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অবশেষে একটু একা। প্রথম সুযোগেই পাশের ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রকাশ। নাকের উপর দিয়ে গালের এপাড়া-ওপাড়া জুড়ে লিউকোপ্লাস্ট। কপাল আর গালে মারকিউরোক্রোমের লাল ছোপ। মাথা জুড়ে ভোঁ-ভোঁ, কোমরে অসহ্য ব্যথা। মনটা কিন্তু ফুরফুরে, হাওয়ায় উড়ছে। প্রকাশ চেয়ে রয়েছেন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। এইবার পর্দা সরে যাচ্ছে, প্রকাশ বুঝতে পারছেন, দিব্যদৃষ্টি জেগে উঠছে তাঁর ভিতরে। অবশেষে তিনি দেখতে চলেছেন নিজের আসল চেহারা।

কী দেখবেন?

আফ্রিকার সিংহ?

সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল?

আমাজনের গোরিলা?

প্রাণভরে স্বরূপ দেখলেন প্রকাশ। তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

একটি মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর সামনে।

মাঝারিই, তবু গোটা একটা মানুষ।


About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...