বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য — প্রথম পর্ব

বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য -- সুকুমারী ভট্টাচার্য

সুকুমারী ভট্টাচার্য 

 

বিশিষ্ট ভারততাত্ত্বিক ও পুরাণবিদ সুকুমারী ভট্টাচার্য (১৯২১-২০১৪) অধ্যাপনা করেছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি – তিন ভাষাতেই নিবিড় অধিকার তাঁর অধ্যয়ন ও মননকর্মকে দিয়েছে গভীরতা ও বিস্তার। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত বহু গ্রন্থের প্রণেতা, যেগুলি দেশে বিদেশে সমাদৃত হয়েছে।

 

ভূমিকা

সংশয় ও নাস্তিকের মধ্যে প্রকৃতিগত, ব্যাপ্তিগত এবং মাত্রাগত পার্থক্য আছে। সব সংশয় নাস্তিক্য থেকে আসে না। আবার মূল নাস্তিক্যও সংশয়ের চেয়ে গভীর ও ব্যাপক। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংশয় থাকতে পারে আস্তিকেরও। সংশয় পরিসরে ছোট, গভীরতাতেও। নাস্তিকের সংজ্ঞা হল ‘ঈশ্বারাপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ যে ঈশ্বরকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে না, এবং ‘বেদপ্রামাণ্যবাদী’ অর্থাৎ বেদকে প্রামাণ্য বলে মানে না। এ ছাড়া উপনিষদে দেখি, যে পরলোকে বিশ্বাস করে না সে-ও নাস্তিক। পরলোক মানে শুধু স্বর্গনরক নয়, পরলোক থাকতে গেলেই মরণোত্তর আত্মা থাকতে হবে। তাই যে পরলোক নয়, শুধু ইহলোককেই স্বীকার করে সে-ও নাস্তিক। পরলোককে স্বীকার করলেও ঈশ্বরকে স্বীকার নাও করা যেতে পারে, এবং এ দুটি স্বীকার করেও বেদের প্রামাণ্যতা যে মানে না সে-ও নাস্তিক। হেমচন্দ্রের অভিধান বলে, নাস্তিকের প্রতিশব্দ হল, বার্হস্পত্য, চার্বাক ও লোকায়তিক। যে ‘নাস্তি’, শব্দ থেকে নাস্তিক শব্দের ব্যুৎপত্তি, তার তিনটি অর্থ হতে পারে — যে ঈশ্বর মানে না, যে পরলোক মানে না এবং যে বেদের প্রামাণ্য মানে না। এখনই দেখা গেল ঈশ্বর, পরলোক ও বেদে বিশ্বাস পরস্পর-নিরপেক্ষ; তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে এ তিনটিই ছিল বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের তিনটি মূলস্তম্ভ। পরবর্তীকালে বুদ্ধের আগে যেসব বেদবিরোধী প্রস্থানের উদ্ভব হয়েছিল তারা সকলেই বেদের প্রামাণ্যে অবিশ্বাসী, ঈশ্বরের অস্তিত্বেও আস্থাহীন, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই পরলোকে বিশ্বাসী; এর সঙ্গে বৌদ্ধ, জৈন ও আজীবিকরাও আছেন। অথচ এই পরলোক নিয়ে ব্রাহ্মণসাহিত্য, আরণ্যক ও উপনিষদে নানা সংশয়। শাস্ত্রমতে এ সংশয়ও নাস্তিক্য, তবে এ নাস্তিক্যের সংজ্ঞা শুরু হয় উপনিষদে।

ধ্রুপদী নাস্তিক

এই কালবিন্দুতে ধ্রুপদী নাস্তিক আবির্ভূত হন। তাদের সম্পর্কে সমাজের তীব্র তিক্ততাতেই বোঝা যায় কোনও একটি সুসংহত ছকে এরা আর পরস্পর-সাপেক্ষতায় সম্পৃক্ত নয়। এর প্রাথমিক সূত্রপাত কিন্তু পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রী নিয়ে পারস্পরিক নির্ভরতা থেকে। নাস্তিক্যের ইংরেজি ‘এথিইজম’, এ শব্দটির ব্যুৎপত্তি, a-theos থেকে অর্থাৎ ‘অনীশ্বর’ বা ‘ঈশ্বর না মানা’। একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্মে আত্মা ও পরলোক ঈশ্বর-সমর্থিত তত্ত্ব, অতএব ঈশ্বরকে না মানার সঙ্গেই এগুলো সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে এই তিনটি তত্ত্ব : বেদ, ঈশ্বর ও পরলোক পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ কেউ এর মধ্যে দুটিকে বিশ্বাস করে, কেউ একটিকে, কেউ-বা কোনওটিকেই বিশ্বাস করে না; যদিও এখানেও এই তিনটি পরবর্তী যুগে পরস্পর-সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এবং বেদ বলতে শুধু মন্ত্রব্রাহ্মণ-উপনিষদই বোঝাত না, তার সঙ্গে যজ্ঞও বোঝাত, যেটা বেদের প্রায়োগিক দিক। এই যজ্ঞ সম্বন্ধে সংশয়, অনীহাও নাস্তিক্যেরই একটি প্রকাশ বলে মনে করা হত। যজ্ঞের নানা প্রবক্তা ছিল, নানা গোষ্ঠীর ও তার নানা রূপভেদ ও বিবর্তন ঘটেছিল; কিন্তু এসবের বাইরে উত্তর ভারতে নানা বিকল্প রূপের মধ্যেও একটি বিমূর্ত ‘যজ্ঞ’ ব্যাপার মানুষের চেতনায় ও আচরণে ছিল, নাস্তিকের ঔদাস্য ও অনাস্থা এই যজ্ঞ ব্যাপারটাকে অবলম্বন করেই।

যজ্ঞতত্ত্ব অপরিহার্যরূপে বেদের প্রতীকী, এমনকি বেদের বিবক্ষিতের সারবস্তু বলেই স্বীকৃত ছিল। তাই বেদোক্ত যজ্ঞক্রিয়াকে না মানাও নাস্তিক্য। তখন আস্তিক গার্হস্থ্য আশ্রমে থেকে নানা যজ্ঞক্রিয়া করবে, এইটেই ছিল সামাজিক অনুশাসন; তার বিরুদ্ধাচরণ সমাজ সম্পর্কে একটা প্রতিস্পর্ধা, এবং সে-সমাজ তো শাসিত হত এই বেদ দিয়েই, কাজেই এই বিরুদ্ধাচরণ নাস্তিক্য বলেই অভিহিত হত। ক্রমে পরস্পর সংঘর্ষে উত্তীর্ণ হওয়া। যজ্ঞকারী ও নাস্তিক উভয়েই (যজ্ঞ) কর্ম অর্থে গোষ্ঠীগত আনুষ্ঠানিক আদানপ্রদান-নির্ভর কর্মকে পরিহার করে, উভয়ের পার্থক্য হল, বেদের ব্যক্তিগত কর্মের সত্য মিথ্যা বিষয়ে বেদের সার্বভৌম অনুজ্ঞা।… যজ্ঞকারী (ও তার আস্তিক বংশধর) মানুষের লোকাতীত স্তরে উত্তরণের জন্যে লোকাতীত অনুশাসনের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা সমর্পণ করে। অপরপক্ষে, নাস্তিক লোকাতীতকেই বিসর্জন দেয় ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্যে [It is no longer a question of denying a particular persons (or groups) sacrifice, but of denying the abstract institution of sacrifice. The doctrine of sacrifice is either true or false. It is at this point that the classical nastika makes his appearance. The utter acerbity of their relations signifies the fact that they are no longer bound together in a complementary pattern. The initial point is, however, the breakthrough out of mutual dependence in the contest for the goods of life. Both ritualist and nastika reject karman in the sense of the (sacrificial) “work” of agnostic exchange between two parties. What divides them is the truth or falsehood of the doctrine of individual karman regulated by transcendent Veda junction…. The ritualist (and his astika progeny) in order to safeguard man’s transcendence subjects his freedom to transcendent injunction. The nastika, on the other hand, surrenders his transcendence in favour of man’s freedom — J.C. Heesterman, p. 184]। কর্মকাণ্ডের শেষদিকে দেহাতীত আত্মা দেখা দেয় বৈদিক সাহিত্যে; যজ্ঞেও পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রীর অনেকটাই ভাগ হত পুরোহিত ও যজমানের মধ্যে। পরে যখন আত্মার কল্পনা উদিত হল তখন যজ্ঞকারীরা লোকাতীত সত্তায়, আত্মায় উত্তরণ করলেন যজ্ঞতত্ত্বের দ্বারা এবং এইখানে ঘটল নাস্তিকের সঙ্গে তার মৌলিক বিচ্ছেদ। বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করতে গিয়ে সে তার ব্যক্তিসত্তার অর্থাৎ স্বাধীন চিন্তার অধিকার বিসর্জন দিল লোকাতীত তত্ত্বের কাছে, আর নাস্তিক সেই লোকাতীতত্ত্বকে বিসর্জন দিল ব্যক্তিসত্তার, চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে। ব্যক্তিচিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার দুটি প্রধান অর্থ : বেদের প্রামাণ্য যেহেতু প্রত্যক্ষ নয়, অর্থাৎ দেবতা, যজ্ঞ, ধর্মাচরণ নিয়ে বেদ যত কথা বলছে তা যেহেতু প্রত্যক্ষ নয় তাই তাকে বিসর্জন দিল এবং পরে এরই সঙ্গে বিসর্জন দিল দেহব্যতিরিক্ত আত্মাকে। বিনিময়ে সে তার চিন্তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখল, অর্থাৎ যে-বিশ্বাসের সপক্ষে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি সে খুঁজে পাচ্ছে না তাকে সে অনায়াসে পরিহার করল। উপনিষদে স্বপ্ন ও জাগ্রত অবস্থার প্রসঙ্গে বারবার বলা হয়েছে স্বপ্নে মানুষ বহু অবাস্তব বিষয় দেখে, পরে জেগে উঠে জানতে পারে যে সে-দেখাগুলো সম্পূর্ণ অলীক এবং যে-জগতে জেগে ওঠে সেটাই বাস্তব। তা হলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ বাস্তব জগতের আপেক্ষিক সত্যতাই স্বীকার করা হল।

আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়ী

প্রত্যক্ষ মানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তাকে স্বীকার করতে গেলে বেদের অতিলৌকিক অনুজ্ঞা স্বীকার করা যায় না। বহু প্রস্থানই বেদের প্রামাণ্যতা মানতে পারেনি, সেগুলির মধ্যে প্রধান হল বৌদ্ধমত, আত্মা ও পরলোক মানলেও বৌদ্ধধর্ম বেদকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেনি, যজ্ঞকেও অস্বীকার করেছে। ‘যখন ঐতিহ্যের অভ্যন্তরীণ প্রাস্থানিক বস্তু বিপর্যস্ত হচ্ছে তখনই বাইরের (বাহ্য) ও বিরুদ্ধ (নাস্তিক) বৌদ্ধমতের প্রতিস্পর্ধার বিরুদ্ধে বেদকে উদ্ধৃত করা হয়ে থাকে।… ঐতিহ্যগত (আস্তিক) ও ঐতিহ্যবহির্ভূত (নাস্তিক) মতের পার্থক্য হল ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে মৌলিক ও পরিচিত লক্ষণ। ঐতিহ্যবাহিত ভারতীয় স্তোত্রসাহিত্যে যেমন, তেমনই অধুনাতন ভারতীয় দর্শনের সমীক্ষাতেও স্পষ্ট।’ [It (Veda) is invoked against the internal sectarian disintegration of the tradition, as well as against the “external” (bahya) and heterodox (nastika) challanges of Buddhism…. The distinction between “orthodox” (astika) and “heterodox” (nastika) systems is among the most basic and familiar traditional Indian doxographies as it is in modern surveys of Indian philosophy — Halbfass : p. 16 and p. 237]। প্রাচীন গ্রিক ভাষাতেও নাস্তিকতার সংজ্ঞা আদিতে শুধু ঈশ্বরে (অর্থাৎ দেবদেবীতে) অবিশ্বাসীকেই বোঝাত না কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক বা না করুক, রাষ্ট্রের সর্বস্বীকৃত দেবতাদের (অস্তিত্বে) অবিশ্বাসীকেও বোঝাত। রোম সাম্রাজ্যে (নাস্তিক) খ্রিস্টান অজ্ঞেয়বাদীদের বোঝাত। [Greek (AEOS) atheos originally used in Greece of all those whether they believed in god or not, disbelieved in the official gods of the state…. In Roman empire (the word) was used by pagans to denote Christian agnosticism. — The Oxford Dictionary of the Christian Church, p. 100]। দর্শনের কোশগ্রন্থ বলে : ‘সংশয়বাদ একটি সমালোচনাশ্রয়ী দার্শনিক মনোভাব হিসেবে জ্ঞানের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে দার্শনিকদের ও অন্যদের যে দাবি, তাকে প্রশ্ন করে।’ [Macmillan Encyclopaedia of Philosophy : Skepticism, Vol. VII, p.499]। গ্রিক ‘স্কেপটিকস’ শব্দটি অনুসন্ধিৎসু এই অর্থ বহন করে; সংশয় শব্দটির অর্থ অনুসন্ধান। কোনও নিশ্চিত বিশ্বাসের অভাবই সূচিত করে ‘সংশয়’। ইংরেজি doubt শব্দটি ব্যুৎপত্তির দিক থেকে double শব্দটির সঙ্গে অন্বিত, অর্থাৎ এর মুখ্য অর্থ দ্বিত্ব, ‘এও হয়, হয়তো ও-ও হয়’ এই মনোভাব। লাতিন dubtis প্রাচীন লাতিন dubo, জার্মান zweifel এসবের অর্থ দ্বিত্বতা, অর্থাৎ স্থির সিদ্ধান্তের অভাব, দোলাচলতা। তা হলে প্রাচীন গ্রিক, লাতিন, জার্মান সংশয়ের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল, দ্বিধা, অর্থাৎ নিশ্চয়তার অভাব। এর একপ্রান্তে আছে বিশ্বাস, যার মধ্যে অন্তর্নিহিত দৃঢ়তা, স্থিরতা, অসংশয়িত প্রত্যয়; অপরপ্রান্তে আছে ঠিক তার বিপরীত মনোভাব : অবিশ্বাস, নাস্তিক্য, এর মধ্যেও আছে দৃঢ়তা ও অসংশয়। আস্তিকের যেমন দ্বিধা নেই যে ঈশ্বর, পরলোক, আত্মা, বেদ সবই আছে এবং সবই প্রামাণ্যক, অসংশয়িত, ঠিক তেমনই নাস্তিকের চিন্তাতেও কোনও যথার্থ দ্বিধা নেই। আস্তিকের মতোই নাস্তিকেরও কোনো সংশয় নেই, সে সংশয়ী নয়, বরং নিশ্চিতই জানে বেদ, আত্মা, পরলোক, ঈশ্বর বা দেবতারা কেউই কিছুই বাস্তবিকপক্ষে নেই বা প্রমাণসিদ্ধ নয়। এ কল্পনাগুলি তার জীবনচর্যায় অকিঞ্চিৎকর, নিরর্থক এবং বাস্তবে নিষ্প্রয়োজন। অর্থাৎ আস্তিক ও নাস্তিক দুজনেরই তত্ত্বগত অবস্থান ইতিবাচক, এবং স্পষ্ট; শুধু সংশয়ীর অবস্থান ইতি-নেতিবাচক, অতএব অস্পষ্ট। অজ্ঞেয়বাদীর অবস্থানও ইতি-নেতির মধ্যবর্তী, কিন্তু স্পষ্ট। সে বলে, কিছু আছে কি না, কেউ আছে কি না আমি জানি না, জানা যায়ও না। তার জ্ঞানে দোলাচলতা নেই, থাকা-না-থাকা সম্বন্ধে তার না জানাটা খুবই দ্ব্যর্থহীন : সে নিশ্চিত জানে যে, সে নিশ্চিতভাবে কিছুই জানে না। থাকা ও না-থাকার উভয়মুখী সম্ভবনাকে সে স্বীকার করে মাত্র; এবং প্রচ্ছন্নভাবে সে নিশ্চিতভাবে জানে না, কিছু আছে কি না, থাকলেও জানা সম্ভব কি না। ঠিক এই অবস্থান প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে কোথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মাঝে মাঝে ‘কে জানে’ এ ধরনের বাক্যাংশের সঙ্গে যুক্ত থাকলে অজ্ঞেয়বাদের আভাস যেন পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে স্পষ্ট নাস্তিক্য এবং স্পষ্ট সংশয়ের প্রকাশই বেশি পাওয়া যায়।

গ্রিসের মতো প্রাচীন ভারতবর্ষেও যজ্ঞক্রিয়াই ধর্মাচরণ ছিল বলে যজ্ঞে ও তৎসংশ্লিষ্ট দেবদেবীতে অবিশ্বাসই ছিল নাস্তিক্য। নাস্তিক্য খুব ব্যাপক শব্দ, একদিকে কোনও একজনের মনে বিশ্বাসের জগতের সমগ্র ব্যাপারটা নিয়ে আমূল অবিশ্বাস জন্মায় কদাচিৎই, কিন্তু খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত ব্যাপারে, যজ্ঞপ্রক্রিয়ায়, বিশেষ বিশেষ দেবতা সম্বন্ধে, তাঁদের উৎপত্তি, অস্তিত্ব, কার্যক্ষমতা, যজ্ঞক্রিয়ার যাথার্থ্য সম্বন্ধে বহু মানুষের মনেই জাগতে পারে। এ ধরনের সংশয় সংহিতা ব্রাহ্মণে, অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের সাহিত্যে বিক্ষিপ্তভাবে বহুবার ব্যক্ত হয়েছে, এগুলি সংশয়, যদিও এর মধ্যে কিছু কিছু নাস্তিক্যের ধারঘেঁষা। নেম ভার্গব যখন তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দেবতা ইন্দ্র সম্বন্ধে অসংশয়িত উচ্চারণ করেন, ইন্দ্রকে কে জন্মাতে দেখেছে? নেম ভার্গব বলেছেন, ইন্দ্র বলে কেউ নেই; তখন সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খণ্ড সংশয় থেকে অখণ্ড নাস্তিক্যে উত্তীর্ণ হয়ে যায়, কারণ তখন ধর্ম হল যজ্ঞ এবং যজ্ঞের মুখ্য দেবতাই ইন্দ্র, কাজেই ‘ইন্দ্র নেই’ বলা সংশয়কে ছাড়িয়ে নাস্তিক্যের পর্যায়ে চলে যায়।

এ দেশে বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব থেকেই সাহিত্যে বিশ্বাসে ভিত্তিভূমি নানা অংশ নিয়ে সংশয়ের প্রকাশ দেখা গেছে। বেদে যা আছে তার বাইরেও অন্যান্য সংশয়ের প্রকাশ গণমানসে নিশ্চয়ই ছিল, কারণ বেদে সমগ্র গোষ্ঠীর বিশ্বাস বা সংশয়ের সমস্ত অনুপুঙ্খ নিশ্চয়ই বিধৃত নেই, মোটের ওপর বেদ জনসাধারণের ধর্মাচরণ ও তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পটভূমিকার একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সাহিত্য। তবু তার মধ্যেও অবিশ্বাসের নানা চিহ্ন আছে — দেবতাদের স্বরূপ, আচরণ, অভিপ্রায়, ক্ষমতা এবং যজ্ঞকর্মের যাথাযথ্য সম্পর্কে সংশয়। সংহিতা থেকে উপনিষদে পৌঁছোনোর পথ-পরিক্রমায় সংশয়গুলি বাড়ছিল; সংখ্যায়, প্রকারে, গভীরতায় এবং ব্যাপকতায়। যদিও বিশ্বাস ও তত্ত্বের বিবর্তনের নিজস্ব ক্রম থাকে, তবু মোটের ওপরে জীবন ও জীবিকার ভিত্তি — উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার সঙ্গে তার একটি অঙ্গাঙ্গী যোগ থাকে কারণ উৎপাদন অর্থাৎ সমাজের অবগঠন বহুলাংশে নিরূপণ করে সমাজের মানসিক অধিগঠনকে। মানুষের অবচেতন প্রত্যাশা থাকে যে, ‘তার জীবনের ভিত্তিগত গঠনে পুরো অথবা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশগুলি তার বোধগম্য হবে এবং তার কর্মপ্রচেষ্টার নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।’ [The assumption that all or the most significant features of these structures are knowable and controlled by the human effort…. — Guy E. Swanson, p.188]। এই প্রত্যাশাকে চূর্ণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা। মানুষ আবিষ্কার করে যে তার জীবনের অবগঠনের অনেকটাই তার বোধের এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তখনই দেখা দেয় সংশয় তার জানা জগতের অংশবিশেষ সম্বন্ধে এবং সৃষ্টি সম্বন্ধে যে সংশয় বা সমগ্র জগৎটি সম্পর্কে।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের গ্রিসে তার্কিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য, ‘যে পৃথিবীটা সকলের পক্ষেই একই রকমের সেটি কোনও দেবতা বা মানুষ সৃষ্টি করেনি, সেটি বরাবরই ছিল, এখনও আছে এবং চিরকালই থাকবে।’ [The World which is the same for all, has not been made by any god or man; it has ever been, is now, and ever shall be… orphic fragments 334 EBc 30 quoted in George Thomson: Vol.II, p.227]। এ মহাবিশ্ব কখনও সৃষ্টি হয়নি, চিরদিনই এরকম ছিল, আছে ও থাকবে, এমন কথা মনে করলে সৃষ্টিকর্ম ও সৃষ্টিকর্তার প্রশ্নটা চলে যায়, থাকে শুধু সৃষ্টিটাই, এবং সেটা প্রত্যক্ষ অতএব সংশয়াতীত।

বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সংশয়

উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত ছাড়া আর কোনও দর্শনপ্রস্থানই প্রত্যক্ষকে অস্বীকার করেনি; এরাও স্বপ্পকে অলীক ও অবাস্তব এবং জাগ্রত অভিজ্ঞতাকে বাস্তব বলে স্বীকার করে, প্রত্যক্ষকে অন্তত একটা আপেক্ষিক স্বীকৃতি দিয়েছে, ভূতবাদী (যারা প্রত্যক্ষ জীবন ও জীবিতকেই স্বীকার করে, আত্মাকে নয়), পরমাণুবাদী (বৈশেষিক, যারা পরমাণুকে সৃষ্টির সূক্ষ্মতম উপাদান বলে), লোকায়ত, সাংখ্য ও ন্যায়-প্রস্থান সকলেই প্রত্যক্ষকে অবিসংবাদিত সত্তা বলে স্বীকার করে। বেদের যুগে দৃশ্য বা দৃষ্ট বস্তু নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না। যা অতীতে ঘটেছে বলে মনে করা হত, অর্থাৎ প্রত্যক্ষের অগোচরে, সেইসব ব্যাপার নিয়ে সংশয় ছিল, যেমন বিশ্বসৃষ্টি বা দেবতাদের উৎপত্তি।

এ ছাড়া সংশয় ছিল যজ্ঞ নিয়ে; কোন যজ্ঞে কী ফল পাবার কথা তা বলাই ছিল; যজ্ঞ করেও প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে স্বভাবতই সংশয় জাগে যজ্ঞের প্রক্রিয়া, দেবতাদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা, দেবতাদের যজ্ঞফল দেবার ক্ষমতা, ইচ্ছা এবং শেষত, তাঁদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেও। বলা বাহুল্য, কাকতালীয় হিসেবে কিছু কিছু যজ্ঞের ফল পাওয়া যেত, কাজেই এ নিয়ে সংশয় ব্যাপক, গভীর বা সার্বত্রিক হতে পারত না। তবু যত দিন যাচ্ছিল তত নিষ্ফল যজ্ঞের সংখ্যা বাড়ছিল এবং সংশয়ও বাড়ছিল। যজ্ঞে ফল দেবার প্রতিশ্রুতির দায়িত্ব দেবতাদেরই সেই ভরসাতেই অত স্তোত্র হব্য দিয়ে তাঁদের আরাধনা। ফল না হলে জন্মায় ‘একটা আততি (tension) (সৃষ্ট হয়) দিব্য অঙ্গীকারও এবং এর প্রকাশ্য ব্যর্থতা, অন্য আততিটি হল ঈশ্বরের ইচ্ছা, তাঁর দিব্য পথনির্দেশ ও মানবিক স্বাধীনতা। মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করবার ক্ষমতা… পরিনির্দিষ্ট ছক ও বিশৃঙখলা,  দিব্য নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা — এ দুটি দ্বান্দ্বিকতা।’ [(the tension) between the divine promise and its ostensible failure to be fulfilled; the other is a tension between God’s will, His providential guidance and human freedom, the refractory nature of man… the double dialectic between design and disorder, providence and freedom. — Robert Alter, p.141]। দৈব শৃঙখলা, দেবতাদের নিয়ন্ত্রণ এসব মানতে হলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এসবের ব্যত্যয়, অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা, নানা ধরনের বিপর্যয় এসবের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না; ফলে মানুষ সুপরিনির্দিষ্ট দিব্য আকল্পের পৃথিবীতে দেবতাদের প্রতিশ্রুত যজ্ঞফল না  পেলে ধাক্কা খায়, তার জানার জগতে এর ব্যাখ্যা মেলে না, তখনই জাগে সংশয়।

শুধু প্রত্যাশিত যজ্ঞফল না পাওয়া নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতায় নানা বিরুদ্ধ, ক্ষতিকর অভিজ্ঞতাও তো আছে: খরা-বন্যা-পঙ্গপাল, ব্যাধি-জরা-মৃত্যু, প্রিয়বিচ্ছেদ-ইষ্টলাভে বঞ্চনা ইত্যাদি বিভিন্ন অপ্রীতিকর তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে মানুষ বুঝে যায় যে, বিশ্ববিধান তার পক্ষে সততই মঙ্গলময় নয়, প্রায়ই দুঃখজনক। দেবতা-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বপ্রকৃতির ওপরে ভরসা রাখা চলে না। ‘প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ যদি সর্বব্যাপী হয়, তা হলে যা কিছু ক্ষতি ও যন্ত্রণা ঘটায় তাকে (এভাবে) ব্যাখ্যা করতে হবে যে, সবকিছু জানা থাকলে সেটিকে মানুষের পক্ষে হিতকর বলে মানতে হবে।’ [ If Nature’s providence is all inclusive, then any event which causes injury or suffering has to be integrated as something which, if all the facts were known, would be recognized as beneficial by man. – A. A. Long, p.170]।  অথচ মানুষের অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে, কাজেই সর্বমঙ্গলময় বিশ্ববিধান কোনওটাই নিজের উপলব্ধিতে বা বুদ্ধিতে মানুষ পায় না, তাই জাগে সংশয়, যার একটি পরিণতি নাস্তিক্য। সংশয়মাত্রই নাস্তিক্যের জন্ম দেয় না, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বহু মানুষের চেতন ও অবচেতন মনে বহু যজ্ঞের নিষ্ফলতা, বহু সামাজিক বঞ্চনা, দারিদ্র্য, অত্যাচারের পুঞ্জিত স্মৃতি কোনও কোনও চিন্তাশীল মানুষের মনে সৃষ্টি করত সমস্ত বিশ্ববিধান সম্বন্ধে গভীর অবজ্ঞা এবং বিধাতা বা যজ্ঞে-আরাধ্য দেবদেবীদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে এই ব্যাপক সর্বাত্মক সংশয়ের একটি পরিণতি নাস্তিক্য।

সংশয় ও নাস্তিক্যের অন্তর্বর্তী একটি অবস্থার নাম অজ্ঞেয়বাদ (agnosticism), অর্থাৎ বিধাতা বা দেবদেবীরা আছেন কি না সে-বিষয়ে নিজের জ্ঞানের ও বিশ্বাসের অভাব, এবং জ্ঞানের এই অভাবের প্রকাশ্য স্বীকৃতি: ‘কেউ কোথাও আছেন কি না জানি না, অর্থাৎ থাকতেও পারে, না থাকতেও পারে কিন্তু আমি নিশ্চিত নই।’ এ অবস্থা সংশয়ের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে, কিন্তু পূর্ণ নাস্তিক্য এটা নয়। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাসের ভাষায়: ‘দেবতাদের বিষয়ে আমি জানতে পারি না, তাঁরা আছেন কী নেই, কিংবা কেমন তাঁদের আকৃতি; কারণ জ্ঞানকে প্রতিহত করে অনেকগুলি বিষয়: জ্ঞেয় বিষয়টির দুর্বোধ্যতা এবং মনুষ্যজীবনের স্বল্পায়ুতা।’ [About the gods, I am not able to know whether they exist or do not exist, nor what they like in form, for the factors preventing knowledge are many; the obscurity of the object, at the shortness of human life. — Protagorus for 4. The Sophist]। সংশয়ে থেকে নাস্তিক্যের মধ্যে অজ্ঞেয়বাদ একটি স্তর। সংশয়ের ভিত্তি অনিশ্চয়তা, দোলাচলতা, আর নাস্তিক্য হল স্পষ্ট নিঃসংশয় ঘোষণা: কিছু নেই, কেউ নেই। অজ্ঞেয়বাদ এ দুটির মধ্যবর্তী স্তর: ‘কিছু থাকলেও থাকতে পারে, আমি জানি না; কিছু না-ও থাকতে পারে, আমি জানি না।’ এর ভিত্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অজ্ঞেয়বাদে। এতে দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে; প্রথমত, নিশ্চিত বিশ্বাসের অভাবে মর্মযন্ত্রণা এক ধরনের আত্মিক নিরালম্বতা; দ্বিতীয়ত, সমস্ত ব্যাপারটা সম্পর্কেই অনীহা ঔদাসীন্য। অর্থাৎ আমি যখন খেয়েপড়ে ভালোভাবেই বেঁচে আছি তখন ভগবান থাকুন বা না থাকুন আমার কিছু এসে যায় না। এ ঔদাসীন্য সংশয়ের অন্তরালেও প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে, নাস্তিক্যেও থাকতে পারে। কিন্তু যে-মানুষ জীবনে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে গভীরভাবে দ্বিধাগ্রস্ত এবং এ দ্বিধায় যার মর্মযন্ত্রণা আছে তার পক্ষে ঔদাস্য তো সম্ভব নয়, তার পক্ষে এ সিদ্ধান্ত জীবনমরণের সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তবে সংশয়, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য এ তিনটির ভিত্তিভূমি শুধু জ্ঞান নয়, বিশ্বাসও, যেটি উপলব্ধির স্তরে অনুভূতির প্রান্তবর্তী। এবং জ্ঞান ও বিশ্বাস দুইয়েরই সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এবং ঠিক এই কারণেই এই পুরো ব্যাপারটাই জীবনের গভীরতম অংশ থেকে উদ্ভূত, এবং মর্মের স্পর্শকাতর তন্তুগুলিতে প্রবল যন্ত্রণার স্পন্দন তোলে। বেঁচে থাকার মানে কী, এ নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সর্বদেশে সর্বকালে মানুষ তীব্রভাবে অনুসন্ধিৎসু। এ সন্ধান শুধু বুদ্ধিগত হলে তা এমন মর্মন্তুদ হত না, শুধু আবেগনির্ভর হলেও হত না, কিন্তু যেহেতু হৃদয়ের আবেগ এবং বুদ্ধির মনন এতে সমানভাবে সম্পৃক্ত, তাই এ ব্যাপারটা সম্পর্কে মানুষের প্রতিক্রিয়া এত জরুরি। আবেগ (emotion), মনন (intellection), এ দুটিই তো প্রণোদিত করে ইচ্ছাশক্তি (volition)-কে, অর্থাৎ মানুষ তার সত্তার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় যে-গভীর স্তর থেকে সেখানে সে হয় বিশ্বাসী, নয় অজ্ঞেয়বাদী, নয় নাস্তিক। এবং এ তিনটি বিকল্পই নিরূপণ করে তার বেঁচে থাকার অর্থের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মপন্থা কী। যজ্ঞের যুগে তার জীবনের সমস্ত সংঘাতের, অভাবের, অভিযোগের প্রতিকার চাইবার জায়গা ছিল দেবতাদের অনুগ্রহ এবং সেখানে পৌঁছোবার পথ ছিল যজ্ঞ।

শাস্ত্রে সংশয়

যজ্ঞের যুগের শাস্ত্র রচনার শেষ পর্যায়ে  আর্যাবর্তে কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। শাস্ত্রগুলি রচিত হচ্ছিল আর্যাবর্তে, গঙ্গার উত্তরে হস্তিনাপুরে। সেখানে গৌরব রাজা নিচক্ষুর আমলে একটি প্রকাণ্ড প্লাবনে আর্যাবর্তের অনেক অংশই বিধ্বস্ত হয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে। সেইসময়ে যজ্ঞ-সম্পর্কিত শাস্ত্র অর্থাৎ ব্রাহ্মণ এবং সংহিতার শেষাংশ রচিত হচ্ছিল। ওইসময়ে রাজধানী হস্তিনাপুর থেকে যমুনার পারে কৌশাম্বীতে সরিয়ে আনা হয়। ‘এ ঘটনার পরে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রের সৃষ্টিশীল পর্যায়ের যেন অবসান ঘটে; (এর পরেও) আচার্য পরম্পরার নাম পাওয়া যায় এবং নিশ্চয়ই কিছু কিছু বৈদিক শাস্ত্রাংশের পুনরনুশীলন চলছিল… কিন্তু স্বতন্ত্র রচনা যেন নিবদ্ধ রইল গৌণ শাস্ত্রচর্চায়, যজ্ঞকর্ম, অর্থশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, জ্যোতিষ ও জ্যামিতিতে।’ [After this event the creative period of Brahmanism appears to have come to an end, lines of teachers are recorded and there was clearly some revision of Vedic texts… but original composition seems to have been confined to the subsidiary studies, actual law, linguistics, astronomy and geometry. — A. K. Warder, p.28]। এর অর্থ, খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকের মধ্যেই যজ্ঞতত্ত্ব পরিনিষ্ঠিত হয়ে যায়, খুব বড়ো রকমের কোনও পরিবর্তন আর ঘটেনি, সামান্য আঞ্চলিক পরিবর্তন, ছোট ছোট যজ্ঞের অঙ্গে ঘটে থাকতে পারে, কিছু কিছু ছোট যজ্ঞ উদ্ভাসিতও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সমস্ত গোষ্ঠীর পক্ষে অনুষ্ঠিত যেসব বৃহৎ শ্রৌতযাগ রাজসূয়, বাজপেয়, অশ্বমেধ, অগ্নিচয়ন, সত্র — এগুলি এর আগেই তাদের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক রূপ ও হোতার আবৃত্তির, উদগাতার গানের এবং অধ্বর্যুর উপাংশু (মৃদু স্বরে) আবৃত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। তার অর্থ, এর পরে যেসব যজ্ঞের অনুষ্ঠান হচ্ছিল সাধারণ মানুষ তার সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। এর ফলে মানুষ একটু দূর থেকে মিলিয়ে দেখতে লাগল যজ্ঞ থেকে যে-ফল পাবার কথা তা পাওয়া যায় কি না। যখন হিসেব মিলছিল না তখন নানাভাবে নানা সংশয় মানুষের মনে উদ্রিক্ত হচ্ছিল এবং তৎকালীন ও তার পরবর্তী শাস্ত্রে — সংহিতা ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে — উচ্চারিত হয়ে স্থায়ীভাবে বিধৃত রইল।

পরের যুগে জ্ঞানকাণ্ডে, আরণ্যক উপনিষদে পূর্বতন সংশয়ের উত্তর আর মিলল না, বরং যজ্ঞ তখন ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হলেও ক্রমশ যেন গৌণ একটি ধর্মক্রিয়ায় পর্যবসিত হল এবং আত্মব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে চর্চাই হয়ে উঠল মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্যায়ে পরিবর্তিত সমাজজীবনের দ্বারা প্রভাবিত মননজগতে যেসব নতুন সমস্যার উদয় হল, তার মধ্যে জন্ম নিল নবতর সংশয়। এগুলির সঙ্গে পূর্বতন সংশয়ের অনেক পার্থক্য চোখে পড়ে। বিশেষ কোনও দেবতা, তার উদ্ভব, আচরণ, ক্ষমতা, অভিপ্রায় বা যজ্ঞকর্ম ও তার যাথাযথ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন আর তেমন নেই। তার বদলে বরং বিশ্বচরাচর, মানুষের শরীর, ইন্দ্রিয়, মন এবং এগুলির সঙ্গে বহির্জগতের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন অনেক বেশি। তাছাড়া নতুন কিছু সংশয়, আত্মা ও ব্রহ্ম এবং তাদের সম্পর্ক নিয়ে, মরণোত্তর অবস্থান নিয়ে (অবশ্য এ বিষয়ে কিছু সংশয় আগেও দেখা গেছে)। এখন সমাজপতি, শাস্ত্রকার ও পুরোহিতদের সমবেত চেষ্টায় মানুষের জীবনদর্শন ও ধর্মাচরণের লক্ষ্য একেবারে বদলে যায়: পরলোকের অস্তিত্ব এখন স্বীকৃত, অর্থাৎ সাধারণ মানুষ জানে মৃত্যুতেই সব শেষ হয় না, আত্মা থাকে, অতএব পরলোক আছে, স্বর্গ নরক ও পুনর্জন্ম আছে। স্বভাবতই এখনকার প্রশ্ন মুখ্যত এইগুলি নিয়েই। এইসব উপাত্ত নিয়ে যে-বিশ্ববিধান লোকের মনে দেখা দিল, এ পর্যায়ের প্রশ্নগুলি সেই নিয়ে এবং সে-বিশ্ববিধানের সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার বস্তুগুলি -– শরীর, মন, প্রাণ, ইন্দ্রিয়, পঞ্চভূত ও বহির্বিশ্ব ইত্যাদির সম্পর্ক নিয়ে।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে একাধিকবার পড়ি “মৃত্যুর পর চেতনা নেই, সে কথা বলছি” এমন বলেন যাজ্ঞবল্ক্য। [ন প্রেত্য সংজ্ঞাস্তি ইতি আরে ব্রবিমীতি হোবাচ যাজ্ঞবল্ক্য| ২|৪|১২: ৪|৫|১৩] এটি সংশয়ের উক্তি নয়, নাস্তিক্যের; কঠোপনিষদে নাস্তিকের একটি সংজ্ঞা হল, যে পরলোকে বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক। এখন উপনিষদের বিশিষ্ট তত্ত্বগুলির এক মুখ্য প্রবক্তা হলেন যাজ্ঞবল্ক্য। তিনি স্বয়ং বলছেন মৃত্যুর পর আর জ্ঞান থাকে না। জ্ঞানই যদি না থাকে তো আত্মা থাকলেও তেমন আত্মা সুখ-দুঃখের অনুভবের বাইরে। কাজেই স্বর্গনরকও যেমন আত্মার পক্ষে নিস্ফল, পুনর্জন্মও সেই কারণে নিরর্থক। অথচ এই যাজ্ঞবল্ক্যই বৃহদারণ্য উপনিষদেই একটির পর একটি উপমা সাজিয়ে আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমা বর্ণনা করেছেন, নানাভাবে আত্মব্রহ্ম-তত্ত্ব প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন। আবার তিনিই বলছেন, মৃত্যুর পর চেতনা থাকে না। এই যাজ্ঞবল্ক্যই [এমন মতও অবশ্য আছে যে, একাধিক যাজ্ঞবল্ক্য ছিলেন, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মতের প্রবক্তা] অনেক কারণ দেখিয়ে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন শতপথব্রাহ্মণে, এবং বলেই প্রায় এক নিশ্বাসেই বলেছেন, ‘আমি কিন্তু খাব যদি রান্নাটা ভালো হয়’। ইনি ব্রহ্মোদ্যে ব্রহ্মোদ্যে আত্মব্রহ্ম-তত্ত্ব নিয়ে বহু পণ্ডিত ও জিজ্ঞাসুর সঙ্গে তর্ক করেছেন, দৃশ্যমান জগৎ মায়াস্বরূপ ঘোষণা করেছেন, আবার জনকের সভায় উপস্থিত হলে রাজা যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছেন ‘কী মনে করে ঠাকুর, ব্রহ্মজ্ঞান না গোধনের জন্য এসেছেন?’ তখন অসংকোচেই বলেছেন ‘দুটোরই জন্যে, মহারাজ।’ জনক ব্রহ্মিষ্ঠের (ব্রহ্মজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতের) পুরস্কার হিসেবে যে বহুসংখ্যক সোনায়-মোড়া শিং গাভী সাজিয়ে রেখেছিলেন, যাজ্ঞবল্ক্য বিনা ব্রহ্ম-সম্বন্ধীয় পরিতর্কে ওই গাভীগুলি নিয়ে বাড়ী চললেন, সমবেত পণ্ডিতরা প্রশ্ন করলে বললেন ‘যিনি ব্রহ্মিষ্ঠ তাঁকে আমরা নমস্কার করি, কিন্ত আমরা এখন এখানে সকলে গাভীর কামনায় এসেছি।’ কথাটা সত্যও ছিল, তাই প্রতিপক্ষ তেমন আপত্তিও করেনি, তবু তর্ক হয়েছিল।

যাজ্ঞবল্ক্য সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ উপনিষদের আত্ম-ব্রহ্মতত্ত্বের তিনিই মুখ্য প্রবক্তা, তা সত্ত্বেও ঐহিক প্রয়োজন — গাভী অর্থাৎ বিত্ত সম্বন্ধে তাঁর কোনও ঔদাসীন্য নেই, জনকের কাছে তিনি ব্রহ্মজিজ্ঞাসুও বটে আবার গোধনপ্রার্থীও বটে, গোমাংসভক্ষণ সমাজে নিষেধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বলেন ‘আমি কিন্তু খাব’। অর্থাৎ তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জীবনে অসঙ্গতি তাঁকে পীড়া দেয় না। তাই উপনিষদের আত্ম-ব্রহ্মতত্ত্ব প্রতিপাদন করেও বলেন, মৃত্যুর পর চেতনা থাকে না। বলছেন দ্বিধাহীন প্রত্যয়ের সুরে, ঘোষণার ভাষায়। এই উক্তিতে আত্মা, পরলোক, জন্মান্তরের সযত্ন রচিত ইমারত যে বিধস্ত হয়ে যায় তা কি তিনি জানেন না? জানেন কিন্তু তবু যে বলছেন এটা তাঁর তত্ত্ব নয়, উপলব্ধি বা মননজাত তত্ত্ব, একে তিনি অস্বীকার করেন কী করে? মরণোত্তর আত্মার সংজ্ঞা তাঁর যুক্তিবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না তাই দৃঢস্বরে তা অস্বীকার করলেন। সমাজের বহু মনীষীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই এরকম ছিল: কোথাও প্রত্যয়, কোথাও সংশয়, কোথাও স্পষ্ট নাস্তিক্য।

শুধু বৃহদারণ্যক উপনিষদেই নয়, সব-কটি উপনিষদ মিলেও একটি সুসংহত দর্শন একেবারেই পাওয়া যায় না। উপনিষদগুলি স্বতন্ত্রভাবে অথবা সমগ্রভাবে কোনও সম্পূর্ণ, সংহত কিংবা যুক্তিপূর্ণভাবে সংগঠিত বিশ্বতত্ত্ব উপস্থিত করে না [The Upanishads either individually or as a whole do not offer a complete, consistent and logically systematized conception of the World-Hajime Nakamura, p.79]। একটু ভাবলেই বোঝা যায় উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে, প্রায় দু-আড়াইশো বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে, কালে, বিভিন্ন মনীষীর চিন্তার সংকলন এই উপনিষদ সাহিত্য; ফলে এর মধ্যে যুক্তির সংহতি খোঁজা বাতুলতা। যে যার অভিজ্ঞতা অকুণ্ঠভাবে ব্যক্ত করে গেছেন, তাঁরা অধিকাংশই আচার্য ও শিক্ষার্থী। তাঁরা জানতেনও না যে তাঁরা উপনিষদ রচনা করেছেন এবং তামাতুলসী গঙ্গাজল ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞাও করেননি যে, নতুন একটি দর্শনপ্রস্থান তাঁরা সৃষ্টি করতে বসেছেন। ফলে বহু পরস্পরবিরোধী উক্তির সমাহার রয়ে গেছে এর মধ্যে। দেশে চিন্তার জগতে আত্মা, পরলোক ও জন্মান্তরকে অবলম্বন করে যে নতুন হাওয়া বইছিল তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এঁরা প্রত্যেকে নিজের উপলব্ধি ও মনন গ্রন্থনা করে রেখে গেছেন, তাতে সৌষম্য ও সংহতি বজায় রইল কিনা সেটা লক্ষ করার দায়ও তাঁদের ছিল না, কারণ খুব সম্ভব তাঁদের সকলে পরস্পরকে চিনতেনও না। যজ্ঞ থেকে মানুষের মন সরে গেছে, এমনই একটা পরিবেশে মনীষীরা সমাজের সংহতি রক্ষার জন্যে যজ্ঞের একটা বিকল্প নির্মাণ করেছিলেন।

যুক্তির কাঠামো গড়ে উঠেছিল প্রায় দেড় হাজার বছর পরে শঙ্করাচার্যের হাতে। উপনিষদে যা পাই তা তত্ত্বের দিকে শিথিল, পরস্পর-অসংলগ্ন কখনও-বা পরস্পরবিরোধীও। তাই তাঁরা যখন জীবন সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছেন তখন সে-প্রশ্নগুলিও কোনও স্পষ্ট বিষয়কে অবলম্বন করে উদিত হয়নি। ফলে সমগ্র উপনিষদে তত্ত্বের দিকে নানা অসঙ্গতি রয়ে গেছে এবং এইটেই স্বাভাবিক। নানা বিষয়ে নানা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে বিভিন্ন লোকের মনে। নানা অঞ্চলে ও নানা সময়ে; এগুলি পরস্পর-অসম্পৃক্ত, একই ধরনের প্রশ্ন বারেবারে উচ্চারিত হয়েছে। এই প্রশ্নের মধ্যে যেগুলি যজ্ঞ বা যজ্ঞীয় দেবতা সম্পর্কে নয় সেগুলি এই বিশেষ যুগের চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত, জ্ঞানকাণ্ডের নিজস্ব চরিত্র সেগুলির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। এসবের মধ্যে যা বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় তা হল, প্রশ্নের  বৈচিত্র, সংখ্যা ও কৌতূহলের ব্যাপক বিস্তার। সংশয় শুধু একটি স্বাভাবিক মননপ্রক্রিয়াই নয়; সংশয়, অবিশ্বাস ও নাস্তিক্য মানুষের জীবনের একটি যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাও বটে। যখন কোনও সংশয় থাকে না, নিজের দেহমন ও বহির্জগত সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট সর্বজনস্বীকৃত ছক মানুষ মেনে নিতে পারে তখন সে-অবস্থাটা মানুষের মানুষের শান্তি ও স্থৈর্যের অনুকূল, জীবন সম্বন্ধে একটা আশ্বাস ও স্বস্তি খুবই আরামের অবস্থা। অথচ সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাওই সামগ্রিকভাবে এ-অবস্থা সত্য ছিল না: কিছু সজাগ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে, সেসব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর মেলেনি, ফলে অনুত্তরিত প্রশ্ন যন্ত্রণা দিয়েছে সংশয়ে, বিশ্বাসহানিতে, নাস্তিক্যে।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে ইহুদি ধর্মের সৃষ্টিশীল পর্বের অবসান ঘটে। এইসময়ে নানা সংশয়, প্রশ্ন উচ্চারণ করেন মনীষীরা। এজরা ও নেহেমায়াহ এঁদের অন্যতম। এজরা ভগবানকে অনুযোগ জানিয়েছেন, ‘তুমি কাউকেই দেখিয়ে দাওনি তোমার আচরণ কেমন করে বুঝতে হয়।’ [(Thou) has not shown anyone how thy way is to be comprehended — Ezra 3:3]। যাঁর আচরণই দুর্বোধ্য, হীনবল ক্ষীণবুদ্ধি মানুষ তা যদি অবধারণ না করতে পারে তবে তা দিয়ে মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। যে-ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টিকর্তা বিশ্ববিধানের নিয়ন্তা, তিনি মানুষকে এনে ফেলে রেখেছেন এমন এক পৃথিবীতে যেখানে কেন কখন কী ঘটে তা মানুষের বোধের অতীত; অথচ মানুষ বুঝতে চায় ও বারেবারে অন্ধগলিতে মাথা ঠুকে মরে। তাই এত অনুযোগ, কেন মানুষকে বুঝিয়ে দিলে না কোনওদিন, এই ভুবন যে-নিয়মে চলে তার প্রকৃতি কী? মানুষ বুঝতে চাইছে, পারছে না; কারণ তুমি দুর্বোধ্য আচরণও করবে আর সে-নিয়ে মানুষের মনে বহুবিধ প্রশ্ন যখন উদিত হবে তখন তুমি তাকে কিছুই বুঝিয়ে দেবে না যা হয়, যেমন করে হয় তা কেন তেমনভাবে ঘটে। চারিদিকে তাকিয়ে মানুষ কোথাও তার সংশয়ের সমাধান খুঁজে পায় না। এমন বোধাতীত ভুবন-ব্যবস্থায় মানুষ কীরকম অসহায় এবং মনের জগতে কী পরিমাণ পীড়িত ও বিধ্বস্ত তা কি তুমি জান না? এ যেন ‘আঁধার রাতে একলা পগল যায় কেঁদে/আমায় বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে’। এজরার অনুযোগ আরও গভীর, এমনই দুর্বোধ্য বিশ্ববিধানের মধ্যে যদি আমাকে ফেলে রেখে দেবে, তা হলে, স্রষ্টা, আমাকে এমন করে সৃষ্টি করোনি কেন যেন আমার মধ্যে কোনও প্রশ্ন না জাগে? ‘প্রভু আমার, আমি তোমাকে মিনতি করছি (জানবার জন্যে), কেন তুমি আমার মধ্যে বোধশক্তি দিয়েছিলে?’ [I beseech you, my lord, why have I been endowed with the power of understanding. — Ezra 4:22]। তাহলে সংশয়, অজ্ঞেয়বাদ ও নাস্তিক্য যা বোধশক্তিমান মানুষের মর্মস্থলে যন্ত্রণা জাগায় সেটা যে ভগবান মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন, এই ধরনের গভীর, নিষ্প্রতিকার যন্ত্রণায় তাকে অভিশপ্ত অস্তিত্বে নির্বাসিত করে রেখেছেন। যদি প্রশ্নের সমাধানই না দেবেন তবে যাতে মনের মধ্যে প্রশ্নের উদ্রেক না হয় সে-ব্যবস্থা করলেন না কেন? অর্থাৎ মানুষ ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন করছে, কিন্তু সে-প্রশ্ন নিষ্ফল মাথা কোটায় অবসিত হচ্ছে, কোথাও কোনও সমাধান মিলছে না। এই মর্মযন্ত্রণা থেকে বেদের মনীষীরাও প্রশ্ন করেছেন এবং অনুরূপ নিরুত্তর স্তব্ধতার সম্মুখীন হয়েছেন।

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]

[উপরের প্রবন্ধাংশটি সুকুমারীর ভট্টাচার্য-এর ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’-র থেকে গৃহীত। রচনাটি ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাডেমি থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটি বর্তমানে গাঙচিল প্রকাশনা থেকে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত লেখকের প্রবন্ধসংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত হয়েছে এবং প্রকাশকের সহৃদয়তায় ও অনুমতিক্রমে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ পুনর্মুদ্রিত হল।]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...