আমরা নিশ্চিত, শংকরদা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন

শঙ্কর চক্রবর্তী | জনবিজ্ঞান কর্মী

শ্যামল চক্রবর্তী

 

‘দেশে আমরা সিকি মানুষ দেখতে পাই। আধলা মানুষ দেখতে পাই। পুরো মানুষ চোখে পড়ে না। একজন ছিলেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’

আমাদের প্রায় সময়েই এ কথাটা যিনি বলতেন তাঁর নাম শংকর চক্রবর্তী। মেধাবী ছাত্র, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে পড়াশুনো করেছেন, চাকুরীও করেছেন সামান্য কিছুকাল, তারপর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি জনবিজ্ঞান আন্দোলনের কাজে ব্যয় করেছেন।

আমাদের দেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজে সময় দিয়েছেন এমন মানুষ বিজ্ঞানজগতে কমবেশি রয়েছেন। নিজেকে পূর্ণ সময়ের বিজ্ঞান আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে গড়ে তুলতে তাঁর মতো ওইসময় কাউকে দেখা যায়নি।

বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে ১৯৩৩ সালের ২৫ শে জানুয়ারি তাঁর জন্ম। তাঁর আদর্শ ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় তিনি নিজেকে ভিন্নভাবে গড়ে তুলেছেন। বহু বড় ও খ্যাতিমান মানুষের কাছে শুনেছি, ছোটবেলায় কোথাও শংকর চক্রবর্তী বিজ্ঞানের বক্তৃতা করবেন শুনলে ওরা ছুটে যেতেন। এক একটা সময় তিনি কোলকাতা মহানগরে এই নিয়ে আলোড়ন তৈরি করেছিলেন। মানুষের চন্দ্র বিজয়ের পর স্লাইড দিয়ে তাঁর বক্তৃতা, কিংবা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তাঁর বক্তৃতা এখনও বহু মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে। ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ নিয়ে তিনি ও তাঁর বন্ধু দিলীপ বসু ছুটে বেড়াতেন গ্রাম থেকে শহরে। দিলীপ বসুর অকাল প্রয়াণে তাঁর দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। এখন বিজ্ঞান প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। শংকর চক্রবর্তী নিজের হাতে কাচের উপর লিখে ও লেখচিত্র এঁকে স্লাইড তৈরি করতেন, সেসব আমাদের তিনি দেখিয়েছেন।

১৯৬২ সাল। বয়স তাঁর তিরিশ। গড়ে তুললেন ‘সায়েন্স ফর চিলড্রেন’। রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে এক চিলতে ঘর পাওয়া গিয়েছিল। সেখানেই বলা যায়, তাঁর সাংগঠনিক যাত্রা শুরু। অনেকেই তখন তাঁকে সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে। সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় ও চিন্মোহন সেহানবীশের কথা বলতেন তিনি। তারপর পূর্ব ভারতের এখানে সেখানে গড়ে ওঠা বিজ্ঞান ক্লাসগুলিকে সংঘবদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়া সায়েন্স ক্লাস এসোসিয়েশন’ গড়ে তুলেছিলেন। সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায়, দূরদর্শন ও বেতারে ও তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান নিয়ে বলতেন ও লিখতেন। বইও লিখেছেন বেশ ক’খানা।

১৯৮৬ সালে রাজ্যে গড়ে উঠেছিল একটি বিজ্ঞান সংগঠন যার নাম ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’। ব্যক্তি উৎসাহে নানা জায়গায় বিজ্ঞান ক্লাস তৈরি হয়। তারপর আর সেগুলি বেঁচে থাকে না। ‘বিজ্ঞান মঞ্চ’ তৈরির একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল, সকলে মিলে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজ একসাথে করা। এই কাজে আমরা কেউ তাঁকে বাদ দিয়ে চলার কথা ভাবতে পারিনি। প্রথমে কিছুদিন তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কার্যকরী সভাপতি ছিলেন। তারপর সভাপতির দায়িত্ব তিনি আমৃত্যু পালন করে গিয়েছেন। তাঁর কাজের অবদান তাঁকে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকবছর আগে তাকে জগত্তারিণী পদকে ভূষিত করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি যাই হোক, মানুষের স্বীকৃতি তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল চোখে পড়ার মতো। দেশের মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞানের বোঝা মাথায় চেপে বসে আছে তা দূর করার এক নিরলস যোদ্ধা ছিলেন শংকর চক্রবর্তী। অত্যন্ত সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন, স্পষ্ট ছিল তার উচ্চারণ। বলার ভঙ্গি অননুকরণীয়।

অকৃতদার এই মানুষটি অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। শংকর চক্রবর্তীকে সাধারণ মানুষ কতটা শ্রদ্ধা করতেন তা শংকরদার প্রতিবেশী পরিজনদের দেখেই বোঝা যেত।

সারা দেশে সমন্বিত বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্ক’। এর নানা কর্মসূচিতে তাঁর প্রস্তাব ও পরামর্শ খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। দেশের প্রতিটি রাজ্যের অগ্রণী বিজ্ঞান সংগঠকেরা শংকরদাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। ১৯শে ডিসেম্বর ২০১৭ সকাল সাড়ে ছটায় পঁচাশি বছর বয়সে চলে গেলেন শংকরদা। দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের দপ্তরে এসে পৌঁছেছে একের পর এক শোকবার্তা। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ডঃ বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরী। ২০১৭ তাঁর জন্মশতবর্ষ। আর এই বছরেই রাজ্যের ও দেশের বৃহত্তম জনবিজ্ঞান সংগঠক ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’ তাদের প্রিয় সভাপতিকে হারাল।

শারীরিকভাবে হারিয়ে গেছেন তিনি। গবেষণার কাজে দেহ দান করে গিয়েছেন। তাঁর আদর্শ, তার শৃঙ্খলাবোধ ও পরিশ্রমের স্পৃহা আমাদের মধ্যে যেন বেঁচে থাকে, আমরা তা চাইব।

—————————   

লেখক পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের অন্যতম সহ-সভাপতি

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...