পূর্ব কলকাতা জলাভূমি : একটি আদানপ্রদান প্রচেষ্টা

কাজল সেনগুপ্ত

আগের সপ্তাহের পর

 

এর মধ্যে, মানে ধরুন, গত এক সপ্তাহে কেউ সল্টলেক করুণাময়ীর দিকে গেছেন? আমাকে কাজের সূত্রে নিয়মিত যেতে হয়। আমিই একমাত্র ঠিক বুঝছি, এরকম দাবী করাটা নেহাতই বালখিল্য হবে, তবে, খুব আলাদা করে কয়েকটা জিনিস টের পাচ্ছি। চোখ জ্বালা করছে, মুখের চামড়ায় একটা জ্বালাপোড়া অনুভূতি হচ্ছে, নাকে পোড়া গন্ধ লাগছে — এরকম আর কারও মনে হয়েছে? হতে পারে, আমার ভুল, বা যাঁরা করুণাময়ীতে দাঁড়িয়ে আমার কথায় সায় দিয়েছেন, হতে পারে তাঁদেরকে লীডিং কোয়েশ্চেন করেছিলাম বলে, সায় দিয়ে দিয়েছেন বা আমাকে পছন্দ হয়নি বলে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ইতিবাচক উত্তর দিয়ে সময়সংক্ষেপ করেছেন, কিন্তু যাঁদেরকেই জিজ্ঞেস করলাম, সবাই সায় দিলেন। এখানে আমি সেই সমস্ত মানুষের কথাই বলছি, যাঁরা নিয়মিত এই চত্বরে আসেন। কারণ সেটা সকলকেই প্রথমে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম, নিয়মিত যাঁরা তাঁদেরকেই পরের প্রশ্নটা করেছিলাম।

বইমেলা হবে বলে, করুণাময়ী চত্বরে মোটামুটি কর্মযজ্ঞ চলছে এখন। পার্কিং-এর জন্য যে জায়গাটা HSBC আর উন্নয়ন ভবন-এর মাঝখানে, ওখানে বেশ কিছু বড় গাছ ছিল। আর বেশ ঘন উঁচু আগাছা। সে জায়গাটা পুরো সাফ হয়েছে, সাফ মানে একদম ন্যাড়া। ওই সবুজটুকু হাপিস হয়ে যাওয়ার কারণেই, চোখ কড়কড়, চামড়ায় জ্বালা, পোড়া গন্ধ এগুলো টের পাওয়া যাচ্ছে। আমি একদমই বইমেলা বিরোধী নই। ময়দান থেকে বইমেলা সরানো কতটা যুক্তিসঙ্গত ছিল, তা নিয়ে আমার এখনও ধন্দ আছে। এবং আমি কোনওরকম মামলাকে বেজায় এড়িয়ে চলি, কারণ, ওটা আমার জানা কাজের মধ্যে পড়ে না। আমি শুধু একটা অবজার্ভেশন মেলাতে চাইছি। এই মাত্র।

জলাভূমি নিয়ে, কাজের সূত্রে অল্প অল্প করে যখন যোগাযোগগুলো বাড়ছে, তখন একটা বড় অংশ, আমি বিশ্বাস করি যাঁরা কলকাতা কমন্স-এর শুভাকাঙ্খী, ব্যক্তিগতভাবে আমারও, সিরা-র বিভিন্ন প্রয়োজনে বার বার সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁরা মাঝেমধ্যেই আপত্তি করতেন পঞ্চায়েতে গিয়ে আলাপ আলোচনা করা নিয়ে। এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে জলটুঙিতে বসে আলাপ করাটা এড়াতে বলতেন, কারণ সেখানে অবধারিতভাবেই ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনীতির কোনও নেতা-কর্মী আছেন।

পঞ্চায়েত শুধুমাত্র প্রশাসনিক জায়গা, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই, এমনটা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা কেউই মনে করেন না। আমিও না। কিন্তু পঞ্চায়েতে না যাওয়ার পরামর্শটা, এলাকার মানুষের সঙ্গে গজল্লা করাটা এড়ানোর পরামর্শটা আসত মূলত, জলাভূমির সংরক্ষণের ইস্যুর থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখার পরামর্শের এক্সটেনশন হিসেবে।

গত দেড়দিনে, সোমেন তিনবার তাগাদা দিয়ে ফোন করার পরে, আজ যখন ফাইনালি লিখতে বসেছি, যা লিখব ভেবে রেখেছিলাম তার থেকে সম্পূর্ণ অন্য কিছু লিখছি। আর হ্যাঁ সোমেন প্রথম তাড়া মেরে ফোনটা করেছিল, আগের সপ্তাহের কিস্তিটা আপলোড করার ৪৭ মিনিটের মাথায়। হোয়াটসঅ্যাপে তাড়াটা এসেছিল ফোন রাখার আড়াই মিনিট পরে। আমার কাছে স্ক্রিনশট আছে।

যাহোক, চটে ফিরি। করুণাময়ী থেকে নয় নম্বর ট্যাঙ্কের দিকে যেতে, গোলচক্করটার আশেপাশের যে কুকুরগুলো পাবেন, তাদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট নাম আছে। খেয়াল করলে দেখবেন, ইদানিং তাদের মেজাজ খুব একটা শরিফ নয়। সেই যুব বিশ্বকাপের সময় থেকে, ধীর লয়ে সৌন্দর্যায়নের কারণে যে উচ্ছেদ শুরু হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায়, প্রথমে গেল গুমটি, রাস্তার ধারের ছোট দোকান, তারপরে ঝুপড়ি, তারপরে বড় দোকান কিছু, এবং এখন বইমেলার জন্য গাছ-আগাছা মিলিয়ে একটা জঙ্গল। প্রতিভা সরকার, ফেসবুকে একবুড়ির ছবি দিয়েছিলেন, পঞ্জি নাম, পরে ওনার ওই পোস্টের কমেন্টের একটা ভিডিওতে দেখেছি, হাভেলি রেস্তোঁরার উল্টোদিকে ডিভাইডারের ওপরে একটা ছোট ছাউনি বানিয়ে থাকতেন, (কুঁড়ে নয় সেটা ঠিক, কুঁড়ের মধ্যে কেমন একটা বাঙালি রোমান্টিসিজম আছে, ঝুপড়ির মতো অবিন্যস্তও নয়, ছাউনি ছাড়া আর কিছু তাই মাথায় এল না), নয় নম্বর ট্যাঙ্কের আশেপাশের কুকুরগুলো সব তাঁর পুষ্যি। আশি উত্তীর্ণ এই পঞ্জি এবং দিনে দুবার রিক্সায় নিয়ম করে আসা খোরাক বরাদ্দ ছিল এই কুকুরগুলোর। পঞ্জি যবে থেকে ঠাঁইনাড়া হয়েছেন, কুকুরগুলোর যত্নআত্তিতে খানিক অনিয়ম এসেছে।

এটা ঠিক গৌরচন্দ্রিকা নয়। মূল বিষয়টাই। হুগলী, মুর্শিদাবাদ, সুন্দরবন (পঞ্জি এসেছেন অবশ্য পাঞ্জাব থেকে, তবে তা ইতিহাসেরও আগে) থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা কিছু মানুষ, গত দশ-কুড়ি-তিরিশ বছর ধরে, সল্টলেকে একরকম স্ট্রিট ফুড রেজিম তৈরি করেছিলেন। ফলে অফিসযাত্রী, সরকারি অফিসে আসা মানুষজন, ট্যাক্সি-অটো-বাসচালক, অন্যান্য পরিবহণকর্মী, এঁদের প্রয়োজনে, সস্তায় টিফিন বা মধ্যাহ্নভোজনের একরকমের সাপ্লাইসাইড তৈরি হয়েছিল। এই ছোট দোকান উচ্ছেদের সময় থেকে, সল্টলেকের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে জিরিয়ে নেওয়া, দুপুরের ভাতটা খেয়ে নেওয়া ট্যাক্সিচালকরা হঠাৎ করে কেস খেতে শুরু করলেন। সাপ্লাই-ডিমান্ড দুদিকেই কোপ দিলে নতুন ভারসাম্য বিন্দুতে পৌঁছনো সহজ হয়।

মানে আমি এই চোখ জ্বালা টের পাওয়ার পরে চোখ কচলে এইরকম একটা উপলব্ধিতে পৌঁছেছি। যুব বিশ্বকাপের কারণে প্রথম উচ্ছেদটার দিনই নির্ধারিত ছিল, আমার চামড়া জ্বালা করবে, নাকে কটু গন্ধ আসবে, বাসের নম্বর দেখতে গিয়ে, চোখ থেকে জল পড়ে ঝাপসা হয়ে যাবে, ইত্যাদি প্রভৃতি। তাই গাছ কেন নেই প্রশ্ন করার এক্তিয়ারটা পেতে গেলে, মানুষগুলো সব কোথায় গেল, কী খেল, এখান থেকেই শুরু করতে হবে। অন্য একটা উপায়ও আছে। বাড়ি ফিরে আগে একটু খেয়াল রেখে সিগারেট ধরাতাম, বাচ্চাটা কাছাকাছি নেই সেটা বুঝে নিতাম। ইদানিং সেই বুঝে নেওয়ার যত্নটা কমেছে। একটা যুক্তি মাথায় পাকাপাকি দানা বাঁধছে, এমনিতেই যা ধোঁয়া খায়, সিগারেটে ধোঁয়ায় কতটা আর বেশি ক্ষতি হবে। নিজের বাচ্চার কারণে অন্যের বাচ্চার ক্ষেত্রেও অভ্যেসটা তৈরি হয়েছিল। সেটাও বোধহয় অচিরেই যাবে।

এই গোটাটা নিয়েই ইকোসিস্টম। শুধু গাছ, আগাছা এগুলো নয়। সম্ভব হলে, ধ্রুবদার, ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের, লেখাগুলো যোগাড় করে পড়বেন, বুঝতে আরও সুবিধে হবে। আর যদি সামনাসামনি বসতে পারেন, এবং বোকা কথা বলে ভদ্রলোককে চটিয়ে না দেন, তাহলে তো ইকোসিস্টেম বোঝার মোক্ষলাভ হয়ে গেল।

বিশ্বকাপ, উচ্ছেদ, স্মার্টনেস, গাড়ি, বই, গাড়ি চড়ে বইমেলা, পার্কিং, প্রিন্ট অন ডিমান্ড, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর দৌলতে ভালো খারাপ নতুন নতুন লেখক, আরও বই, বিক্রি, মেলা, রোজগার, গাড়ি, এই সবকিছু নিয়ে আর জটিলতা না বাড়িয়ে আসুন জলাভূমি যাই। গেলেই আপনি মোবাইল বার করে ফেলবেন, ১০ জনে ৮ জন বলবেন, কলকাতার কাছে এরকম একটা জায়গা আছে, জানাই ছিল না। দিগন্ত দেখা যায়, পরিষ্কার, হাওয়া অনেক সাফসুতরো, ধরা যাক একটু ভোরের দিকেই গিয়েছেন, জল, জলের পরে জল, আরও জল এই সব দেখে আপনি যখন প্রায় নির্বিকল্পতা ছুঁয়ে ফেলেছেন, আপনার আশপাশ দিয়ে কর্কশ বেল বাজিয়ে, পুরুষ মহিলা, বাচ্চা বুড়ো-র সাইকেলের একটা প্রায় মিছিল। এঁরা হয় যাচ্ছেন রাজারহাট নয় রুবি, আনন্দপুর ব্রিজ থেকে রুবি মোড় পর্যন্ত জটলা করে করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। সেমিস্কিল্‌ড, আনস্কিল্‌ড মিস্ত্রি, যোগাড়ের যোগান। সকালের জালটানা হয়ে গেছে। তার থেকে যা আসবে, তাতে হরিমটরের বেশি কিছু জুটবে না। বাকি নুন-ভাতের প্রয়োজনে, এছাড়া অন্য কোন গতি নেই।

যে জলাভূমি নিয়ে আমরা কথা বলছি, সেটা টিঁকে আছে, এই মানুষগুলোর জন্য। এঁদের পূর্বপুরুষের জন্য। আপনার টয়লেটের নালার জল যে ব্যাকফায়ার করছে না, সেটা এঁদের জন্য।

২০১০-১১ নাগাদ, কলকাতা কমন্স (তখনও রিসার্চ কালেক্টিভ অবশ্য, কলকাতা কমন্স হবে আরও পরে, ২০১৩-১৪তে) যখন কাজগুলো সদ্য সদ্য শুরু করেছে, নতুন জানার উত্তেজনায় বাচ্চা বাচ্চা যে ছেলেমেয়েগুলো আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, ওই প্রশ্নটা আসলে তারা কয়েন করেছিল। “রোজ আপনার বাথরুম থেকে যে জলটা বেরোয়, আপনার বাথরুম থেকে বেরিয়ে সেটা কোথায় যায়, কোনও ধারণা আছে? বলবেন সংক্ষেপে?” সামনে যাকে পাচ্ছে, তাকেই পড়া ধরছে। তাদের পড়া ধরাটা বন্ধ করা গেছিল বটে, কিন্তু আমরা কিনা কোনও চান্সই ছাড়ি না, এটা একটা রেন্ডম সার্ভে করা হল। এই যে এক্ষুণি রেন্ডম লিখলাম, এটা চোখে লাগছে না? কিছু টুইকিং ছাড়া, র-এ য-ফলা দেওয়া যায় না, যদি না প্রেডিক্টিভ টেক্সট-এর ভোকাবুলারিতে থাকে। র-কানেক্ট-য, লিখলেই ওটা য-এ রেফ হয়ে যাবে। কিন্তু এরকম একটা খুঁতো বানান নিয়ে, বা প্রেডিক্টিভ টেক্সট-এর সুবিধে নিয়ে, আমরা কি চালিয়ে দিচ্ছি না? দিচ্ছি তো!

ওই প্রশ্নটাও ওরকম। দশজনে আটজন জানেন না, অম্তত ওই সময়ে জানতেন না যে বাথরুমের জল কোথায় যায়। তার মধ্যে ছয়জনের ক্ষেত্রে, প্রশ্নটাই প্রথমবার অকার করল। বছর দুয়েক আগে সম্ভবত, Society for Creative Opportunities and Participatory Ecosystems (SCOPE)-এর পক্ষ থেকে ধ্রুবা দাশগুপ্তরা, এইরকম একটা প্রশ্ন নিয়েই মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে, সেটা অডিও ভিশুয়ালি ডকুমেন্টও করেছিলেন। তখনও চিত্রটা প্রায় একইরকম ছিল। সোমেনের দৌলতে এবার বরং অনেক বেশি ওয়াকিবহাল মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। সোমেন নিজে যে আনাড়ি উত্তরটা দিয়েছে, ওটা সিরিয়াসলি নেবেন না। ওটা আসলে আমাকে বোঝানোর একটা চেষ্টা, দেখো কেন লিখতে হবে, লোকে বিষয়টা নিয়ে কতটা অসচেতন। এবং অত্যন্ত সম্পাদকীয় ধূর্ততার সঙ্গে, নিজেকে জনগণের প্রতিনিধি বানিয়ে দেয়, অথচ, আমাকে গত শনিবার থেকে থ্রেট দিয়ে চলেছে, “আমি সব বুঝি। তুমি লেখা কবে দেবে বলো।”

কিন্তু, আমি যেহতু সোমেন বা সম্পাদক নই, তাই আমি জানি এবং মানি, জনগণের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তাই এবার শেষের প্রশ্নগুলো, এবং তার জন্য যতটুকু ভ্যানতারা করা দরকার, সেটুকুই।

আমরা যখন পূর্ব কলকাতা জলাভুমি নিয়ে প্রথম জানার চেষ্টা করছি, তখনও মনে হয়েছিল, কলকাতার রেফারেন্সে, জলাভূমিটাকে চিহ্নিত করার মধ্যে একটা ডিলেমা আছে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে, এই জলাভূমি অঞ্চল, কলকাতার থেকে অনেক প্রাচীন জনপদ। ইতিহাস আমার বিষয় নয়, যাঁরা চর্চা করেন, অনেক ভালো বলতে পারবেন। তবে ডকুমেন্টেড রেফারেন্সই পাওয়া যায়, পাল-সেনযুগ থেকে, পাঠান যুগ, বারো ভুঁইয়া হয়ে এবং মুঘল যুগের মধ্যে বিদ্যাধরী দিয়ে পর্তুগীজদের আসা — এ অঞ্চল কলকাতার থেকে অনেক বেশি কুলীন। ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড নামের মধ্যে এক ধরণের কলোনিয়াল ও আরবান হেজিমনি আছে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে যিনি বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছেন, ধ্রুবদাকে একবার জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তবে নিরুপায়ত্বটা ভাবতে পারছিলাম, ১৯৮০-র দশকে, ওই কৌলীন্যের ইতিহাস অনেক দূরে সরে গেছে। ইমিডিয়েট রেফারেন্স হিসেবে ‘(ইস্ট) কলকাতা’ প্রশাসনিক প্রয়োজনে অনেক বেশি ন্যাচারাল চয়েস ছিল।

হ্যাঁ, বেশিরভাগই যেমন বলেছেন, এই জলাভূমি প্রায় গোটা কলকাতা-র ময়লা জল গলাধঃকরণ করে। বৃটিশরা যখন বুঝলেন, হুগলী নদীতে ময়লা ফেলা ঠিক হচ্ছে না, তখন, এই অঞ্চলে স্বাভাবিক ভৌগোলিক অবস্থান ও ঢালকে কাজে লাগিয়ে, DWF (ড্রাই ওয়েদার ফ্লো) এবং SWF (স্টর্ম ওয়েদার ফ্লো) দুটো খাল কাটলেন। সম্বৎসরের জন্য DWF, বর্ষার বাড়তি জলের জন্য SWF। খানিক দূর গিয়ে, খালদুটো আবার মিশেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া খাল, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বওয়া বিদ্যাধরীর ধারাকে আড়াআড়িভাবে কাটল। দিনের পর দিন, কলকাতার ময়লা জল বইতে বইতে, brackish salty water-এর চরিত্র পরিবর্তন হল। বিদ্যাধরীর একটা স্ট্রিম এখন, প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার একটি রাস্তা। তাড়ডহ বন্দরের উল্লেখ পেয়েছিলাম কোনও এক জায়গায়, সে বন্দর নাকি তাম্রলিপ্ত বন্দরের সমতুল সম্পন্ন ছিল। খুব অসম্ভব নয় কিন্তু, জানেন। ‘যার নাই পুঁজিপাটা, সে যায় বেলেঘাটা’ এই কথাটা তো অনেকের চেনা লাগতে পারে। বেলেঘাটা নাকি এমন সম্পন্ন বন্দর ছিল, যে মাল ওঠানো নামানোর সময়ে, পড়ে যাওয়া উচ্ছিষ্ট-উদ্বৃত্ত নিয়ে ব্যবসা করে নাকি অনেকের ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। বেলেঘাটার নস্করদের জমিদারি ছিল খেয়াদহ ও সংলগ্ন অঞ্চলে। ১৯৪৭-র আগে পরেও নাকি তাঁরা নৌকা করেই জমিদারির কাজ তদারকিতে যেতেন। এবং এই অঞ্চলের বড় ভূস্বামীদের অনেকেই সম্ভবত, প্রতাপাদিত্যের সহচর বা নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। যাঁদেরকে জমি দিয়ে বসিয়ে যশোর পর্যন্ত গোটা যাতায়াতের রাস্তাটাকে সিকিওর করা হয়েছিল। ফলত এই অঞ্চলের অনেক বড় ভূস্বামীই সম্ভবত পাইক। বাগদি নয়, পাইক, যাঁরা জলপথে লড়াই করতে দক্ষ। যাই হোক, তাড়দহের লাগোয়া মৌজার নাম, তাড়দহ কাপাশাটি। নামেই মালুম, এটা কার্পাস তুলোর হাট হিসেবে পরিচিত ছিল। খুব নিশ্চিত করে জানি না, তবে এমনটা হওয়া হয়তো অসম্ভব নয়, যে তাড়দহ বন্দরটিই আজকে তাড়দা ফুটবল মাঠ। বাঁকুড়া পুরুলিয়ার দিকে যেমন তান্ত্রিক বৌদ্ধদের অনেক মঠ পরবর্তীতে মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনই, এখানে সম্ভবত বেশ কিছু আদতে পর্তুগিজ কাঠামো পরে স্থানীয়করণ হয়ে গেছে।

সোমেন একটা বড় সাহায্য করেছে। আগের কিস্তিটা ফেসবুকে যে বিভিন্ন প্রোফাইলে শেয়ারড হয়েছিল, সেগুলো থেকে কমেন্ট হিসেবে আগের কিস্তিতে করা প্রশ্নের উত্তরগুলো একসঙ্গে সাজিয়ে দিয়েছিল। সম্পাদক হিসেবে ভদ্রলোকের তুলনা হয় না।

একটি কমেন্টে একজন লিখেছেন, বৃটিশদের কাছ থেকে ময়লাজলে মাছচাষ শিখেছিলেন এখানকার মানুষ। এইটার কোনও রেফারেন্স থাকলে, একটু জানাবেন? আমরা কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টোটা বুঝেছি। এটা পুরোপুরি দেশজ জ্ঞান, এবং সেটা চর্চিত হয়েছে, উন্নীত হয়েছে, কমিউনিটি প্র্যাক্টিসের মধ্য দিয়ে। এই অঞ্চলে মাছ, মীন ধরাটা বহু পুরনো পেশা। রেফারেন্স — চিংড়িঘাটা। জলের চরিত্র পরিবর্তনের সঙ্গে এই মানুষেরাই, ময়লা জলে মাছ চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ফলে, এই অঞ্চলে ভেড়িগুলো সেটলমেন্ট ট্যাঙ্কের প্রয়োজন পূরণ করে। বায়োরেমিডিয়েশনের একটা প্রক্রিয়া তৈরি হয়। নোংরা জল ভেড়িতে ঢোকে, তার মধ্যেকার ময়লা উপাদানগুলো প্রেসিপিটেট (এটা অধঃপতিত না অধঃক্ষিপ্ত? সন্দেহ হচ্ছে বলে ইংরেজিটা রাখলাম) করে, ময়লাগুলো মাছ খায়, তিন থেকে সাতদিন পরে পরিষ্কার জল বেরিয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে, কুলটি গাঙ-এ পড়ে, মানে ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমের মধ্যে ঢোকে। মানে, এমনটাই মোটের ওপর হওয়ার কথা।

এবারে প্রশ্নটা। গত কিস্তিতে প্রশ্নগুলো কি খুব বড় বড় হয়ে গিয়েছিল? মানে, ওই আট বা ষোলো নম্বরের ডেসক্রিপটিভ কোয়েশ্চেন-এর মতন? বিশ্বার করুন, আমি আপনাদের কে পড়া ধরার জন্য, এই প্রশ্নগুলো রাখছি না। বরং, নিজেদের বোঝাগুলো যাচাই করা এবং না বোঝাগুলো বোঝার চেষ্টা করার জন্য রাখছি। তাই একটু সময় নিয়ে, ভাবনা চিন্তা করে বলবেন, প্লিজ?

যদি ওপরে বলা ধরণটা মোটের ওপর ঠিক হয়, তাহলে, এটা কি বলা যায়, যে পূর্ব কলকাতা বলে পরিচিত অঞ্চলটা, কলকাতা শহরকে একটা পরিষেবা দেয়। এবং এই পরিষেবাটার জন্য তার কিছু প্রাপ্য হয়? কোনও মিউচুয়াল এক্সচেঞ্জ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি, যেটা এই প্রাপ্যের দাবিকে নাকচ করে?

এই প্রশ্নটা ধরে আপনাদের মতামত যদি পাওয়া যায়, আলোচনা, চর্চাটা যদি তৈরি হয়, তবেই আগামী সপ্তাহে লেখার মতন কিছু আছে। নাহলে, আমরা যা যা জানতে পেরেছি সবই মোটামুটি বলা হয়ে গেছে। রামসর ইত্যাদি ব্যাপারগুলো, লিঙ্ক দিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। আমার কিছু লেখার নেই।

সোমেন,………………………………………………………………………………………………………টা টা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4646 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...