জননী ভাষার কাছে : মেল ট্রেন। দশম যাত্রা। ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

স্টেশন মাস্টার

 

প্ৰসপেরোর কাছে যেদিন থেকে ক্যালিবানের ভাষাশিক্ষার পাঠ শুরু, বিশ্বজোড়া সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসও লেখা শুরু সেদিন থেকেই। যাদবপুরের ইংরেজির অধ্যাপক শ্রী অশোক রুদ্রের কাছে শোনা এই কথাটি বহুবছর পরে আবার মনে পড়ে গেল বিপুল চক্রবর্তীর একটি কবিতার মুখোমুখি হয়ে। অতিশয় কৃশ, পালকের মতো নির্ভার অথচ মন্ত্রের মতো অমোঘ সেই লেখাটির সামান্য দু’তিন পংক্তির শরীরে ঘুঙুরের মতো বেজে ওঠে সামুহিক লোকজীবনের একেবারে কেন্দ্রে থাকা ভাষাস্পন্দ – যা বস্তুত এক নিবিড় কৌমযাপনের মৌলিক সুফল। পুরো কবিতাটির উদ্ধার এ-প্রসঙ্গে তত জরুরি নয়, কিন্তু কেবল এইটুকু উল্লেখ থাকা দরকার – সেই লেখায় জনৈক দুখিয়া চামারের সঙ্গে কবি পরিচয় করিয়ে দেন আমাদের, যে আপনমনে গান গেয়ে চলে – হয়তো বা সাগাইয়েরই গান – কিন্তু সে-গানের বহিরঙ্গে প্রেম ও উৎসবের আবহের পেছনে নির্ভুলভাবে বাজতে শোনা যায় কাঠচেরাইয়ের ঘসঘস – নিশ্চিত টের পাওয়া যায় দুখিয়ার কড়া-পড়া হাতের মুঠিতে ধরা কুঠারের মর্মান্তিক ধার।

জীবনানন্দ-কথিত “শ্নেষে লিখিত মহাকবিতা”-র অর্ধস্ফুট ইঙ্গিতে বিপুল, নাকি বিপুলের কলমে দুখিয়াই, আমাদের ফের একবার মনে করিয়ে দিয়ে যায়, “আমার সমস্ত কাজে, সমগ্র যাপনের মধ্যে, কৌমের সঙ্গে আমার যে শ্রমের সম্পর্ক প্রতিনিয়ত কথা কয়ে উঠতে থাকে, সে-ই আমার জন্মজন্মান্তরের আসল ভাষা”। এভাবেই সৌভেন্দ্রশেখরের গল্পে, তা সে যতই চোস্ত ইংরেজিতে লেখা হোক, আমরা শুনি রুপি বাস্কের গলায় খাঁটি সাঁওতালি ভাষায় কথা বলছে সিংভূম জেলা… সুন্দরবনের মধুশিকারির গানে – সে হয়তো দুখে আর বনবিবির পালাই গাইছে – কিন্তু তার মধ্যে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে রায়মঙ্গলে জোয়ার আসার শব্দ – কানে আসছে নৌকোর পেটের নীচে ধাক্কা দেওয়া জলের আদর…

এ-ই তা হলে আমার আসল ভাষা, যা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আমার রক্তের মধ্যে জোয়ার-ভাটার মতো পেয়েছি। যা, আমি মার খেতে-খেতে ভুঁয়ে লুটিয়ে পড়লে, ভিজে গামছায় চোখমুখ মুছিয়ে জল-বাতাসা খাইয়ে ফের আমায় লড়াইয়ের ময়দানে ফেরত পাঠায়। এ-ই তা হলে আমার আসল ভাষা, যা আমায় বলে, “বাছা, তোর প্রণামে-প্রার্থনায়-প্রেমে-প্রত্যাখ্যানে যেন তোর মায়ের নাড়ির রক্ত তোর বাপের ঘাম মিশে থাকে – তুই যে-কথাই বলিস, দেখিস, তা যেন তোর পূর্বপুরুষের উপার্জনের মাটিতে পা রেখে ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে পারে। আর মনে রাখিস, চারপাশের যারা তোকে তোর ভাষা থেকে উপড়ে নিতে চায়, তোর এই উপার্জনকে অস্বীকার করতে শেখায়, তারা তোর শত্রু।”

এ-ই তা হলে আমার আসল ভাষা, যা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আমার রক্তের মধ্যে জোয়ার-ভাটার মতো পেয়েছি। যা, আমি মার খেতে-খেতে ভুঁয়ে লুটিয়ে পড়লে, ভিজে গামছায় চোখমুখ মুছিয়ে জল-বাতাসা খাইয়ে ফের আমায় লড়াইয়ের ময়দানে ফেরত পাঠায়। এ-ই তা হলে আমার আসল ভাষা, যা আমায় বলে, “বাছা, তোর প্রণামে-প্রার্থনায়-প্রেমে-প্রত্যাখ্যানে যেন তোর মায়ের নাড়ির রক্ত তোর বাপের ঘাম মিশে থাকে – তুই যে-কথাই বলিস, দেখিস, তা যেন তোর পূর্বপুরুষের উপার্জনের মাটিতে পা রেখে ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে পারে। আর মনে রাখিস, চারপাশের যারা তোকে তোর ভাষা থেকে উপড়ে নিতে চায়, তোর এই উপার্জনকে অস্বীকার করতে শেখায়, তারা তোর শত্রু।” আচমকাই মনে পড়ে যায়, কী আশ্চর্য, প্রায় এভাবেই তো ‘দ্য রুট্‌স’-এ অ্যালেক্স হেইলি ব্যাখ্যা করেন কৌমের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে, আলফঁস দোদে তাঁর ‘দ্য লাস্ট লেসন’-এ মাতৃভাষাকে আমাদের অন্তিম ও চূড়ান্ত অভিজ্ঞান বলে দাবি করেন – কালিদাসে শকুন্তলার যেমন আংটি, আমাদের তেমনই মাতৃভাষা।   

ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষাদিবসের মাস। ভাষার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য মরণপণ লড়াইয়ের মাস। আর সেই সূত্রেই কানে বাজতে থাকে কবি অমিতাভ গুপ্তের মন্ত্রোপম সেই পংক্তি… “জননী ভাষার কাছে এসেছি ভূমিকাহীন, আমাকে পূর্ণ করো…”। আমাদের মনে হতে থাকে, ফেব্রুয়ারি সংখ্যার মূল বিষয়ভাবনা হতে পারে ভাষাকে ঘিরেই। এই ভাবনা থেকেই আমাদের ফেব্রুয়ারি সংখ্যার কেন্দ্রীয় থিম, যাকে আমরা বলি রিজার্ভ্‌ড বগি – ‘জননী ভাষার কাছে’

এমনই নানা ভাবনার মধ্যে মনে পড়ে, ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষাদিবসের মাস। ভাষার সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য মরণপণ লড়াইয়ের মাস। আর সেই সূত্রেই কানে বাজতে থাকে কবি অমিতাভ গুপ্তের মন্ত্রোপম সেই পংক্তি… “জননী ভাষার কাছে এসেছি ভূমিকাহীন, আমাকে পূর্ণ করো…”। আমাদের মনে হতে থাকে, ফেব্রুয়ারি সংখ্যার মূল বিষয়ভাবনা হতে পারে ভাষাকে ঘিরেই। এই ভাবনা থেকেই আমাদের ফেব্রুয়ারি সংখ্যার কেন্দ্রীয় থিম, যাকে আমরা বলি রিজার্ভ্‌ড বগি – ‘জননী ভাষার কাছে’। লিখেছেন পবিত্র সরকার, সেলিনা হোসেন, নিরুপম চক্রবর্তী, সঞ্জীব দেবলস্করমোহাম্মদ ইরফান

জানুয়ারিতে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন বিশ্রুত সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, কার্টুনশিল্পী চণ্ডী লাহিড়ী ও প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী। স্মরণ বিভাগে রইল তাঁদের নিয়ে একাধিক লেখা। লিখেছেন বিনয়কান্তি চক্রবর্তী, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। এ-ছাড়াও রইল গল্প-অণুগল্প-প্রবন্ধ-অন্যগদ্য-কবিতা ও অন্যান্য সব নিয়মিত বিভাগ।

সময়াভাবের কারণে এই সংখ্যায় দরবারী ঝুমুরের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মিহির লাল সিংদেওকে স্মরণ করতে পারলাম না। কবি মণীন্দ্র গুপ্তকেও তাঁর প্রাপ্য শ্রদ্ধাটুকু শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্তরে জানিয়েই আমাদের এই সংখ্যা প্রকাশ করতে হল। আমরা আশা করছি আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই দুই মহান স্রষ্টাকে আমাদের পত্রিকার তরফ থেকে আমরা যথাযোগ্য সম্মান জানাতে পারব।

আর যে-কথাটি বিশেষভাবে বলার, তা হল বই ও বইমেলাকে কেন্দ্র করে দু’টি বিশেষ বিভাগ – যার একটি, যে বই পড়বই প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। পছন্দের, অথচ এখনও পড়ে না-ওঠা বই নিয়ে লিখেছেন অভিজিৎ মুখার্জি, পরিমল ভট্টাচার্য, চৈতালি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ কওসর জামাল, স্বাতী ভট্টাচার্য, সুমন গুণ প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা। দ্বিতীয় বিশেষ বিভাগ বইমেলা ডেলি প্যাসেঞ্জার শুরু হয়েছে ৩১ জানুয়ারি থেকে, চলবে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন মেলার মাঠ থেকে সরাসরি প্রতিবেদন থাকছে এই বিশেষ বিভাগে।

আজ এ-পর্যন্তই। কোনও লেখা পড়ে কেমন লাগল যদি জানান, ভালো লাগবে। ভালো থাকবেন..

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. পত্রিকা পড়া শুরুর আগেই এই সম্পাদকীয় মন কেড়ে নিল।

Leave a Reply to অসিত দত্ত Cancel reply