আর একটা বইমেলা

বিপুল দাস

 

–জোজো, ওদিকে যেও না। ওখানে সব বেঙ্গলি বুকস।

কথাটা কানে যেতেই পেছন ঘুরে তাকালাম। আট দশ বছর বয়স হবে বাচ্চাটার। স্টলের একদম সামনে সাজিয়ে রাখা বইগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সব ছোটদের বই। বলা ভালো কিশোরদের। নামগুলো পড়ে দেখলাম অ্যাডভেঞ্চার, ভূতের গল্প আর শিকার কাহিনি। বেঙ্গলি বুকস-এর নামগুলো জোজো পড়তে পারছে কিনা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু প্রচ্ছদের ছবিগুলোর দিকে তার নজর আঠার মতো আটকে রয়েছে। ছবির তো আর ইংলিশ বা বাংলা মিডিয়াম হয় না। তার চোখের ভাষায় মুগ্ধতা ঝরে পড়ছিল। ছবির ভাষার অনুবাদ হয় না।

–মাম্মি, আমি জাস্ট একবার টাচ করব ওই বইটা?

–হোয়াই জোজো? ইউ কান্ট রিড বেঙ্গলি। বেঙ্গলি বুক টাচ করার কী দরকার তোমার? চলো এবার ফুডকোর্টের ওদিকে যাই।

ইংলিশ মিডিয়ামের মা তার ছেলেকে বিপজ্জনক অঞ্চল থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে নিচ্ছিল। আমার মনে হল ওই সুকুমার সমগ্র, টারজান অমনিবাস, পলাশগড়ের গুপ্তধন, চাঁদের পাহাড়, আম আঁটির ভেঁপুর প্রচ্ছদ থেকে একটা বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছিল, যে তরঙ্গ বিপদসীমা অতিক্রম করে ছুঁয়ে দিতে পারে শ্রীমান জোজোকে। আর একবার যদি এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পৌঁছে যায় ইংলিশ মিডিয়ামের সিলেবাসের ভেতরে — একটা অন্তর্ঘাত ঘটে যেতে পারে। আর, কে না জানে বইয়ের চেয়ে বড় অন্তর্ঘাতক আর হয় না। নিঃশব্দে অক্ষরমালা ভাঙাগড়া চালিয়ে যায় প্রতিটি পাঠকের মস্তিষ্কে, শিরা-উপশিরায়। বিপ্লব সম্পন্ন হলে ইংলিশ মিডিয়ামের মা বিস্মিত হয়। জোজো বেঙ্গলি বুকস পড়তে পারে।

ময়দান, মিলনমেলা হয়ে বইমেলা এখন সেন্ট্রাল পার্কে। প্রতিটি পরিবর্তনের আগে সংশয় থাকে, পক্ষে ও বিপক্ষে মন্তব্য থাকে। অথচ সব অসুবিধাকে উপেক্ষা করেও মানুষ এসেছে প্রতিটি মেলাতে। ফলত, মনে হয় যে আশঙ্কার কথা শোনা যায় পাঠক ক্রমশ বই বিমুখ হয়ে ফেসবুকমুখী হয়ে উঠছে সেই আশঙ্কা বোধহয় ততটা সত্য নয়। এত মানুষ শুধু বইয়ের টানে এসেছে — এ কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি শুধুই হুজুগে এসেছে, এটাও ঠিক নয়। আসলে বই নিয়ে এত বড় উৎসব বাঙালির শ্লাঘার কারণ বৈকি। এ এখন এক পার্বণ, যা সবরকম মানুষের ভাষা, জাতি, ধর্ম নিরপেক্ষ হয়ে এক উঠোনে টেনে আনে সবাইকে।

প্রত্যেকবারই মনে হয় এবারের মেলা আরও ঝলমলে, আরও বেশি সুবিধার কথা ভাবা হয়েছে পাঠকদের কথা ভেবে। সেই ময়দান থেকে এবারের মেলা – সব মেলাতেই অন্তত একবার ঢুঁ মেরেছি। আমার মনে হয়েছে এই সাজানো গোছানো বইমেলার ভেতরে ভেতরে অন্য একটা বইমেলা আছে। খুব নিবিড়, আন্তরিক, খুব মোহময়। যতই কর্পোরেট লুক আসুক বইমেলায়, সেই চোরাগোপ্তা অন্য এক মেজাজ কিন্তু অন্তঃসলিলা থাকে। সব বইমেলাতেই কেমন করে যেন সেটা তৈরি হয়ে যায়। সেই স্পন্দন টের পাওয়া যায় মমার্তের গলিতে, লিটল ম্যাগাজিনের স্টলগুলোতে, কাঙ্খিত বইটির খোঁজে আসা বারাসাতের মৌমিতা প্রামাণিকের কথায়। লিটল ম্যাগাজিনে নিজের কবিতা দেখবে বলে উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে স্টল কিংবা টেবিল খুঁজে বেড়াচ্ছে ভদ্রেশ্বরের তরুণ কবি।

নবীন অক্ষরের গন্ধ, ফিশ ফ্রাই-এর গন্ধ, সেলফির ধামাকা পার হয়ে হঠাৎ নাকে আসে গাঁজার গন্ধ। কোনও সেবায়েত সিগারেট রিফিল করে আড়াল খুঁজে নিয়েছে। এও বইমেলার এক অন্দর কি বাত! কোথাও একটা এক্সেনট্রিসিটি, একটা তীব্র প্যাশন আক্রমণ করে শিল্পকে ভেঙেচুরে নবনির্মাণ করবে বলে। এইসব ছবি আছে, তাই মেলার ভেতরে অন্য একটা মেলা প্রাণের উৎসব তৈরি করে। শুধু মেলা নয়, আসলে বইপার্বণ হয়ে ওঠে বইমেলা।

কেউ যদি হুজুগ বলে, বলুক। বইমেলা তো আসলে বিশাল একটা মিলনমেলা। কত মানুষ, কত বই! নতুন লেখকদের বই-ও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ কি আনন্দের কথা নয়? এই জীবিকাসর্বস্ব যান্ত্রিক জীবনের দিকে একটা বই অন্তত ছুঁড়ে দিয়ে যদি আবদ্ধ জলাশয়ে একটা তরঙ্গ ওঠে, কার কীসের ক্ষতি!

কোথাও একটা উন্মাদনার চোরাস্রোত টের পাওয়া যায়। ছোট ছোট পাবলিশার্স অসাধারণ কিছু ভালো বই প্রকাশ করছেন, পাঠক নিয়েছেও সে বই। সোশ্যাল মিডিয়ায় কানাকানি হতে হতে ব্যতিক্রমী কিছু লেখার কথা ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ কবি, প্রাক্তন অধ্যাপক, নবীন গল্পকার আড্ডায় মেতে ওঠে। বইমেলার এই মেজাজটাই আসল রস।

তার প্রথম কবিতার বই-এর ওপর হাত রেখে উষ্ণতা নিচ্ছে কবি। প্রচ্ছদ থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ছে কবির মুখে। কী এক দৈব বিভায় উদ্ভাসিত কবির মুখ! প্রেমিকার জন্য স্টল থেকে স্টলান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক পাগলপ্রেমিক। একটাই জিজ্ঞাসা- দাদা, কথোপকথন সিরিজটা আছে? কথা হচ্ছিল গড়িয়া থেকে আসা চিত্তরঞ্জন নস্করের সঙ্গে। সিরিয়াস প্রবন্ধের পাঠক। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন থেকে নিয়েছেন সম্পূর্ণ লালনগীতি সংগ্রহ। ধর্মপুস্তকের ব্যাপারে কথা তুলতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সোশ্যাল রিফর্মার হিসেবেই বিবেকানন্দ, চৈতন্যকে দেখতে চান। তাঁদের দেবতা বানিয়ে দেওয়ায় ঘোর আপত্তি। এবারের মেলার পরিবেশ তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে।

এক বৃদ্ধা বলছিলেন এ নেশা তাঁর যাবার নয়। বগলে ক্রাচ নিয়ে সমীরণ ঝুঁকে পড়ে বই-এর পাতা উল্টে যাচ্ছে। এক শিখ যুবক অবলীলায় বাংলায় ঝগড়া করছে বাঙালি প্রেমিকার সঙ্গে। অবশ্যই বই নিয়ে। মায়ের কোল থেকে এক শিশু হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া সেই লাল রং-এর বেড়ালটা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...