কাঞ্চনমালা

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 

পঞ্চম উপকথা, শেষ পর্ব এখানে

 

ধুর্বা উপকথা, মূল হিন্দি -- বেদনসিং ধুর্বে, ‘কোয়া পুনেম গোণ্ডিয়ন গাথা’ (২০১৪) 

 

সে অনেককাল আগের কথা। ধুর্বা বংশের শাসনে ছিল এক রাজ্য — ফুলঝর। রাজ্যের রাজা আদলশা’। তার ভাই দলশা’ আবার ছিল অত্যন্ত ধার্মিক প্রকৃতির। সেই রাজ্যেরই লৌঢ়ী নামের এক গ্রামের এক শান্ত কোণায় কুটির বানিয়ে ঘর করছিল দলশা’ আর তার বউ কাঞ্চন।

এই দলশা’ আবার ছিল দাদা অন্ত প্রাণ। সে মাঝেমধ্যেই রাজধানীতে রাজপ্রাসাদে গিয়ে বড়দা আদলের সঙ্গে নানান বিষয়ে শলা-পরামর্শ-চর্চা করত, উপদেশ নিত, আবার কখনও সখনও দিতও। সৌভ্রাতৃত্বের এই বন্ধন দেখে চোখ টাটাত অনেকেরই। দু’ভায়ের সুসম্পর্কে ফাটল ধরানোর দুষ্ট অভিপ্রায়ে দুর্জনে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।

সুযোগ মিলেও গেল অচিরে। এমনই এক মন্দজন রাজা আদলকে নিভৃতে পেয়ে দিল তার মন তার ভাই দলশা’র উপর বিষিয়ে। দলশা’র নামে একের পর এক মিথ্যে অভিযোগ আনল সেই মন্দজন। এ-ও বলতে কসুর করল না যে দলশা’ নাকি মনে মনে ছক কষছে কীভাবে আদলশা’কে সিংহাসনচ্যুত করে রাজ্য হাত করা যায়। রাগে থরথর করে কেঁপে উঠল সেই গোণ্ডভূপ আদলশা’ ধুর্বা। খাসদরবারে গোপন রাজবৈঠকে তলব পড়ল রাজার বিশ্বস্ত প্রিয়পাত্র বোডাসাগরের জমিদারের। জারি হল রাজার হুকুম -–

–‘তুমি যদি দলশা’র মুণ্ডু কেটে আমার সামনে নিয়ে আসতে পারো, ইনামে পাবে – জাগিরদারী!’

ভূসম্পত্তির লোভে কাজে নেমে পড়ল সেই জমিদার।

রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে সেই জমিদার ও তার দুই সেপাই সন্তর্পণে প্রবেশ করল লৌঢ়ীগ্রামে। পা টিপেটিপে তারা পৌঁছে গেল কাঞ্চন-দলশা’র কুটিরপ্রাঙ্গনে। কুড়ের পিছনে দাওয়ায় ঘুমিয়ে ছিল দলশা’, ভিতরে দিনের শেষ কিছু গৃহকর্ম সমাপন করছিল কাঞ্চন। সুযোগ বুঝে এক কোপে ঘুমন্ত দলশা’র মুণ্ডু ধর থেকে আলাদা করে ফেলল জমিদারের সেপাই। তারপর সেই মুণ্ডু বগলদাবা করে ফুলঝরের রাজধানীর দিকে রওয়ানা হল সেই তিন গুপ্তঘাতক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঞ্চন দেখল, কুড়ের পিছনের দাওয়ায় তার বরের মুণ্ডুহীন শব পরে আছে খাটিয়ার উপর। বুকফাটা কান্নায় অচিরেই সেখানে জড়ো হল সমস্ত গ্রামবাসী। ধার্মিক এই রাজভ্রাতার এইভাবে খুন হয়ে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারছিল না। সকলেরই শোকে-সাদমায় পাগলপারা দশা। রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে বুঝি কান্নার রোল উঠল। আর, সাথেসাথেই, ধকধক করে প্রতিশোধস্পৃহার আগুন শিখা তুলল কাঞ্চনমালার বুকের ভিতর। ঘোড়ায় চেপে সে ছিটকে ছুটে চলল রাজধানীর পথে। তার দুই চোখ ভাটার মতো জ্বলছে তখন।

পথিমধ্যে পড়ল বূঢ়া-দেওর থান। শত রাগে-দুঃখে-অভিমানেও কাঞ্চন ভুলল না গোণ্ডদের সেই আদি ইষ্টদেবতার স্মরণ নিতে। বড়ঠাকুরের থানে প্রবেশ করল সে। থানে মাথা ঠেকিয়ে প্রতিজ্ঞায় কঠোর হল — যেভাবেই হোক, স্বামীর খুন হয়ে যাওয়ার বদলা সে নেবেই। সেই থান থেকেই সে কুড়িয়ে নিল একটা কাঠের খাড়া। আবার ঘোড়ার খুরে ধুল উড়িয়ে শনশনশন হাওয়ার আগে ছুটে চলল সে — বুঝি রাতের নিথর অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলেছে আগুনের গোলা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পিছধাওয়া করে কাঞ্চন ধরে ফেলল সেই জমিদার আর তার দুই সেপাইকে। মহানন্দে তারা দলশা’র কাটামুণ্ডু দোলাতে দোলাতে চলেছিল আদলশা’র প্রাসাদ অভিমুখে। ঠিকঠাক ঠাউর করে ওঠার আগেই পিছন থেকে কালবিভীষিকা বুঝি সাক্ষাৎ মানবীরূপ ধারণ করে ধেয়ে এল। সেই কাঠের খাড়ার তড়িদ্গতি কোপে মুণ্ডু হারাল তিনজনেই। তিনটে কাটামুণ্ডু রক্তলেপা ধুলোমাটি থেকে তুলে নিয়ে আবার ছুটে চলল কাঞ্চন আর তার ঘোড়া।

কিছুদূর গিয়েই সে দেখতে পেল আরও চারজন সেই জমিদারের দলেরই সেপাই। তারাও ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে প্রাসাদের দিকেই। আসলে, রাজার হুকুম পালন করতে বোডাসাগরের সেই জমিদার রাতের অন্ধকারে তার সাথের দুই হতভাগ্য সেপাই ছাড়াও এই চারজনকেও সঙ্গে নিয়েই সেই অশ্বত্থমাসম ‘অপারেশন’-এ বেরিয়েছিল। জমিদার স্বয়ং আর দুই সেপাইকে সঙ্গে নিয়ে যখন গুটিগুটি পায়ে কাঞ্চন-দলশা’র কুড়ের দিকে এগোচ্ছিল, তখন, সেই রাতের অন্ধকারের নিঃশব্দ আড়ালেই, সেই আততায়ী-বাহিনীর এই পরের চারজন সেপাই লৌঢ়ীগ্রামের সীমানার ভিতরে-বাইরে নানান ‘স্ট্র্যাটেজিক লোকেশান’-এ ওৎ পেতে ছিল। বেগতিক দেখলেই, পরিস্থিতি বুঝে ‘সিগনাল’ দেবে অথবা ‘অ্যাকশন’-এ নামবে, এই ছিল মোটমাট ছক, যা প্রাথমিকভাবে অভীষ্টসিদ্ধে সফল হয়েছিল, আসন্ন আগামীতে কী ঘটতে চলেছে, তার আঁচ আসেনি যখন।

প্রথম তিনজনের মতোই, পরের চারজনও যখন সেই আঁচ পেল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঘাতকদলের এই সাত সদস্যের সাতখানা কাটামুণ্ডু দিয়ে মালা বানিয়ে নিজের গলায় পরে নিল কাঞ্চন। হাতে কাঠের খাড়া। এই মূর্তিতেই রাজমহলের সিংহদুয়ার দিয়ে প্রবেশ করল সে।

রাজার বৌদিকে এই রূপে দেখে বাধা দেবে কি, প্রাসাদ-প্রহরীদের বেশিরভাগই হয়ে পড়ল বিস্ময়ে মুহ্যমান। লড়তে হাত-পা সরল না তাদের। কেউ কেউ আবার ভীত-সচকিত হয়ে এদিকে ওদিকে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যে এক দুইজন তরোয়াল ওঠানোর দুঃসাহস দেখাল, তাদের পরিণতি সহজ-অনুমেয়। সেই পরিণতি দেখে বাকিরাও ‘য পলায়তি স জীবতে’ নীতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে কসুর করল না।

ভ্রাতৃহন্তারক অদলশা’ যখন দেখল খাড়া হাতে মূণ্ডমালা গলায় সেই রণাঙ্গনা শক্তিরূপ এগিয়ে আসছে তার দিকে, সেও তখন চোঁচাঁ দৌড় দিল। তারপর তার কী হল, কেউ জানে না। কাঞ্চনমালা সেই চম্পটমান রাজার প্রতি অভিসম্পাত বর্ষণ করে মাটি গেঁথে আছড়ে ফেলল তার হাতের সেই কাঠের খাড়াটা। ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতে করতে সে ফিরে এল তার গ্রামের কুঁড়েঘরে।

 

এরপর সপ্তম উপকথা, প্রথম পর্ব

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...