বাংলা বই-এর আজ ও আগামী

ইন্দ্রাণী রায় মিত্র

 

‘গেল গেল রব তোলা হল বাঙালির জাতীয় নেশা’

২০১৮ সালে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলায় আমাদের অর্থাৎ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স-এর সমস্ত সদস্যকে প্রচুর গালিগালাজের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর কারণ আমরা এবছরই প্রথম প্রকাশ করেছি রোমান হরফে কিছু কালজয়ী বাংলা বই — আবোল তাবোল (সুকুমার রায়), সহজপাঠ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) ও হাসিখুশি (যোগীন্দ্রনাথ সরকার)। এক শ্রেণির অত্যন্ত ‘সংবেদনশীল’ সমালোচক আমাদের শুধু কাঠগড়ায় তুলতে বাকি রেখেছেন কারণ আমরা নাকি বাংলাভাষার অন্তিম সংস্কার করবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। আসলে গেল গেল রব তোলা হল এক শ্রেণির বাঙালির জাতীয় নেশা। রোমান হরফে বাংলা বই প্রকাশের ইচ্ছা ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বহুবছর আগেই প্রকাশ করেছিলেন। আমরা শুধু আমাদের এই মহান পূর্বপুরুষটির নির্দেশিত পথে দু’পা বা বলা ভাল তিন বই হেঁটেছি মাত্র। কিন্তু তাতেই বেশ কিছু ‘বৈঠকখানার বিপ্লবী’ তেড়েফুঁড়ে আমাদের যথেচ্ছ গালমন্দ করছেন। কেউ কেউ আবার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আমাদের চোর-জোচ্চোর বলতেও ছাড়েননি। তবে একদল পাঠক ও লেখক কিন্তু সোৎসাহে এই বইগুলি গ্রহণ করেছেন, অন্যদের কিনিয়েছেন এবং আমাদের এই নতুন প্রচেষ্টাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন। তাঁদেরই একজনের অকাট্য যুক্তি আমাদের খুবই মনোগ্রাহী মনে হয়েছে। বাংলাভাষা এত ঠুনকোও নয়, পল‍্কাও নয় যে সামান্য কতগুলি রোমান হরফে প্রকাশিত বাংলা বই-এর জন্য ডুবে যাবে।

‘বাংলা বই বিক্রি হয় না — কে বলেছে?’

বাঙালিদের মধ্যেই এমন একটি শ্রেণি বিরাজ করেন যাঁরা খুবই অদ্ভুত। তাঁদের মজ্জায় মিশে আছে সমালোচনার নামে কুৎসা করার স্পৃহা, তাঁদের রক্তের মধ্যে বয়ে চলেছে নিরন্তর দুঃখ বিলাসিতা। অর্ধেক জলে ভরতি গেলাসটাকে তাঁরা সবসময়ই অর্ধেক খালি পাত্র হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। তাই প্রায়শই নানা জ্ঞানগর্ভ আলোচনায়, বক্তৃতায়, সেমিনারে, আমরা শুনে থাকি বাংলা বই-এর বাজার নাকি নিম্নগামী। এঁদের কথা শুনে প্রকাশক হিসেবে হাসি সংবরণ করা খুব মুশকিল হয়ে পড়ে। ঠিক যেমন অবাক লাগে যখন দেখি আমার পাশের পাড়ার দু’টো বা তিনটে টেস্ট ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারটি কোনও তাবড় খেলোয়াড়ের খেলার বিশ্লেষণ করেন বেশ নাটকীয়ভাবে টেলিভিশনের বিশাল পর্দায়। দীর্ঘ দু’দশক ধরে বইমেলায় অংশগ্রহণ করে আমি নিশ্চিত যে বাংলা বই-এর বাজার ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। আমাদের নিজস্ব পরিসংখ্যান যা বলে তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার যে গত পাঁচ বছরে নিয়মিতভাবে বাংলা বই-এর বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। তার মানে বাংলা বই-এর পাঠকও নিশ্চয়ই বেড়েছে। যতই টেলিভিশনের দাপট বাড়ুক না কেন, যতই বর্তমান প্রজন্ম কম্পিউটার গেমস বা অ্যাপস-এ মেতে থাকুক না কেন, তারা বইও পড়ছে — এটা প্রমাণিত সত্য কারণ বর্তমান প্রজন্ম যদি বই-এর জগতে প্রবেশ না করত তাহলে বই-এর বিক্রি এই হারে বৃদ্ধি পেত না।

‘ফেসবুক বই-এর পরিপন্থী? একদমই না’

২০১৮ সালের আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা মিত্র ও ঘোষ পরিবারের কাছে ছিল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথমত পুস্তকমেলা স্থানান্তরিত হয় মিলনমেলা প্রাঙ্গণ থেকে সল্টলেকের করুণাময়ীর কাছে সেন্ট্রাল পার্কে। আমাদের অন্যান্য প্রকাশক বন্ধুর মতো আমরাও কিছুটা সংশয়ে ছিলাম। নতুন জায়গায় পাঠক তথা ক্রেতারা আসবেন তো? দ্বিতীয়ত ব্যবসায়িক দিক দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে আমরা এক বহুল প্রচলিত পত্রিকায় আমাদের নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিই। তার বদলে বেছে নিই ফেসবুককে, পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে। আমরা শুরু করি ফেসবুক লাইভ এবং ফেসবুকে বিজ্ঞাপন তথা বই-এর খবর জানানো। আর আশ্চর্যরকমভাবে আমাদের এই নতুন পদ্ধতি বিপুল সাড়া ফেলে পাঠকদের মধ্যে যার ফলস্বরূপ এবছরে বইমেলায় আমাদের বিক্রির পরিমাণ অনেক পেছনে ফেলে দেয় ২০১৭-এর বিক্রিকে। সুতরাং, আবারও আগের কথার রেশ টেনেই বলতে হয় যারা ফেসবুক করেন তাঁরা বইও পড়েন।

‘আমি শাড়ি-গয়না কিনি না, সেই টাকায় বই কিনি’

আমার দাদু সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র প্রায়শই বলতেন, জানিস বড়দি, প্রত্যেক পাঠকের একটা নিজস্ব গল্প থাকে। বইমেলায় বহুদিন এক নাগাড়ে বসার সুবাদে আমি এরকম বহু গল্প ‘দেখেছি’। কী করে ভুলি পাইকপাড়া থেকে নিয়মিত বইমেলায় আসা মধ্যবয়স্কা মানুষটিকে, যিনি একটি অতি সাধারণ পোষাকে এসে এক একদিনে শুধু আমাদের বিপণি থেকেই পাঁচ-ছ হাজার টাকার বই কেনেন। শেষদিনে বিদায় নেবার আগে নিয়ম করে আমায় বলে যান, এবছরের মতো আমার কেনাকাটা শেষ, আগামী বছর আবার দেখা হবে। না থাকতে পেরে আমি যখন তাঁকে শুধোই, বছরে আপনার বই কেনার বাজেট কত? তখন কিছুমাত্র না ভেবে সেই মানুষটি বলে ওঠেন দেড় থেকে দু’লাখ টাকা, তিন লাখও হয়ে যায় কোনও কোনও বছর। আমি তো দামী শাড়ি গয়না কিনি না, কিনি শুধু বই। কী করেই বা ভুলি সেই দম্পতিটিকে, যাঁরা দুধের শিশু কোলে নিয়ে সুদূর ব্যারাকপুর থেকে তিন চারদিনের ব্যবধানে পনেরো-ষোল হাজার টাকার বই কিনে ভারি ভারি ব্যাগ হাতে একগাল হাসি নিয়ে ফিরে যান নিজেদের বাড়ি। একজন অদ্ভুত দর্শন বৃদ্ধ মানুষ যখন কাঁপা কাঁপা হাতে এক তাড়া পঞ্চাশ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বলেন, দেখো তো মা, কত টাকা আছে? কিরীটী অমনিবাস-এর ক’টা খণ্ড হবে ঐ টাকায়? এই সব ‘অপ্রকৃতিস্থ’ পাঠকেরাই বাংলা ভাষা তথা বাংলা বই বাজারের ধারক এবং বাহক। আমরা যারা বই বেচে খাই, কুর্ণিশ জানাতে বাধ্য হই এই মানুষদের।

‘আমি চাকরি ছেড়ে বই-এর ব্যবসায় এসেছি’

বর্তমানকালের বই-এর ব্যবসার পারদ ঊর্ধ্বগামী হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হ’ল হালে এক ঝাঁক তরুণ প্রকাশক এসে পড়েছেন হৈ হৈ করে। তাঁরা শুধু বই পড়তেই ভালোবাসেন না, ভালোবাসেন বই প্রকাশনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে। এঁদের মধ্যে মধ্যে কেউ কেউ আবার দামী চাকরি-বাকরি ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছেন বাংলা বই-এর প্রকাশনার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। এঁদের কাছ থেকে আমাদের অর্থাৎ যারা আমরা বয়েসটা বেশ বাড়িয়ে ফেলেছি তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। কোন নেশায়, কী প্রত্যয়ে তাঁরা নিরাপদ চাকরির নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে বই-এর ব্যবসায় ঝুঁকি নিয়ে দিনযাপনের চেষ্টা করেন তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যুক্তি-তর্কের আওতার বাইরে। আমার মনে হয় এই তরুণ প্রকাশকের দলই হ’ল বাংলা বই তথা সাহিত্য ভাণ্ডারের সঞ্জীবনী সুধা। এঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমেই প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত হচ্ছে বাংলা বই-এর বর্ণময় জগৎ।

বই-এর বেআইনি পিডিএফ? ধ্যুস‍্স‍্!!

চোরাকারবারির অভাব কোনও ব্যবসাতেই হয় না, স্বভাবতই বই-এর ব্যবসাতেও এদের অবাধ বিচরণ। প্রায়শই দেখা যায় অনেক নামী দামী লেখকের কালজয়ী সৃষ্টিটির জাল সংস্করণ ও পিডিএফ যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা বিরক্ত হই, ক্ষুব্ধ হই এবং কখনও কখনও আইনের দ্বারস্থ হয়ে থাকি। এই বেআইনি পিডিএফ কি বই-এর ব্যবসার ক্ষতি করছে? মনে হয়, না – কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যদি এক শতাংশ পাঠক পথের পাঁচালীর পিডিএফটাকেই বই ভেবে তৃপ্ত থাকে নিরানব্বই শতাংশ পাঠক পথের পাঁচালী বইটি সংগ্রহ করে নিজের বই-এর তাকে তুলে রাখতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাই আপাতদৃষ্টিতে বাংলা বই-এর পিডিএফ বাংলা বইবাজারকে ধ্বংস করে দেবে এমন মনে হলেও আমার মতে সেই মনে হওয়া অমূলক শুধু নয় ভিত্তিহীনও বটে। যাঁরা বই কিনে পড়বার তাঁরা বই কিনবেন এবং বই পড়বেন, অন্য কোনও মাধ্যমই তাঁদের সন্তুষ্ট করতে পারবে না।

‘বই আপনার শিশুটির একমাত্র বন্ধু’

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স সম্প্রতি ‘বই-বন্ধু’ নামে একটি নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ’টি ক্ষুদে পড়ুয়াদের একটি ক্লাব। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কোনও শনিবার বা রবিবার, এই ‘বই-বন্ধু’ ক্লাবের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে কচিকাঁচারা গল্প বলে, তাদের স্বপ্নের সাহিত্যিকদের মুখোমুখি হয় এবং নিজেদের সৃষ্ট সাহিত্য পাঠ করেও থাকে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স ‘বই-বন্ধু’ ক্লাবের মাধ্যমেই খুঁজে পায় দশম শ্রেণীর ছাত্র অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং এবছরের বইমেলায় তার উপন্যাস ‘দুর্গাপুজোয় অসুর নিধন’ প্রকাশ করে। ‘বই-বন্ধু’ ক্লাব ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্ত থাকে ডাক পাচ্ছে। প্রচুর উৎসাহী বাবা-মা-অভিভাবক-শিক্ষকরা চাইছেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা যেন কিছু বাংলা বই পড়ে। বলাই বাহুল্য এই বাবা-মায়েদের অনেকেই তাঁদের অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলা সন্তানদের জন্য সোৎসাহে সংগ্রহ করছেন রোমান হরফে ছাপা বাংলা বই। পশ্চিমবঙ্গ তথা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বসবাসকারী বাঙালিরা ‘বই-বন্ধু’ এবং রোমান হরফে ছাপা বাংলা বই-এর মাধ্যমে তাঁদের ভাষার শেকড় ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। বাংলাভাষা অমর, পৃথিবীর কোনও শক্তিই এই ভাষার ক্ষতি করতে পারেনি, পারবেও না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to PARTHA DEY Cancel reply