তারান্তিনো — দুই

প্রিয়ক মিত্র

 

গত সংখ্যার পর

 

২৫-এ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট, রাষ্ট্র কর্তৃক নির্বিচারে গণহত্যার পর স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের যুবসমাজের একমাত্র লক্ষ্য। হাতে অস্ত্র তুলে নেয় বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। খানসেনা হত্যা আর ধর্ষণ চালিয়েই যাচ্ছিল যখন, তখন মুক্তিসেনা হয়ে ওঠে খানসেনাদের ত্রাস। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির রাজাকাররাও তটস্থ হয়ে থেকেছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার জন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়েছে খানসেনারা। তাদের পরিবারের ওপর নিষ্ঠুর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি।

“বল পুঙ্গির পুত, হালা পাকিস্তানির বাচ্চাদের মোচ্ছব করনের জায়গাটা কোথায়?” — ইকবালের চোখে হিংস্র ক্রোধ। ওই রক্তাভ চোখ দেখে ভয় পাবে না এমন সাহসী কেউ নেই।

চুলের মুঠি ধরে আহত রক্তাক্ত খানসেনার মাথাটা তুলে ধরল সাজ্জাদ, “আসমা আখতার কি ডেরা মে”, কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিল সন্ত্রস্ত খানসেনা। এর আগে তার ঊর্ধ্বতন মুক্তিসেনার কোনও প্রশ্নের জবাব তো দেয়ইনি, উপরন্তু তাদের ‘অওকাত’ নিয়ে তামাশা করেছিল। তার ছিন্ন মুণ্ডু এখন ধুনির আগুনের সামনে সযত্নে রাখা। সে আর কোনও স্পর্ধা দেখাবে না।

সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এক জায়গায় হাজির হবে গোটা শত্রুশিবির। আক্রমণের এর চেয়ে ভাল সুযোগ হয় না।

“এ শুয়োরের বাচ্চারে বাঁচিয়া রাখনের দরকার আছে কি আর”, আড়চোখে বন্দি খানসেনার দিকে তাকিয়ে বলল মঈদুল।

“বাঁচামরার মাঝে লটকে দিলেই হয়। এ আমাদের সিক্রেট ইনফরমেশন দিয়া দিছে। জানতি পারলে শালাক বাঁচ্যে রাখবে না খানসেনারা। আমরা না মারলেও ও মরবে। তার চেয়ে রগড় করা যাক”, সূর্য উবাচ।

গোটা শিবির খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল।

বুকে ছুরি দিয়ে করা চাঁদতারার খোদাই নিয়ে ঘষটে ঘষটে নদীর ধার পর্যন্ত আসতে পেরেছিল খানসেনাটি। তার কেটে পড়া জিভ তখনও মুক্তির শিবিরে পড়ে। জল মুঠোতে তুলেও মুখে দিতে পারল না সে। যে কটা নারীধর্ষণ সে করেছে এখনও অবধি, যে কটা বাঙালি যুবককে মেরেছে বেয়নেটে খুঁচিয়ে, সেই সব হত্যা, ধর্ষণ যেন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে ঘিরে। কোনওমতে নিজের ফিরে পাওয়া পিস্তলটাকে মাথায় ঠেকাতে পারল সে। চিত হয়ে শুয়ে।

খুলি উপচে যাওয়া রক্ত মিশে গেল নদীতে।

ইকবাল, সাজ্জাদ, আনিসুর, রফিক, সূর্য, আকবর, চঞ্চল, মঈদুল — এই আটজন এমনই ভয়ঙ্কর। খানসেনাদের কাছে এরা ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। কেন একটু খতিয়ান নেওয়া যাক এদের কার্যকলাপের।

জেনারেল আনসারির নাম চিটাগং, ঢাকা, রাজশাহীর বহু লোকে জানত। বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা লিস্ট তৈরি করেছিলেন তিনি। তাদের বাড়ি এবং তাদের সম্ভাব্য লুকিয়ে থাকার জায়গায় খোঁজ চালানোর জন্য একজন গোয়েন্দা নিয়োগ করেছিলেন তিনি। খতরনাক সেই গোয়েন্দার নাম ওয়াসিম আলী। এই লোকটির ইতিহাস বিশেষ কেউ জানত না। শুধু এটুকু জানা ছিল সকলেরই, মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তিনি শিকারী নেকড়ের মতন। তার মতন ধূর্ত এবং হিংস্র এবং বুদ্ধিমান প্রাণী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বিরল।

যাই হোক, যা বলছিলাম, এই জেনারেল আনসারি একজন আদ্যোপান্ত নারীলোলুপ ইতর, অমানুষ। বহু মুক্তিযোদ্ধা, যাদের খোঁজ পেতে মরিয়া হয়ে রয়েছে খানসেনারা, তাদের মা, বোন, স্ত্রী ধর্ষিতা হয়েছে এই জানোয়ারটির হাতে। একে শায়েস্তা করতে তৎপর ছিল অনেকেই।

এক সন্ধেবেলা ঢাকা শহরের এক বিলাসবহুল হোটেলের ঘরে এক বিদেশিনীর সঙ্গে রয়েছেন জেনারেল। এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।

জেনারেল একটি শেরির বোতল থেকে বিদেশিনীটির গ্লাসে মদ ঢেলে দিচ্ছিলেন। বিরক্ত হয়ে অনাবৃত ঊর্ধাঙ্গকে বিছানা থেকে উত্থিত করে দরজা খুললেন জেনারেল।

একটি অল্পবয়সী বাঙালি রুমবয় দাঁড়িয়ে ছিল বাইরে। মদের গ্লাস হাতে খালি গায়ের জেনারেলকে দেখে প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে গেল সে। কী বলবে বুঝে ওঠার আগেই ওপাশ থেকে বাজখাঁই স্বর ভেসে এল, “কেয়া চাহিয়ে?”

হতবুদ্ধি রুমবয় বাক্যব্যয় না করে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল জেনারেলের হাতে। চিরকুট খুলে জেনারেল দেখলেন অপটু ইংরেজিতে লেখা চারটি বাক্য। যার মর্মার্থ করলে দাঁড়ায়, রাজশাহী থেকে আগত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের চারজন সেনা দেখা করতে চায় তার সঙ্গে। একটা প্রচণ্ড জরুরি বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চায় তারা। আনসারির বডিগার্ডদের মধ্যে কিছু মুক্তিসেনা ঢুকে বসে রয়েছে। আনসারির জীবনের ঝুঁকি প্রবল, ইত্যাদি।

আনসারি মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রাস হতে পারেন, কিন্তু তিনি নির্বোধ। এই চিঠি পড়ে তার চোখ জ্বলে উঠল দপ করে। তিনি এই চারজনকে পাঠিয়ে দিতে বললেন তার স্যুইটে। বডিগার্ডদের মধ্যে কে গদ্দার জানা প্রয়োজন। তার সঙ্গিনীকে বললেন পাশের ঘরে অপেক্ষা করতে। নিজে ইউনিফর্মে সজ্জিত হলেন। সেনাদের সামনে বিনা ইউনিফর্মে থাকাটা শোভন হবে না।

দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুললেন জেনারেল। মাটিতে পা ঠুকে স্যালুট জানানোর পর ঘরে ঢুকল চারজন সৈন্য। জেনারেল আনসারি দরজা বন্ধ করলেন।

জীবনে শেষবার কথা বলার জন্য মুখ খুললেন জেনারেল আনসারি। কিন্তু কোনও ধ্বনি নির্গত হওয়ার আগেই মেশিনগানের শব্দে এবং আলোর ঝলকানিতে ঘর ভরে উঠল। সশস্ত্র অবস্থায় কী করে ওই ঘর অবধি পৌঁছেছিল ইকবাল, মঈদুল, চঞ্চল এবং সাজ্জাদ, তা কেউই জানে না। বাকিদের কাছে যা অসাধ্য এই আটজনের প্রত্যেকের কাছে তা জলভাত। জেনারেল আনসারির শরীরের এমন কোনও অংশ ছিল না যা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়নি। তবে এই দেহ দেখে অনেকেই আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন, তার কারণ আলাদা। তার কারণ আনসারির লিঙ্গ কেটে মুখগহ্বরে ঢুকিয়ে তারপর ঠোঁটজোড়া নিপুণভাবে সেলাই করে দেওয়া ছিল। আনসারির বডিগার্ডরা গুলির শব্দ শুনে যতক্ষণে ঘরে এসে পৌঁছেছে ততক্ষণে এই ঘটনাটি ঘটে গেছে। এবং এই গোটা ঘটনাটি ঘটিয়ে ঘরের জানলা দিয়ে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় পালিয়েছিল এই চারজন।

ছবি : স্বস্তিক করগুপ্ত

ভয়ঙ্কর সব গল্প জানা যায় এই আটজনের সম্পর্কে। খানসেনাদের আতঙ্ক এই আটজনের দলটি।

বারাসাতের অদূরে ইছামতীর ধারে একটি বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমিতে একটি জিপ দাঁড়িয়েছিল এসে। তার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল ইকবালদের দল। এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেনান্ট অধীর চক্রবর্তী। এদেরকে ট্রেনিং দিয়েছেন তিনিই। আজ ঢাকায় খুব জরুরি মিশন ওদের। রীতিমতো কঠিন মিশন। গেরিলা হয়ে শত্রুশিবিরে মিশে থাকা, বালির বস্তার পেছনে থাকা সৈনিককে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া, বুকে ভর দিয়ে সরীসৃপের মতন হাঁটা, সাঁতার, সবকিছু শিখে নিয়েছে তারা এ কদিনে। তারা যদিও জানত না, এই ভারতরাষ্ট্রের পোষা পুলিশ কুকুররা পশ্চিমবঙ্গে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাদেরই মতন বিপ্লবী যুবকদের।

ভোরের আলো ফুটছে আস্তে আস্তে। বর্ডার পার করবে এরা। আর্মির জিপ পৌঁছে দিয়ে আসবে বর্ডার অবধি।

অধীর চক্রবর্তী হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “বেস্ট অফ লাক ফর ইওর মিশন ইন ঢাকা।”

হাত মেলাল প্রত্যেকে। তারপর সমস্বরে বলে উঠল, “জয় বাংলা!”

ঢাকায় অভিনেত্রী আসমা আখতারের বাড়িতে আজ মোচ্ছব। পার্টি। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভিড় জমেছে। এই নিমন্ত্রিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের চিত্রতারকারা, শিল্পপতিরা, রাজনীতিকরা এবং অবশ্যই সেনাপ্রধানরা। আর অন্যান্য অনেক সেনাপ্রধানদের সঙ্গে সঙ্গে হাজির থাকবেন স্বয়ং জেনারেল নিয়াজী।

জেনারেল নিয়াজীর নাম কে না জানে? কুখ্যাত এই জেনারেলকে ঘৃণা করে না এমন লোক বোধহয় দুপক্ষেই খুঁজে পাওয়া ভার। তবু, যুদ্ধের খাতিরে একপক্ষের কাছে তিনি বরণীয়‌।

নাজমা খাতুনের মাথার ভেতর গিজগিজ করছে নানান ভাবনা। অস্থির লাগছে তার। কোনও কাজে সঠিকভাবে মন দিতে পারছে না নাজমা।  আসমার সবথেকে নির্ভরযোগ্য সহকারী সে। আসমা তাকে ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না অধিকাংশ সময়। সে যদি আজকে এমন গুরুত্বপূর্ণ দিনেই নিষ্ক্রিয় থাকে তাহলে চলবে কী করে! আসমা অতিথি আপ্যায়নের ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যেই খেয়াল করছিল নাজমা অন্যমনস্ক এবং স্লথ। আসমা জানে নাজমার জীবনের ট্র্যাজেডি। নিজের চোখের সামনে নিজের গোটা পরিবারকে ধ্বংস হতে দেখার থেকে বীভৎস আর কী হতে পারে! কিন্তু আজ কোনও বিষয়ে ত্রুটি থাকলে ঘোরতর বিপদ। কারণ আসমাকে আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। অভিনেত্রী হিসেবে সবথেকে কঠিন পরীক্ষায় তাকে আজ সসম্মানে পাশ করতে হবে, নইলে শিয়রে শমন।

আজ সকালেই ভারতবর্ষ থেকে আটজনের একটি দল রওনা দিয়েছে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে  রয়েছেন কমান্ডার মফিজুল ইসলাম। আজ তারাও আসমার বাড়ির অতিথি। তারা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসবে বিশেষ উদ্দেশ্যে। আজ এই আমোদফূর্তির মাঝেই নিয়াজীকে লাশে পরিণত করবে তারা। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে উপস্থিত হওয়া সমস্ত সেনাপ্রধান, সরকারি লোক এবং পাকিস্তানপন্থী শিল্পী, বেনিয়াদের আজ শমন জারি হবে। পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে আজ। কিন্তু ওই মুক্তিযোদ্ধারা এখনও যেটা জানে না সেটা নিয়েই আসমা বেশি ভাবিত। আজ, এই পার্টিতে, যেকোনও মুহূর্তে এসে উপস্থিত হতে পারেন ইয়াহিয়া স্বয়ং। ভারতবর্ষের বুকে ইয়াহিয়াকে খতম করার নীল নকশা ব্যর্থ হয়েছে। আজ মুক্তিযোদ্ধাদের সুবর্ণ সুযোগ। ২৫শে মার্চের দগদগে স্মৃতি যাদের কাছে টাটকা, তাদের কাছে প্রতিশোধ সত্য, ধ্রুব সত্য। সেই প্রতিশোধের পবিত্র আগুনকে অস্বীকার করে কার সাধ্যি।

নাজমা। নাজমা খাতুন। ব্রাহ্মণবেড়িয়া গ্রামে ওদের বাড়ি ছিল। বাড়ির ‘হওয়া’ যদি অতীতসূচক হয় তাহলে সেখানে রক্তপাত অবধারিত, সে রক্তপাত অন্তর্বর্তীও হতে পারে, তবু তা রক্তপাতই।

নাজমা। নাজমা খাতুন। তার মনে পড়ে তাদের ইরফান সাহেবের বাড়ির গোপন কুঠুরিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাদের। তার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের সন্ধানে তখন ক্ষ্যাপা কুত্তার মতন লেগে রয়েছে কালান্তক খানসেনারা।

নাজমার মনে পড়ে ওর বাড়ির কাছে বিকেল আসত চুপিচুপি‌। সেই বিকেল দেখে নাজমার মনে হত বিদেশের নিখুঁত গ্রামগুলোতে বিকেল হয় এমন করেই। সেই বিকেল যেন আসত শুধু নাজমার জন্যই। সে বিকেল দলছুট।

তেমনই এক বিকেলে এক সুদর্শন পাকিস্তানি ঊর্দিধারী এসে হাজির হল ইরফান সাহেবের বাড়িতে।

“অধমের নাম ওয়াসিম আলী! আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশ নিয়ে পড়েছেন না? আমি কিন্তু আপনের জুনিয়র ছিলাম…”

বাংলা সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা বলে চলেছেন ওয়াসিম আলী। ইরফান সাহেবের সঙ্গে। দম বন্ধ করে রয়েছে নাজমা। এবং তার গোটা পরিবার।

কী মোলায়েম গলা ওয়াসিম আলীর। কী অমায়িক ভদ্রলোক।

“জনাব, শামসুর রহমান আপনের ফেভারিট পোয়েট? জসীমউদ্দীন আর জীবনানন্দের মধ্যে কে বেশি প্রিয়?”

কথা এগোচ্ছিল যত, তত ঠান্ডা হয়ে আসছিল ওয়াসিম আলীর গলার স্বর। ইরফান সাহেবের গলা ততই ভাঙছিল। এসব আলাপ চালাতে চালাতে ইরফান সাহেবের টেবিল থেকে একটা খাতা টেনে নিয়েছিলেন ওয়াসিম আলী। সেই খাতার পাতায় ওয়াসিম আলীর পেনসিল চলছিল দ্রুতবেগে, চোখের দৃষ্টি হিমশীতল, খুনে হয়ে উঠছিল ক্রমশ, অথচ কথা বলে চলেছেন লালন, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। ইরফান সাহেবের সন্ত্রস্ত চোখ চলে গেল খাতার পাতায়, সে পাতাটা কথা বলতে বলতেই তার সামনে মেলে ধরেছেন ওয়াসিম আলী।

“মুক্তিযোদ্ধা রাকিব আর তার পরিবার আপনার বাড়িতে আত্মগোপন করেছে তা আমরা জানি। ওভাররিঅ্যাক্ট করবেন না খবরদার, শুধু আমার ইনস্ট্রাকশনস ফলো করুন। কথার নড়চড় হলে স্রেফ খতম হয়ে যাবেন।”

ইরফান সাহেবকে সন্ধান দিতে হয়েছিল নাজমাসহ রাকিবের গোটা পরিবারের। কয়েক রাউন্ড গুলিতে সাবাড় হয়ে গিয়েছিল নাজমার বাবা, তার বড়দা, তাদের কত পুরনো সঙ্গী করিমচাচা। নাজমার বৌদি আর সৎমাকে ওরা বেঁধে ফেলেছিল। নাজমা পালিয়ে বেঁচেছিল। যতক্ষণ ও ওদের দৃষ্টিগোচর ছিল, ছুটতে ছুটতেও ও টের পাচ্ছিল ওয়াসিম আলীর নেকড়েসুলভ দৃষ্টি ওকে লক্ষ করে চলেছে।

“নাজমা…”

আসমার ডাক যেন এল চরাচর ভেদ করে। হু হু ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ, আর্তচিৎকার ফুঁড়ে একরাশ লোকের গুঞ্জন, ফিসফাস, অট্টহাসি। আসমার কাছে এগিয়ে গেল নাজমা।

“এমন ফ্যাকাশে লাগছে কেন তোকে? কত বড়মানুষের ভিড় হয়েছে আজ আমার বাসায়। একটু সাজতে পারতিস তো!” একটু থামল আসমা। নাজমার মাথায় হাত রাখল। “পুরনো কথা মনে করিস না নাজমা। কষ্ট বাড়িয়ে কী লাভ?”

ভরা দীঘির মতন টলটলে চোখ তুলে তাকাল নাজমা। আসমা আর কী বুঝবে কী লাভ! নাজমা জানে কী লাভ! আজ আসমার বাড়িতে এই অনুষ্ঠানের ফাঁকেই সেনাপ্রধানদের গোপন বৈঠক। সেখানে উপস্থিত থাকবেন স্বয়ং জেনারেল নিয়াজী। থাকবে রাজাকাররা। আর সকলের সঙ্গে আর একটা মুখও চোখে পড়েছে নাজমার। সেই শীতল চাহনি, সেই মোলায়েম গলা। তার পরিবারের হন্তারক ওয়াসিম আলীও আজ হাজির থাকবে এই বৈঠকে।

নাজমার চোখে দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। কেরোসিনে ভেজানো কার্পেট প্রস্তুত। শুধু ওপরের ঘুলঘুলির বড় ফাঁক দিয়ে খুব সাবধানে জ্বলন্ত লাইটার গলিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। এই কাজটার প্রস্তুতিও সারা। ঘরের পেছনদিকে একটা টুল রাখা। সেটার ওপর উঠে পড়লেই হল। এখানকার নিরাপত্তা নিয়ে কারুর কোনও দুশ্চিন্তাই নেই। এই সুযোগটাই নিতে হবে। নাজমার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল ভাবতে ভাবতে। স্বাধীন বাংলাদেশের থেকেও তার কাছে বেশি জরুরি এবং পবিত্র হল প্রতিহিংসা।

“কেমন আছেন, আপা?”

‘আপা’ সম্বোধনটা ওয়াসিম আলীর মুখে শুনে হেসে ফেললেন আসমা। “ভালো, আপনি কেমন আছেন আলীসাব?”

“ভালো। আসুন একটু বারান্দায় দাঁড়ানো যাক…”

জোছনায় ভিজে গেছে আসমা আখতারের বাড়ির বাগান। বারান্দা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ম্যাগনোলিয়া, বোগেনভোলিয়া। আসমা আখতারের ভেতরে উদ্বেগ টহল দিচ্ছে। এখনও এসে পৌঁছয়নি ওই আটজনের দল?

ফস করে দেশলাই জ্বালানোর শব্দ। চুরুট ধরালেন ওয়াসিম আলী।

“আপনের গেস্টরা কখন আসবে?”

আসমা আখতার আঁতকে উঠলেন। ঠান্ডা গলা, শিরদাঁড়ায় হিমেল স্রোত বইয়ে দেওয়া চাহনি ওয়াসিম আলীর।

গলার কাছটা শুকিয়ে এসেছে আসমার। যথাসম্ভব স্বাভাবিক থেকে কাষ্ঠহাসি হেসে আসমা বললেন, “গেস্ট! গেস্টরা তো সব এসে গেছে। বাকিরাও এসে পড়বেন।”

“না! অরিজিনাল গেস্টরাই তো এখনও হাজির হয় নাই!”

কী বলবেন আসমা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। এই ধূর্ত শয়তানটা জেনে গেছে সব? তাহলে তো সমূহ সর্বনাশ! কিন্তু এত গোপনীয় একটা অপারেশনের কথা ও জানল কোত্থেকে! না কি ও ইয়াহিয়ার হঠাৎ এসে হাজির হওয়ার কথা বলছে!

শেষ সম্ভাবনাটার কথা মাথায় রেখে আসমা বুকে খানিক বল নিয়ে মুচকি হেসে বলল, “এ খবর তো আপনি ভালো রাখবেন আলীসাব। আসলি মেহমানের আদরযত্ন তো আপনার করার কথা, আমার তো নয়। প্রেসিডেন্ট সাব কি আর আমার মত অ্যাকট্রেসের জন্য এখানে…”

আসমার নরম ঠোঁটে আঙুল রাখলেন ওয়াসিম আলী। “কী করেন কী মিস আখতার! এ খবর রাষ্ট্র করবেন না। বাই দ্য ওয়ে, আপনাকে আমি জিগাইতাসি আপনের এক্সক্লুসিভ গেস্টদের ব্যাপারে। প্রেসিডেন্ট সাবের কথা জিগাইতেসি না।”

আসমার মুখ সাদা হয়ে গেল। সে সবরকম পরিস্থিতিতে নিপুণ অভিনয়ের জন্য তৈরি ছিল আজ। কিন্তু এই পরিস্থিতি একেবারে আচমকা। ওয়াসিম আলীর বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল আসমার।

ওয়াসিমের চোখ লাল। দাঁতে দাঁত ঘষে একবার বললেন, “ট্রেটর!” তারপর আসমাকে কোনও সতর্কতার সুযোগ না দিয়ে একেবারে টেনে নিলেন নিজের কাছে। আসমা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওয়াসিমের আস্তিনে লুকিয়ে রাখা একটা ছুরি তার শিফনের পোষাক ভেদ করে, পেটের বাঁদিকের ওপরের অংশের চামড়া ভেদ করে সোজা লিভারে গিয়ে ঠেকল। তারপর মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ঘুরিয়ে ছুরির বাঁটটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মারলেন ওয়াসিম আলী। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন আসমা আখতার।

আরাফাত শিকদার, কমান্ডার ইন চিফ, তিন নম্বর সেক্টর, অপেক্ষা করছিল আসমা আখতারের প্রাসাদোপম অট্টালিকার সিংহদরজার সামনে দাঁড়িয়ে। একবার আড়চোখে দেখে নিল, দরজার সামনে দাঁড়ানো দুজন দারোয়ানের দিকে। খানসেনা। চোখেমুখে বর্বরতা। নিয়াজী এবং ইয়াহিয়া যখনতখন এসে পৌঁছতে পারেন চরম গোপনীয়তায়। অন্তত সেরকম খবরই রয়েছে মুক্তিসেনার কাছে।

আরাফাত শিকদারের কানে মৃদু শিস এল একটা, আরাফাত লহমায় সতর্ক। মুক্তিসেনারা প্রত্যেকেই খানসেনার ছদ্মবেশে ঢুকবে। কাজেই সামনের দরজা দিয়েই ঢুকবে তারা।

কিন্তু আসমা আখতার কই? তার আতিথেয়তা ছাড়া তো মুক্তিসেনারা সহজে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করতে পারবেই না।

এসব সাতপাঁচ ভাবছিল আরাফাত, আচমকা তার অবশ লাগতে শুরু করল। মাথা ঝিমঝিম করছে কেন এরকম?

মুক্তিসেনারাই বা কই? চারপাশ এমন আশ্চর্য রকমের নীরব কেন?

দরজায় প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন খানসেনা তার দিকেই এগিয়ে আসছে না?

এত আবছা লাগছে কেন তার দৃষ্টি?

তার নাকে ক্লোরোফর্ম দেওয়া রুমালটা যে আরও সুষ্ঠভাবে বসে যাচ্ছে, সেটা এবার অনুভব করল আরাফাত। তারপর সব অন্ধকার।

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...