রানিগঞ্জ-আসানসোল : প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার এক নিকৃষ্ট নজির

অরিত্র ভট্টাচার্য

 

২৬শে মার্চ আসানসোলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হয়। ঘটনার সূত্রপাত পাশের রানিগঞ্জ শহর থেকে। যেখানে তার আগের দিন একটি রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়ায়। পরবর্তী দিনগুলিতে গোটা আসানসোল শহর জুড়েই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। এই হানাহানিতে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। কার্ফু জারি হয়। চার বা তার বেশি লোকের একসাথে জড়ো হওয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। অবশেষে নিষেধাজ্ঞাগুলি গত সোমবার তুলে নেওয়া হয়।

ঘটনাবলি সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান করে এবং এই ঘটনাগুলি যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তেমন মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে — এর মধ্যে যারা মিছিলগুলি সংগঠন করেছিলেন বা তাতে অংশ নিয়েছিলেন তেমন মানুষও আছেন — একটা জিনিস পরিষ্কার যে, পুলিশ এবং প্রশাসন এই দাঙ্গার ঘটনাকে ঠেকাতে বা তা ছড়িয়ে পড়া আটকাতে অনেক দেরিতে তৎপর হয়েছে। অনেকেই স্ক্রল.ইন-কে জানিয়েছেন যে বহু ক্ষেত্রেই নিকটবর্তী থানা কয়েক মিনিটের দূরত্ব হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ পৌঁছেছে কয়েক ঘণ্টা পর।

তাদের আরও অভিযোগ, যে সমস্ত এলাকাগুলিতে রামনবমীতে অতীত সংঘর্ষের ইতিহাস আছে, সেসব জায়গায় যথেষ্ট পুলিশ মোতায়েনও করা হয়নি।

সূত্রপাত : লাউডস্পিকার

২৬ এবং ২৭শে মার্চ রানিগঞ্জ এবং আসানসোলের বিভিন্ন অঞ্চলে যে দাঙ্গাটা ছড়াল, তাতে একটা বড় ইন্ধন জোগাল রামনবমী উপলক্ষে ব্যবহার হওয়া লাউডস্পিকারগুলি। অথচ বোর্ডের পরীক্ষা চলছে বলে এগুলি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

প্রথম সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায় রানিগঞ্জের রাজাবাঁধ এলাকায়। এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত। আঞ্জুমান ইমদাদ-এ-বাহমি স্কুলের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আনোয়ার বললেন, ‘মিছিলটিতে অনেকগুলি পিক-আপ ভ্যান এবং ছোট ট্রাক ছিল যেগুলির প্রতিটিতে একগাদা করে সাউন্ড বক্স লাগানো। সেগুলিতে ধর্মীয় গান বাজছিল আর প্ররোচনামূলক স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা ওই মিছিলটির যে ভিডিও ফুটেজ নিয়েছেন তাতেও সাউন্ড বক্স ভর্তি অনেকগুলি ছোট ট্রাক দেখা গেছে।

স্ক্রল.ইন যাদের সঙ্গে কথা বলেছে তারা অনেকেই এই প্ররোচনাদায়ক স্লোগানগুলি শুনেছেন। যেমন, ‘হিন্দুস্তান মেঁ রহেনা হ্যায় তো জয় শ্রীরাম বোলনা পঢ়েগা’, ‘মুসলমান কা জায়গা, ইয়া পাকিস্তান ইয়া কবরিস্থান’, এবং ‘হাম অ্যায়লান করতে হ্যায় ডঙ্কে কি চোট পর, মন্দির বনেগা হর মোড় পর’।

সংঘর্ষ শুরু হয় যখন কিছু মুসলিম ছেলে এইসব স্লোগানের প্রতিবাদ করে এবং মিছিলকারীদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ায়।

মহম্মদ খালেক খানের থেকে যা শোনা গেল, তাতে আসানসোলের বিধান চন্দ্র রায় রোডেরও একই ঘটনা। তিনি বললেন, ‘যখন মিছিল রিলায়েন্স মার্কেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন এলাকার মসজিদে আজান শুরু হয়। কিছু যুবক ছেলে মিছিল সংগঠকদের কাছে গিয়ে বলে আজানের সময়টুকু লাউডস্পিকার আস্তে করতে। এই বলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।’

মিছিল সংগঠক এবং দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি লাউডস্পিকার এবং সাউন্ড বক্স ব্যবহারের পুরো দায়টাই প্রশাসনের ওপর চাপালেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আসানসোল জেলা কমিটির সভাপতি শশী ভূষণ যাদব বললেন, ‘রানিগঞ্জ আসানসোল সব জায়গাতেই মিছিলের সময় পুলিশবাহিনী উপস্থিত ছিল। যদি সাউন্ড বক্সের ব্যবহার নিষিদ্ধই ছিল, তবে সেগুলি তারা সিজ করল না কেন?’

যাদব আরও বললেন, ‘বস্তুত আমরাই পুলিশ এবং প্রশাসনের কাছে ডিজে বক্স এবং অস্ত্রের ব্যবহার যে নিষিদ্ধ সেই মর্মে লিখিত সার্কুলার দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা দেখাতে পারেননি। আমরা এমনকি একটি আর টি আই (রাইট টু ইনফর্মেশন) অ্যাপ্লিকেশনও ফাইল করে সরকারকে এ বিষয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দিতে বলেছিলাম। কিন্তু সরকার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।’

আসানসোল মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি অবশ্য বললেন, যে সেরকম কোনও লিখিত সার্কুলার ছিল না, এবং তার প্রয়োজনও নেই। তার কথায়, ‘প্রতিটি মিছিলের আয়োজকদের মিছিলের পারমিশন দেওয়ার সময়েই স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া হয়েছিল যে লাউডস্পিকার এবং অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। তার পরেও আবার লিখিত সার্কুলারের কী প্রয়োজন?’

রিপোর্টে জানা যাচ্ছে অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে কড়া নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতেই খোলা তরোয়াল নিয়ে রামনবমীর মিছিল হয়েছে।

তিওয়ারি আরও বলেন, ‘আসানসোল পুর এলাকার মধ্যে (যার মধ্যে রানিগঞ্জও পড়ে) আমরা মোট ১৪৬টি মিছিলের অনুমতি দিয়েছি, এবং সব সংগঠকরাই এই পূর্ব শর্তে সম্মতি জানিয়েছিলেন যে তারা কোনও অস্ত্র বা লাউডস্পিকার ব্যবহার করবেন না।’ কিন্তু যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় যে সেই সম্মতি লিখিত ছিল কিনা, তিনি না বলেন।

স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিলই, কিন্তু পুলিশি ব্যবস্থা ছিল না

আসানসোলে এই হানাহানি কিন্তু মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। স্ক্রল.ইন-কে অনেকেই বলেছেন যে সংগঠকদের মারমুখী মনোভাব সম্পর্কে প্রশাসন ভালোই ওয়াকিবহাল ছিল। তারা এটাও জানত যে মিছিলের পথে কোন কোন অঞ্চলগুলি উত্তেজনাপ্রবণ। কারণ গত তিন বছরে সেই অঞ্চলগুলি এরকম সংঘর্ষের সাক্ষী থেকেছে।

রাজাবাঁধে মিছিলের এক সপ্তাহ আগে রানিগঞ্জ থানার ওসি এই ঘটনার প্রস্তুতির জন্য একটি মিটিং ডেকেছিলেন। তাতে আমন্ত্রিত ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর আরিজ জালিস। তিনি জানাচ্ছেন পুলিশ যখন জানায় যে সরকারের সিদ্ধান্ত কোনও ডিজে, লাউডস্পিকার এবং অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যাবে না, তখন মিছিল সংগঠকদের অনেকেই বিরোধিতা করে। ‘তারা বলে যে তারা এসব শর্ত মানবে না, এবং নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই মিছিল বের করবে। ওসি তাদের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে গেলে তারা থানার মধ্যেই জয় শ্রীরাম স্লোগান দিতে থাকে।’

জালিস বলছেন, বিরোধিতার এমন প্রকাশ্য নমুনা দেখেও পুলিশ সম্ভাব্য ঘটনা ঠেকানোর পরিকল্পনা করতে পারেনি। তার কথায়, ‘তাদের (পুলিশের) উচিৎ ছিল যথেষ্ট সংখ্যায় বাহিনী মোতায়েন করা যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। কিন্তু তারা সেটা না করাই শ্রেয় মনে করল!’

রানিগঞ্জের বিজেপির সাধারণ সম্পাদক মদন ত্রিবেদীও এই হিংসাত্মক ঘটনার জন্য পুলিশকেই কাঠগড়ায় তুললেন। ‘যেখানে গণ্ডগোলের সূত্রপাত সেটি সংবেদনশীল এলাকা। ২০১৪ থেকে এই মিছিলের সময়ে হিল বস্তি মোড়ে পুলিশ পিকেট করা হয়, এবং মিছিলের সময় পুলিশ ব্যারিকেড করে মিছিল পার করে দেয় যাতে কোনও সমস্যা না হয়।’ ত্রিবেদী জানাচ্ছেন কোনও কারণ ছাড়াই এ বছর সে ব্যবস্থা করা হল না।

আসানসোলের চাঁদমারি এলাকা, যেখানে ২৭শে মার্চ একটি রামনবমী মিছিলের জেরে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, সেটিও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা। পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজি নাসিম আনসারি জানালেন রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে গত দুবছর এই এলাকায় বাদানুবাদ এবং ছোটখাটো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই প্রেক্ষাপটেই আনসারি সহ এলাকার বাসিন্দারা মিছিল যাওয়ার রাস্তায় অনেকগুলি বুথ তৈরি করেছিলেন এ বছর এটা নিশ্চিত করতে যে মিছিল যেন শান্তিপূর্ণভাবে চলে যায়। এই বুথগুলিতে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শশী ভূষণ যাদব জানালেন যে তাদের সংগঠনের কাছে খবর ছিল যে চাঁদমারিতে ঝামেলা হতে পারে এবং তারা সেটা পুলিশকে জানিয়েওছিলেন। তিনি বললেন, ‘২৬শে মার্চ রাত দেড়টায় আমরা আসানসোল দক্ষিণ এবং উত্তর থানার ওসিদের সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের মিছিলের পথে যে উত্তেজনাপ্রবণ অঞ্চলগুলি পড়বে তার একটা তালিকা দিই। এই তালিকায় চাঁদমারিও ছিল। এই সমস্ত এলাকাগুলিতে ঝামেলার সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের কাছে যেসব খবর ছিল সেগুলি সবই তাদের জানাই। দুই থানাতেই আমাদের যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার এবং সংবেদনশীল জায়গাগুলিতে সিনিয়র অফিসারদের মোতায়েন রাখার আশ্বাস দেওয়া হয়।’

কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন চাঁদমারি এলাকায় তারা কোনও সিনিয়র অফিসারকে দেখতে পাননি। গুলজার মহল্লার এক বাসিন্দা জানালেন, ‘মিছিলের সঙ্গে দুটো ছোট গাড়িতে মাত্র ১২-১৫ জন পুলিশ ছিল। মিছিলকারীরা যেখানে বন্দুক বোমা নিয়ে সশস্ত্র, সেখানে পুলিশের সাথে কিন্তু কোনও অস্ত্রশস্ত্র ছিল না।’

‘পুলিশকে বারবার ডাকা হয়’

রানিগঞ্জে যখন সংঘর্ষ বাধে, এলাকার অনেক বাসিন্দাই পুলিশকে ফোন করেন, এবং তাদের সবাইকেই বলা হয় পুলিশ বেরিয়ে পড়েছে। হিল বস্তির কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দা দুটি কমবয়সি ছেলে, যারা ঐ মিছিলে ছিল, জানাল যে তারা মিছিলের অন্যদের সঙ্গে রাজাবাঁধের চার রাস্তার মোড়ের একটি রাস্তায় হাতধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিল, কারণ স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় দল তাদের তাড়া করেছিল।

এই ছেলে দুটি, এবং স্থানীয় বাসিন্দারা যারা বাড়ির ভেতর থেকে এই সংঘর্ষ দেখেছিলেন, সবাই বললেন যে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে মারামারি চলে, এবং যে হাতেগোনা কয়েকজন পুলিশ কর্মী মিছিলের সঙ্গে ছিলেন তারা এই পুরো সময়টাতেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন।

কাউন্সিলর আরিজ জালিস সহ এলাকার বেশ কিছু বয়স্ক লোক ঘটনাস্থলে যান, এবং যারা মারামারি করছিল তাদের একদম টেনে সরিয়ে নিয়ে দাঙ্গা থামাতে চেষ্টা করেন। জালিস জানালেন, ‘আমরা দুই পক্ষকে আলাদা করি এবং পুলিশকে খবর দিই। আমাদের বলা হয় পুলিশ বেরিয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই আবার দুই দল পরস্পরের দিকে পাথর ছুঁড়তে শুরু করে এবং আবার মারামারি শুরু হয়। আমরা আবার দুই পক্ষকে আলাদা করার চেষ্টা করতে থাকি।’

আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট, যেখানে অতিরিক্ত বাহিনী মজুত ছিল, সেটি এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূর এবং আধঘণ্টার রাস্তা। কিন্তু পুলিশ রাজাবাঁধে পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টা লাগায়।

বিজেপির মদন ত্রিবেদী রামনবমীর মূল মিছিলটিতে ছিলেন। রাজাবাঁধের মিছিলটির এটির সঙ্গেই যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। তিনি বললেন, ‘আমরাও বহুবার পুলিশকে ফোন করেছি। রাজাবাঁধ এলাকার লোকেদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছিলাম এবং ওখানে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে সে খবর পেয়েছিলাম। খুব পরিষ্কারভাবেই, পুলিশ মানুষকে সেই দাঙ্গা করতে দিল এবং তিন ঘণ্টা পর গিয়ে সেখানে হাজির হল।’

রাস্তায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়তেই হিল বস্তিতে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়েরই বহু বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ যখন সেখানে পৌঁছয়, ততক্ষণে প্রায় ৫০টা বাড়ি লুঠপাট হয়ে গেছে।

২৮শে মার্চ হাজি নগর-রামকৃষ্ণ দঙ্গল এলাকায় যে সংঘর্ষগুলি হয়, সেখানে পৌঁছতে পুলিশ আরও বেশি সময় নেয়। দুই সম্প্রদায়েরই যেসব কমবয়েসি ছেলেরা এই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, তারা স্ক্রল.ইন-কে জানিয়েছে যে সকাল ১১টায় সংঘর্ষ শুরু হয় এবং বিক্ষিপ্তভাবে সাত ঘণ্টা ধরে পুলিশ এসে না পৌঁছনো অবধি চলতেই থাকে। পার্শ্ববর্তী চাঁদমারি-শ্রীনগর এলাকাতে সংঘর্ষ চলে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। রানিগঞ্জের মতনই, এইসব এলাকাতেও দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই ঘরবাড়ি লুঠপাট করা হয়, আগুন লাগানো হয়।

কিন্তু রানিগঞ্জের থেকেও পুলিশ এখানে বেশি কাছে ছিল। এই দুই অঞ্চল থেকেই আসানসোল উত্তর থানা দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, পুলিশ সেদিন বেশিরভাগ ফোনই ধরেনি।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শশী ভূষণ যাদবের থেকে জানা গেল প্রশাসনের অন্য আধিকারিকরাও কোনও সাহায্যে আসেননি। ‘দুপুর ১২টা নাগাদ, যখন ঐ এলাকা থেকে আমাদের লোকেরা পাগলের মতো ফোন করে যাচ্ছে, আমরা একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি বানাই এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করতে যাই। ডিএম আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিলেন এবং কার্যত কিছুই করলেন না।’

যাদব আরও বললেন, ‘সিপি (পুলিশ কমিশনার) তার অফিসে ছিলেন না। তাই আমরা ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারের কাছে যাই, কারণ চাঁদমারি এলাকাটা রেলের জুরিসডিকশনে পড়ে। ডি আর এম আমাদের সেই সমস্ত রেল কোয়ার্টারগুলির লিস্ট দিতে বললেন যেগুলি থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে হবে, এবং বললেন লিস্ট পেলে এই উদ্ধার কাজের জন্য তিনি কিছু রেল পুলিশ পাঠাবেন।’

বাসিন্দাদের থেকে জানা গেল, সেই বিকেল ৪টের পর থেকে যথেষ্ট পুলিশবাহিনী এলাকায় মোতায়েন হয়। পরিস্থিতি তারপর থেকেই নিয়ন্ত্রণে আসে।

‘ভিখারি, মাতালদের ধরা হচ্ছে’

আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার এল এন মীনা পুলিশি অবহেলা এবং দেরি করার অভিযোগকে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিলেন। স্ক্রল.ইন-কে বলা তার বক্তব্য : ‘হিংসা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।’

কিন্তু, যতই বলা হোক, এই হিংসার ঘটনায় পুলিশের প্রতিক্রিয়াতেই শুধু তাদের লজ্জার শেষ হচ্ছে না। ২৮শে মার্চ পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় এক মহিলার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এরই মধ্যে। সেই মহিলার ছেলে শৈলেন্দ্র রাউত জানালেন, ‘যে এলাকায় মারামারি হচ্ছিল আমি সেদিন সকালে সেখানে গেছিলাম, আর মা আমায় খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। সাথে আরও কিছু মহিলা ছিল যারা সবাই নিজেদের ছেলেদের খুঁজছিলেন। ওরা যখন বন্ধ হয়ে থাকা রূপরেখা সিনেমা হলের সামনের জায়গাটায় পৌঁছান তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া শুরু করে। কয়েকজন ওখানেই পড়ে যান, আর আমার মা পড়েছিলেন রাস্তার ধারে। তখনই ওনাকে পুলিশের একটি গাড়ি পিষে দেয়।’

দাঙ্গার ঘটনায় পুলিশ এখন অবধি ৮০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এখানেও অভিযোগ উঠছে যে পুলিশ আসল লোকদের না ধরে যাকে তাকে ধরছে। রেলপাড়ের অনেক বাসিন্দাই জানালেন যে আশেপাশের এলাকার অনেক নামকরা গুণ্ডা মস্তান এই হিংসাত্মক ঘটনাগুলিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের দিকে সেভাবে দেখছেই না। তাদের অভিযোগ, সেই মস্তানদের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু পরদিন সকালেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

শশী ভূষণ যাদব আবার অভিযোগ করলেন পুলিশ বেছে বেছে বিভিন্ন মিছিল আয়োজক কমিটির স্বেচ্ছাসেবকদের ধরছে। ‘এ বছর পুলিশ প্রতিটি মিছিল আয়োজক কমিটির কাছ থেকে তাদের ১৫ জন করে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি তালিকা দিতে বলেছিল। এখন তারা সেই লিস্ট ধরে ধরে ওই স্বেচ্ছাসেবকদের ধরে গারদে পুরছে। রানিগঞ্জে ইতিমধ্যেই আমাদের ২৫ জন কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। আমাদের পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।’

তিনি জানালেন সেই গণ্ডগোল শুরু হওয়ার দিন থেকে তিনি বাড়ি ফিরতে পারেননি, এবং ক্রমাগত এদিকওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

লেখাটি স্ক্রল.ইন-এ ৮ই এপ্রিল প্রকাশিত। স্ক্রল.ইন-এর সম্পাদক এবং লেখকের অনুমতিক্রমে আমরা লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম। শিরোনাম আমাদের। মূল লেখার লিংক : https://scroll.in/article/874746/help-came-three-hours-late-behind-the-communal-clashes-in-asansol-complaints-of-police-failure
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. পুলিশ প্রশাসনের এই আচরণের কারণ কি? তাহলে কি সরকারও চেয়েছিল দাঙ্গাটা হোক?

আপনার মতামত...