পয়লা বৈশাখ : একটি অনার্য অডিসি

শিবাংশু দে

 

প্রশ্নটা উঠতে দেখেছিলুম যখন বাংলা ১৪০০ সন এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছিল। সিকি শতাব্দী আগে। তখন আমরা মত্ত ছিলুম কুসুমচয়নে। নব নব অনুষ্ঠান চারিদিকে। সঙ্গীত-সাহিত্য-ইতিহাস-পরিবেশ থেকে খুঁজে নিচ্ছিলুম ‘বাঙালিয়ানা’র সূত্রগুলি নতুন করে। কবি ভেবেছিলেন ১৪০০ সনে তাঁর লেখা সবাই ভুলে যাবে। দেখা গেল তাঁর লেখার কথা অনেকটা ভুলে গেলেও নামটাকে কেউ ভোলেনি। বাঙালিদের মতো কে আর মানে, ‘কলৌ নামৈব কেবলম।’ সবাই খোঁজে নিজের শিকড়। কিন্তু বাঙালিদের মতো আত্মপরিচয় খুঁজতে ব্যাকুল জাতি আমি ভারতবর্ষে আর দেখিনি। আসলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা আগে ইংরিজি শিখেছিলেন বলে গত দুশো বছর ধরে একটা স্ব-আরোপিত গরিমা নিয়ে আমরা প্রায় ধৃতরাষ্ট্র। ধারণাটিকে এককথায় মিথ্যা বলা যায় না বটে। কিন্তু যাঁদের দৌলতে এই ‘গরিমা’, তাঁদের নাম ছাড়া আমাদের আর কিছু মনে নেই। তাঁরা যা বলতে চেয়েছিলেন তার সব কিছুই ঢাকিশুদ্ধু বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু আত্মম্ভরিতা রয়েছে টনটনে। উড়ে, মেড়ো, খোট্টার নামকরণও সেই ‘নাম’বাদেরই অংশ। ম্যাড্রাস থেকে আসা ক্লাইভের জাহাজ তিনটে যদি ফলতার বদলে পারাদীপে নোঙর করত, যেটা ভাবা হয়েছিল প্রথমে, তবে কলকাতার বদলে কটক হত ইংরিজি শিক্ষার কেন্দ্র। ‘বাঙালি’দের হাতে স্লেটপেন্সিলের বেশি কিছু থাকত না।

হয়তো আমাদের ভঙ্গুর অবচেতন থেকে এই আত্মসংকটটা যায়নি কখনও। তাই আত্মপরিচয় নিয়ে এত নিরাপত্তার অভাবে ভুগি আমরা। সত্যি কথা বলতে কী, বাঙালির আত্মপরিচয় চিরকালই স্ববিরোধের কাঁটায় ব্যাথাতুর। আর্যভারতের কাছে চিরকাল অবহেলিত, নিন্দিত, নিপীড়িত। কিন্তু আর্য স্বীকৃতির দরবারে “বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া”র অসম্মানকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারেনি কখনও। বাংলার অনার্য বা আর্যেতর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কিন্তু কোনওভাবেই সমসাময়িক আর্য গৌরবের রশ্মিবলয়ের থেকে অনুজ্জ্বল ছিল না। কিন্তু বাঙালির আত্মবিশ্বাসের অভাব তাকে চিরকাল আর্যবলয়ের দরিদ্র জ্ঞাতি করেই রেখে দিয়েছে। মাঝখানে দুশো বছর দাস্যভাবে গরীয়ান বাঙালি পেয়েছিল ইংরেজ প্রভুকে। তারা প্রতাপে, প্রভাবে, গাত্রবর্ণে, কনৌজিয়া ‘আর্য প্রভুদে’র থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকত। তাই বাঙালি ঐ সময়টার জন্য ‘স্বদেশীয়’ দেবতাদের ছেড়ে বিদেশি দেবতাদের প্রতি আনুগত্য উজাড় করে দিয়েছিল। কিন্তু গোরা প্রভুরা বিদায় হতেই দেশি ‘গোরা’ মালিকরা বঙ্গাল মুলুকের ছেড়ে আসা অধিকার কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিতে মাঠে নেমে পড়ে। এপার বঙ্গে কনৌজিয়া মৌলবাদ আর ওপার বঙ্গে আরবি অতিবাদ, এই দুই বহিরাগত ক্ষমতার আস্ফালন বাঙালিকে তার গরিমাময় আত্মপরিচয় থেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়। তার অধুনাতম একটি নিদর্শন স্পষ্ট হয়ে উঠছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূত্রে। বাঙালির সার্বভৌম ধর্ম-উদাসীন যে পার্বনটি আজ এপার-ওপার দুই বাংলার একটি প্রধান উদযাপন, তার প্রতি আর্যমন্য ও সেমিটিক, উভয় মৌলবাদী অন্ধকারের শক্তিই অস্ত্র শানিয়ে চলেছে। পয়লা বৈশাখ কেন বাঙালির একটা গৌরবজনক উত্তরাধিকার, সে প্রশ্নটির উত্তর আজ বিশেষ প্রয়োজন।

‘বাংলা নববর্ষ’ বিষয়ে বলার আগে বুঝে নেওয়া দরকার ভারতবর্ষে বর্ষপঞ্জিকার ইতিহাসটি কী? এদেশের উত্তর অংশে (কিছুটা পূর্বেও বটে) এবং নেপালে যে পঞ্জিকাটি জনপ্রিয় ছিল তার নাম ‘বিক্রমসম্বৎ’। এই নামটি কোনও এক রাজা বিক্রমাদিত্যের সূত্রে এসেছে। এটির শুরু খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ সাল থেকে। আমাদের স্বীকৃত ইতিহাসে এই সময়কালে ‘বিক্রমাদিত্য’ নামে কোনও মান্য রাজা ছিলেন না। তবে লোককথায় সর্বযুগে ‘বিক্রমাদিত্য’ নামে রাজার অভাব হয়নি। চতুর্থ-পঞ্চম শতকে কৃতাসম্বৎ বা মালবসম্বৎ নামে পঞ্জীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ভিনসেন্ট স্মিথ এবং দেবদত্ত ভাণ্ডারকরের মতে গুপ্তযুগের বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্য মধ্য ভারতে, বিশেষত উজ্জয়িনীতে, প্রচলিত সম্বৎটি নিজের নামে ‘বিক্রমসম্বৎ’ রেখে দেন। গুপ্ত রাজত্বে উজ্জয়িনী থেকে আর্যধর্মের যে বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা, তাকে ভারত ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলে থাকেন অনেকে। ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের পরাজয়ের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর আর্যধর্মের অক্ষটি অনেকটা উত্তরপূর্বে সরে যায়। থানেশ্বরের রাজা পুষ্যভূতি বংশের রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধন আর্যাবর্তে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। তাঁদের রাজত্বে কান্যকুব্জ বা কনৌজিয়া ব্রাহ্মণরা রাজ অনুগ্রহে নিজেদের প্রকৃত নীলরক্তের আর্য ব্রাহ্মণ্যধর্মের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হ’ন। লক্ষ করার বিষয় বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রবেশ ও উত্থান কনৌজ থেকেই আসে। ফলে বঙ্গদেশসহ সমগ্র উত্তর ভারতে বিক্রমসম্বৎ মান্যতা পেয়ে যায়। বর্তমানে প্রতিবেশী নেপাল রাষ্ট্রের সরকারি পঞ্জী বিক্রমসম্বৎ। নবম শতকের আগে আমাদের পুরানিদর্শনে বিক্রমসম্বতের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই ধরে নেওয়া যায় এই পঞ্জী খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকে এদেশে প্রচলিত নেই। বিক্রমসম্বৎ শুরু হয় চৈত্র শুক্লপক্ষের প্রথম দিন থেকে। ২৬শে নভেম্বর ১৯৪৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের হিন্দি সংস্করণে তারিখ দেওয়া হয়েছিল বিক্রমসম্বৎ অনুসারে। পরবর্তীকালে শকাব্দই ভারতীয় সরকারি পঞ্জী হিসেবে স্বীকৃত হয়।

শকাব্দের প্রবর্তন কবে হয়েছিল বলা মুশকিল। কারণ একটি প্রাচীন শকাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে, যেটি খ্রিস্টপূর্বকালের ব্যাপার। কিন্তু বর্তমান শকাব্দটির প্রচলন ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে। উল্লেখ্য, এই পঞ্জীটির উল্লেখ পাওয়া মূলত দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন পুথিপত্রে। দেশের এই প্রান্তে কনৌজিয়া ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব তেমন পড়েনি এবং দ্রাবিড়ীয় ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতিই মান্য পন্থা ছিল। এইসব স্থানে শকাব্দের প্রচলন দেখা যায়। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে উত্তরাপথ ও পূর্ব ভারতে প্রচলিত বিক্রমসম্বতের সমান্তরাল ছিল দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে স্বীকৃত শকাব্দ। বিক্রমসম্বতের সঙ্গে যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজ্যাভিষেককে যুক্ত করা হয়, শকাব্দের প্রবর্তনাও ৭৮ খ্রিস্টাব্দে শক রাজা চাস্তনের রাজপদ গ্রহণের সঙ্গে শুরু হয়। অবশ্য চাস্তন ছাড়াও আরও জনাতিনেক শকরাজার নাম পাওয়া যায় এ প্রসঙ্গে। কিন্তু অন্ধাউ, কচ্ছপ্রদেশে পাওয়া শিলালিপি থেকে জানা যায় ৮৯ এবং ১৩০ খ্রিস্টাব্দে চাস্তনই রাজা ছিলেন। একটি বহু প্রচলিত মত হল সম্রাট প্রথম কণিষ্কের রাজ্যাভিষেক থেকে শকাব্দের প্রচলন হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে হেনরি ফক সাহেব জানিয়েছেন কণিষ্কের রাজ্যাভিষেক হয় ১২৭ খ্রিস্টাব্দে। অধিকন্তু তিনি ছিলেন কুষাণ, শক নয়। অবশ্য আমাদের ইতিহাসে কিংবদন্তির আধিক্য চিরকালই গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই এত সহজে শকাব্দের প্রবর্তনকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

শক-রাজত্বের নৃপতিদের পশ্চিমি ক্ষত্রপও বলা হত। শালিবাহন রাজা গৌতমী শাতকর্ণী নাকি তাঁদের পরাজিত করেছিলেন এবং শকাব্দের অন্য নাম শালিবাহন অব্দ। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার বলেছেন এটা ভ্রান্ত রটনা। তিনি অন্য রটনাটিকেও সমান ভ্রান্ত বলেছেন। যেখানে বলা হয় কিংবদন্তির রাজা বিক্রমাদিত্য (গুপ্ত সম্রাট ন’ন) শকরাজাকে পরাজিত করে বিজয়সূচক কীর্তি হিসেবে শকাব্দের প্রচলন করেছিলেন। সপ্তম শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত ব্রহ্মগুপ্ত থেকে অল বিরুনি সবার লেখাতেই এই কিংবদন্তিটির উল্লেখ আছে। গুপ্তযুগের আগে দ্বিতীয় শতকে শকরাজা প্রথম রুদ্রসিংহ উজ্জয়িনীতে রাজত্ব করতেন। তাঁরা নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে ব্রাহ্মীলিপিতে খোদিত। অতএব তখনও শক যুগ শেষ হয়ে যায়নি।

যেটা বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন অব্দের প্রচলন রাজাগজারা নিজেদের প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা প্রমাণিত করার জন্যই শুরু করেছিলেন। রাজার প্রতাপ ও তার প্রতি পুরোহিতের সমর্থন থেকেই বিভিন্ন ধর্মাচরণের দিন-লগ্ন-মুহূর্তও নির্ধারিত হত। রাজ নির্দেশিত পঞ্জীও ধর্মীয় স্বীকৃতি পেয়ে বৃহত্তর জনসমাজে গৃহীত হয়ে যেত। আমাদের দেশে চিরকালই সৌর অব্দ পালনের প্রচলন আছে। শুধু ধর্মীয় তাৎপর্য নয়, এর পিছনে অর্থনীতিরও একটা বড় ভূমিকা আছে। রাজস্ব আদায়ই যেকোনও রাজব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান প্রাথমিকতা। রাজকীয় পঞ্জিকা প্রণয়নে সে ব্যাপারটা সর্বদা মনে রাখা হত। কিন্তু ইসলামি শাসনকালে প্রথমদিকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকার অর্থনৈতিক মাত্রাটি নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা হয়নি। কারণ ইসলামি পঞ্জিকা হিজরি সনের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর। এটি চান্দ্র পঞ্জিকা হবার জন্য এদেশের কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে তার কোনওরকম সংযোগ ছিল না। শস্যরোপণ ও আহরণের সময়কাল এই পঞ্জিকার সঙ্গে মিলত না। ফলে উপযুক্ত সময়ে রাজস্ব আদায়ের কাজটি ব্যহত হত। কথিত আছে, এর নিরাকরণ করার জন্য ভাবনাচিন্তা শুরু হয় আকবর বাদশার সময়।

‘সন’ শব্দটি আরবি এবং ‘সাল’ শব্দটি ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। মির্জা জলালুদ্দিন শাহ অকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বাদশাহ হয়েছিলেন (২রা উল-সানি, হিজরি ৯৬৩)। একটা প্রচলিত ধারণা ঐ বছরের এপ্রিল মাস থেকে বঙ্গদেশে তিনি নতুন পঞ্জিকার প্রচলন করেন। অবশ্য বঙ্গদেশে সুলতানি আমল থেকেই চান্দ্রমাস অনুযায়ী হিজরি সন প্রচলিত ছিল। আকবর চান্দ্রমাসের বদলে সৌরমাসের পঞ্জিকার প্রচলন করলেন। ফসলচক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে একে ‘ফসলি’ সনও বলা হত। অথবা গৌরবে ‘আকবরী বর্ষ’। সৌরমাস অনুযায়ী বঙ্গাব্দ কিন্তু বাংলাদেশে প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত ছিল। আকবর বাদশা পুরনো ব্যবস্থাটিকেই হিজরি বর্ষের সঙ্গে সমন্বিত করেন। বঙ্গাব্দের ধারণা আকবরের প্রস্তাব নয়। তার দীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাস আছে। সাধারণ ধারণা, বঙ্গাব্দ হিজরি বর্ষেরই অন্যতম রূপ, একেবারেই যথার্থ নয়।

প্রায় সমসময়ে প্রবর্তিত ওড়িশার বিলায়তি বা উমলি সাল, উত্তরাপথের ফসলি সাল এবং দাক্ষিণাত্যের ফসলি সাল বিষয়ে আমাদের স্থানীয় ইতিহাস মৌন ছিল। ১৮৩৬ সালে সাহেবদের কল্যাণে এই বিষয়ে খোঁজখবর শুরু হয়। সদর দেওয়ানি আদালতের কাগজপত্রে কিন্তু ফার্সি বর্ষলিপিই ১৭৬৪ থেকে ১৮৩৪ পর্যন্ত অনুসৃত হত। হ্যারিংটন সাহেব Analysis of the Land and Revenue Regulations নামক রিপোর্টে প্রথম এই ‘ফসলি’ সন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। “A solar year for financial and other civil transactions was then engrafted upon the current lunar year of the Hejira, or subsequently adjusted to the first year of Akbar’s reign.” প্রায় একই সময়ে কাশীর কাছে একটি গ্রাম থেকে ক্যাপ্টেন অর্সবি সাহেব এক ফার্সি পুথি আবিষ্কার করেন। সেই পুথির প্রামাণ্যতা বিচার করা হয়নি। যেহেতু সেখানেও হ্যারিংটন সাহেবের বক্তব্যের সমর্থন ছিল। তখন থেকেই সরকারি আনুকূল্যে পরিবর্তিত হিজরি ফসলি সনই যে আসলে সন-ই-বাঙ্গালা এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। অথচ প্রামাণ্য উৎস আইন-ই-অকবরি’তে কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। বরং উক্ত পুথিতে পাওয়া সূত্র অনুযায়ী রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, “The Bengali era, to which the year began with the arrival of the sun at the vernal equinoztial point, and the months were regulated by his passage through the twelve signs of the zodiac.” যেটা প্রমাণ করে আকবরের সময়ই, বা আরও অনেক আগে থেকেই  বাংলা সৌরমাস অনুযায়ী গণিতভিত্তিক বাংলা সন এদেশে প্রচলিত ছিল। অবশ্য সেই সন কার দ্বারা প্রবর্তিত বা প্রচলিত ছিল সে ব্যাপারে কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই। বিক্রমসম্বৎ বা শকাব্দের এতে কোনও রকম ভূমিকা আছে কি না, তা নিয়েও কোনও রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই।

উল্লিখিত দক্ষিণী বা ওড়িশী সন গণনা নিয়েও যখন সমস্যা দেখা দেয়, বলা হয় আকবর মন্ত্রীদের পরামর্শক্রমে উক্ত তিনটি সনকেই ৯৬৪ হিজরি সনের সঙ্গে সমন্বিত করে প্রচলিত করে দেন। উত্তরাপথের ফসলি সন গণনা শুরু হল আশ্বিন (কুনওয়র) মাস থেকে আর দাক্ষিণাত্যে বিলায়তি সন ভাদ্রমাসের শুক্লা দ্বাদশী থেকে। বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ কিন্তু এই দুই ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র ছিল। “…. The era introduced into Bengal was denominated San-i-Bangala and the year was continued there, in the periods if its commencement, on the sun entering Aries, as here to fore.” অস্যার্থ বাংলার পূর্বপ্রচলিত সৌর বঙ্গাব্দটিরই নাম বদলে ‘সন-ই-বাঙ্গালা’ করা হল। যদিও আবার বলা হয়েছে “… The three eras therefore owe their origin to the fiat of the Emperor Akbar, and they are formed upon the basis of the Muhammudan epoch, but the annual revolutions accord with these of the eras which they suspected…।” এই উক্তিটি বিভ্রান্তিকর হলেও ইংরেজদের সরকারি অবস্থান এরকমই ছিল। যদিও আগেই স্বীকার করা হয়েছে বঙ্গদেশে ৯৬৩ হিজরি সনের আগেই বঙ্গাব্দের অস্তিত্ব ছিল।

এখন প্রশ্ন ওঠে ৯৬৩ হিজরি সনে বঙ্গাব্দের বয়স কত ছিল? অধ্যাপক সিলভ্যা লেভি তাঁর Le Nepal গ্রন্থে দাবি করেছিলেন বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়েছিল একটি তিব্বতি পঞ্জিকা অনুসারে। কিন্তু কাশীপ্রসাদ জয়সওয়াল তাকে Untenable বলে উড়িয়ে দেন। পণ্ডিত জয়সওয়াল তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ সাহেবের গবেষণা থেকে। উপরন্তু অধ্যাপক লেভির মতামত বিষয়ে তিনি বেশ বিরূপই ছিলেন। বঙ্গাব্দের উদ্ভব বিষয়ে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনার কথা মানুষ ভেবেছে। তার মধ্যে ব্রাহ্মণ্য ও আর্যেতর, উভয় বিকল্পই রয়েছে। প্রথমে ব্রাহ্মণ্য সম্ভাবনাগুলি বিচার করা যাক। একটা মত আছে রাজা শশাঙ্কই নাকি বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। পক্ষে রয়েছে হিউ-এন-সাঙের লেখা। যদিও শশাঙ্কের সময়কাল এখনও সঠিক নির্ণীত হয়নি, কিন্তু হিউ এন সাঙ লিখেছেন ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক রাজত্ব করতেন। সেক্ষেত্রে ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রাজ্যাভিষেক হতেই পারে। কিন্তু শশাঙ্কের মতো দাপুটে রাজা নিজের নামে অব্দ চালু করলেন না, এটা মেনে নেওয়া একটু শক্ত। আবার একটা সম্ভাবনা আছে, হয়তো শশাঙ্কের নাম ছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে বৌদ্ধ পালবংশের রাজত্বের সময় ‘বৌদ্ধবিদ্বেষী’ শশাঙ্কের নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ প্রাক ইসলামিকালে সমাজের ইতর শ্রমজীবী মানুষের কাছে বঙ্গাব্দের উপস্থিতি বিশেষভাবেই বর্তমান ছিল। এই উপস্থিতি কৃষি ও বাণিজ্যগত কারণেই টিকে গিয়েছিল। ধর্মীয় লোকাচারে কিন্তু শকাব্দের ব্যবহার হত। যদি রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রচলন করতেন তবে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে শকাব্দের পরিবর্তে বঙ্গাব্দের ব্যবহারই স্বাভাবিক ছিল। কারণ ব্রাহ্মণ্য অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে শশাঙ্কের দাবি ছিল শেষকথা। অন্যপক্ষে ইতর জনতার কাছে বঙ্গাব্দ কদাপি প্রত্যাখ্যাত হয়নি। এই সময়কালটি আকবর বাদশার অনেক আগের ব্যাপার। অন্য একটি মত সুলতান হোসেন শাহই ছিলেন বঙ্গাব্দের জনক। কিন্তু তাঁর নামও এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়নি। যদিও তাঁর রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্যের নামে চৈতন্যাব্দের প্রচলন হয়েছিল। অতএব হোসেন শাহের সম্ভাবনাটিও নিরাপদে নাকচ করে দেওয়া যেতে পারে।

হান্টারসাহেব অন্যদিক দিয়ে গণনা করেছিলেন।

বিষ্ণুপুরের রাজা আদিমল্ল জন্মেছিলেন ১২২ বঙ্গাব্দে (৭১৫ খ্রিস্টাব্দ)। ১৪৩ বঙ্গাব্দে ২১ বছর বয়সে তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়। সেদিন থেকেই মল্লাব্দের শুরু। তিনি রাজত্ব করেছিলেন ৩৪ বছর। মারা যান ১৭৭ বঙ্গাব্দে। অতএব ৭১৫ (খ্রিস্টাব্দ) — ১২২ (বঙ্গাব্দ) = ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।

৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে যদি বঙ্গাব্দের সূচনা হয়, তবে ১৫৫৬ সালে আকবরি ফসলি বর্ষ শুরু হওয়া পর্যন্ত বঙ্গাব্দের প্রকৃত অবস্থা কী ছিল?

এবার আর্যেতর ইতিহাসটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। অধ্যাপক লেভির প্রস্তাবিত তত্ত্বটি নিয়ে বিচার করা যাক। এটা স্বীকৃত, ‘সন’ শব্দটি বাংলায় আরবি ভাষা থেকে এসেছে। কিন্তু এই শব্দটির প্রাচীনতর প্রয়োগ দেখা যায় তিব্বতি ভাষায়। একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে আরবি ভাষার এই শব্দটি মূলত তিব্বতি ভাষা থেকেই এসেছে। কারণ আরবি ও তিব্বতি সংস্কৃতির বাণিজ্যিক যোগসূত্র ইসলামি পর্বের বহু আগে থেকেই স্থাপিত হয়েছিল।

ছয় শতকের শেষদিকে স্রং সন নামে একজন তিব্বতি অখ্যাত মানুষ বিভিন্ন পাহাড়ি উপজাতিকে একত্র করে একটা শক্তিশালী তিব্বতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র স্রং সন গাম্পো ছিলেন তিব্বতি ইতিহাসের প্রথম এবং অতি গরিমাময় আইকন। শুধু রাজা বা জাতীয় নেতাই ছিলেন না তিনি। তিব্বতিরা ভক্তির আধিক্যে তাঁকে বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণির অবতার বলেও মনে করতেন। এই রাজা সম্রাট হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক। এই সময়কালে নেপালে ঠাকুরী বংশের মহাসামন্ত ছিলেন অংশুবর্মণ। তাঁর এক কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন রাজা গাম্পো। এই বিবাহ সম্পর্কের সূত্রে গাম্পো বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। এর ফল সুদূরপ্রসারী হয়। উত্তরভারতের মহাযান বৌদ্ধধর্ম তিব্বতের উপজাতিক বন-ধর্মের সঙ্গে মিলে লামাতান্ত্রিক তিব্বতি বৌদ্ধসংস্কৃতির জন্ম দেয়। একটা জনশ্রুতি রয়েছে রাজা স্রং সন বঙ্গদেশ ও অসম বিজয় করেছিলেন। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ফার্সি দলিলে, যেমন হিজরি বছরের ক্ষেত্রে, স্বাভাবিকভাবে শুধু ‘সাল’ শব্দটিরই উল্লেখ থাকে। কিন্তু বঙ্গাব্দের উল্লেখ থাকলে প্রথমে সন…. ও তার পর সাল শব্দটি যোগ করা হয় (যেমন, সন ১১৫৬ সাল)। দুবার ধরে সমার্থক শব্দের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। এর একটাই কারণ থাকতে পারে, ইসলামি শাসন আসার আগে থেকেই বঙ্গাব্দের সঙ্গে ‘সন’ শব্দটি ব্যবহার হয়ে আসছে এবং সম্ভাবনা আছে শব্দটির উৎস ইসলামি নয়। অন্য কোথাও। অধ্যাপক লেভির মতে বঙ্গদেশে অব্দ হিসেবে ‘সন’ শব্দের প্রয়োগ রাজা স্রং সনের নাম থেকেই এসেছে।

ইসলামি আমলে বাংলার সমাজজীবনে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের টানাপড়েন ব্যাপারটি বেশ ভালোভাবেই উপস্থিত ছিল। যদিও রাষ্ট্রীয় শাসন প্রণালীতে তার স্বীকৃতি ছিল যৎসামান্য। থাকলেও তা ছিল নিতান্ত সীমাবদ্ধ কিছু গোষ্ঠীগত ক্রিয়াকলাপের মধ্যেই। ইসলামি রাষ্ট্রীয় স্তরে তার কোনও উপস্থিতি ছিল না। চণ্ডীমণ্ডপ ও চতুষ্পাঠী’র বদ্ধ জলাতেই তার প্রতাপ ছিল সীমাবদ্ধ। এদিকে ঘটনা হল দেশের এই প্রান্তে প্রাক ইতিহাসের কাল থেকেই নীলরক্তের আর্য উপস্থিতি বা আধিপত্য ছিল নগণ্য। বাঙালির জাতীয় অবয়ব তৈরি হয়েছিল অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, কিরাত ও ভোটমোঙ্গল নৃগোষ্ঠীর বিস্তীর্ণ যোগদানে। কল্পিত পুরাণকথা হলেও প্রতাপী বলিরাজা নিজে আর্যেতর। তাঁর তিন পুত্র অঙ্গ, বঙ্গ বা কলিঙ্গও আর্যেতর। আর্যেতর বঙ্গ ও বাঙালিজাতির প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যভারতের মনোভাব আবহমান কাল ধরেই উপেক্ষাসূচক। উত্তরপশ্চিম ভারতের আর্যসংস্কৃতির ধ্বজাধারীরা এদেশীয় জনসমষ্টির চিত্তবৃত্তিকে যথোচিতভাবে পরিশোধন করে ‘মনুষ্যপদবাচ্য’ করার প্রয়াসে কখনও বিরতি দেয়নি। শুধু ব্রিটিশরাই নয়, বাঙালিদের প্রাচীনকাল থেকে আর্যভারতও White man’s burden-ই মনে করেছে। আমাদেরও ভৃত্যমানসিকতার ইতিহাস অতি দীর্ঘ। মধ্যযুগ থেকেই বাংলার যত ছোটবড় রাজন্যবৃন্দ সবাই নিজেদের শিকড় খুঁজতে রাজস্থান, পঞ্জাব, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে পৌঁছে যেতেন। অথচ এই হীনমন্যতার কোনও কারণ ছিল না। দেড়-দুহাজার বছর আগে থেকেই বঙ্গদেশের আদি নৃগোষ্ঠী নিজস্ব গরিমার বিকাশ ছাড়াও আর্যভারতের শ্রেয়ফলসমূহ আত্মস্থ করেছিল। কিন্তু সঙ্গত কারণেই আর্যভারত তার স্বীকৃতি দিতে বিশেষ কার্পণ্য করেছে। বাঙালি নিজস্ব আত্মপরিচয়কে নির্মাণ করতে চিরকালই ভুল ঘোড়ায় বাজি ধরে এসেছে। একটা উদাহরণ দিই। রাজা শশাঙ্ক নাকি পরম প্রতাপী বাঙালি রাজা ছিলেন। যিনি আর্যভারতের কেন্দ্র থানেশ্বরের সম্রাটকে পরাজিত করতে পারেন। কিন্তু শশাঙ্ক বাংলার রাজা হলেও ‘বাঙালি’ ছিলেন না। তিনি উজ্জয়িনীর গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামন্তসমাজের সন্তান। জনৈক হঠকারী বাঙালি জমিদার প্রতাপাদিত্যকে আমরা নায়ক বানিয়ে অনেক ভজনা করেছি। কারণ তিনি একজন সামান্য হিন্দু ‘নৃপতি’ হয়েও স্বয়ং আকবর বাদশাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। তাঁর এই হঠকারিতার পিছনে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষমতাপিপাসাই কাজ করেছিল। ‘বাঙালি জাতীয়তা’ বোধ নয়। সম্পূর্ণভাবে ‘অবাঙালি’, ইরানি শিয়া বংশজ অপদার্থ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাহকে বাঙালির শেষ গৌরবস্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসও আমাদের অন্তঃসারশূন্যতার প্রকাশমাত্র। বাংলার গৌরবকালের শীর্ষবিন্দু ছিল পালসাম্রাজ্যের পর্ব। অত বিস্তীর্ণ ভূভাগের অধিকার কোনও বাঙালি নৃপতির ছিল না কখনও। শুধু রাজনৈতিক নয়, বাংলা সামগ্রিক সম্পন্নতা দেখেছিল সেসময়। পালরাজারা ছিলেন ভূমিপুত্র, আর্যেতর উৎসের সন্তান। সঙ্গতভাবেই তাঁরা সমত্ববাদী বৌদ্ধ ধর্মসংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিভেদবাদী আর্যসংস্কৃতির প্রতি নয়। অথচ পরবর্তীকালে আমরা দেখি দাক্ষিণাত্য থেকে আসা বণিকবৃত্তির সেনবংশজ রাজাদের প্রস্তাবিত বর্ণাশ্রমবাদী সমাজব্যবস্থা বাঙালিরা অতি অনুগতভাবে মেনে নিয়েছিল। ভূমিজাত গরিমার উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে আমদানি করা আর্য ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা বুঝিয়ে দেয় জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মবিশ্বাস কত কম। বাঙালির প্রধান সংকট তার আত্মপরিচয়বোধের দুর্বলতা থেকেই এসেছে। বহিঃশত্রুর অস্ত্রাঘাত থেকে নয়।

তিব্বত বা ভোটমোঙ্গলদেশের সঙ্গে বাংলা ও অসমের যোগাযোগ কিন্তু ষষ্ঠ শতকের আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। উত্তর, পূর্ব ও রাঢ়বঙ্গে ‘কিরাতজনকৃতি’ সহ ভোটমোঙ্গলদেশের মানুষের আগমন ও উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে। তিব্বতি ইতিহাস তো বলছে ৫৮৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে তাঁরা সিকিম, নেপাল, অসম ও বাঙ্গালাদেশ জয় করেছিলেন। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতি রাজা স্রং সন নেপাল জয় করেন। আবার এই বছরেই তাঁর পুত্র স্রং সন গাম্পো’র জন্মও হয়েছিল। এই জয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই ৫৯৫  খ্রিস্টাব্দ থেকে নেপালি অব্দের প্রচলন করা হয়। রাজনৈতিকভাবে তিব্বতের এই ‘জয়’ ঘটনা কি না তা নিয়ে আমাদের ইতিহাসে কিছু বলা নেই। তবে তাঁদের বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বিনিময় বেশ গভীরভাবেই হয়েছিল বোঝা যায়। খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে হিউ এন সাঙের বর্ণনায় আমরা ‘বৌদ্ধ বাংলা’র যে ছবি পাই সেখানেও ভোটমোঙ্গল দেশের বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। একটা সম্ভাবনা এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। ‘বাংলা জয়ে’র স্মারক হিসেবে তিব্বতি সন শুরু হচ্ছে ৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে। যদিও লর্ড কর্নওয়ালিসকে তৎকালীন দলাই লামা (১২০৩ ও ১২০৬ বঙ্গাব্দে) জানিয়েছিলেন তিব্বতি সন শুরু হয় ৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে। এই দুচার বছরের ব্যতিক্রম বাদ দিলে বোঝা যায় এই সময়টিতে নেপাল, উত্তরবঙ্গ, মধ্যবঙ্গ ও রাঢ় অঞ্চলের উপজাতি ও কৌম সমাজে তিব্বতি সংস্কৃতির প্রভাব বিশেষভাবে বেড়ে উঠেছিল। দুই প্রতাপশালী তিব্বতি রাজা স্রং সন ও স্রং সন গাম্পো’র প্রতিপত্তি বাংলা ও অসমে বেশ ভালো’ই ছিল। তিব্বতি রাজশক্তির শীর্ষপর্বে ইতরযানী কৃষিসমাজে তিব্বতি সনের প্রচলন হওয়াটা নেহাৎ অসম্ভব নয়। কারণ পুরাণযুগের এই সময়টিতে দেশে ব্রাহ্মণ্যশক্তির শক্তি ও চাপ ক্রমাগত বেড়ে ওঠায় ইতরযানী মানুষ বৌদ্ধধর্মে আশ্রয় খুঁজছিল। কিন্তু দেশে কোনও প্রভাবশালী বৌদ্ধ রাজাও ছিলেন না তখন। তিব্বতের বৌদ্ধ রাজা ক্রমে এদেশের বৌদ্ধদের কাছে আশ্রয় হয়ে উঠেছিলেন। অতএব সমাজের এই স্তরের মানুষের কাছে ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতি সনের অনুকরণে বঙ্গাব্দের প্রচলন হয়েছিল এরকম একটা তত্ত্ব বিশেষ অবাস্তব মনে হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হল যদি এই অব্দ বৌদ্ধরাজাদের প্রভাবে প্রচলিত হয়েছিল তা মেনে নেওয়া হয়, তবে পরবর্তীকালে (৭৫০-১১৭৪ খ্রিস্টাব্দ) বৌদ্ধ পাল রাজত্বে কেন বঙ্গাব্দের পরিবর্তে শকাব্দকে গ্রহণ করা হল? এর একটাই উত্তর হতে পারে। বঙ্গাব্দ চিরকালই ইতরযানী, কৃষিজীবী মানুষের অবলম্বন হয়ে থেকে গেছে। এই দীর্ঘ বিকাশের পথে কখনওই তার রাজ আনুকূল্য লাভ করার সৌভাগ্য হয়নি। হয়তো এটাই একযোগে তার শক্তি ও দুর্বলতা। রাজশক্তির ক্রমাগত পরিবর্তন বঙ্গাব্দের অগ্রগতিকে কক্ষচ্যুত করতে পারেনি। বিক্রমসম্বৎ, শকাব্দ, লক্ষ্মণসম্বৎ, মল্লাব্দ, হিজরি সাল, গ্রেগরিয় পঞ্জী ইত্যাদি রাজকীয় পঞ্জিকা বারবার বদলে গেছে। কিন্তু বাংলা সন বা বঙ্গাব্দকে ভূমিজ মানুষের বাস্তব নির্ভরতা থেকে কেউ স্থানচ্যুত করতে পারেনি। বস্তুত প্রথমে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও পরে গ্রিয়রসন সাহেব একটি শাসনপট্টের উল্লেখ করেন যেটি মিথিলারাজ্যের রাজা শিবসিংহ কবি বিদ্যাপতিকে দিয়েছিলেন। এই শাসনপট্টটিতে লক্ষ্মণসম্বৎ, বিক্রমসম্বৎ ও শকসম্বতের সঙ্গে সনাব্দ বা বাংলা সনেরও উল্লেখ ছিল।

একটা ব্যাপার স্পষ্ট, বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ কোনও আর্য হিন্দু রাজার প্রবর্তিত সম্বৎ নয়। সেক্ষেত্রে তা বহুপূর্বেই হিন্দু শাস্ত্রকারদের আনুকূল্য লাভ করত। আকবরি সন বা ‘ফসলি সন’ কখনও কোনও দলিলে বঙ্গাব্দ নামে উল্লিখিত হয়নি। উপরন্তু তার শুরু ভাদ্রমাসের শুক্ল প্রতিপদে। পয়লা বৈশাখে নয়। অন্যপক্ষে শকাব্দও সরকারিভাবে চৈত্রমাসে শুরু হয়। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষিভিত্তিক, ইতরযানী যেসব অব্দ প্রচলিত আছে সেগুলি সবই পয়লা বৈশাখেই শুরু হয়। যেমন উত্তরভারতের বৈশাখি, অসমের রঙ্গালি বিহু, তামিলনাড়ুর পুথাণ্ডু, কেরালার ভিশু, ওড়িশার বিষুব সংক্রান্তি, মিথিলার জুড় শীতল এবং বাংলার পয়লা বৈশাখ। উল্লেখ্য তিব্বতি বর্ষারম্ভও পয়লা বৈশাখেই পালিত হয়। মুঘল ব্যবস্থার ‘ফসলি সন’ বা হিজরি সালের বর্ষারম্ভের সঙ্গে একে কোনও ভাবেই যুক্ত করা যায় না। বীরভূমের সুরুল নথি সংগ্রহে একটি হুকুমনামা পাওয়া গিয়েছে, যেখানে ”বাঙ্গালা সন ১১৯৭ সালের ১৮ অগ্রহায়ণ মত্তাফেকে ফসলি সন ১১৯৮ সালের ১০ অগ্রহায়ণ” তারিখ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা সন ও ফসলি সনের মধ্যে ৩৫৭ দিনের ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। আকবর বাদশা যে চান্দ্র হিজরি সালকে সৌর বঙ্গাব্দের জুড়েছিলেন তার স্বীকারযোগ্য কোনও উল্লেখ সরকারি মুঘল দলিলপত্রে পাওয়া যায় না। বিশেষত আইন-ই-অকবরিতে তার উল্লেখ না থাকাটা বিস্ময়কর। মুঘল আমলে রাজস্ব বা কোষাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দেওয়ানের হাতে, দেওয়ানিরাজ বা সিভিল গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পরে। সেটা বাদশা জাহাঙ্গীরের শাসনকালে হয়েছিল। তার আগে নিজামৎ, অর্থাৎ শাসনব্যবস্থা ও দেওয়ানি বা রাজস্বব্যবস্থা সবই দেখতেন সিপাহসলার, সর’লশকর বা হাকিম পদে যেসব প্রশাসকরা থাকতেন, তাঁরা। এঁরা মূলত ছিলেন সামরিক সেনাধ্যক্ষ। বাংলায় দেওয়ানিরাজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর পরে। যদি ধরেও নেওয়া যায় ‘আকবরি সন’ এদেশি সৌর অব্দের সঙ্গে হিজরি সালকে যুক্ত করেই প্রচলিত হয়েছিল তবে প্রশ্ন উঠতে পারে কেন পরাক্রমী রাজশক্তি শকাব্দ বা বিক্রমসম্বতের মতো ‘কুলীন’ পঞ্জিকাকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গাব্দের শরণ নিল? বঙ্গাব্দের প্রাচীনত্ব ও কৃষিপঞ্জিকা হিসেবে এর গুরুত্বই কি এর কারণ? দেশের সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী সমাজ, যাঁরা রাজস্বব্যবস্থার মেরুদণ্ডও বটে, তাঁদের প্রাথমিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞ মুঘল সরকারি ব্যবস্থা বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

বর্ণাশ্রমবাদী আর্য সমাজব্যবস্থায় যেকোনও রকম আর্যেতর ঐতিহ্যকে গ্রহণ করার ব্যাপারে তুমুল প্রতিরোধ দেখা যায়। এমন কি এই মুহূর্তেও সরকারি আনুকূল্যে কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে ঘোরাবার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। পুরাণযুগ থেকে যে সব শক্তি বঙ্গাব্দের যাথার্থ্যকে অস্বীকার করে ভিক্ষালব্ধ ভিনদেশি বিক্রমসম্বৎ বা শকাব্দকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের অংশ করতে চেয়েছে তারা আজকেও সমান সক্রিয়। বাংলার গর্বিত কৃষিজীবী সমাজের জেদ বা আত্মমর্যাদাবোধ বঙ্গাব্দকে অপ্রাসঙ্গিক হতে দেয়নি। হিন্দু বা মুসলিম পুনরুত্থানবাদীদের আপ্রাণ প্রয়াস প্রতিরোধ করে বঙ্গাব্দ এবং পয়লা বৈশাখ আজ আপামর বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত মিলনক্ষেত্র, যেখানে বিভেদপন্থীদের ষড়যন্ত্র সফল হয় না। গত চৈত্রমাসে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে দেখলুম কিছু বঙ্গভাষী মানুষ ‘বাঙালি’দের আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা যেন পয়লা বৈশাখের নববর্ষকে ত্যাগ করে প্রকৃত হিন্দু হিসেবে পয়লা চৈত্রকে নববর্ষ হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু শকাব্দের প্রবর্তন হয়েছিল শকরাজা চাস্তন বা বৌদ্ধরাজা কণিষ্কের দৌলতে। তাঁরা কেউই ‘হিন্দু’ ছিলেন না। এমন কি আর্যও নয়। উপরন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে চোখে পড়ে বঙ্গাব্দ নাকি তুর্কি-মুঘলস্পৃষ্ট ভ্রান্ত ‘অহিন্দু’ পঞ্জিকা। আবার একদল মুসলিমের কাছে এই কারণটিই নাকি বঙ্গাব্দের গ্রহণযোগ্যতার প্রধান হেতু। ধর্ম, ধর্ম, তোমার হৃদয় নাই? বাঙালি?

আরও বহু কিছুর মতো বঙ্গাব্দকেও কৃষিজীবী আর্যেতর ভূমিস্তর থেকে অভিজাত সমাজের প্রার্থিত কৌলীন্য এনে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-উত্তর বাংলা সংস্কৃতিতে পয়লা বৈশাখের ‘পবিত্রতা’ ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই অবান্তর। দূষিত রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে যাঁরা এই ষড়যন্ত্রে নিযুক্ত, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালি তাঁদের প্রতিরোধ করুন। নববর্ষে এটাই হোক আমাদের আজকের প্রতিজ্ঞা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. অসাধারণ আলোচনা। তবে একটা জিনিস… অঘ্রাণ মাস থেকে বছর শুরুর একটা কৃষি ক্যালেন্ডার ছিল জানতাম এক সময়। মাসটার নামও তাই অগ্রহায়ণ। এবং আমাদের আমন ধানটাও ও সময়েই ওঠে। পয়লা অঘ্রাণ এখনও নবান্ন পালিত হয় গ্রামবাংলার প্রচুর জায়গায়। এটার কোনও উল্লেখ লেখাটায় নেই। এটা কি তাহলে ভুল জানতাম? একটু জানালে ভালো হয়…

আপনার মতামত...