তারান্তিনো — তিন

প্রিয়ক মিত্র

 

গত সংখ্যার পর

বগুড়ার কাছাকাছি কোথাও এই জায়গাটা। খোলা মাঠ। ভোরের আলো সদ্য ফুটছে এখানে।

ইকবাল সাজ্জাদ আনিসুর রফিক সূর্য আকবর চঞ্চল মঈদুল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। আর দাঁড়িয়ে আরাফাত। তাদের মিশন ব্যর্থ হওয়াটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। আসমা আখতার নিহত। তাদের প্রত্যেককে পাকড়াও করেছে খানসেনারা, ওয়াসিম আলীর তত্ত্বাবধানে। কিন্তু কী এক অলৌকিক উপায়ে পাকিস্তানের বহু সেনাপ্রধান, ব্যবসায়ী, রাজাকার একটা ঘরের ভেতর ভস্মীভূত হয়ে গেছেন। প্রত্যেকের বডি ছাই হয়ে গেছে।

নিয়াজী এবং ইয়াহিয়া — কেউই অবশ্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি শেষমেষ। ওয়াসিম আলীর তদারকিতেই বোধহয় তাদের আসমা আখতারের বাড়িতে আসা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। কারণ ওয়াসিম আলী সবকিছুই জানতে পেরেছিলেন আগে, তার প্রখর বুদ্ধি দিয়ে এই হামলার নীল নকশা দেখে ফেলেছিলেন তিনি। এরকম একজন গোয়েন্দাই খানসেনাদের প্রয়োজন।

কিন্তু তিনিও টের পাননি নাজমা নামক এক তরুণী কী ভয়াবহ মরণফাঁদ পেতে রেখেছিল পাক প্রশাসকদের জন্য।

এইরকম ধূর্ত, শয়তান ওয়াসিম আলী আজ চমকে দিয়েছে ততোধিক ধূর্ত এই আটজন মুক্তিসেনা এবং তাদের মাথা আরাফাত শিকদারকে।

আরাফাত শিকদার ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ। আরাফাত মুক্তিসেনায় যোগ দেওয়ার আগে অন্তত শ খানেক খানসেনাকে নিজের হাতে মেরেছে। আরাফাতের মোডাস অপারেন্ডি বীভৎস। আরাফাতের দুটো হাতের বুড়ো আঙুলে ধারালো রুপোলি নখ চকচক করতে দেখেছে অনেকেই। আরাফাত কাউকে কিচ্ছু বুঝতে না দিয়ে, আচমকাই মৃত্যুদূত হিসেবে হাজির হয়েছে বহু খানসেনা এবং রাজাকারের কাছে। খালি হাতে শুধু দুটো বুড়োআঙুলের ধারালো রুপোলি নখের চাপে বর্বর খানসেনাদের চোখের গোল্লা সে তুলে এনেছে নিজের আঙুলে।

এই আরাফাত এখন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওয়াসিম আলীর ভয়াবহ অথচ খ্যাঁকশেয়ালমার্কা চাহনির দিকে।

কিছু দূরে দাঁড়িয়ে চারজন খানসেনা। সতর্ক।

ওয়াসিম আলী কয়েকটি দাবি পেশ করেছেন আরাফাত এন্ড কোং-এর কাছে। যাদের শান্তি কমিটির রাক্ষসেরা নাম দিয়েছিল ‘বেজম্মা মুক্তির ছাওয়াল’। সেই তারা এখন এক অদ্ভুত ধূসর অবস্থানে দাঁড়িয়ে, স্বাধীন হতে চলা বাংলাদেশের এক গ্রামাঞ্চলে, খোলা মাঠের ওপর।

খুব শিগগিরি মুক্তিবাহিনী দখল করে ফেলতে পারে ঢাকা ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ। ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করল বলে। চীনের ঘোষালয্য পাওয়ার আশায় পাকিস্তান বুক বাঁধছে বটে, তবে সে আশাও ক্ষীণ। ভারত একবার যুদ্ধে নামলে ঢাকা দখল সময়ের অপেক্ষা।

সম্যক পরিস্থিতি বুঝে ওয়াসিম আলী যা যা দাবি রেখেছেন,

১ — ভারত যুদ্ধ ঘোষণা না করা পর্যন্ত আরাফাত এবং এই আটজনের আত্মগোপনের ব্যবস্থা তিনি করবেন। এই কদিন এই আরাফাতরা কোনও অপারেশনে যেতে পারবে না।

২ — ঢাকা দখল যখন সুনিশ্চিত হবে তখন এরা প্রকাশ্যে আসবে। যদিও জানা যাচ্ছে না আসমা আখতারের বাড়ির ঘটনার মূল চক্রী কে? কিন্তু তারাই সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নেবে এই ঘটনার। এবং তারা তাদের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে তুলে ধরবে ওয়াসিম আলীকে।

৩ — যুদ্ধবীর হিসেবে আরাফাতরা যে সম্মান পাবে স্বাধীন বাংলাদেশে, তার সমান মর্যাদা, এবং পদমর্যাদা যেন ওয়াসিম আলীও পান।

ইকবাল মঈদুল সাজ্জাদ চঞ্চল সূর্যরা চাইছিল এক্ষুণি ওয়াসিম আলীর মুণ্ডু নিয়ে লোফালুফি করতে। কিন্তু আরাফাতের সম্মতি প্রয়োজন।

আরাফাত একবার হাসল। “আমরা রাজি”।

আরাফাতের কথা শুনে সকলেই আঁতকে উঠত যদি না আরাফাত একবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টি স্থাপন করত ওদের ওপর।

ওয়াসিম আলীর চোখ চকচক করে উঠল। খানসেনাদের তলব করলেন তিনি। বলে দিলেন কী কী ভাবে আরাফাতদের নিয়ে যেতে হবে গোপন ডেরায়।

কথামতন এগিয়ে এসে প্রত্যেকের হাতের বাঁধন খুলে ফেলল জান্তব চেহারার খানসেনারা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধপ ধপ করে তিনটে শব্দ। প্রয়োজনমতো দড়ি কাটার জন্য যে গোপন ছুরিটা অবিশ্বাস্যভাবে লোকানো ছিল ওদের হাতের তালুতে, সেই ছুরি মসৃণভাবে তিনজন খানসেনার গলার নলির ওপর দিয়ে চলে গেল। তিনটে মুণ্ডু মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গেল।

ওয়াসিম আলীর এরকম ভয়ার্ত দৃষ্টি কেউ কখনও দেখেছে? আরাফাতরা দেখল, সোল্লাসে।

পলায়নরত আরেকজন খানসেনার পিঠ চিরে ঢুকে গেল একজন মৃত খানসেনার কোমরের পিস্তলের তিনটে গুলি।

ওয়াসিম আলীর সমস্ত বক্তব্য চঞ্চল রেকর্ড করেছিল কলকাতা থেকে কিনে আনা ছোট্ট টেপরেকর্ডারে। তার প্রাণভোমরা এখন এই নজনের হাতে। তিনি ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরাফাতদের দিকে। আরাফাতদের ধীর পা এগিয়ে চলেছে তার দিকে।

বেশ কিছুদিন পর, স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হওয়ার পর, সুন্দরবন এলাকায় অর্ধোন্মাদ, অর্ধনগ্ন ওয়াসিম আলীকে পাওয়া যায়। তার খোলা বুকে একটি গভীরে বসে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন। ঠায় তাকিয়ে থাকলে তার আকৃতিটা বোঝা যায়, পাক পতাকায় এই চিহ্ন চোখে পড়ে, চাঁদতারা।

এত ঘটনা অবশ্য আদিনাথ জানে না। সে শুধুই জানত আসমা আখতারের বাড়ির হামলার নীল নকশা। সে চিনত না নাজমাকেও, যার জন্য শেষমেষ ব্যর্থ হতে হতেও হয়নি মুক্তিসেনার মিশন।

“বাংলাদেশের সিভিল ওয়ারে যা সম্ভব, এক্ষেত্রে তা আদৌ সম্ভব?”, প্রশ্ন করল রঞ্জন, ওপর থেকে ঝুলতে থাকা বাল্বের আলো এসে পড়েছে আদিনাথের মুখে। সে শ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল রঞ্জনের দিকে।

“আমি কিন্তু এখনও বলা শেষ করিনি।” আদিনাথের গলা ধীর।

রোহিতাশ্ব: “লেট হিম টক”

অঞ্জন এবং রঞ্জন দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিল একবার। প্রায় রেনিগেডের মতন পার্টির ওপরমহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা ঠিক কী ধরনের অপারেশন করতে চলেছে, তার কোনও আন্দাজ পাচ্ছে না তারা।

আদিনাথ একটু থেমে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শুয়োরের বাচ্চা সি আর পি আমাদের কমরেডদের বেছে বেছে মারছে। আমরা পার্টিলাইন মেনে এগোচ্ছি ঠিকই, কিন্তু স্ট্র্যাটেজি দিয়ে আর কতদূর এগোনো সম্ভব সেটা আমি বুঝতে পারছি না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাদের অ্যাজেন্ডা ফেল করবে। এইসব টিকটিকি, খোচড়, সি আর পি-গুলো ওপেনলি ঘুরে বেড়াবে। এগুলোর বন্দোবস্ত করা উচিত। ইকবালদের ওপর ওদের কমান্ডার ইন চিফ আরাফাতের কড়া নির্দেশ ছিল, প্রত্যেকে যেন অন্তত পঞ্চাশজন খানসেনার ধড় আর মুণ্ডু আলাদা করে। আমি বলছি না আমাদের এরম কোনও মোটো থাকা উচিত, কিন্তু আমরা যখন প্রায় বিচ্ছিন্ন, তখন অন্তত বসে না থেকে এই খতম অভিযানটা আমাদের চালানো উচিত। ওরা আমাদের কমরেডদের মুণ্ডু নিয়ে গেন্ডুয়া খেলবে, আর আমরা আঙুল চুষব বসে?”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আদিনাথের দিকে। আদিনাথের মতন একজন ঠান্ডা মাথার মানুষ এসব কী বলছে?

একটু দম নিয়ে ধরা গলায় আদিনাথ বলল, “বাতিস্তা সরকার ফেলে দেওয়ার পর কিউবায় রেভোলিউশনারি ট্রাইবুনাল বসিয়ে শায়েস্তা করা হয়েছিল শয়তানদের। আমরা সে সুযোগ পাব না। আমাদের সঙ্গে নেতৃবৃন্দের যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। সি এম ফেরার। সি এম একবার ধরা পড়ে গেলে আন্দোলন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?”

“তাই বলে আমাদের অ্যানার্কিস্ট হয়ে যেতে হবে নাকি!” অঞ্জন বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল। “ননসেন্স”, তার বিড়বিড় গোটা ঘরের লোক শুনতে পেল।

হো হো করে হেসে উঠলেন আদিনাথ। “অ্যানার্কিজম কাকে বলে তাই নিয়ে তোমার সঙ্গে তর্ক করার ইচ্ছে নেই কমরেড। এসব টার্মের ভুলভাল প্রয়োগ আমি টলারেট করতে পারি না।”

তপন বলে উঠল, “কিন্তু আদিনাথদা, তুমি যা ভাবছ সেটা কীভাবে সম্ভব?”

“হ্যাঁ, আমাদের কোনও ব্যাক আপ নেই। সবথেকে বড় কথা অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটতি। ওয়েপনস ছাড়া আমরা কোনও অপারেশনেই যেতে পারব না।”

“কী চাই বলো?” মুচকি হেসে বলল আদিনাথদা‌। “কালাশনিকভ? মলোটোভ ককটেল?”

রোহিতাশ্ব এই মুচকি হাসি এবং এমন একটি অবাস্তব কথার মানে জানে। হিপিপাড়ায় একটা বেআইনি অস্ত্রের গোডাউনে যাতায়াত আছে আদিনাথদার। পার্টি নেতৃত্বের একাংশ সেটা জানত না। তাদের আপত্তি ছিল আদিনাথের হিপিপাড়ায় যাওয়া নিয়ে। আর একাংশের কাছে খবর ছিল যে কলকাতা শহরে নকশালদের হাতে শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দেওয়ার অন্যতম কাণ্ডারী আদিনাথ রায়।

“একটা ব্লু প্রিন্ট আমাদের ছকে ফেলতে হবে শিগগির,” আদিনাথ ব্যস্ত হয়ে বলল।

সকলেরই মাথা ঝুঁকে পড়ল টেবিলের ওপর। পাঁচটা মাথা দ্বিধা, আশঙ্কা, প্রত্যয় নিয়ে জড়ো হল ঝুলন্ত বাল্বের নীচে, যেমন ঝুলন্ত বাল্বের তলায় তখন তাদের বহু কমরেডের ওপর চলছিল পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের নারকীয় থার্ড ডিগ্রি।

ভবানীপুরের ‘তৃপ্তি’ বারে বসেছিলেন এক অফিসফেরতা ভদ্রলোক। অজস্র স্বর, অঢেল চিৎকার, মদের ফোয়ারা। কবি, ফিল্ম ক্লাবের সদস্য, নাট্যকর্মী, ইতিউতি নকশাল সিমপ্যাথাইজার, এবং কেরানিরা ভিড় জমিয়ে বসে। কেরানিদের বিমর্ষ মুখে নাগরিক ক্লান্তি। কেউ গোগ্রাসে গিলছে সেক্স জার্নাল, স্বপনকুমার। এক বৃদ্ধ ধুতি পাঞ্জাবী লাল চামড়ায় মোড়া একটি বই পড়ছেন অদূরে বসে। অফিসফেরতার চোখ পড়ল বইটার ওপর। একবার সতর্ক দৃষ্টি চালিয়ে নিল বুড়োর ওপর।

সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট টিপটপ, মুখে একটা পাইপ ধরিয়ে উঠে এসে বসল অফিসফেরতার সামনে।

“আও হুজুর তুমকো সিতারোঁ মে লে চলুঁ” — গান বেজে চলেছে।

পাইপ টেনে ধোঁয়া ছাড়লেন টিপটপ।

ফিসফিস করে কথা শুরু হল দুজনের।

অন্য একটি টেবিলে হঠাৎ একজন চাপড় মেরে চিৎকার করে বলল, “আলবাত বলছি হাইডেগার ঠিক! তুমি বিইং অ্যান্ড টাইম পড়েছ?”

সবাই একবার চোখ ফেরাল। উত্তেজিত ভদ্রলোককে শান্ত করে বসানো হল।

সাদা টিপটপ এবং অফিসফেরতার গোপন কথোপকথন চলছে।

“ন্যাংটা নকশাল! মানে ওই দুই নটোরিয়াস ভাই! তুমি শিওর?”

“হ্যাঁ স্যার! আরও তিনজন রয়েছে ওই আড্ডায়। তার মধ্যে একটি ছেলের নাম জানতে পেরেছি। তপন দাস!”

“ওহ মাই গড! নর্থবেঙ্গলের ছেলেটা। সবকটা ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল একজায়গায় জুটেছে। আর?”

“চিনি না স্যার!”

“আদিনাথ রায়কে চেনো?”

“না স্যার”

“খোচড় হয়েছ কী করতে? দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস এলিমেন্ট অ্যামংস্ট দ্য নকশাল গুনস। যাক গে! এই আড্ডার খবরটা চিন্তায় ফেলল। তুমি যা বলছ… মাঝে একটা গ্রুপ সি এম-কে টার্গেট করেছিল।”

একটু থেমে টিপটপ হো হো করে হেসে উঠল।

“কী অদ্ভুত না! আমরাও সি এম-কে টার্গেট করেছি। ওরাও সি এম-কে টার্গেট করেছে। দুজন আলাদা আলাদা সি এম!”

সাউথ সিঁথির কোনও এক গলিতে সন্ধে ঘন হয়েছে, রাত নামার অপেক্ষায়। বসন্তের শেষ প্রায়। গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া দরজার বাইরে অপেক্ষারত। সারাদিনের রোদ আর ক্লান্তি সান্ধ্য গা ধোয়ায় শান্ত হয়ে পাখার মৃদু হাওয়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তুলসীতলায় প্রদীপ, শাঁখের আওয়াজ সব রোজকার মতন। আজ বুধবার, বিনাকা গীতমালা শুরু হল। ভাড়াবাড়ির পাখার ঘটাং ঘটাং শব্দ, আর হালকা হলুদ আলোর মধ্যে বাজছে, “শুনো সজনা  পাপিহে নে কাহা সবসে পুকার কে।” দেওয়ালে লেখা “সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করুন,” “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান,” “পুলিশ কুত্তা দিয়ে বিপ্লব ঠেকানো যাবে না।”

একটা বেড়াল ঘাপটি মেরে লক্ষ রাখছে তিনটে ছায়ামূর্তির ওপর। কোনও খোচড়বৃত্তির দায় নেই তার। সে শুধু দার্শনিকের মতন সবকিছুর ওপর লক্ষ রেখে যাবে।

ছায়ামূর্তিরা দাঁড়িয়েছিল গলির একটা বাঁক ঘেঁষে। একটা কানাগলির মুখে। আপাদমস্তক অন্ধকারে মিশে। চট করে কোনও পথচলতি মানুষের চোখে পড়বেই না। এই গোপনীয়তায় বাধ সাধছে কেবল বেড়ালটাই। সে সাক্ষী হয়ে বসে রয়েছে জবুথবু। তবে কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করছে না একেবারেই।

“কী বলছিস পরিষ্কার করে বল।” একজন ছায়ামূর্তি হিসহিসিয়ে বলল। তপন। বাকি দুজন অঞ্জন ও রঞ্জন।

“আদিনাথদার মতন একজন কমরেডকে সন্দেহ করছিস তোরা?” আবার বাতাসে ফিসফিস ভাসিয়ে দিল তপন।

“কমরেড! আমরা এখন কেউ কারুর কমরেড নই। সংগঠন থেকে আমরা যে বিচ্ছিন্ন সেটা তুইও খুব ভালোভাবেই জানিস। এখন এভাবে আইসোলেটেড হয়ে আমরা এমন একটা আজগুবি অপারেশন করতে চলেছি যেটা… যেটা অবাস্তব! সি আর পি আর পুলিশ অফিসারদের বেছে বেছে মেরে আমরা বিপ্লবের দিকে কতটা এগোব?”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো শেষ করার পর অঞ্জন দম নিতে থামল। তপন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তোরা কবে থেকে সুশীতল রায়চৌধুরী লবিতে নাম লেখালি?”

“বোকার মতো কথা বলিস না তপন।” ঈষৎ উত্তেজনায় রঞ্জনের কথাগুলো কেঁপে উঠল সন্ধেরাতের হালকা হাওয়ায়। “কমরেড চারু মজুমদারের লাইন আমরা অস্বীকার করছি না। খতম অভিযান চলুক। কিন্তু পার্টির তো একটা ডিসিপ্লিন আছে। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে বসে যেমন খুশি তেমন প্ল্যান করে…”

কথা শেষ হল না রঞ্জনের। বেড়াল সজোরে কেঁদে উঠেছে। দুটো জোরালো হেডলাইট। এগিয়ে আসছে এদিকেই। পুলিশ জিপ। ধীরে এগোচ্ছে।

সতর্ক হল ওরা। অপারেশনের সময় উপস্থিত।

অন্ধকার গলি থেকে সি আর পি-র বেশে বেরিয়ে এল এই তিনজন।

পুলিশ জিপ দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন সাদা উর্দি বিস্মিত দৃষ্টিতে নেমে এগিয়ে এলেন তিনজনের দিকে।

ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল পনেরো বছরের একটি ছেলে। হ্যালোজেনের হলুদ আলোয় সে দেখতে পেল সিআরপি-বেশী তিনজন লোক সাদা উর্দির সঙ্গে দাঁড়িয়ে নীচে।

সাদা উর্দি সন্দিহান। এইসময় হঠাৎ তিনজন সি আর পি এরকম বিচ্ছিন্নভাবে এই এলাকায় কী করছে?

“কোনও খবর আছে নাকি?” চাপা গলায় হিসহিস করে বলল সাদা উর্দি।

তপন এক কদম এগোল। মুঠোর তলা থেকে একটা খুর বার করে একবার চালাল চুলের ওপর।

“রমেন ঘোষাল না? কাশীপুর থানার ওসি?”

সাদা উর্দি কিছু একটা আন্দাজ করে সোজা হাত দিল নিজের কোমরের পিস্তলের বকলসে।

তারপর একমুহূর্ত। চিরুনি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পরে পরেই খুরের আরেকটি অমোঘ ব্যবহার হল। সেটি সোজা চলে গেল রমেন ঘোষালের গলাবরাবর। ধুরন্ধর দাপুটে রমেন ঘোষাল, অন্তত দশটি নকশাল ছেলের কাস্টডিয়াল ডেথ এবং একটি নকশাল মেয়ের ব্রুটাল রেপের কাণ্ডারী, ঝু্ঁকে পড়লেন তপনের ওপর। তপনের সি আর পি উর্দির কাঁধ রক্তে ভেসে গেল।

দুজন কনস্টেবল আর একজন সাব ইনস্পেক্টর ঘটনাটা সামান্য বুঝতে পেরেই জিপ থেকে নেমে পিস্তল এবং গাদাবন্দুক তুলে তাক করল এই তিনমূর্তির দিকে। “শুয়োরের বাচ্চা!” সাব ইনস্পেক্টরের কর্কশ গলা বেজে উঠল।

প্রথম ঘটনাটার জন্য ছাদের ওপরের পনেরো বছর একদম প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু এবার সে পরিস্থিতি খানিক আন্দাজ করতে পেরে হাতে তুলে নিল দুপায়ের ফাঁকে রাখা পেটোটা। তার নিখোঁজ দাদা যেটা ট্যাঙ্কের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। একমাত্র সেই জানত এই পেটোটার সন্ধান।

পেটোটা চার্জ হল সাদা উর্দিদের তাক করে। থ হয়ে গেল তপন, অঞ্জন এবং রঞ্জন। এতক্ষণ যা হচ্ছিল নিঃশব্দে হচ্ছিল। এবার পাড়ার লোক সতর্ক হল। কিছু জানলা সপাট বন্ধ হল। কিছু জানলার খড়খড়ি ফাঁক হল। কিছু বারান্দার ঘুলঘুলিতে চোখজোড়া স্থির হল।

পেটোর ধোঁয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল তিনমূর্তি। তারপর ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে যখন সন্ধানী চোখগুলো ধাতস্থ হল, তখন দেখা গেল সাউথ সিঁথির গলির রাস্তায় পড়ে রয়েছে চারজন সাদা উর্দির গলাকাটা লাশ।

(আবার আগামী সংখ্যায়)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...