এক অদ্ভুত সমাপতন

অশোক মিত্র | অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

সকাল থেকে ফোনে ভেসে আসছে মে দিবস নিয়ে নানা রসিকতা। আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস এখন মাংসভাত খাওয়ার ছুটির দিন বই কিছু নয়। তার ভেতরেই খবরটা এল। ডক্টর অশোক মিত্র আর নেই। দুর্নিবার কমিউনিস্ট যিনি ভেতরে ভেতরে এখনও পোষণ করতেন আপোষহীন কমিউনিস্ট ভাবনা, নবতিপর হয়েও সপাটে কাজ করে চলেছিলেন, নানা লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনা করে ‘আরেক রকম’ পত্রিকাটি বের করছিলেন শুধু বিকল্পের চিন্তা থেকেই। ভালো মন্দ, সাফল্য বিফলতার উর্ধে, কমিউনিজম বিলুপ্তির এই সময়ে সাচ্চা মানুষের অপসারণ, বয়সোচিত হলেও, বেদনার। এসব খবরে, আজকাল, কেবলই ধ্বস্ত লাগে।

একইসঙ্গে এ আমার খুব ব্যক্তিগত ক্ষতি। কেন, তা পরে বলছি।

মোটামুটি সবাই জানেন অশোক মিত্র ছিলেন অর্থনীতিবিদ, এবং ১৯৭০-৭২ সালে ছিলেন দিল্লিতে ইন্দিরা সরকারের চিফ ইকনমিক অ্যাডভাইজার পদে বৃত। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এ যান সে সূত্রেই। ক্যাপিটালিজমের ভেতরের কলকব্জা স্বচক্ষে দেখে আসেন সেই দশকেই। আর ১৯৭৭-এ জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হবার সময়ে অর্থমন্ত্রী হন এবং ১৯৮৭ অব্দি সেই পদে থাকেন। শ্রুত আছে, ১৯৮৭-তেই জ্যোতি বসুর সঙ্গে মতানৈক্যের ফলেই পদটি ছেড়েছিলেন স্বেচ্ছায়। মার্ক্সিস্ট রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ এই পরিচয় ছাড়াও তাঁর লেখক পরিচয়ও অনেকের জানা। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পেয়েছেন অশোক মিত্র। অসম্ভব প্রাণবন্ত ও স্বাদু গদ্য লিখেছেন। কবিতাও লিখেছেন। কবিতা থেকে মিছিলে, বা আপিলা চাপিলা-র মতো বিখ্যাত বই যেমন তাঁর, তেমনই অসংখ্য ইংরেজি বইয়েরও লেখক তিনি। এই সব তথ্যগুলিই অবশ্য গুগল করলে পাওয়া যায়। আর আমার চেয়ে ঢের বেশি যোগ্য মানুষ এগুলি নিয়ে লিখবেন আশা রাখি। (শুধু বলে রাখি একটি ট্রিভিয়া। সমনামী, আই সি এস অশোক মিত্রের সঙ্গে অনেকে মার্ক্সবাদী অশোক মিত্রকে গুলিয়ে ফেলেন। প্রায় এক বয়সী আই সি এস অশোক মিত্র স্বাধীন ভারতের জনগণনার কাজের জন্য বিখ্যাত, তিনিও আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তিন কুড়ি দশ নামে।)

আরেক রকম কাগজটি বেরই করেছিলেন অশোক মিত্র বাম জমানার শেষাশেষি, শুধু অন্যরকম, অলটারনেটিভ, একটা কথা বলার স্পেস তৈরি করতে। এই স্পেসটা ওঁর কাছে যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের একটা অক্সিজেন, আমার মনে হয়েছে। কেননা চারিদিক থেকে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে আসছে তখন বাম নীতি, বাম আদর্শের সবরকম কথা। যে তীক্ষ্ণ কান ফাটানো অথচ চাপা, আওয়াজ বাজতে শুরু করেছিল নয়ের দশকে সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের পতনে বা লেনিনের একের পর এক মূর্তি ভূলুন্ঠিত হওয়াতে, সেই ভয়ানক ঢেউ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকেও ছুঁয়েছে ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১১ অব্দি। তারপর তো সেই বিখ্যাত ৩৪ বছরের জমানা বদল, সব রকমের কমিউনিস্ট বা বাম ভাবধারাকে প্রশ্ন করে, তাচ্ছিল্য করে, ছুঁড়ে ফেলার দিন।

অশোক মিত্র মন্ত্রিসভায় ছিলেন একদা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে। তার পর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও ক্রমাগত নিজের লেখালেখির মধ্যে দিয়ে ব্যাপৃত ছিলেন বাম আদর্শ নিয়ে কথা বলায়। টেলিগ্রাফ বা আনন্দবাজারে সেই সব ক্ষুরধার লেখা আমরা পড়তাম। একই সঙ্গে কবিতার পাঠক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। নানা ধরনের পড়াশুনোর ভেতরে জীবন্ত ঝকঝকে এক মেধাকে লালন করতেন। প্রতি মুহূর্তে ভাবনাচিন্তার ভেতরে থাকতেন।

এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত পরিসরের কিছু কথা বলে ফেলা জরুরি। অশোক মিত্রের মা ছিলেন ঢাকার বিখ্যাত মালখাঁনগরের বসুঠাকুর বংশের কন্যা। আমার মাতামহী শোভারানি ঘোষও সেই একই বংশের মেয়ে। এবং দুজনের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল বোনের। অর্থাৎ অশোক মিত্রের মাসি হতেন আমার দিদিমা। সে অর্থে উনি আমার মামাস্থানীয় হতেন নিশ্চয় তবে আমার দিক থেকে কখনও এ পরিচয় দিয়ে আলাপ করার স্পর্ধা হয়নি যদি না উনিই আমাকে একবার নিজে থেকে ফোন করতেন, আমার কোন কবিতা পড়ে।

একদিন ফোন পাই, সেই বিখ্যাত কাঁপা কাঁপা অথচ দৃঢ় বাচন, শুনেই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।

“আমি অশোক মিত্র বলছি। আমি আপনার কবিতার ভক্ত। কিন্তু গদ্য লিখতে হবে যে, আমরা অন্য ধারার একটা কাগজ করছি, আরেক রকম। আমি চাইছি আপনি লিখুন।”

এবং ক্রমশ প্রকাশ করলেন, তিনি ভোলেননি আমার দিদিমা শোভারানি ঘোষ অর্থাৎ তাঁর বেবিমাসি! দক্ষিণপন্থী, ভারতীয় জনসংঘের একদা প্রেসিডেন্ট দেবপ্রসাদ ঘোষের ঘরণী শোভারানি ঘোষ।

সত্তরের দশকে শুনেছি আমার দিদা বলতেন, আমাগো ভ্যাদনের ছেলে তো এখন মন্ত্রী। সে আমার শৈশবকালে শোনা, দিদাদের অনেক আত্মীয়দের নামগুলিই ছিল এমন অদ্ভুত, মেথু ভানু ছুনি খান্তু ইত্যাদি। কথাটা মাথার কোনও কোণে গোঁজা ছিল। কিন্তু অশোক মিত্রের মুখে যখন এই পারিবারিক পরিচয় মান্যতা পায় তখন আশ্চর্য হয়ে যাই।

এই দেবপ্রসাদ এমনকি, জীবনানন্দ বুদ্ধদেব বসুকে ল্যাম্পুন বা ব্যঙ্গ করে কবিতার বইও লিখেছিলেন ত্রৈরাশিক, গণিত নহে, রসায়ন নামে। দেবপ্রসাদকে তাঁর দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের জন্য সব লেখায় প্রচণ্ডভাবে সমালোচনা করেছেন বামপন্থী অশোক মিত্র। কিন্তু ভোলেননি পারিবারির নৈকট্য, শোভামাসি বা বেবিমাসিকে। ক্ষুরধার বাচনে আঘাত করতে পারতেন নিজের যা পছন্দ নয় সেই সব ব্যবহার বা মতাদর্শকে, এই মেধার সঙ্গে নিজের যা কিছু তার প্রতি শ্রদ্ধা বা আমাদের মতো অকিঞ্চিৎকরদের প্রতি স্নেহ, দুটোই অদ্ভুত মেলবন্ধন বলে মনে হত আমার।

আরেক রকম পত্রিকায় বেরোনো স্মৃতিবিস্মৃতি নামের ধারাবাহিক লেখায়, “অথ কুলকলঙ্কগরিমা কথা” নামের অত্যন্ত স্বাদু, রসালো এবং ব্যঙ্গবঙ্কিমভাবে নিজের পারিবারিক ইতিহাসচর্চিত লেখায়, সে কথা তিনি উল্লেখ করেওছিলেন। কিছুটা তুলে দেবার লোভ সম্বরণ করা যাচ্ছে না। কেননা এখানে অশোক মিত্রের সেই অসামান্য গদ্যের স্বাদও কিছুটা পাওয়া যাবে।

বৃটিশ শাসনের প্রথম পর্বে কর্নওয়ালিস সাহেবের একটি বিশেষ চতুরালি ভারতবর্ষের পূর্বাংশে মুষ্টিমেয় বিদেশিদের আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে প্রভূত সাহায্য করেছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রমাদে উচ্চবর্ণীয় বাঙালি হিন্দুদের অন্তত দেড়শো বছর নিশ্চিন্ত আরামে কেটেছে। … পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জেলাতেই … বৈদ্য ও কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্তরাই জমিদারিত্বে জমিয়ে বসলেন। … উচ্চবর্গীয় হিন্দুরাই ইংরেজি ভাষায় তালিম নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গনে বিদেশি শাসকদের আদেশনির্দেশ পালনে আত্মনিয়োগের সুযোগ পেলেন। স্বাচ্ছল্য ও বিদেশি ভাষায় দীক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই নানা ধরনের প্রতিভার জন্ম দিল এসব পরিবারে… একটি উচ্চ কুলীন কায়স্থ বংশ ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুর পরগণার মালখাঁনগর গ্রামের বসুঠাকুর পরিবার। ঠাকুর লেজুড়টি কবে বংশপদবীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তা অবশ্য স্পষ্ট করে জানা যায়নি, তবে বংশ গরিমা জাহিরে এই পরিবারেরও কোনওদিন খামতি ছিল না। শাসন প্রজাপীড়ন পরিচিত অভ্যাসের মতো, পাশাপাশি বিদ্যাচর্চা, বিভিন্নপ্রকৃতির সংস্কৃতিচর্চাও। … খোদ বুদ্ধদেব বসু এই বংশজাত, এক সময় শিশুসাহিত্যিক সুনির্মল বসুও, এমনকি সম্প্রতি প্রয়াত ক্ষুধার্ত কবিদের মস্ত পৃষ্ঠপোষক-পরে ভদ্দরলোক বনে যাওয়া উৎপলকুমার বসু পর্যন্ত। দিলীপ কুমার রায়ের অনুশীলনে কণ্ঠনালীকে ক্ষইয়ে দেওয়া অকালপ্রয়াতা সঙ্গীতশিল্পী উমা বসু মালখাঁনগর তনয়া, একদা হিমাংশুকুমার দত্তের চামেলি পর্যায়ের গানগুলির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত সাবিত্রী ঘোষও একই বংশজাতা। …বংশগৌরব প্রচারকরা দাবি করেন নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁরাই পথ দেখিয়েছেন। গোটা বিক্রমপুর পরগণার প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট শোভারানি বসু তাঁদেরই বংশোদ্ভূতা। শোভারানি যাঁকে গ্রামে সবাই ‘বেবি’ বলেই জানত অচিরে পরিণয়বদ্ধ হন গণিতে গভীর পণ্ডিত দেবপ্রসাদ ঘোষের সঙ্গে। গণিত পেরিয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস পেরিয়ে বহুদূর বিস্তৃত। ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি সাহিত্যেও তাঁর গভীর জ্ঞান অথচ প্রচণ্ডরকম হিন্দু রক্ষণশীল, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসংঘ রাজনৈতিক দলটির প্রথম সভাপতি এই দেবপ্রসাদ ঘোষ। যিনি সবরকম আধুনিকতার বিরুদ্ধে, তদানীন্তন কালের বাংলা কবিতাচর্চাকে বিদ্রুপ করে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁর সাক্ষাৎ দৌহিত্রী যশোধরা রায়চৌধুরী যে-ধরনের কবিতা লিখে এখন আমাদের চমকে দিচ্ছেন তা যদি তাঁর বহুদিন প্রয়াত দাদামশায়ের চোখে পড়ত কী কুরুক্ষেত্রই না বেধে যেত।

এই অসম্ভব মেধাসম্পন্ন ভাষায় আক্রমণ, একমাত্র অশোক মিত্র মহাশয়ের পক্ষেই সম্ভব ছিল।

প্রথম ও শেষবার অশোক মিত্রের বাড়িতে যাই ২০১৫ নাগাদ। আলিপুরে। অনেকক্ষণ কথা বলি এবং পরিপাটি করে খাই লুচি তরকারি দার্জিলিং চা ও দারুণ সব মিষ্টি। আতিথ্যে ঢাকাইয়া বাঙালেরা চিরদিনই অনন্য, কে তা না জানে।

কেন গিয়েছিলাম? হয়ত আপাত দৃষ্টিতে আরেক রকমের সূত্রেই, কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল, আমার এই যাওয়া জরুরি, ওই পারিবারিক দায় থেকেই। কথায় বলে স্নেহ নিম্নগামী। এই ব্যক্তিটি আমাকে নানা সময়ে কী যে উৎসাহ দিয়েছেন কবিতা লেখায়। একটি বই পাঠিয়েছি, সেটি পড়ে ফোন করে উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলেছিলেন অনেক দিন আগে। তাছাড়াও নিজের লেখার ভেতরে কবিতার আলোচনায় আমাকে উল্লেখ করে লজ্জা দিয়েছেন।  তবে, তাঁর সম্পাদিত আরেক রকম পত্রিকাটি যখন থেকে বেরুতে শুরু করেছে, তখন থেকে আমার কাছে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই মানুষটির মূল্য অন্যরকম।

এটাই হয়ত ওঁর মতো মানুষের বৈশিষ্ট্য। শিকড়ের প্রতি মায়াবান ও যত্নশীল। আমার প্রণাম। নবতিপর ব্যক্তির মৃত্যুতে কোনওভাবে অসময় শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু এটা বামপন্থার খুব অসময় তো বটেই। মে ডে-তে এই দুঃসংবাদ পেয়ে মনে হল একটা অদ্ভুত সমাপতন। হারিয়ে ফেলা সময়ের এক মানুষকে প্রণাম। তাঁর অযাচিত স্নেহ পেয়েছি এ কথা যেন ভুলে না যাই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...