পিতৃসম

উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

আজ পয়লা মে, দুপুর নাগাদ আমার কাছে খবরটা এল। ইমানুলদা হোয়াটসঅ্যাপে জানালেন, অশোক মিত্র আর নেই। অপ্রত্যাশিত ছিল না খবরটা, বেশ কিছুদিন ধরে উনি অসুস্থও ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দুঃসংবাদ শোনার পর থেকে বিধ্বস্ত বোধ করছি। একটু আগে দাহ করিয়ে ফিরলাম, তবুও বিশ্বাস হচ্ছে না মানুষটি আর নেই। ওঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ভেসে উঠছে চোখের সামনে।

অশোক মিত্রের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ দু’হাজার বারো সালে। তার আগেও ওঁকে চিনতাম, ঠিক যেভাবে আর সাধারণ পাঁচজন বাঙালি ওঁকে চেনেন — বর্ষীয়ান চিন্তাবিদ, বামপন্থী, রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও বিখ্যাত লেখক-প্রাবন্ধিক হিসেবে। কিন্তু দু’হাজার বারোয় যখন আমাকে ফোন করেছিলেন, তিনি তখন পাক্ষিক ‘আরেক রকম’-এর সম্পাদক। অন্যান্য পত্রপত্রিকায় আমার সামান্য লেখালেখির সুবাদে আমার সম্বন্ধে জেনেছিলেন, তাই ফোন করে ‘আরেক রকম’-এ লেখার কথা বললেন। সেই শুরু। ‘আরেক রকম’-এ নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম, সান্নিধ্য পেলাম এমন এক প্রাজ্ঞ মানুষের যার পাণ্ডিত্যের সীমা-পরিসীমা নেই। নিয়মিত ফোনে কথা হত, শুধু লেখালেখির বিষয়েই নয়, দেখতাম সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা লঘু গুরু বিষয়ে কী অনায়াস গতায়াত ছিল তাঁর! মনে আছে, আমার কলার টিউনে সে সময় লতা মঙ্গেশকরের একটা পুরনো বাংলা গান ছিল, তিনি একদিন ফোন করে সেই গান শুনে তা নিয়েই প্রাণবন্ত আলোচনা শুরু করে দিলেন।

পরের বছর একদিন ফোন করে আমাকে ওঁর বাড়িতে ডেকে নিলেন। গেলাম। অনেকক্ষণ যাবৎ কথাবার্তা হল, আমাকে ‘আরেক রকম’-এর সম্পাদকমণ্ডলীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। পত্রিকায় যোগ দেওয়ার দিন থেকে আরও নিবিড় হল আমাদের মধ্যেকার অসমবয়সী কিন্তু ‘সেরিব্রাল’ এক বন্ধুত্ব। আরও কাছ থেকে উপলব্ধি করলাম তাঁর প্রজ্ঞা। রাজনীতি-সমাজনীতির কথা বাদই দিলাম, আধুনিক বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের হালহকিকৎ ছিল তাঁর নখদর্পণে, তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক জটিল বিষয় নিয়েও তাঁকে বিভিন্ন সময়ে সপ্রতিভ আলোচনা করতে দেখেছি। ওঁর বাড়ির ড্রয়িংরুমে জমে উঠত আমাদের আড্ডা। আমি, কুমার রানা, গৌরী চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্যরা মিলে চলত পত্রিকা নিয়ে আলোচনা।

শুধু আলোচনা নয়, বিভিন্ন সময় তেড়ে তর্কাতর্কি এমনকি ঝগড়াও করেছি স্যারের সঙ্গে। প্রধান সম্পাদক হিসেবে আমাদের প্রয়োজনীয় স্পেস দিতেন, আলোচনায় উঠে আসত বিরুদ্ধমতও। রসবোধও ছিল অসাধারণ। একবার কী একটা বিষয় নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা কাটাকাটি তুঙ্গে, হঠাৎ কথা থামিয়ে হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে আমাকে বললেন, ‘তুমি এখন আমার গলা টিপে ধরলেও আমি তোমার কথা মানব না!’ গুরুগম্ভীর পরিবেশ মুহূর্তে বদলে গেল হাসিঠাট্টায়।

প্রকৃত বামপন্থী আদর্শের প্রতি আজীবন কমিটেড দেখেছি এই মানুষটাকে। দল ভুল করলে সমালোচনা করতে ছাড়েননি, সিঙ্গুর কাণ্ডের সময় থেকেই স্পষ্ট করেছেন নিজের বিরোধী অবস্থান। একান্ত দুঃখ করেছেন, ‘ওরা তো আমার কথা শোনে না।’ তবে নির্বাচনে সিপিআই(এম) পরাজিত হওয়ার পর হাহাকার করেননি, চেয়েছিলেন দল শুদ্ধ হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক।

দু’হাজার চোদ্দ সালের শেষের দিকে পত্রিকাসংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে মতান্তরের জেরে আমি ‘আরেক রকম’ ছেড়ে বেরিয়ে আসি। উনি থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন অনেকবার, অবশ্য ফিরে যাবার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি সেই মুহূর্তে ছিল না। তারপরও ব্যক্তিগত যোগাযোগ অটুট ছিল ওঁর সঙ্গে। মাত্র একটাই দুর্বলতা ছিল অশোক মিত্রের, অবশ্য যদি সেটাকে দুর্বলতা বলা যায়। তিনি খুব সহজে অন্যের কথা বিশ্বাস করে ফেলতেন, আসলে কোনও মালিন্য, কোনও কপটতা ছিল না তাঁর মনে, আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ তাঁকে ব্যবহার করারও চেষ্টা করত।

গত ছয় বছর ধরে অসম্ভব স্নেহ পেয়েছি ওঁর কাছ থেকে। আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘আমি তো নিঃসন্তান, তুমি আমার পুত্রসম!’ আজ মনে হচ্ছে এমন মানুষের সান্নিধ্যে ফিরে যাবার ডাক প্রত্যাখ্যান করে বোধহয় অন্যায়ই করেছি। আজ পিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার শেষ সুযোগটাও পেরিয়ে গেল।

বৈদগ্ধে থাকবেন, বিপ্লবে থাকবেন, ভালোবাসায় থাকবেন, স্যার। আমার আনত প্রণাম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...