মৃদু মানুষের খনা দর্শন

আহমেদ খান হীরক

 

খনা
বটতলা নাট্যদল
রচনা: সামিনা লুৎফা নিত্রা
নির্দেশনা: মুহম্মদ আলী হায়দার
অভিনয়: সামিনা লুৎফা নিত্রা, মুহম্মদ আলী হায়দার, তৌফিক হাসান, ইমরান খান মুন্না, শারমিন ইতি, কাজী রোকসানা রুমা, খালিদ হাসান রুমী, জিয়াউল আবেদীন রাখাল, সেউতি শাহগুফতা প্রমুখ।

খনাকে চেনো নাকি?

মানে ওই বচনঅলা?

হ্যাঁ ওই যে, যদি বর্ষে মাঘের শেষ ধন্য রাজার পুণ্য দেশ!

হ্যাঁ এরকম বচন দুয়েকটা তো জানিই। দাদা-দাদির কাছ থেকে শুনেছি। নানুও বলত। আব্বাকে বলতে শুনেছিলাম কী কী যেন… এখন তো আর কাউকে বলতে শুনি না।

ও-ই! খনা! খনার বচন!

না, এখন তেমন তো শুনি না আর। তো, এই খনাটা কে?

২.

খনা কে, তা নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই আসলে আমাদের। থাকার তো কোনও কথা নেই। খনার সাথে আমাদের প্রয়োজনটা বড় ছোট হয়ে এসেছে। কৃষক-চাষা-ভুষাদের, খনার কিছু কার্যকরী প্রয়োজন ছিল আগে। কৃষকের ফসল ফলানো আগে যে খুব বেশি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। আর সেই প্রকৃতির কিছু টেনডেন্সির খবর পাই খনার বচনে। কখন বৃষ্টি হলে কী হয় তার ইঙ্গিত যেমন পাওয়া যায় খনার শ্লোকগুলোতে তেমনি মানুষের অবস্থানের তারতম্যের বর্ণনাও আসে তার ছন্দে।

খনা যখন বলে—

যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ

তখন আমরা বুঝি মাঘের শেষে বর্ষণ হওয়া বেশ ভালো একটা ঘটনা। এই ঘটনা ফসলের সাথে খুব জড়িত। বর্ষা মানে বৃষ্টি আর সময়মতো বৃষ্টি মানে বাম্পার ফলন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মানে এখন শুধু আকাশের বৃষ্টির ওপর তো ফসল নির্ভরশীল নয়। এখন বরং বিদ্যুৎহীনতায় ডিপটিউবওয়েল নষ্ট হয়ে যাওয়াটাই অধিক ঝামেলার কারণ। কৃষক এখন ঠিক আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ মেঘ দে পানি দে বলে কাতর হয় না, রেডিও শুনে জানতে চায় না কখন বৃষ্টিপাত হতে পারে, বরং তার চোখ থাকে সন্ধ্যার পর তার ফসলের মাঠের ডিপসেচের যন্ত্রে ‘কারেন্ট’ পৌঁছাচ্ছে কিনা! যদি না পৌঁছে তাহলে মাঘের শেষের বৃষ্টিও খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না তার ফসলের ওপর।

খনা যখন বলে—

থেকে গরু না বায় হাল
তার দুঃখ চিরকাল

আমরা একটু থমকাই। ভাবি, আহা সত্যবচন বটে। এমন চরিত্র তো এখনও আমাদের মধ্য বিরাজমান। কিন্তু এও সত্য যে এ ধরনের কথা বড় ক্লিশে হয়ে গেছে। নতুন কিছু তেমনভাবে বলছে না তো খনা। বাঙালির বসে আয়েশ করার চিরন্তন ‘গুণে’র খবরই শুধু প্রকাশ করে এখানে খনা। এর অধিক মূল্যমান আর কীইবা আছে উক্ত বচনের?

তাহলে কি খনা ফুরিয়ে গেছে?

এই মোবাইল অ্যাপের যুগে, উড়ে আসা হাজার হাজার তথ্যের ভিড়ে, খনার বচনের আর কী প্রয়োজন? কী প্রয়োজন এমনকি খনার?

আর যার প্রয়োজন দেখি না সময়ে ও সামাজিকতায় তখন তাকে নিয়ে আস্ত একটা নাটক রচিত হয়, তা আবার মঞ্চায়নও হয়, এবং কী অদ্ভুত ব্যাপার তার মঞ্চস্থের সংখ্যা হাফ সেঞ্চুরি হয়ে যায়… ঘটনাটা কী?

আমাদের মতো মৃদু দর্শকের মনে এরকম প্রশ্ন উদয় হয়। আমাদের খারাপ লাগে যে আর্ট আসলে উল্টো পায়েই হাঁটছে। ধীরে ধীরে মধ্যযুগের দিকে উল্টো ভৌতিক পা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমাদের খুব ‘ধুর’ বলতে ইচ্ছা করে — কিন্তু আমরা বলি না; বরং টিকিট কাটি। খনার ৫০ দেখার জন্য চুপিচুপি গিয়ে বসি মঞ্চের সারবদ্ধ চেয়ারগুলোতে। আমরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই না যে, ‘খনা দেখতে আসছি’। হলিউডি কোনও অ্যাভেঞ্জার দেখতে গেলে না হয় ফলাও করে জানানো যেত। সঙ্গীসাথীর নামটাম দিয়ে ফাটায়ে দেয়া যেত। কিন্তু খনা? না…

৩.

খনা দেখতে বসে দেখি বরাহকে। মিহিরকে দেখি। সেই সময়ের বাংলাকে দেখি। খনাকে আর দেখি না।

দেখি মিহিরের সাথে লীলাবতীর বিয়ে হয়ে গেছে। আর বিখ্যাত জ্যোতিষী বরাহের কাছে তারা ফিরে আসে। ফিরে আসে? কেন? কারণ মিহিরের ভাগ্য গণনা করে প্রখ্যাত বরাহ দেখেছিলেন বিপদের কথা। তাই নদীতে মিহিরকে তিনি ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মিহির ফিরে এসেছে বরাহের কাছে। সঙ্গে লীলাবতী। আর এসেই লীলাবতী প্রমাণ করে দিল শ্বশুর বরাহের গণনা ছিল ভুল। মিহির বিপদ নয়, বিপদেরও নয়। লীলাবতী জানাল শুভক্ষণে জন্মেছিল বলে তাকে সবাই খনা নামেও ডাকে। আমরা বুঝতে পারি যে লীলাবতীই আসলে খনা। কিন্তু লীলাবতীকে আর খনা বলতে ইচ্ছা করে না তখন। প্রচলিত খনাকে ছাপিয়ে লীলাবতী প্রকটতর হয়ে উঠেছে ততক্ষণে।

আর আমাদের মধ্যে পুরনো খনার কনসেপ্ট ভাঙতে থাকে। যেন এক মূর্তি ভেঙে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আর ভেঙে ভেঙে সেখানে লীলাবতীর বিগ্রহ স্থাপিত হচ্ছে।

৪.

বরাহ যেন প্রাচীন। মহীরুহই হয়তো। তাঁর পেছনে আছে খ্যাতির একটা লম্বা আচ্ছাদন। আছে অহংও। লীলাবতী যেন নবীন এক চারাগাছ। চকচকে দুটো পাতা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। আকাশের দিকেই তার গতি। আকাশ ছাড়িয়ে সেই গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে সে ধাবমান। লীলাবতীও তো গুণিন। তারও দৃষ্টি তাই আকাশের দিকেই থাকার কথা। কিন্তু অচিরেই লীলার দৃষ্টি পড়ে জমিনে। যেখানে তার শিকড় প্রোথিত। যেখানে জমিনে বিচরণ করে সাধারণ মানুষ, চাষাভুষা মানুষ, আর মৃদু মানুষেরা। লীলা তাদের সাথে মিশতে তাদের সাথে কথা বলতে তাদের কথা ভাবতেই যেন আগ্রহী হয়ে ওঠে। দূরের গ্রহ দূরেই থাকে, লীলা জনমানুষের হয়ে উঠতে থাকে।

অতি গম্ভীর বরাহ’র নিকট যা কোনও দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার নয়। বরাহ’র কাজে শ্রম আছে, বিশ্রাম নেই। আড়ম্বর আছে, আরাম নেই। শৃঙ্খলা আছে, স্বাধীনতা নেই। অন্যদিকে লীলাবতী যেন উড়ে চলা এক স্বাধীন বিহঙ্গ। প্রাসাদের দমবন্ধ করা জলদগম্ভীরতা থেকে তার অধিক পছন্দ গ্রামবাংলার মুক্ত জলহাওয়া।

তাই বরাহ আর লীলার দ্বন্দ্ব ছিল অবশ্যম্ভাবী। পিতা আর স্ত্রীর মধ্যে এক নিদারুণ টানাপোড়েনে দাঁড়িয়ে থাকে মিহির। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কি শুধু শৃঙ্খলা আর স্বাধীনতার?

আমরা ভাবি, লীলা যদি পুরুষ হত তাহলে এই দ্বন্দ্বের যবনিকা কি অন্যরকমভাবে হতে পারত?

লীলাবতী নারী। আর লীলাবতী নারী বলেই বরাহের অনেক বিষয়ে আপত্তি। যদিও লীলার সূত্র চুরি করে নিজের গ্রন্থে ব্যবহার করতে বরাহ’র কোনও আপত্তি থাকে না। কিন্তু তার সকল আপত্তি লীলাবতীর এই বেরিয়ে পড়া, ছুটে যাওয়া, উড়ে যাওয়া, আর শিকড়ের মধ্যে থাকার বিস্তারে।

লীলা জনপ্রিয়। বরাহ কি তার জন্যেও ঈর্ষাকাতর? এ ঈর্ষা বড় প্রাচীন। যুগে যুগে ঘটিয়ে এসেছে কত না বিপত্তি। পুত্রবধুর প্রতি বরাহ এই ঈর্ষা লালন করে। এই ঈর্ষা ছাপিয়ে যায় সম্পর্কের সমস্ত সীমানা। বরাহ, যে ছিল এক মহীরুহ, লীলাবতীর মতো এক কিশলয়ের কাছে ধীরে ধীরে বামন হতে থাকে। বরাহের লম্বা ছায়া লীলাবতীর দীর্ঘ ছায়ায় ঢেকে যেতে থাকে। তাই ইতিহাস সেদিকেই যেতে থাকে যেদিকে যাওয়ার কথা তার থাকে।

নারী লীলাবতীকে, জনমানুষের প্রিয় লীলাবতীকে, বরাহ’র প্রাচীন পুরুষ সত্তা কোনওভাবেই করায়াত্তে রাখতে পারে না। পারে না বলেই বরাহ লীলাবতীর জিভ চেয়ে বসে। লীলার জিভ — যে জিভ প্রথা মানতে চায় না, যে জিভ মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয় না, যে জিভ সত্য বলে ফেলে অনায়াসে।

ফলে খনা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে হঠাৎ করেই। এই কম্পিউটার আর তথ্যের ভিড়ে, খনা, একমাত্র খনাই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। যখন সত্য লুপ্ত গভীর কোনও জঙ্গলে, যখন মুখোশ আর মিথ্যার বিপুলে পৃথিবী নুয়ে আসে, তখন এসবের বাইরে শিকড়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে এক সত্যবাদী। লীলাবতী। খনা। দাঁড়িয়ে থাকে একা। আর তার দীর্ঘ শরীর মহীরুহ আর মেঘ ফেলে আকাশ ফুঁড়ে উঠে যায় মহাকাশের দিকে। সত্য এক নির্মোহ সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করে লীলাবতীর মাথায়। খনার ললাটে।

ফলে খনা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। যখন পহেলা বৈশাখে নারী লাঞ্ছিত হয়, যৌন হয়রানির শিকার হয় অথচ তার কোনও প্রতিকার হয় না, প্রতিকার চাইতে গিয়ে আবারও লাঞ্ছনার শিকার হয় যখন নারী, যখন ধর্ষিত হয় শিশু, যখন নারীকে বিশ্রীরকম উপমায় ভাসানো হয়, নারী যখন একমাত্র বিনোদন হয়ে ওঠে সমাজের, নারী যখন চা-খানা থেকে শুরু করে যে কোনও আড্ডার একমাত্র অশালীন বক্তব্য হয়ে ওঠে, যখন পুরুষ কেবল পুরুষ হয়েই থাকতে চায় — মানুষ হয়ে উঠতে পারে না যখন, যখন পুরো সমাজরাষ্ট্র বরাহ হয়ে যেতে চায় তখন তার বিপরীতে এক অদ্ভুত মহিমায় আর ব্যক্তিত্বে, খনা, একা, সমস্ত ঔজ্জ্বলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে তার গ্রীবায় সত্যের বিচ্ছুরণ আর চোখে অশ্রু নিয়ে। এই অশ্রু কেন? এই অশ্রু কি মিহিরদের জন্য? এই অশ্রু কি ভালোবাসা? আর করুণাও?

আমরা শিহরিত হই। এত আলো আমাদের চোখ সহ্য করতে পারে না। পুরুষ হিসেবে আমাদের অস্বস্তি হয়, আমরা বুঝতে পারি না আমাদের কী করা উচিত। মৃদু দর্শক হিসেবে আমাদের অস্বস্তিও হয়। আর লীলাবতী আমাদের আছড়ে ফেলে আমাদের সৃষ্ট পুংমহলের মিথ্যামহৎ ইমারত থেকে। আমরা কুঁকড়ে যাই। পুরুষ হিসেবে আমাদের কাছে খনা এক বিরোধী সুপ্রিম শক্তি নিয়ে ঝলমল করে ওঠে। কেন্নোর মতো আমরা গুটিয়ে যেতে যেতে পুরুষ থেকে ক্রমশ মানুষ হতে শুরু করি। আমরা বুঝতে পারি আমাদের ভেতরটা পাল্টে যাচ্ছে। আমরা পাল্টাতে পাল্টাতে মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকি। লীলাবতী আমাদের ভেতর তীব্র নদীর মতো বইতে থাকে, ধেয়ে যেতে থাকে, আমাদের দৃষ্টি ভাঙতে থাকে। আমরা মৃদুর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করি।

তখন খনায় ফেরত যাওয়া মানে মধ্যযুগে ফেরত যাওয়া আর মনে হয় না। মনে হয় উৎসে ফেরত গিয়েছি। মনে হয় ভষিষ্যতের দিকেই এই যাত্রা। ভবিষ্যত, যা সত্য ও সমতার হবে, এমন একটা স্বপ্ন আমরা লালন করি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...