আনন্দ বেদনার ব্যবচ্ছেদ

রোমেল রহমান

 

যাকে আজ কিনে আনা হয়েছে তার চেহারা সুন্দর। অর্থাৎ সুন্দর এবং সুস্থদের তাহলে পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। মানুষ সত্যিই মহান, প্রকল্পটা শুরু হয়েছিল বিকলাঙ্গ বা কদাকার দেখতে যারা তাদেরকে নিয়ে। কিন্তু যেটা হয় আর কি এবার আসলটা বেরিয়ে গেছে। আসলে অভাব এমন একটা জিনিস যা পরিমাণে বাড়িয়ে দিতে পারলে একটা সময় লাভ আসবেই।

গত সপ্তাহে দীর্ঘ সাফল্যজনিত ক্লান্তির শেষে ছেলেমেয়েরা পার্টি দিয়েছিল, সেখানে আনা হয়েছিল একটা উন্মাদকে কিনে। সরাসরি মফস্বলের রাস্তা থেকে গুম করে এনে দিয়েছিল এজেন্টরা। দাম অবশ্য কম নেয়নি বরং বলেছিল ‘একেবারেই জঘন্য জিনিস’, ফলে ছেলেমেয়েরা আনন্দ অনুভব করেছিল ভীষণ, হিংস্র আর ঘেন্নাকর এক আনন্দ, কেননা পাগলটাকে যখন বের করে আনা হল দেখা গেল এতটাই নোংরা যে, রাস্তায় পায়খানা করে করে না ধোয়ায় মল শুকিয়ে একেবারে চলটা পড়ে গেছে ওর পাছায় আর ত্বকে যেন ফাঁপা পলেস্তারার মতো ময়লার পরত, ফলে ছেলেমেয়েরা উত্তেজনা বোধ করল ভয়ানক, নোংরা ঘাটার উল্লাস। যৌনতার জন্য এখন আর কাউকে কিনে আনা হয় না, নগ্ন নৃত্যর বিক্রি নেমে গেছে, ওগুলো যখন সস্তায় পাওয়া যায় তখন আনন্দের জন্য নতুন কিছু চাই, গত প্রজন্মের যারা এই ছেলেমেয়েদের বড় ভাইবোন তারাও কিছুটা যৌনতায় পিপাসিত ছিল কিন্তু এদের কাছে ওসবের থেকে আরও নতুন কিছুর স্বাদ গুরুত্বপূর্ণ, তাই হয়তো কিনে আনা নগ্ন পাগলটাকে যখন ছেড়ে দেয়া হল ওদের সামনে, চিবুক বেয়ে নেমে আসা কষ আর একটু পর পর কেঁপে ওঠা পাগলটার উপর ঠিক যেন পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেমেয়েদের কয়েকজন এবং তারা পাগলের শরীরের নোংরা চাটতে লাগল শুঁকতে লাগল তার ঘ্রাণ। ফলে আমাদের বমি পেলেও তারা কিন্তু মাদকতা পাচ্ছিল, কিন্তু আচমকা এরকম জাপটাজাপটি কিংবা এরকম চাটাচাটিতে পাগলও আঁতকে উঠে চিৎকার দিতে দিতে হাতপা ছুঁড়তে লাগল আর সেই বিকট বিকৃত চিৎকার শুনে ছেলেমেয়েদের অন্যরা উল্লাস করতে লাগল আর ঠিক তখনই পাগলটার সর্বোচ্চ শক্তিতে ছুঁড়ে দেয়া লাথিটা লাগল এই ধনকুবের প্রজন্মের এক মোমের পুতুল টাইপ মেয়ের টসটসে পাছায়, এবং অতিরিক্ত গতির ফলে মেয়েটা ছিটকে গিয়ে পড়ল তার মতো নরম সোফায়, ফলে অন্যরা আতঙ্কিত হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের একজন বেসবল খেলার মুগুর দিয়ে এক পিটানে পাগলের একটা পা ভেঙে দিতেই সবাই উল্লাসে চিৎকার করতে লাগল আর তখনই তারা আবিষ্কার করল যে, এক পা ভেঙে দিলে পাগল দেখতে অন্যরকম হয়ে যায়, ফলে যন্ত্রণায় যখন পাগলও চিৎকার করছিল তখন একজন বলল, ওর জিহ্বা কেটে দিলে কিন্তু চিৎকারের স্বর পাল্টে যাবে, অন্য কিছু একটা ঘটবে, চরম ফান হবে; তখন তারা এগিয়ে গেল, আর জিহ্বা হাতে ধরতে না পারায় একজন বলল, একটা সাঁড়াশি নিয়াস তো…!

ফলে সেইদিনের অভিজ্ঞতা তারা শেয়ার করেছে তাদের সোসাইটির অন্য বন্ধুদের সঙ্গে এবং সেই গ্রুপ আরও বেশি মজা করার জন্য একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা কিনে এনেছিল অন্ত্যজ পাড়া থেকে, এবং প্রেমিকের সামনে প্রেমিকাকে বা প্রেমিকার সামনে প্রেমিককে থেঁতলে দেয়া হয় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, ফলে তারা বিস্ময় নিয়ে দেখে মানুষের জন্য মানুষের ক্রন্দন। চারদিকে আনন্দে শুধু হাততালি পড়ছিল আর একটা চকলেটের মতো ছেলে বলল, জীবনে এই প্রথম সে কান্না দেখল, ফলে সবাই তার জন্য আবার চিৎকার দিয়ে উঠল, ফলে মৃতপ্রায় প্রেমিক বা প্রেমিকার সামনে এবার যখন তার প্রেমিক বা প্রেমিকার পাঁজরের হাড় কার্টার দিয়ে কট্‌ কট্‌ করে কাটা হচ্ছিল হৃদপিণ্ড খুবলে এনে দেখার জন্য, তখন ছেলেমেয়েরা দেখল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচাতে কাতরাচ্ছে বেঁধে রাখা আহত প্রেমিক বা প্রেমিকাটি আর গোঙাচ্ছে, ফলে তারা এর মূল অনুভূতিটি উপলব্ধি করতে পারে না, কেননা শারীরিক যন্ত্রণায় মানুষ কাঁদতে পারে তা বলে অন্য কী এমন যন্ত্রণা থাকতে পারে যার জন্য একজন মানুষ অন্যজনের জন্য কাঁদে, এটা কি অনর্থক নয়? সেদিনের সেই ঘটনার পর একটা মহল চিন্তিত হয়ে গেছে কান্নার কারণ বিষয়ক অনুভূতি উপলন্ধির জন্য কিন্তু কেউ খুঁজেই পাচ্ছে না যে তারা কী করে সেটার স্বাদ পাবে।

ফসল ফলছিল ভালোই, শহর থেকে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা এসে অতিরিক্ত ফসল ফলনের ছবি তুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু কৃষক বা উৎপাদকেরা যে শেষমেশ দাম পায়নি এটা কেউ তুলতে আসেনি, ফলে যারা ফসল ক্ষেত থেকে কিংবা হাট থেকে কিনে নিয়ে শহরের পাইকারদের কাছে বিক্রি করে তারা বলেছিল, ‘…বেচলে বেচো নাইলে না খায়া মরো’, কিংবা খরায় ফসল ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কৃষকদের মাথায় অনাহারী দিন নেমে এল, নেমে এল দাদনের টাকার বোঝা। ফলে এক সময় বীজের দাম সারের দাম কিংবা সংসার চালাতে না পারায় কৃষকেরা জমি বেচে দিয়ে বর্গা করতে লাগল আর কবছরের মধ্যে সে কাজ ফেলে তাদেরকে কারখানায় চাকরি নিতে হয়েছে, আর সংসার চালানোর খরচ যোগাড় করতে না পেরে যারা আম জাম গাছে ঝুলে পড়তে পারেনি তাদের কাছে একটা নতুন প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল একদল লোকেরা, তারা বলেছিল… সাহেবরা নতুন আনন্দর লাইন খুলেছে যেখানে তারা মানুষ কিনে নেয়। অভুক্তরা বলল, বেশ্যাগিরি? তারা বলল, ‘…ব্যবহৃত মাল তারা ফেরত দেন না, ডাস্টবিনে ফেলে দেন!’ ফলে গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা বুঝতে পারল না মানুষ কী করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া যায়। শুধু তারা জানতে পারে যে, যাকে বিক্রি করে দেয়া হবে সে আর ফিরবে না। ফলে ক্ষুধার মুখোমুখি এক মা যখন অন্য সন্তানদের খাবার দিতে না পারার জন্য সবাইকে নিয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল ঠিক একই সময়ে অন্য মা বাকি সন্তানদের বাঁচানোর জন্য তার প্রতিবন্ধী বাচ্চাটাকে বিক্রি করে দিল প্রথম। আর তারপর দেখতে ভালো না বা একটু শারীরিক সমস্যা আছে এমনদের সংখ্যা কমে আসতে লাগল। শহরে এখন পয়সাওয়ালার সংখ্যা কত তা কারও জানা নেই, ফলে নগরকাঠামোর বদল এসেছে, মূল শহরে একজনও নিম্নবিত্ত নেই, এক ফোঁটা উদোম মাঠ নেই, নদী দেখলে মনে হয় শানবাঁধানো লেক, আর মূল নগরের বাইরে যারা তারা মূলত এই নগরের পরিষ্কারকর্মী, আর তারপর বসবাস করে শ্রমিকেরা, কিন্তু সেখানে যাওয়া যায় না, কেননা এই নগরের রূপের রহস্য তাহলে ফাঁস হয়ে যায়, সেখানকার কারখানাগুলোর মধ্যে মনে হয় যেন, ক্রীতদাসের খোঁয়াড়, ফলে গ্রামগুলোতে এখন এজেন্টরা আসে মানুষ কিনতে।

আজ যাকে আনা হয়েছে সে শারীরিকভাবে পুরো স্বাভাবিক, একজন বলল, ‘ও দেখতে তো আমাদের মতোই সুন্দর’, কয়েকজন বলল, ‘আসো শুঁকে দেখি ওর গন্ধ কেমন!’ সকলেই তার সমস্ত শরীর শুঁকে দেখতে লাগল আর উদ্দীপ্ত বোধ করতে লাগল, তবে সবাই সতর্ক ছিল কেননা এরা ঘেন্নাকর মানুষ এদের দিয়ে বিশ্বাস নেই যদি লাথি দিয়ে বসে, তখন একজন বলল, ‘আসো সেক্স করি, ওকে সবাই মিলে ধরি!’ অন্য কেউ বলল, ‘বাদ দাও ওটার দরকার নেই, যদি কোনও অসুখ হয়ে যায়, এরা তো মানুষ নামক জানোয়ার’, কে যেন বলল, ‘সেটাই তো মজার!’ অন্য কে যেন বলল, ‘উঁহু! আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে’, তখন সে বলল, ‘দেখো ওর গায়ের চামড়া ভীষণ সুন্দর, আমরা সবাই মিলে ওর চামড়া ছুলে ফেলতে পারি!’ সকলেই হইহই করে উঠল আর প্রস্তাব পাশ হয়ে গেল, একজন বলল, ‘এটা কেউ আগে করেনি, এই আনন্দ আমরাই প্রথম করব!’ তখন অন্য কেউ বলে, ‘ওর চামড়া এমনভাবে ছিলতে হবে যেন একটা কোটের মতো গায়ে দেয়া যায়, তাহলে আমরা ওর রক্তমাখা চামড়া গায়ে দিয়ে অন্যদের দেখিয়ে জানাতে পারব আনন্দ আবিষ্কারে আমরা কতটা তীব্র এগিয়ে।’ সবাই সম্মত হল, অথচ তার চোখ নির্বিকার। তখন চামড়া ছিলে ফেলার প্রস্তাব যে করেছিল সে তার কানের নিচে চুলকায়, এবং আচানক সে খেয়াল করে তার আঙুল রক্তে ভিজে উঠছে, এবং সকলেই তখন চিৎকার শুরু করে কেননা তারা দেখে রক্ত তার শরীর চিরে চিরে চুইয়ে পড়ছে, আতঙ্ক সকলের মধ্যে তখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ওদের অন্য একজন তার আঙুলগুলোতে খেয়াল করে দানাদানা বিচি উঠছে আর মুহূর্তমধ্যে সেই বিচি ফেটে আঠালো কষ ঝরতে থাকে, এবং তারপর রক্ত; অন্যরা আতঙ্কে চেতনা হারিয়ে ফেলে আর বলে, নির্ঘাত ওটা একটা আস্ত পিশাচ, রক্ত খেতে এসেছে… এরা ভয়ানক রক্তপিপাসু! আতঙ্ক চিৎকার আর ক্রন্দনের বিপন্ন সুর শুনতে পেয়েও বাইরে থাকা সিকিউরিটি গার্ডরা ভেতরে খোঁজ নিতে আসে না, তারা জানে ভেতরে তীব্র হিংস্র আনন্দ চলছে, এ তারই শীৎকার!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...