রোদজলের আখরগুলো

মধুময় পাল

 

১.

আমাদের স্টেশন কবে থেকে যেন মুছে মুছে অন্যরকম হয়ে গেল।

হয়তো ব্যস্ত ছিলাম আমরা শিককাবাবের মতো গরম ও মশলাদার স্লোগান শূন্যে ও দেওয়ালে দেওয়ালে ছুঁড়ে দিতে। যা আসলে পলিটিকাল। হয়তো ব্যস্ত ছিলাম টাটকা বিদেশি ভাবনাটাবনার চুইংগামে চোয়ালের খেলায়। যা আসলে অন্যরকম পলিটিকাল। হয়তো কেন। বটেই তো।

সাহেবসুবোদের তৈরি করা ওয়েটিংরুমটা মুছে গেল কবে। প্ল্যাটফর্মের ধারে আকাশজোড়া জলাভূমি আর পাখপাখালির ছবির গায়ে ছিল প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের হলুদরঙা প্রতীক্ষালয়। অপোগণ্ড সাহেবসুবোদের ফূর্তিফার্তার নমুনা। ঘরের দরজায় কাঠচাঁপা ছিল। গাছটার গুঁড়ি বাদে বাকিটা উধাও। খড়খড়ি জানালাগুলো উড়ে গেল। পশ্চিমের প্ল্যাটফর্মে পলাশও নেই হয়ে গিয়েছে। লোহাঘষা কাগজের মতো ট্রেন এখন খসখস কর্কশ। ছায়া নেই বলে মেঘও আসে না। ওভারব্রিজের মাথায় নীলসাদা মেঘের খেলায় ঢুকে পড়ে না বিকেলের রোদ। যদিওবা ঢোকে, জাগতিক নিয়মে, এখান থেকে দেখা যায় না সেই প্রণয়ের কাল। উড়ে আসে না বক আর। দূরটান লম্বা ঝিলটাই যেন কাহাদের পকেটে সমাধিস্থ হয়েছে।

তবু, সবই বুঝে জেনে, স্টেশনে আসি। রাতের পেটে মাঝরাত ঘুমোতে গেলে। শেষরাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে নামফলকে হেলান দিয়ে। ঘোষণা হয়, এক নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে। যাত্রীরা নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। এ ঘোষণা ব্যবহৃত হতে হতে লোকাল ট্রেনের ভিক্ষের গানের মতো ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে গিয়েছে। ট্রেন আসে। নিজের নিয়মে দাঁড়ায়। ভীষণ লাজুকের মতো। পুরনো দিনের প্রেমের মতো। এখনকার প্রেমে হাতধরাধরিতেই ঘটাংঘটাং শব্দ হয়। নেমে এল রেডিও, ঠোঁটে আঙুল রেখে ভাবুক শিশু। কোনও রাতে শচীনকর্তা বা গীতা দত্ত। এক রাতে নেমেছিল জবাকুসুমের গন্ধ। বড়দিনের রাতে গির্জার ঘণ্টা। মাম্পি যে নোনা দিয়েছিল লুকিয়ে, সেটাও এল। মিনুদের বাড়ির গায়ে ঝিমধরা দুপুরের পুকুর এল এক রাতে। কৃষ্ণনগরের কোমরদোলানো পুতুল। জালছেঁড়া পকেটের আশেপাশে ক্যারমের লাল ঘুঁটি এখনও ঘুরঘুর করে। ভিস্তিওলা খুলে দেয় ভোরের আলোর মুখ। তখন অন্ধকার শেষরাতের পায়ে হেঁটে ট্রেনের কাছে আসে। আমি দেখি, আজও আসেনি সেই মাটি, যা ফুলে ফুলে ভরে যাবে, দুটি ফল চেয়ে থাকবে আমার দিকে, ঈশ্বরীয় নিজস্ব সম্পদের মতো, শস্যের ডাকে আমার শরীর ভরে যাবে। শস্য তো সভ্যতার বীজ। আসবেই। অপেক্ষা করি। ট্রেন চলে যাবার আগে কুমিরডাঙা খেলি। ছুঁতে পারে না, ছুঁ তে  পা রে না। শেষরাতের আকাশ জুড়ে খেলা, ছুঁতে পারে না।

২.

ইন্দ্রর কথা বলি।

বছর কুড়ি আগে। কলেজ স্কোয়ারের পুবে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের পেছনে অল্পবিস্তর নির্জনতা ছিল। দু-চারটে পাখি থাকত, সংসার করত, ডাকত কারণে অকারণে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন, তাদের পূর্বাপর অপদার্থতার প্রমাণস্বরূপ কোটি কোটি হকারের চাপে সেই পথের বাতাস দমবন্ধপ্রায় এখন। কুড়ি বছর আগে এইখানে পথের বাঁকে হঠাৎ উঠে এসেছিল ইন্দ্র। তখন দুপুর। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। ইন্দ্রর মাথায় বেতের হাতলের ঢাউস ছাতা। আমি ওকে দেখি। তেমনই বড্ড রোগা। ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবি ওর শরীরের প্রেমহীন হাড়গোড়ের কান্না লুকোতে পারে না।

আমিই ডেকেছিলাম, ইন্দ্র!

বেতের হাতলের ঢাউস ছাতাসুদ্ধ ওর পাজামা পাঞ্জাবি কেঁপে উঠেছিল। ভাঙা গালের মেকআপ বা গ্যাটিস হিসেবে ঝোলানো দাড়ি আর উদাসী হাওয়ার প্রেমিকের মতো চুলও কম্পনে নড়েছিল।

ও কি ভয় পেয়েছে আমাকে দেখে? জেল-ফেরত আমাকে দেখে? জেল-ফেরত জীবিত আমাকে দেখে? স্বপ্নের কৃষকদের খুন হয়ে যাওয়া যে-সময়ের নিয়তি, তখন আমাকে বেঁচে থাকতে দেখে ও ঘাবড়ে যেতেই পারে। হয়তো শুনেছে কিছু আমার ও আমাদের কথা। নিহত পাখির ছিন্ন পালকের মতো আতঙ্ক ওড়ে বাতাসে।

ইন্দ্র মানে বিজয়েন্দ্র। কবি হবে বলে ‘বিজয়’ খসিয়ে ফেলেছে।

জিজ্ঞেস করি, এখানে?

ও বলে, একটা কাজ আছে।

আমি বলি, নদী কেমন আছে?

ইন্দ্র আমার দিকে অ-কপট চোখে তাকিয়ে বলল, নদী! তুমি সেই নদীর কথা বলছ? এতদিন পর দেখা। এত দূরত্বের পর দেখা। এত নীরবতার পর দেখা। তুমি জিজ্ঞেস করলে কিনা নদীর কথা! তুমি তো প্রকৃত কবি হে!

আমি আবার বলি, নদী কেমন আছে?

ইন্দ্র টেনে টেনে কথা বলে। শেষ শব্দটা ভাসিয়ে দেয়। এখন যেন আরও বেশি। ও কি প্র্যাকটিস করে এই বিলম্বিত আলুলায়িত বলা? রাস্তায় যদি একপাল নেড়ির মধ্যে পড়ে বা ষাঁড়ের দাপাদাপির মধ্যে বা জাঙ্গিয়ায় ঢুকে যায় বিছে, তখনও কি এভাবে বলবে? আমার জানতে ইচ্ছে করে।

আমি বলি, তুমি আমাকে নদীর কাছে নিয়ে গেলে। বাঁধের ওপর বসলাম। দুপুরের উঠোন থেকে লেবুর আচার নিয়ে গিয়েছিলাম। শরীরকামনার স্বাদগন্ধময় তীব্র আচার। আমরা কোনও নারীর কথা ভেবেছিলাম। আমরা কোনও নারীকে দেখেছিলাম। দুপুর নেমে গেল জলে। দুটো ডিঙি মাছ ধরছিল। নিরামিষ সবুজে তারা বিকেল হয়ে গেল।

ইন্দ্র আবার সেই চোখ মেলে তাকায়। বলে, তুমি কি লেখো? জেলে থাকার সময় কি লিখতে? অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। জমে আছে। অনেক কথা। পুঁথি খুলে বসব দুজনে। বেলা অবেলার পুঁথি। আমার একটা গ্রন্থ দেব তোমাকে। তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো। এই ছাতা আর থলে তোমার কাছে রইল। আমি যাব আর আসব। ওরা আমাকে কেন ডাকল জানি না। আমি তো প্রতিষ্ঠান মানি না। জনপ্রিয় লেখা লিখি না। আমার মতো পদ্য লিখি। গদ্য লিখতে পারি না। তবু কেন ডাকে? দেখা করে আসি। যাব আর আসব।

ইন্দ্র থলে থেকে একটা ফাইল বের করে সঙ্গে নেয়। একটা বাড়ির দিকে গেল। বাড়িটা অনেকেরই জানা।

এবং আসে না। আসে না। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। সে আসে না। আমার কাছে ছাতা ও থলে। ফেলে যেতে পারি না। সে আসে না। বৃষ্টি আর নেই। আমি কেমন একটা জেদে পড়ে দু ঘণ্টারও বেশি দাঁড়িয়ে থাকি। বারবার সেই বাড়িটার দিকে তাকাই। যে বাড়িতে ইন্দ্র ঢুকেছে। যে বাড়িতে এক বিশাল দরোয়ান আছে। সেই দরোয়ানকে নাকি বুদ্ধিজীবীরা যুগে যুগে খাতির করে।

এরপর ফুটপাথ বদলে দাঁড়াই। বাড়ির দিকে নজর রাখি। এবার সে বেরোয়। দ্রুতপায়ে আসে সেই জায়গায়। দু-একবার এদিকওদিক দেখে। আমি ডাকি না। পাজামা-পাঞ্জাবি লতপতিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল সে।

কুড়ি বছর পর, এখন, ইন্দ্র আরও আলুলায়িত বাচনে নিজেকে বিশিষ্ট করেছে। চুল দাড়ি আরও বড় হয়েছে। পাকিয়েছে সুন্দর করে।

ইন্দ্রর বেতের হাতলওলা ঢাউস ছাতা আর কাপড়ের থলেটা আছে আমার কাছে। গ্রন্থ ভেবে যত্নে রেখেছি।

৩.

একটা কুলগাছ ছিল এই স্টেশনে। আপ প্ল্যাটফর্মের মাথায়। গরিব ছেলেদের সঙ্গে গরিব ফলের ভালোবাসা ছিল দেখবার মতো। জীবনতারা হালদার বলতেন। সামাজিক গাছ ফলেছিল সামাজিক নিয়মে। আমগাছ লাগিয়েছিল এক ফেরিওলা। রেজাউল করিম চিনতেন। বলেছিলেন, ওর নাম রহমত। জিয়াগঞ্জে বাড়ি। তোমাদের পাড়ায় পাড়ায় অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি বাটি থালা বেচে ঘুরে ঘুরে। বিকেলের ওভারব্রিজে বসে সুধীরলাল-ধনঞ্জয়ের গান গাইতেন বঙ্কিম পাত্র। সুরে ঢালা একটা হারমোনিয়াম সম্বল। প্রফুল্ল কলোনির বাসিন্দা। বড় মেয়ে দাঙ্গায় হারিয়েছে। ঘরে রুগ্‌ণ স্ত্রী। তবু কি সুন্দর গাইতেন। প্রিয়নাথ সেন বলেছিলেন, দুঃখ থেকেই তো শিল্পের প্রতিদিন নবজন্ম হয়। একটা অমলতাস ছিল ডাউন প্ল্যাটফর্মে। বোধহয় সাহেবদের লাগানো। নিবারণ চক্রবর্তী বলেছিলেন। যুদ্ধে বা বন্যায় প্ল্যাটফর্ম আপে ও ডাউনে মাইল মাইল লম্বা হয়ে যেত। যদুনাথ সরকার বলতেন। একবার কুন্তীর মরাখাতে ঠেলা মারে দামোদর। বিপদে পড়লেই ডিভিসি জল ছাড়ে তো। আর এদিকে, বিপদের জলে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। পলিথিনের সংখ্যাহীন তাঁবু প্ল্যাটফর্মকে দু মুখে টেনে পেরিয়ে যায় সিগনালের পর সিগনাল। একবার যুদ্ধ বাধল পাশের দেশে। প্ল্যাটফর্ম জনস্রোতে গেল ভেসে। সারাদিন চেঁচামেচি, খিদের কান্না, দুপুরে কার বউ চলে গেল রোদমাথায়, রাতে কোন ছাউনিতে মারা গেল শিশু। সুধাময়ীর কথা বলছিলেন রণবালা। এখন যেখানে যাত্রী প্রতীক্ষালয় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ে আছে, সেখানে বসে থাকতেন একটার পর একটা ট্রেন। কেউ আসে না। কোনওদিন আসে না। কে আসবে সুধাময়ীও জানেন না। তাঁর নাকি মাথার গোলমাল ছিল। শেষ ট্রেন আসার আগে ধীরপায়ে হেঁটে চলে যেতেন। শেষ ট্রেন নাকি বড় দুঃখের হয়। প্ল্যাটফর্মে একটা ঘড়ি ছিল। ঢাউস। দূর থেকে দেখা যেত কাঁটা নড়ছে টিকটিক। ঘড়িটা সত্তরের ঝড়ে উড়ে গিয়েছে। রাধানাম শিকদার বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, ওই তো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এখন আটটা বেজে দশ। যে ঘড়ির স্বপ্ন থাকে, তার ভুল নেই, ধ্বংস নেই। চিন্তাহরণ চক্রবর্তী বলতেন, শেষ ট্রেন চলে গেলে ভোরের প্রথম ট্রেন আসার আগে ঘুরতে যায় প্ল্যাটফর্ম। তাকে তখন পাবে তুমি হাতিঘিষা বা শীতলকুচি বা জামবনিতে। খোলা বাতাসে ঘুরে আসে একা একা। জীবনতারা হালদার-রেজাউল করিম-যদুনাথ সরকাররা আর নেই অনেককাল। লোকে বলে, ওঁরা নাকি মাঝে মাঝে আসেন। প্ল্যাটফর্মের কোথাও বসে গল্পগুজব করেন। ভালোবাসা যে জড়িয়ে রাখে বহু কিছু ফুরিয়ে যাবার পরও। সত্যি তাঁরা আসেন কিনা দেখতে গিয়ে আমি অবাক। একটা বাংলা বই প্ল্যাটফর্মের এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়াচ্ছে একা। কেউ তাকে ডাকে না। কেউ তাকিয়েও দেখে না। কথা বলা তো দূরের কথা। সে একা হেঁটে বেড়ায়। বাংলা ভাষা।

৪.

দোকানটা শিবচরণ ধাড়ির নামে। প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। ওই যেমন নকুড়ের, গাঙ্গুরামের, ভীমনাগের তেমনই ধাড়ির। এখন যেখানে কাউন্সিলরের বাড়ি পাঁচতলা হচ্ছে সেখানে ছোটমতন পুকুর ছিল। ছোট হলেও বড় আদরের। পুবদিকের ভোরের শিরিষগাছে পাখিরা ডাকত কলকলিয়ে। যেন ওরা জলপাখি। প্রথম আলোয় ওদের গলা জলে ভরে যায়। দুপুরে পাখিদের নিরিবিলি স্নান। বর্ষায় বক আসত মেঘে মেঘে গা ধুয়ে। কলমির গন্ধে ভরে যেত বাতাস। বর্ষা ও বসন্তে বাতাসের রং আলাদা হয়, জানত ডাহুক আর আমের বোল। রেডিওয় আকাশবাণী কলকাতা বাজিয়ে শিবচরণ এই পুকুরে স্নান করতেন বলে জনশ্রুতি আছে। পুকুরের পাশেই শিবের বেদি। একটা কালো পাথর ও একহাতি রোগাসোগা ত্রিশূল। শিবচরণ ও শিববেদির মধ্যে একটা সম্পর্কের কথা কয়েক বছর আগেও কেউ কেউ বলতেন। এখন সে-সব বলতে নেই। বলতে হয় কাউন্সিলরের শিবতলা। সিরিয়ালের মান্টি বান্টি ঝুনুমুনু টুনুপুনুদের এনে শিবরাত্রি গরম করে কে? গরিব মানুষ এক সপ্তাহ ফূর্তিতে থাকে কার দয়ায়? বারোভূতের মেলা বসাতে সরকারি গ্রান্ট বের করছে কে?

তো, শিবচরণ ধাড়ির দোচালা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার পাকা হয়, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বড় হয় তাঁর পৌত্র মহেশ্বর ধাড়ির আমলে। খুঁজে খুঁজে নানা জায়গা থেকে ওস্তাদ কারিগর এনে মিষ্টান্নের উৎসব লাগিয়ে দিলেন তিনি। হেরে গেল বাকিরা। মোদকের মালপো, শীলের সরভাজা, সাবুইয়ের জলভরা, মৃত্যুঞ্জয়ের লর্ড চমচম, সনাতনের দরবেশ সব হেরে ভুট্টা। মহেশ্বর ধাড়ি একটা বিশেষ মিষ্টদ্রব্য উদ্ভাবন করলেন। অমৃতকলস। খাঁটি ছানার অতিউপাদেয় সন্দেশ, নানাবিধ উপকরণে রচিত। পোড়ামাটির তিন ইঞ্চি লম্বা কলসে ভরে দেওয়া হত। কলসের গায়ে আঁকা দুটি চোখ। যেন অন্নপূর্ণা। কী স্বাদ! বেঁচে থাকার সাধ বেড়ে যায়। কলসগুলোর গড়নও ছিল ভারি সুন্দর। যেন মুকুটখোলা নারীমুখ। এই অমৃতকলসের টানে দূরান্তের রসিকজনেরা সাইকেল, বাইক, চারচাকা নিয়ে হাজির হতেন। বাসে তো আসতেনই। লেখক আসতেন, কবি আসতেন, শিল্পী আসতেন, গায়ক আসতেন, আরও আরও গুণীজন আসতেন। মহেশ্বর বেছে বেছে ছবি তুলে রাখতেন ক্রেতাদের। আসল সেলেব্রিটি চেনো কীসে/শ্মশান যার পায় না দিশে। মহেশ্বরের পছন্দে সিনেমা আর রাজনীতির লোকজন ছিল না। সে বাপু মেলার চেয়ে অমিল বেশি/হাস্যমুখে রেষারেষি। ক্রমে অমৃতকলস ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে ও শহরে। আগাম অর্ডার না দিলে পাওয়া কঠিন। শুধু অমৃতকলস কেন, অন্যান্য মিষ্টান্ন কম যায় কীসে! শিবচরণ ধাড়ি নামটির খ্যাতি বিস্তৃত হয়। ওই যেমন নকুড়, ভীমনাগ, গাঙ্গুরাম। দোকানে চিত্রকর আসেন, ভাস্কর আসেন, কবি আসেন, লেখক আসেন, গায়ক আসেন। তাঁরা আড্ডা দেন। মহেশ্বর ছবি তোলেন আর ছবি তোলেন।

মহেশ্বরের ইচ্ছে ছিল, শিবচরণ ধাড়ি ছড়িয়ে পড়বে দিকে দিকে। যাকে বলে শাখাপ্রশাখা। কাছের শহরে, দূরের শহরে। স্ত্রীর ইচ্ছাক্রমে পুত্রকে দায়িত্ব দেন। পুত্রের নাম ছিল অক্ষয়। স্কুল থেকে কলেজে যাওয়ার পথে একদিন হয়ে গেল আক্ষরিক। আক্ষরিক ধাড়ি। মহেশ্বর তো অবাক। আক্ষরিক আবার নাম হয় নাকি? স্ত্রী বলে, হয়, হয়। খুব হয়। আধুনিক নামের আবছা মানে হয়। আবছা হলে মান বাড়ে। তাছাড়া ছেলেপুলেদের শখসাধ একটু মানতে হয়, বাপু! তোমার নামটা তো আমার মোটে পছন্দ নয়। মেজদি ঠাট্টা করে বলত, মহেশ। ষাঁড়ের নাম।

এখানে বলা দরকার, আক্ষরিক ধাড়ি নামটিতে সাব অল্টার্ন জ্ঞানীরা প্রভূত সামাজিক বিবর্তনের উপাদান পান।

ইতিমধ্যে কাউন্সিলরদের যুগ এসে গিয়েছে। মহেশ্বরকে কারণে অকারণে তোলা দিতে হয়। বিবাদে যেতে হয়। চিত্রকর লেখক কবিদের আসা কমছে। সুগারকে কে না ভয় পায়? পুত্র প্রায়ই বলে, এই ব্যবসা চালানো মুশকিল। কারিগর নেই। যা আছে ফালতু। মজুরি চায় বিরাট। একনম্বর মেটেরিয়াল নেই। লাভ কমছে। চাহিদা কমছে। এখন ভুজিয়ার যুগ। অমৃতকলস খাওয়ার মন মরে গেছে। কিছু সেকেলে মানুষের ভরসায় তো ব্যবসা চলে না।

মহেশ্বর বুঝলেন, দিন শেষ। মিষ্টি তোমার দিন ফুরাইয়াছে। তিনি প্রয়াত হলেন। খবর পেয়ে অনেকদিন পর সেই চিত্রকর ভাস্কর লেখক কবি গায়করা এলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।

সর্বশেষ খবর, আক্ষরিক ধাড়ি এখন বাসি নিমকি বেচে। আগে দোকানে বাসি নিমকি থাকত ছোট বয়ামে। আলমারির এককোণে। গরিবগুর্বোরা চাইত। ভিখিরিদের দেওয়া হত। এখন সেই জিনিসই কিছুটা বড় মাপে চুরমুরে প্যাকিংয়ে প্যাকেট ভরে ভরে বিক্রি হচ্ছে। ওপরে লেখা : আক্ষরিক ধাড়ির বাসি নিমকি। বাসি এখন গুণ বোঝায়। যেন পুরনো মদ। বাজারে প্রতিযোগিতা ভুজিয়ার সঙ্গে। আক্ষরিকের প্যাকেটে একটা ছবি থাকে। আবছা ছাপা, সেই লেখক কবি চিত্রকর গায়ক ভাস্করদের মুখ। তাঁদের হাসিমুখ।

৫.

খবর দিল বাপ্পা। ছোটখোকাকে দেখা যাচ্ছে। স্বপ্নের নীরবতায় খবরটা বলল সে।

এখন, দশক দশক ধরে যা পরিস্থিতি, কাঠঠোকরার ঘর তৈরির শব্দের মতো, চারুপিসির নকশিকাঁথা বোনার প্রেমের মতো, সত্যোচ্চারণের মতো নীরবতাও ফুরিয়ে গিয়েছে, মরে গিয়েছে কুরুক্ষেত্রের পশ্চিমে। যে নীরবতা বাজারে আছে, তা ষড়যন্ত্রপূর্ণ, ঘাতকতাময়। এখন প্রতিটি নীরবতার পেছনে ঘাতকের ঘরবাড়ি। প্রতিটি নীরবতার পেছনে ভয়ের সামাজিকতা।

বাপ্পা বলল, ছোটখোকাকে দেখা যাচ্ছে।

একটা স্বপ্ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বাপ্পার আর আমার মাঝখানে।

বাপ্পার আগেও কেউ কি খবরটা বলেছিল? মনে করতে পারি না। কিন্তু কেন জানি মনে হয় কেউ বলেছিল বা কারও বলার কথা ছিল।

জায়গাটা আমার অচেনা নয়। এককালে বেশ যাতায়াত ছিল। বড়খোকার কাছে খবর বা চিরকুট পৌঁছে দিতে হত প্রায়ই। হেমেনবাবুর জন্য ডাক্তার আনতে হত মাঝেমাঝেই। মানিকদাকে সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র থেকে লুকিয়ে বের করে আনার গলিটা আমিই চিনতাম। সুতরাং ছোটখোকাকে যেখানে দেখা যাচ্ছে, আমি ইচ্ছে করলেই যেতে পারি। আমার যাওয়া উচিত। বাপ্পা যেন নীরবে কথাটা বলে চলে গেল।

একটা সমস্যা আছে। বড়খোকা ও ছোটখোকা পুলিশের গুলিতে খুন হওয়ার পর এবং ওদের আত্মীয় ও বন্ধুদের পুলিশ জেলে পোরার পর জায়গাটা আর আগের মতো নেই। শোনা যায়, প্রচুর ইঁদুর হয়েছে। হোটেলও হয়েছে প্রচুর। রাতভর খানাগানাপিনাটুনা হয়। জনসেবক-সেবিকাদের নিজস্ব লোকজন আসে। কন্টিনেন্টাল বা চাইনিজ প্লেটে পরিবেশিত বিবিধ উপাদেয় আইটেম সহ রাং সিনা স্তন যোনি ইত্যাদি রেড লেবেল বা জনি ওয়াকারে মেখে ইঁদুরেরা আন্ডারগ্রাউন্ডে টেনে নিয়ে যায়। ইঁদুরেরা সব খায়। বারুইপুরের পেয়ারা থেকে কাটোয়ার ডাঁটা থেকে সিউড়ির মোরব্বা থেকে আরবের খেজুর থেকে প্যান্টালুন বা পিটার প্যান, জীবনমুখী গান থেকে ব্রিজ সাবওয়ে বাইপাস সব খায়। এরা এতটা ধাড়ি ও ধারালো যে বিড়াল কুকুর কাছে ঘেঁষে না। নকশালপন্থী দমন করে নাম-ফাটানো পুলিশ ও তাদের বাচ্চারা এবং কাউন্সিলর বা এমএলএ ছক্কাপাঞ্জা করে এড়িয়ে চলে। মাঝেমাঝে রক্তাক্ত ইঁদুরের দেহ পড়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে ভোগ ভাগের লড়াইয়ে।

বড়খোকার বডি আমি দেখেছি। রক্তে ভেসে ফুটপাথে পড়ে ছিল। ছোটখোকার বডিও আমি দেখেছি। বড়ুয়া কেকের গলির মুখে পড়ে ছিল। যদি ভুল না হয়, দেখেছি ছোটখোকার ঝুলে থাকা ডানহাতের মুঠি থেকে বেরিয়ে আসা তর্জনী ট্রিগারে চাপ দেওয়ার ভঙ্গিতে বার বার নড়ছিল। ছোটখোকাকে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। দেওয়ালে দেওয়ালে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা। ছোটখোকা অস্ত্র চেয়েছে।

পেয়ে গেলাম। চুল দাড়ি অনেকটাই পেকেছে। বসতে বলল একটা সিঁড়িতে। তখন রাত। ফকিরি গান ভেসে এল দূর থেকে। সঙ্গে বাঁশি, বেহালা। জলের শব্দ পেলাম। পা ভিজে গেল। নদীর জল। ছোটখোকা কপালে হাত রেখে নদীর ওপারে দূরে দেখে। যেভাবে বুড়িবালামের তীরে বাঘা যতীনরা দূরে শহরের পথ দেখছিলেন।

নদীর ওপারে দেখি ঠান্ডাদা। যারা বলেছিল বিপ্লবের দেরি আছে এবং বলে পুলিশের খোচর হয়ে গিয়েছিল, তাদের একজন। পকেট থেকে রিভলভার বের করে ছোটখোকাকে মারল।

যারা বলে ভারতের পথ অহিংসার পথ, তাদের ভাড়াটে খুনি দয়া সিং রিভলভার বার করে ছোটখোকাকে মারল। নলিনীদারোগা, যে রেপের জন্য বিখ্যাত, সে মারল কার্বাইন চালিয়ে।

ছোটখোকা বার বার উঠে দাঁড়ায়। রক্তনদীর জলে ক্ষত মুছে বলে, অস্ত্র পেতে আর দেরি নেই।

ভোরের আলোয় চোখে পড়ে নদীর ওপারে ইঁদুরেরা রাং খাচ্ছে, সিনা খাচ্ছে, ব্রিজ খাচ্ছে, আলিশান টাওয়ার খাচ্ছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...