সব সত্যি…

উন্মেষ মিত্র

 

(১)

ছেলেটার জন্ম এক যাযাবর পরিবারে। পরিবারের সাথে ভেড়ার পাল নিয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় পাড়ি দেওয়া আর অবসর সময়ে ফুটবল এবং ‘দাল পারাম’ খেলা। ‘দাল পারাম’ ওই অঞ্চলের একটি স্থানীয় খেলা যেখানে একটি পাথরকে যে যত দূরে ছুঁড়তে পারবে সেই জিতবে।

১২ বছর বয়সে একটি স্থানীয় ক্লাবে ফুটবলে পায়েখড়ি। স্ট্রাইকার হিসেবে ফুটবল জীবন শুরু তারপর ম্যাচ চলাকালীন দলের গোলকিপার চোট পেলে প্রথমবারের মতন গোলকিপারের গ্লাভস পড়ে মাঠে নামা। কিন্তু বাধ সাধল বাবার আপত্তি, ছেলে ফুটবল খেলবে একদমই পছন্দ নয় বাবার, প্রথমে বকুনি তারপর জার্সি-গ্লাভস ছিঁড়ে ফেলা। ছেলেটা কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল ফুটবল খেলবেই। অতঃপর কিছু টাকা জমিয়ে রাজধানীর পথে যাত্রা শুধু একবুক স্বপ্ন বুকে নিয়ে — ফুটবল।

প্রথম কদিন রাস্তায় দিন কাটানো তারপর একটি ক্লাবে বিনা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে খেলার সুযোগ। কিছুদিন পর অন্য ক্লাব, তারপর আবার মাথার উপর ছাদহীন জীবন। জীবনযুদ্ধে টিকিয়ে রাখতে পিজ্জা স্টোরে চাকরি নেওয়া। তার আগে গাড়ি পরিষ্কার করার কাজ, আর বাকি সময়টা শুধুই ফুটবল।

পরিশ্রমের ফল পাওয়া যায়? হ্যাঁ, পাওয়া যায়। জাতীয় দলে খেলার শিকে ছিঁড়ল ২০১৫ সালে। তারপর থেকেই জাতীয় দলের গোলকিপার পজিশনে প্রথম পছন্দ।

আলিরেজা বেইরান্ডভান্ড

১৫ই জুন, ২০১৮ ইরান বনাম মরক্কোর বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ, গোলপোস্টের ২০ গজ দূর থেকে মরক্কোর হাকিম জিয়েচের আগুনে শট। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির একটা শরীর স্প্রিং এর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ডানদিকে, গোলমুখী শট লক্ষ্যভ্রষ্ট।

অতিরিক্ত সময়ের ৫ মিনিটের খেলা শেষ, রেফারির বাঁশি বেজে উঠেছে। ইরান ২০ বছর বাদে বিশ্বকাপে ম্যাচ জিতেছে, সবাই উচ্ছাসে ফেটে পড়েছে। গোলপোস্টের সামনে হলুদ জার্সি পড়া ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির দীর্ঘদেহী গোলকিপার অঝোর ধারায় কাঁদছে। আসলে গৃহহীন, গাড়ি সাফাইয়ের কাজ করা, পিজ্জার দোকানের কাজ করা, রাস্তায় দিন কাটানো আলিরেজা বেইরান্ডভান্ড ইরানের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ জয়ী দলের গোলকিপার।

(২)

“খানকি মাগির ছেলেদের চুদে দিয়ে আয়”

“রেপ করে দে অপোনেন্টকে”

“মা চুদে দে বোকাচোদাদের”

জিমি ডুমরাজ

ম্যাচ শুরুর আগে খেলোয়াড়দের নাকি এভাবেই উদ্বুদ্ধ করতে হয়। এটাই নাকি রীতি, এই ভাষাতে কথা বললেই নাকি খেলোয়াড়দের পৌরুষ উজ্জীবিত হয়। ময়দানি দুনিয়ার সাথে যারা পরিচিত তাদের এই ব্যাপারে আরও অনেক অভিজ্ঞতা থাকবে। দেশ-কাল-সীমানা পেরিয়ে এটাই নাকি ‘টোটকা’। অনেকেই নাক কুঁচকান, অনেকেরই অপছন্দ হয় কিন্তু ওই পর্যন্তই, ফুটবলের মতন সৃষ্টিশীল, প্রগতিশীল খেলাকে এই লিঙ্গবৈষম্যের, বিকৃত পুরুষত্বের লজ্জা থেকে বাঁচানোর কথা প্রথম ভাবল সুইডেনের ৪ জন কলেজ পড়ুয়া, সাঙ্গা আজিজ, রোজেরিও সিলভা, জুলিয়া ফ্রান্নেক এবং হাম্পুস স্যাগ্রেলিয়াস, তাদের সংস্থা “লকার রুম টক”। দেশের প্রতিটা ক্লাবে ঘুরে ঘুরে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হল। পাশে এসে দাঁড়ালেন এক প্রাক্তন সুইডিশ ফুটবলার। নিজের ফাউন্ডেশন থেকে ১ মিলিয়ন ক্রোনার সাহায্য করলেন “লকার রুম টক”কে, ক্যামেরার সামনে এলেন আরেক সুইডিশ ফুটবলার, স্পষ্ট বার্তা দিলেন লকার রুমে উদ্বুদ্ধ করার নামে লিঙ্গবৈষম্য টোটকা আর চলবে না। মানসিকতা বদলের লড়াই, ফুটবল লড়ছে। এক যোদ্ধা সুইডেনের হয়ে এবার বিশ্বকাপ খেলছেন, জিমি ডুরমাজ। আরেকজন এবার বিশ্বকাপে নেই কিন্তু প্রবলভাবে আছেন ফুটবলকে আরও সুন্দর করার লক্ষ্য নিয়ে, তিনি সুইডেনের কিংবদন্তী জলাতান ইব্রাহিমোভিচ।

(৩)

পাউলো গুয়েরো

এবারের গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম পাউলো গুয়েরো। পেরুর জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক, পেরুর ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। কোয়ালিফাইং রাউন্ডে লাতিন আমেরিকার গ্রুপে পেরু তখন সুবিধাজনক অবস্থায়, সামনে গুরুত্বপূর্ণ কলম্বিয়া আর আর্জেন্টিনা ম্যাচ। ১৯৮২ সালের পর বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করার হাতছানি লাতিন আমারিকার এই ছোট্ট দেশের। রাজধানী লিমার হোটেলে ম্যাচের আগে নিজের স্ট্যোমাক ক্র্যাম্প এবং গ্যাস্ট্রিটিসের সমস্যা কমানোর জন্য পছন্দের পানীয় “অ্যাপেল টি” পান করতে গিয়েই বাধল বিপত্তি। ম্যাচের আগে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ল নিষিদ্ধ বস্তুর উপস্থিতি, সাসপেন্ড হলেন গুয়েরো, সৌজন্যে “অ্যাপেল টি”-র বদলে পান করা “কোকা টি”। ১৪ মাস ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ গুয়েরো। ততদিনে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করেছে পেরু কিন্তু খেলতে পারবেন না প্রাক্তন বায়ার্ন মিউনিখ, হামবুর্গ-এর স্ট্রাইকার গুয়েরো। ৩৪ বছর বয়সী গুয়েরোর দেশের জার্সি গায়ে ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মঞ্চে খেলার আশা কি তবে শেষ? না। বিশ্বকাপ শুরুর আগে এগিয়ে এলেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ৩ অধিনায়ক ফ্রান্সের হুগো লরিস, অস্ট্রেলিয়ার জেডিনাক এবং ডেনমার্কের সিমন। সওয়াল করলেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অধিনায়কের ওপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য। বিশ্বকাপ শুরুর ১০ দিন আগে সুইস আদালতের রায় বেরোল, সমস্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত গুয়েরো, দেশের জার্সি গায়ে খেলতে পারবেন বিশ্বকাপ, সৌজন্যে ৩ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের অধিনায়ক।

(৪)

আইসল্যান্ড

আসুন একটা ছোট্ট অঙ্ক কষি। দেশের জনসংখ্যা ৩ লক্ষ ৩২ হাজার ৫২৯ জন। তারমধ্যে ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ২৭০ জন পুরুষ। তারমধ্যে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে বয়স ৪৪ হাজার ৪১১ জনের। ৫ হাজার ৬৮৬ জন ডাক্তারি, ব্যাঙ্ক, পশুপালন ইত্যাদি নানান পেশার সাথে যুক্ত, ২৩ জন জেলবন্দি, ৭ হাজার ৫৬৪ জন অসুস্থ এবং ১৯৪ জনের দৃষ্টিশক্তি নেই। দেশের বাকি ৩৪ জনের মধ্যে ২ জন ফুটবল টিমের ডাক্তার, ৯ জন সাপোর্টিং স্টাফ, এবার অঙ্ক কষে বলুন কজন বাকি থাকল? হ্যাঁ ঠিক ২৩ জন, আর হ্যাঁ সেই ২৩ জনই এবার আইসল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপে মাঠে নেমেছে। টিমের কোচ একজন ডেন্টিস্ট, গোলকিপার সিনেমা নির্মাতা। আর সেই দেশ থেকে ৩০,০০০ সমর্থক রাশিয়া এসে ভাইকিং ক্ল্যাপে মাতিয়ে রেখেছে, জনসংখ্যার ১০%।

(৫)

রূপকথার গল্প বাস্তব সত্যি হয়?

এতক্ষণ ধরে যা পড়লেন সবই তো সত্যি, একবর্ণও বাড়িয়ে বলা নয়। আলিরেজা বেইরান্ডভান্ড সত্যি, “লকার রুম টক” সত্যি, পাউলো গুয়েরো সত্যি, আইসল্যান্ড সত্যি, ফুটবল সত্যি, রূপকথা সত্যি। সত্যি সত্যি সত্যি, তিনসত্যি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. চমৎকার লাগল
    ফেসবুকে লকার রুম টক চালু করার ব্যাপারে কোন উৎসাহী থাকলে ভালো হত।

Leave a Reply to Somen Basu Cancel reply