সাদাফুলের সন্ধ্যাস্নান

সৌমিত দেব

 

দারুণ এক জাদুকর। তেমনভাবে মঞ্চ করা হয়নি কখনও কিন্তু নামডাক তার ছিল বটে এককালে। ভাগ্যের ফেরে হাত কাটা যাওয়ার পর এখন বাতের মলম বিক্রি করে লোকাল ট্রেনে। রোজকার মতো আজও লাস্ট ট্রেন ফাঁকা। জাদুকর বাড়ি ফিরছে। মনের মতো একটা জানলা বেছে বসে পড়া গেল। তার ঠিক মুখোমুখি এককালে বেশ নামডাকওয়ালা এক ব্যাটসম্যান বসে আছে। কলকাতা থেকে অবধি লোক এসে ডেকে নিয়ে গেছে। তারপর যা হয়। ট্রায়ালে পয়সা নেই। খেপে আছে। ব্যাটসম্যান এখনও খেপে আছে বটে। আজও ক্লায়েন্ট পয়সা দেয়নি, সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, তার মধ্যে এত জায়গা থাকতে উৎকট লোকটা সামনে এসেই বসল। একটা হাত নেই আবার। এসবে চিরকালের অসোয়াস্তি তার। পকেট থেকে সিগারেট বের করে উঠে দরজার ধারে দাঁড়াল ব্যাটসম্যান। জানে বেআইনি, তবুও ধরাল সিগারেট। হাওয়ার সে ধোঁয়া ভেসে পৌঁছল এককালের নামকরা মাচাকন্ঠীর কাছে। সিগারেটেই গান বন্ধ হয়ে গেছে তার। নেশা ছাড়তে না পেরে পেশা বদলে এখন সে তান্ত্রিক। সামান্য নামডাক হতে শুরু করেছে। গুরু আজই বলেছে আর দু-বছরের মধ্যে কোনও এক লোকাল কেবলে বসছেই সে, একেবারে নিশ্চিত। এসমস্ত ভাবতে ভাবতেই আপনমনে এখনকার একটা হিট গানের কলি মনে মনে ভাঁজছিল। কোন জায়গাটায় কেমন মুভমেন্ট হত গানের সময়, কোরাসটা গাইতেই হত না, ছুঁড়ে দিত পাবলিকের দিকে। এই সমস্ত ভাবতে ভাবতেই হাতে যে কাগজটা পাকাচ্ছিল সেটাও ছুঁড়ে দিতে তা গিয়ে পড়ল এককালের নামকরা রূপসীর গায়ে। তার স্কুলের সামনে ছেলেছোকরারা ভিড় করে থাকত। কতবার ছুঁড়ে দিয়েছে তারদিকে প্রেমপত্র, ফুল, শেষে অ্যাসিড। প্রথম প্রথম কষ্ট পেত খুব আয়নার দিকে তাকিয়ে, এখন কষ্ট হয় তারা কেউ ধরা পড়েনি বলে। কষ্টটা রাগ হয়ে গেছে কখন যেন, আর এখন সেটা গিয়ে পড়ল ওই ভণ্ড তান্ত্রিক লোকটার ওপর। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ ট্রেনখানাও থেমে গেছে। সিগন্যাল পায়নি হয়তো। ট্রেনখানা থেমেছে একটা সাদা ফুলে ভরা মাঠের কাছে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে সে মাঠ। হাওয়া দিতে শুরু করল এমন সময়।

বৃষ্টি হওয়ার আগে যেমন হাওয়া দেয়, তেমন হাওয়া। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল চারজোড়া চোখ বাইরের দিকে। সুন্দরী সরিয়ে ফেলেছে মুখের ওড়নাখানা, এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেনের দরজার কাছটায়। তার পাশে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানের মনে হয়েছে ম্যাজিক দেখছে সে। না আজ তার মনে পড়বে না সেই বন্ধুর কথা যাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে গেছিল অ্যাসিড বাল্ব মারতে। না সে জানত না বন্ধুর উদ্দেশ্য। নিজেকে শাস্তি দিতে তাই ছেড়ে দিয়েছে ক্রিকেট। এসমস্ত মনে পড়বে না এখন তার। এখন সে ম্যাজিক দেখছে, ছোটবেলায় যেমন দেখেছিল পাড়ায়। একবার ভাবল নামবে কিনা। কিন্তু তার আগেই, সামনে বসা লোকটা নেমে গেছে কখন তার পাশ দিয়ে। নেমে এগিয়ে যাচ্ছে মাঠের দিকে। এমন যাদুই তো সে দেখাত এককালে। প্রথম দিনই সিরিঞ্জের নেশা করতে চায়নি সে, শেষে হাত বাদ দিতে বাধ্য হল। পৌঁছেই যেত হয়তো মাঠের কাছাকাছি কিন্তু ফিরে চাইল একটা গান শুনে। ট্রেনের ভেতর থেকে আসছে, ব্যাটসম্যান আর সুন্দরীও তাকিয়েছে। কন্ঠী গান গাইছে, নিজের গলায়। রাগের মাথায় একটা মাতাল দর্শককে মেরে পঙ্গু করে দিয়েছিল সে। তারপর আর কেউ কখনও কাজ দেয়নি তাকে। বদনাম হয়ে গেছিল। আজ এসব কথা মনে রাখবে না সে, আজ শুধু গাইবে।

আর ট্রেনটাকে আমি এখানেই থামিয়ে রাখব। যতদিন না আবার কথা শুরু হচ্ছে আমাদের ট্রেনটা এখানেই থেমে থাকবে।

এইখানে, এই সাদা ফুলের মাঠের সামনেটায়।

কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু করল আবার। কারণ কথা শুরু হল আবার তোমার সাথে। একদিন হঠাৎ করেই শুরু হল কথা। তুমি মেসেজ করেছিলে কি? না আমি? হবে কেউ একটা। কিন্তু কথা যে শুরু হল এ কথা মিথ্যা নয়। সেই আবার আগের মতো কথা শুরু হল। সকাল, সন্ধে একে অপরকে জানাতে লাগলাম সমস্ত অপ্রয়োজনীয়তা। এমনই একদিন রাস্তায় দেখেছিলাম একটা লোক পড়ে আছে।

মাঝরাস্তায়, ফুটপাথের ধার ঘেঁষে, একটা লোক পড়ে আছে। পড়ে আছে বলা ভুল। একটা লোক ঘুমোচ্ছে। একেবারে ফুটপাথের মাঝখানে শুয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। নাক ডাকছে মাঝেমধ্যে। বেলা সাড়ে বারোটার সময়ে, শহরের সবচাইতে ব্যস্ত সময়ে, রাস্তার মাঝখানে শুয়ে, ঘুমোচ্ছে। সবাই তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে নাকে রুমাল দিয়ে কারণ, বাংলা মদের গন্ধ।

খানিক পর পাশের দোকান থেকে একটা ছেলে এসে একবালতি জল ঢেলে দিল লোকটার গায়ে। তাতেও সে উঠল না। তারপর আবার দু-বালতি। তারপর লাথি চড়। এবার উঠল লোকটা। তখনও নেশাটা পুরো কাটেনি। আবার চড় থাপ্পড় মারা হল। সারা গা ভেজা লোকটার। কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল। প্যান্টটা খুলে পড়ে গেল। সেটা অনেক কষ্টে তুলল মাথার পেছনে চাপড় খেতে খেতে। তারপর কোনওরকমে একহাতে প্যান্টটা ধরে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একটা গাছ ধরে।

থিতু হয়ে দু-হাতে প্যান্টটা ঠিক করে পরতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল কংক্রিটের রাস্তায়। দুটো দাঁত উপড়ে গিয়ে পড়ল সামনে। নাকটা ফেটে গেছে। উঠে না দাঁড়াতে পারায় লোকটা নিজের রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে নাক দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে রক্ত। কিন্তু লোকটা উঠতে পারছে না। হাতে ভর দিয়ে চেষ্টা করছে, কিন্তু হাত পিছলে পড়ে ফিরে যাচ্ছে আবার আগের অবস্থায়।

এই লোকটার গতকাল পূর্বজন্মের কথা মনে পড়েছে। লোকটা বাবুর মাইনে করা চামচা ছিল। ওর কাজ ছিল বাবুকে খুশি রাখা। শুধু আর শুধু বাবুকে খুশি করে একের পর কথা বলে যাওয়া, বাবু গান গাইলে আহা আহা করা, বাবু ভেনাসের মূর্তি জড়িয়ে শুতে গেলে পাহারা দেওয়া যাতে কেউ বিরক্ত না করে, বাবুকে বেশ্যাপাড়ার নতুন নতুন মেয়েছেলের খবর দেওয়া, বাবুর বাঁধা মেয়েছেলের কানে যাতে সে-কথা না যায় তা খেয়াল রাখা। আমি এগিয়ে যাইনি সাহায্য করতে। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এবার লোকটার কী হবে?

এই যে এই গল্পটা যেটা, যেটা তারপর তোমায় বললাম, সেটায় তো লোকটা আর লোকটার পূর্বজন্ম ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। আমার আর তোমার গল্পের মতো। তাই লোকটার বরাতও নির্ভর করছে এই গল্পটার ওপর।

এখন ধরা যাক লোকটাকে একটা ডানা দেওয়া হল। লোকটার জামা ফুঁড়ে একজোড়া ডানা বেরুল। লোকটা উড়তে উড়তে চলে গেল। বা ধরা যাক এক লোক এই লোকটাকে দেখতে পেয়ে তাকে তুলে লোক জড়ো করে হাসপাতালে দিয়ে এল। অথবা লোকটা নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে, মোবাইল বের করে বাড়ির লোককে ডেকে নিল। গোটাটাই নির্ভর করছে গল্পটার ওপর।

কিন্তু লোকটার পকেটে কি মোবাইল আছে? লোকটা কী করে? লোকটা কেমন জামাকাপড় পরে আছে এখন? লোকটার পকেটে কি পয়সা আছে? লোকটার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়েছে এ নিয়ে তেমন কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু এই লোকটা কে? এই লোকটার নাম কী? কেনই বা সে হঠাৎ করে এমন মদ খেল? নাকি রোজই সে এমন মদ খায়? খেলে কেন খায়? এত প্রশ্ন। কিন্তু এসমস্ত প্রশ্ন এই গল্পটার জন্যে দরকার নেই।

তাহলে হঠাৎ পূর্বজন্মের কথা এল যে? তাহলে কি লোকটার পূর্বজন্মের কেউ এসে লোকটাকে বাঁচাবে? কিন্তু সেসমস্ত জটিল হয়ে যাবে। তাই লোকটাকে মিথ্যুক করে দেওয়া যাক। মানে মিথ্যা কথা ছাড়া যে থাকতে পারে না। গতকাল লোকটা সবাইকে বাংলার ঠেকে মিথ্যা বলেছে যে ওর পূর্বজন্মের কথা মনে পড়েছে। এমনিই বলেছে।

কিন্তু সেসবও কি গল্পটার জন্যে দরকার? না ঠিক তা নয় হয়তো। এবার তাহলে গল্পটার কথায় একটু আসা যাক।

এই লোকটাকে পাশ কাটিয়ে এবার একটা ছেলে তাড়াহুড়ো করে ছুটছে, গাড়িঘোড়া কিচ্ছুর তোয়াক্কা করছে না। কারণ মেয়েটা প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করছে ছেলেটার জন্যে।

ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার একবছর পর আজ আবার দেখা হওয়ার কথা তাদের প্রথমবার। কেন ছাড়াছাড়ি হয়েছিল সেটাও এই গল্পটার জন্যে দরকারি নয়।  ছেলেটাকে এবার একটা গাড়ি ধাক্কা মারবে আর ছেলেটা ওই লোকটার থেকে একটু দূরে এভাবেই পড়ে থাকবে।

ওই যে লোকটা একটু আগে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল আর ছেলেটা মনের আনন্দে দৌড়াচ্ছিল আসলে ওইটুকুই যন্ত্রণার। গল্পটাও তাই যন্ত্রণার। একদিন তোমায় সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব লোকটার পূর্বজন্মে করা সমস্ত ধারের মতো কড়ায় গণ্ডায়। মিথ্যুক ছেলেটা যেমন আবারও দিব্যি করেও মিথ্যে বলত একের পর এক। তেমন নিশ্চিতভাবেই দেব।

তারপর গল্পটা প্রেমের হয়ে যাবে কারণ শেষেমেশ কেউ থাকে না। যন্ত্রণাটাও।

যেমন তোমার আর আমার এখন নেই। এই যে আবার কথা বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের। দুজনের কেউই আর তেমন গা করছি না আমরা। যেন জানতাম এমনটাই হওয়ার ছিল। এমনটাই হয়। এখন আর মনখারাপ করে না আমার তোমার জন্যে। মনে পড়ে মাঝেমধ্যে, কিন্তু মনখারাপ করে না। বরং একটা উৎকট ভালোলাগা নেমে আসে। ওই বাচ্চাটার মতো।

যার আজকে আবার পা কেটে গেছে। পায়ের তলাটা। শামুকের ভাঙা টুকরো পড়েছিল, তাতে। খেলার উত্তেজনায় তখন বোঝা যায়নি। মাঠের ধারের পুকুরঘাটটায় বসে ঘাস ডলে, কাটা জায়গাটায় লাগিয়ে চলছে চিকিৎসা। এইবার বাড়িতে গেলে যেই দেখবে খুঁড়িয়ে হাঁটা হচ্ছে তখন আবার বকুনি! তারপর জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে আনাবে! তাতে অল্প জ্বর আসবে। যদিও জ্বর জিনিসটা খারাপ না। পড়তে বসতে হয় না। সারদিন সবাই কেমন একটা জড়িয়ে থাকে। ভাত খেতে দেয় না, ওটাই যা খারাপ। কিন্তু না, বাড়িতে ঢোকার সময় খোঁড়ানো যাবে না। কালকে আবার স্কুলে ম্যাচ আছে। পা খোঁড়া করে বসে থাকলে নিজের টিমকে জেতাবে কে? কিন্তু রক্তটা যে একটু একটু বেরিয়েই চলেছে! এবার কী হবে? কী আর হবে, কিছুই হবে না।

এই পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই দোকানে চলে যাওয়া হবে। সেখানে দুপুরের ডাঁই করা ঘুঘনির প্লেট, চায়ের কাপ, কড়াই গামলা সব মাজা হবে। তারপর বাদবাকি ফাইফরমাশ খেটে আবার সন্ধ্যার বাসনপত্র যা হবে, সে সমস্ত কিছু মেজে, যা খেতে দেবে তাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া হবে। তারপর সকালে উঠে উনুন ধরিয়ে, দোকানপত্র সাফ করে, ফাইফরমাশ খেটে, দুপুরের কিছুটা বাসন মেজে রেখে তবে শান্তি। না মালিক খুব খারাপ নয়। বিকেলের এই সময়টায় একঘণ্টার জন্যে খেলতে এলে কিছু বলে না। খেলতে অবশ্য খুব একটা ইচ্ছে করে এমনটা নয়। শরীর দেয় না। আর সবাই কেমন যেন আশা করে থাকে গ্রাম থেকে এসেছে মানে ভালো খেলবেই। এই হাড়ভাঙা খাটুনির পর কারই বা আর ইচ্ছে করে খালি পায়ে এ-মাথা ও-মাথা দৌড়ে যেতে। ফিরে তো আবার সেই খাটুনি। কিন্তু খেলতে না এলে, এই সময়টায়, এই সন্ধ্যার একটু আগে, মাঠের ধারের এই পুকুরঘাটটায় যখন একটা দারুণ হাওয়া দেয়, তখন নিজের মতো করে নিজের চারপাশটা ভেবে নিয়ে এই যে দু-পাঁচ মিনিট বসে থাকা যায়, এইটে হত না। এই সময়টাতেই স্কুলে পড়া যায়, বাড়িতে মায়ের গাঁ-ঘেষে শুয়ে থাকা যায়, দিদির কাছে ঘুমিয়ে পড়া যায়, পাড়ার কাকুরা তুমি করে কথা বলে, ছবি আঁকতে যেতে ইচ্ছে করে না, ঘুরতে চলে যাওয়া যায় বাবা মার সাথে।

আমাদের যাবতীয় সত্যিগুলোও ওই পুকুরঘাটে এসে জড়ো হয়েছে। ভাসানের পর যেমন কাঠখড় পড়ে থাকে আর শোলার মুকুট ভাসে উৎসবের রাজসাক্ষী হয়ে, তেমন। জলমাকড়সা দেখে ছোটবেলা মনে পড়ে যায় যাদের, তাদের সবার ব্যক্তিগত প্রচারবিমুখ মুহূর্তদের মতন। এখানে চাকরি পেয়েছে সবাই, নতুন শাড়ি কিনে আনবার পর লুকিয়ে দিতে হয়নি, কেউ জিজ্ঞাসা করেনি আবার কী দরকার ছিল, বাড়ি ফেরার তাড়া নেই এখানে, ঝগড়া নেই। আছে, অভিমান পরবর্তী দিব্যি করে বলা আছে, সময়ে পৌঁছে যাওয়া আছে, বেড়াতে যাওয়া আছে আরও কত কী। এখানে সময় স্থির। একদর। কোনও দরদামের দরকার পড়েও না। এখানে ভালো থাকিস বলতে হয় না। এখানে যা ভাববে, যা চাইবে, সেই সবটা সত্যি। সন্ধ্যার এই একটু আগে আজ দেখা হয়ে গেছে যাদের কথা দেওয়া ছিল। সেই বৃষ্টির জমা জলে নৌকো ভাসছে যে কটা, সবকটা হাতচিঠি দিয়ে তৈরি। ঠিকানার দরকার নেই।

নাহ, এবার ফিরতে হবে। দেরি হয়ে গেল। খুঁড়িয়ে হাঁটা যাবে না। ওইতো মালিক দোকান খুলছে। কিন্তু এইটা কী? ওমা, এটা একটা নৌকো না? গায়ে আবার কিসব লেখা! নাহ, কাল পুকুরপাড়ে বসে লেখাপড়াটা ভাবতে হবে ভালো করে। আসলে যারা খেলতে আসে তারা তো লেখাপড়ার গল্প তেমন করে না, ফলে জানাই যায়নি, কী ভাবতে হবে, কী ভাবলে ভালো লাগবে। কিন্তু নৌকোটা বেশ ভালো। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় এক ছুট্টে পুকুরপারে। খোঁড়া পা নিয়েই। যতটা পারা যায় ঠিকঠাক করে ভাসিয়ে দেওয়া গেল সেটা। ভাসছে।

এটা যেদিন তোমার কাছে পৌঁছবে, দেখবে মোড়কটা আলাদা করে ভেতরে রাখা আছে। উপহার পাঠানোর সমস্ত নিয়ম রক্ষা করা না গেলেও কিছুটা যেতেই পারে। বৃষ্টির জমা জলে ভাসিয়ে দেওয়া নৌকোর গায়ে লেগে থাকা বিশ্বাসের মতো। সন্ধ্যার একটু আগে।

হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না আর। কথা বলতেও নয়। সম্ভবত দুজনেরই। আসলে একটা সময় পর দায়সারায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। হাঁটছিলাম এ সমস্ত ভাবতে ভাবতে। কত কীই তো ভাবি? গুলিয়ে যায় একেক সময় কোনটা ডিপ্রেশন কোনটা এমনিই। ঈর্ষাটা বেড়েই চলেছে আমার। সকলকে ইর্ষা করি আমি। এরা সকলেই আনন্দ বুঝতে পারে। আমি কিছুতেই পারি না। কিন্তু এমন সময় বুঝলাম, এবার বিরক্ত হতে হবে আমায়।

কারণ বৃষ্টি হচ্ছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসস্টপের শেডের তলাটা দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই চুপচুপে ভেজা। বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর সাহায্যে কোনওরকমে বের করা গেল মোবাইলখানা। ভিজেছে। ভালোই ভিজেছে। রুমালটাও একেবারে ন্যাতা। এখন মাথাটা গরম হয়ে যেতেই পারে। এই জন্যে সালার বৃষ্টি ভালো লাগে না। আদিখ্যেতা যত। কিন্তু না, বাসস্টপ বিষয়টা ঠিক জমছে না। এটাকে বরং একটা রেলস্টেশন করে দেওয়া যাক। কিন্তু রেলস্টেশনে যা ভিড়! তাতে আবার ওই ব্যাপারটা হবে না। আর জায়গাটাও খুব বড়। কিন্তু একটা ট্রেন ট্রেন ব্যাপার না হলে বিষয়টা জমছে না। নন্দনের সামনের রাস্তাটা দিয়ে একটা রেললাইন চলে যাবে। সেখানে ধোঁয়া ওঠা ট্রেন আসে।

বাহ, এইবার ভালো হয়েছে। বাসস্টপটা তাহলে হরিদার দোকানের পাশে একটা ছোট্টমতন শেড করে দেওয়া হোক। হ্যাঁ, এইটাই ঠিক হয়েছে। হাত বাড়ালেই চা সিগারেট পাওয়া যাবে। চা-টা পাওয়া না গেলেও চলত কিন্তু সিগারেটটা খুবই ইম্পর্টেন্ট। সিগারেট ছাড়া নিয়ে এককালে অধিকার প্রতিষ্ঠা হত। মানে দুজন পার্টিসিপেন্টের মধ্যে একজন স্মোকার না হলে সিগারেট ছাড়তে বলাটা অনেকটা… আচ্ছা এটা একটা ভালো জোক হতে পারে। গুছিয়ে কনস্ট্রাক্ট করতে হবে পরে। এখন ও নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। এখানে একটা রেডিও দরকার। কিন্তু রেডিও মানে তো এখন চল্লিশ মিনিট বাতেলা, কুড়ি মিনিট জর্জ টেলিগ্রাফের বাইক কেনার স্কিম, পনেরো মিনিট ইভেন্ট, শেষে একটা গান। দরকার নেই। এটাও একটা ভালো বিড হতে পারে। কিন্তু এটাও পরে ভাবলে চলবে। বৃষ্টিটা ধরে আসছে। না, বৃষ্টি ধরে এলে চলবে না। তাহলে বেরিয়ে পড়তে হবে। বৃষ্টিটা চলছে। এবার ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাবে। সিগারেট জ্বলল। ধোঁয়া উড়িয়ে এসে ট্রেন দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই আছে। সিগারেট শেষ হল। চারপাশে দেখলাম, নাহ, এ জিনিস হওয়ার নয়, বা হোক যে চাইছি এমনটাও নয়। অবশ্য চাইলে হচ্ছে বটে, এইযে বৃষ্টির মধ্যেই একটা ঠান্ডা ভাব, যেন পাহাড়ি বৃষ্টি, নামালাম, শুধু আর শুধুমাত্র সিনেম্যাটিক ভ্যালু রক্ষা করতে ট্রেন নিয়ে এলাম, এটা কি কম? তাহলে? দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ হল। ট্রেনটাও আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। আমারও বেড়ানো শেষ হল। রেডিওতে যে গানটা চলছে তার সাথে ছাতের কোনও মিল নেই। না বিকেলের না রাতের না সন্ধ্যার। তারপর লাইনটা অদৃশ্য হয়ে গেল। গাড়ি চলা শুরু। চলল। বেজায় রোদ। ছায়া দেখে অপেক্ষা করছে অনেকে। এরা প্রত্যেকে কখনও না কখনও ট্রেন মিস করেছে। নাকের সামনে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেছে। উঠতে পারেনি। দু-এক জন হাসল, হাত নাড়াল, কথাবার্তা হল খানিক। তারপর হাঁটতে হাঁটতে এক্সাইড। সেখান থেকে মেট্রো। তবু ওই যে ট্রেনটা এসেছিল, ওই সময়টা, আমি ওখানে ছিলাম না। প্রতিবারের মতো এবারেও সেই দেরি করেই পৌঁছেছি। মাঝে এতগুলো বছর পেরোনো চাট্টিখানি কথা নয় যদিও। প্রায় সবকিছুই নতুন।

তাই দেখা হল না। মেট্রোতে সিগারেট খাওয়া মানা।

তোমার সাথে দেখা হয়েছিল। ঠিক দুবার। আর কী আশ্চর্য দেখো, দু-বারই আমি দেরি করে গেছি। এই সবকটা গল্পের মতো।  

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. বাঃ। এইটুকু বলাই যথেষ্ট।
    তার পরেও কিছু থাকে যা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে বাধ্য করে। এ যেন দরজায় সেই ধাক্কা যা দরজা খুলে দিতে বাধ্য হয় ভিতরে থাকা মানুষ।
    লেখনী বেঁচে থাক। কলম বাঁচুক। আরও লেখা।

  2. এই লেখাটা ছাপার অক্ষরে দেখতে ইচ্ছে করছে। কাগজে পেলে লেখা পাঠকের নিজস্ব হয়।

  3. সব লেখা রূপকথা হয় না। কোনও কোনও লেখা হয়…

Leave a Reply to Partha Cancel reply