ক্যাপ্টেন দুপুরে ভাত খেতে গেছে আর নাবিকেরা দখল নিয়েছে জাহাজের — একাদশ পর্ব

চার্লস বুকাওস্কি

অনুবাদ : শুভঙ্কর দাশ

দশম পর্বের পর

 

১১/২২/৯১

দুপুর ১২টা ২৬ মিনিট

আমার ৭১তম বছরটা একটা ফাটাফাটি সৃষ্টিশীল বছর। এ বছরে আমি যত শব্দ লিখেছি সারা জীবনেও অত শব্দ আমি লিখিনি। আর যদিও একজন লেখক তার লেখালিখির ব্যাপারে খুবই খারাপ একজন বিচারক, তবু আমি বিশ্বাস করি আগের থেকে খুব কিছু খারাপ লিখিনি। মানে আমি বলতে চাইছি আমার শ্রেষ্ঠ সময়ের লেখার মতোই তা ভালো। এই কম্পিউটারটা যাতে আমি কাজ শুরু করেছিলাম জানুয়ারি ১৮ থেকে, আমাকে সাহায্য করেছে প্রচুর। সোজা কথায় এটাতে শব্দ নামানো অনেক সোজা, এটা দ্রুত শব্দগুলোকে ব্রেন থেকে (বা যেখান থেকেই তা আসুক) আঙুলের ডগায় চালান দিতে সাহায্য করে আর আঙুলের থেকে স্ক্রিনে যেখানে তা দেখা যায় তৎক্ষণাৎ– মুচমুচে এবং স্পষ্ট। এটা দ্রুতির প্রশ্ন নয়, ব্যাপারটা ফ্লোয়ের, শব্দের একটা নদী আর যদি শব্দগুলো ঠিকঠাক হয় তাহলে ওরা সহজে দৌড়ক। আর কার্বন পেপারের দরকার নেই, দরকার নেই বারে বারে টাইপ করার। এ কাজটা করতে আমার একটা রাত লেগে যেত আর তারপর পরের রাত আগের রাতের ভুলগুলো আর লেখার এলোমেলো ভাবপ্রবণ ব্যাপারগুলো শুধরতে। বানান ভুল, টেন্সের গণ্ডগোল ইত্যাদি, যা এখন সব অরিজিনাল কপিতেই ঠিক করে ফেলা যাচ্ছে আবার নতুন করে রিটাইপ ছাড়াই বা মাঝে মাঝে লেখায় লাইন ঢোকানো বা কাটা ছেঁড়াগুলো। কারওই পড়তে ভালো লাগে না একটা এলোমেলো অবস্থার কপি, একজন লেখকেরও ভালো লাগে না তা। আমি জানি ব্যাপারটা শুনতে লাগছে অতিরিক্ত শালীন আর অত্যধিক খুঁতখুঁতে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়, এটা সাহায্য করে আপনার যেটুকু শক্তি বা ভাগ্য আপনি হয়ত জন্ম দিয়েছেন তা স্পষ্ট বার করে আনতে। এটা ভালোর জন্যি, সত্যিই, আর এভাবেই যদি আপনি আপনার অন্তরাত্মা হারান তাহলে আমি তার পক্ষে।

কিছু কিছু খারাপ সময়ও এসেছে। আমার মনে পড়ছে এক রাতে প্রায় ঘণ্টা চারেক টাইপ করার পর যখন আমার মনে হচ্ছিল আমি সত্যি সত্যি খুব সৌভাগ্যবান ঠিক তখন কিছুতে একটা হাত লেগে গেল আর একটা নীল আলোর ঝলকানি আর অতগুলো লেখা পাতা অদৃশ্য হয়ে গেল। ওগুলোকে ফিরে পেতে আমি সব চেষ্টা চালালাম। কিন্তু ওগুলো জাস্ট চলে গেছে। হ্যাঁ, আমি পুরো ব্যাপারটাকেই সেভ অল-এ রেখে ছিলাম, কিন্তু তবু আটকানো গেল না। এটা আগেও ঘটেছে কিন্তু অতগুলো পাতা নিয়ে ঘটেনি। বলি আপনাকে যখন এভাবে পাতাগুলো অদৃশ্য হয়ে যায় তখন যতটা খারাপ লাগে তা কহতব্য নয়। এখন ভাবতে বসে মনে পড়ছে আমি আমার উপন্যাসের ৩ বা ৪টে পাতা হারিয়েছি অন্যান্য সময়। একটা পুরো চ্যাপ্টার। তখন যা করেছি তা হল নতুন করে মালটা লিখেছি আবার। এটা হলে যেটা হয় তা হল আপনি হারিয়ে ফেলবেন ছোট ছোট হাইলাইটগুলো যা আর ফিরে আসে না কিন্তু লাভটা হল যেহেতু আপনি আবার নতুন করে লিখছেন কিছু অংশ আপনি বাদ দিতে পারবেন যা আপনাকে আগে খুশি করেনি আর জুড়তে পারবেন কিছু অংশ যা অনেক ভালো। তো? রাত্রিটা হয়ে যাবে অনেক লম্বা। পাখিরা উঠে পড়ছে। বউ আর বেড়ালেরা ভাবছে আপনি পাগলে গেছেন।

আমি এই নীল ফ্ল্যাশ নিয়ে কথা বলেছি কয়েকজন কম্পিউটার এক্সপার্টের সাথে কিন্তু কেউই আমাকে কিছু বলতে পারেনি। আমি টের পেয়েছি বেশিরভাগ কম্পিউটার এক্সপার্টই ততটা এক্সপার্ট নয়। যা বইয়ে নেই এমন বিভ্রান্তিকর ব্যাপারস্যাপারও ঘটে। এখন আমি কম্পিউটারের ব্যাপারে অনেক বেশি বুঝি, আমার মনে হয় একটা জিনিস ওই হারানো কাজটাকে ফিরিয়ে আনতে পারত ওই ‘নীল ফ্ল্যাশ’ থেকে…

সব থেকে খারাপ রাত ছিল সেই রাত যখন আমি কম্পিউটার নিয়ে বসেছি আর ওটা পাগলের মতো আচরণ করছে, ছুঁড়ে দিচ্ছে বোমা, অদ্ভুত সব সজোর শব্দ, কয়েক মুহূর্তের অন্ধকার, মৃত্যুর কালো। আমি প্রচুর চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলাম না। তারপর লক্ষ করলাম যা স্ক্রিনের উপর আর ওই স্লটের চারধারে যাকে ‘ব্রেন’ বলা হয়, ওই স্লট যেখানে আপনি ডিস্ক ঢোকান, শক্ত হয়ে জমে আছে যা মনে হচ্ছিল একটা তরল আসলে আমার এক বেড়ালের মুত। আমাকে আবার সব কিছু নিয়ে যেতে হল কম্পিউটারের দোকানে। মেকানিক বাইরে গেছিল আর একজন সেলসম্যান ‘ব্রেন’-এর কিছুটা বাদ দিয়ে দিল, একটা হলুদ তরল তার সাদা জামায় ছিটকে এসে পড়ল আর সে চেঁচাল ‘বেড়ালের মুত’। বেচারা। যাইহোক আমি কম্পিউটারটা রেখে এলাম। বেড়ালের মুতের জন্য ওয়ারেন্টি ছিল না। ওদের ‘ব্রেন’-এর প্রায় সমস্ত নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করতে হল। ওদের ৮ দিন লাগল ঠিক করতে। ওই সময় আমি আবার ফিরে গেলাম আমার টাইপরাইটারের কাছে। সেটা ছিল যেন হাত দিয়ে পাথর ভাঙার চেষ্টা। টাইপ করা আবার নতুন করে শিখতে হল আমায়। নিজেকে ঠিকঠাক করে আর মাতাল করে ফের ফিরতে হল ফ্লোতে। আবার শুরু হল একটা রাত লেখা আর আরেকটা রাত সেটাকে ঠিক করা। কিন্তু ভাগ্যিস টাইপরাইটারটা ছিল। আমরা একসাথে আছি ৫ দশকের বেশি সময় আর বেশ কিছু ভালো সময় কেটেছে আমাদের। যখন কম্পিউটারটা এল কিছুটা খারাপ লাগা নিয়ে আবার পুরনো টাইপরাইটারটাকে রাখলাম ঘরের কোণে ওর নিজস্ব জায়গায়। কিন্তু আমি ফিরে গেলাম কম্পিউটারের কাছে আর শব্দগুলো বেরোতে লাগল পাগল পাখিদের মতো। আর সেই নীল ফ্ল্যাশ আর পাতাদের অদৃশ্য হওয়া ফিরে এল না। বরং আরও ভালো হল সব কিছু। ওই মেশিনে বেড়ালের মুতে দেওয়া সব কিছুকে একেবারে ঠিকঠাক করে দিল। শুধু এখন যখন কম্পিউটার ছেড়ে উঠি তখন একটা বড় বিচ টাওয়েল দিয়ে ঢেকে দি কম্পিউটারটাকে। আর দরজাটা বন্ধ রাখি।

তবু এটা আমার সব থেকে বেশি সৃষ্টিশীলতার বছর। ওয়াইন আরও ভালো হয়ে ওঠে যদি সেটাকে ঠিকমতো বুড়নো যায়।

আমি কোনও প্রতিযোগিতায় নেই কারও সাথে, অমরত্বের কোনও ভাবনা নেই আমার, এসব ব্যাপারকে আমি পাত্তা দিই না। আপনি যতক্ষণ বেঁচে আছেন অ্যাকশনটাই বড় কথা। সূর্যের আলোয় দুম খুলে যাচ্ছে গেট, ঘোড়াগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ছে আলোর ভেতর, সমস্ত জকিরা সাহসী ছোট শয়তানগুলো তাদের উজ্জ্বল সিল্কের জামায়, দৌড়চ্ছে সীমানার দিকে, করে দেখাচ্ছে। বিজয়-গৌরব আসলে গতিশীলতায় আর সাহসে। গোল্লায় যাক মৃত্যু। আজ আর আজ আর আজ-ই আসলে ব্যাপার। হ্যাঁ।

১২/৯/৯১

রাত ১টা ১৮ মিনিট

জোয়ার চলে যায়। আমি বসে তাকিয়ে থাকি ৫ মিনিট ধরে একটা কাগজের ক্লিপের দিকে। গতকাল, ফ্রিওয়েতে এসে দেখেছি কীভাবে সন্ধ্যা অন্ধকারের দিকে এগোয়। হালকা কুয়াশা ছিল। ক্রিসমাস আসছে একটা হারপুনের মতো। হঠাৎ দেখলাম আমি প্রায় একাই গাড়ি চালাচ্ছি। তারপর রাস্তায় দেখলাম একটা বড় বাম্পার একটা গ্রিলের সাথে লাগানো। ঠিক সময়মতো ওটাকে এড়ালাম, তারপর তাকালাম আমার ডানদিকে। একগাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ৪ বা ৫টা গাড়ি, কিন্তু সব চুপচাপ, কোনও নড়াচড়া নেই, আশেপাশে কেউ নেই, কোনও আগুন নেই, কোনও ধোঁয়া নেই, কোনও হেডলাইটের আলো নেই। আমি বড় দ্রুত যাচ্ছিলাম তাই দেখতে পাইনি গাড়ির ভেতর কোনও লোক ছিল কিনা। তারপর হঠাৎ সন্ধেটা রাত হয়ে গেল। মাঝে মাঝে কোনও সাবধানবাণী থাকে না। কয়েক সেকেন্ডে ঘটে যায় সব কিছু। সব পালটে যায়। আপনি বেঁচে আছেন। আপনি মারা গেছেন। আর সব কিছু আগের মতোই এগিয়ে চলে।

আমরা কাগজের মতো পাতলা। আমরা বেঁচে থাকি ভাগ্যের জোরে শতকরা হারে-র ভেতর, সাময়িকভাবে। আর ওটাই সেরা অংশ বা সব থেকে খারাপ অংশ, ওই সময়-সংক্রান্ত ব্যাপারটা। আর আপনি ওটা নিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। আমি পাহাড়ের টঙে উঠে কয়েক দশক ধ্যান করতে পারেন কিন্তু এটা পালটাবে না কিছুতেই। আপনি নিজেকে মেনে নেওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন কিন্তু তাও হয়ত ভুল। হয়ত আমরা খুব বেশি চিন্তা করি। বেশি অনুভব করুন, চিন্তা কম করুন।

সমস্ত গাড়িগুলো ওই গাদায় মনে হচ্ছিল ধূসর। অদ্ভুত।

আমার ভালো লাগে যেভাবে দার্শনিকেরা আগের সমস্ত কনসেপ্ট আর থিয়োরিকে ভেঙে দেন। এটা চলেছে শতকের পর শতক। নাম ব্যাপারটা এভাবে নয়, ওরা বলেন। এইভাবে হবে। এভাবেই তা চলেছে আর আমার তা বিচক্ষণতা বলেই মনে হয়, এই এগিয়ে চলা। দার্শনিকদের নিয়ে আসল ঝামেলা হল তাদের উচিত নিজেদের ভাষাকে আরও মানবিক করা, ব্যাপারটাকে নিয়ে আসা বোধগম্যতার কাছে, তাহলে চিন্তাগুলো আরও বেশি করে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে আকর্ষক। আমার মনে হয় এটা ওরা শিখছেন। সহজ করে বলাই হল আসল চাবিকাঠি।

লেখালিখিতে আপনাকে মসৃণভাবে এগোতে হবে। শব্দগুলো হতে পারে পঙ্গু আর অস্থির কিন্তু যদি তা মসৃণভাবে এগোয় তাহলে এক ধরনের আনন্দ সব কিছুকে উজ্জ্বল করে তোলে। সতর্ক লেখালিখি হল মড়ার মতো। আমি মনে করি সেরউড অ্যান্ডারসন হল সেরা একজন যে খেলেছে শব্দ নিয়ে যেন সেগুলো পাথর, বা খাবারের টুকরোটাকরা যা খেয়ে নেওয়া হবে। সে কাগজে এঁকেছে তার শব্দদের। আর তা ছিল এতই সহজ সরল যে আপনার মনে হবে যেন আলোর ঝলকানি, খুলে যাচ্ছে দরজারা, দেওয়ালগুলো চকচক করছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন কম্বল আর জুতোগুলো আর আঙুলদের। ওর ছিল সেই শব্দগুলো। সেইসব পরমানন্দ। তবু কিছু ছোট ছোট বুলেটও ছিল। যা আপনাকে বার করে আনতে পারে। সেরউড অ্যান্ডারসন জানত ব্যাপারটা, ওর ওই সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। হেমিংওয়ে চেষ্টা করেছেন বড় বেশি। আপনি ওনার লেখায় সেই চেষ্টাটা টের পাবেন। চেষ্টার মোটা মোটা পাথরখণ্ড একসাথে জোড়া। আর অ্যান্ডারসন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আপনাকে বলতে বলতে হেসে উঠতে পারে। হেমিংওয়ে কখনও হাসেন না। যে কেউ যে লেখে সকাল ৬টায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার হাস্যরস থাকতে পারে না। উনি পরাজিত করতে চান কাউকে, কোনও কিছুকে।

আজে রাতে বড় ক্লান্ত। ধোর বাঁড়া, আমি যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমোই না। আমি ঘুমোতে চাই দুপুর অবধি কিন্তু প্রথম ডাক ১২-৩০এ। আমাকে বেরোতে হবে এখান থেকে সকাল ১১টার আগে পিয়ন এখানে আসার আগে। আর রাত ২টোর আগে আমি খুব কমই ঘুমিয়ে পড়ি। বার দুই মুততে উঠি। একটা বেড়াল আমাকে তুলে দেয় কাঁটায় কাঁটায় সকাল ৬টায় দিনের পর দিন, ওকে বাইরে যেতে হয়। তারপর সকাল ১০টার আগেই একা মানুষেরা ফোন করবে। আমি ফোন তুলি না, মেশিন মেসেজগুলো নেয়, মানে আমি বলতে চাইছি ঘুমটা ভেঙে যায় আমার। কিন্তু এটাই যদি সব হত যা নিয়ে আমি পরনিন্দা পরচর্চা করছি তাহলে আমি তোফা আছি বলতে হবে।

আগামী ২ দিন কোনও ঘোড়ার ব্যাপার নেই। কাল আর দুপুরের আগে উঠছি না আর আমার নিজেকে বেশ শক্তিশালী মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে দশ বছর কমে গেছে। হা হা, এটা হাস্যকর– দশ বছর কম মানে আমার বয়স দাঁরায় ৬১, এটাকে কি আপনি একটা সুযোগ বলবেন? আমি বরং কাঁদি, আমাকে কাঁদতে দিন।

এখন রাত ১টা। এখন থেমে শুতে যাই না কেন? একটু ঘুমোই?

আবার আগামী সংখ্যায়

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...