রিলিজ লেটার

সাদিয়া সুলতানা

 

১.

শহরতলির সন্ধের রাস্তা বড় অদ্ভুত। কখনও মিটমিটে হলুদ আলো, কখনও নিপাট অন্ধকার। পাড়ার একমাথার পলেস্তারাখসা বাড়িটি যখন বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ের আয়োজনে আলো ঝলমল করে তখন একই সাথে দেখা যায় পাশের বাড়ি থেকে কোনও লাশের খাটিয়া বের হবার শোকাতুর দৃশ্য। আবার এক বাড়ি থেকে কোনও চঞ্চল শিশুর বিরামহীন চিৎকারের সাথে পাল্লা দিয়ে মায়ের অসহায় চিৎকার শোনা যায়। কখনও বা কোনও বাড়ির জানালা দিয়ে বাড়ির বৌ বা ঝিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে চড়-থাপ্পড় মারার অযাচিত শব্দ ভেসে আসে আর একই সাথে পাশের বাড়ির জানালাতে পর্দার আড়াল ভেদ করে উঁকি দেয় কিছু কৌতূহলী মুখ। আবার হয়তো কোনও কোনও নির্মাণাধীন উঁচু-নিচু দালান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে খোপে খোপে গেঁথে রাখে মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের ইট।

রাস্তার দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ানো আড্ডারত যুবকেরা দরদভরা কণ্ঠে গেয়ে ওঠে প্রিয় শিল্পীর প্রিয় গান। তখনই কোনও দোতলার জানালার গ্রিলের ফাঁকে মুখ রাখে একটা অভিমানী মুখ। গতকাল কেন সে আসেনি! কতবার উঁকি মেরেছে! নিচে তখন গানের তালে তালে ছন্দময় তালি বেজে ওঠে। শ্রোতাদের কেউ কেউ আড়চোখে দেখে নেয় ঝুলবারান্দায় কাপড় তুলতে আসা মেয়েটিকে। সত্যি শহরতলির চেনা রাস্তা বড় অদ্ভুত! কোনও কোনও গলি নিথর, নিস্তব্ধ। অচেনা সব গল্প লুকিয়ে থাকে এসব গলির ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। হঠাৎ কোনও আগন্তুক এলে ভড়কে যায়। এত অন্ধকার! যেন কোনও দুর্মর বিপদের মতো গিলে খেতে হাঁ করে আছে। আবার কোথাও উটকো ভিড় দেখে পথচারী থমকে দাঁড়ায়। কিছু একটা দেখতে পেলেই লোকের ভিড় জমে যায়। সময়টা কাকভোর হোক বা সন্ধে।

বরাবরের মতো আজও আলো-আঁধারিতে এই গলিটা রহস্যময় লাগছে। এই পথ দিয়ে লুনাকে রোজ বাড়ি ফিরতে হয়। লুনার মনের মধ্যে এমনিতে ভয়-ডর বলে কিছু নেই। ব্যাগের মধ্যে কিছু খুচরো টাকাপয়সা ছাড়া কিছু নেই যে কেউ ছিনতাই করবে। তাছাড়া কেউ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে গুম করে ফেলে রাখবে সেই শংকা নিয়ে পথ চললে তো ও কবেই ফুরিয়ে যেত। ওদের পাড়ার এই পাশটায় মোড়ে মোড়ে ছেলেরা আড্ডা দেয়। জহির, হীরা, লাভলু, তারেক, জিতু, শফিক, শিশির। কম বেশি সবাই লুনাকে চেনে। ষোলো-সতেরো বছর বয়সী এই তরুণের দলও লুনার অচেনা নয়। এদের কেউ কেউ লুনার ভাই স্বপনের বন্ধুর ভাই বা ওদের প্রতিবেশী। সেই হাফ প্যান্ট পরা সময় থেকেই লুনা এদের দেখে আসছে। ওরা লুনাকে দেখলে সালাম দেয়। মাঝে মাঝে আঙুলের ফাঁকে থাকা সিগারেটটা লুকাতে লুকাতে বড় ভাইয়ের মতো ভারি গলায় প্রশ্ন করে,

–লুনা আপা, সব খবর ভালো? কেউ আপনারে ডিস্টার্ব করে না তো?

ওদের জ্যাঠামি দেখে লুনা হাসে। কখনও কখনও উল্টো প্রশ্ন করে,

–কীরে শিশির, মলির বাড়ির সামনে রোজ দাঁড়ায় দাঁড়ায় কী করোস?

লুনার প্রশ্ন শুনে শিশির মাথা চুলকাতে চুলকাতে উত্তরহীন হাসে। আবার কখনও কখনও বলে,

–দুর লুনা আপা, খালি খেপাও।

আজ ওরা কেউ নেই। হয়তো একসাথে সবাই সিনেমা দেখতে গেছে নতুবা কোনও বন্ধু-বান্ধবের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমনও হতে পারে যে, ওরা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে গেছে। গতকাল ওরা লুনাদের বাড়িতে গিয়েছিল। মা ছেলেগুলোর দিকে একেবারে তেড়ে গেছে। ‘দ্যাশের মানুষ ভাত খাইতে ভাত পায় না, এখন ভিনদেশ থেইকা মানুষ আইনা দ্যাশে লঙ্গরখানা খুলছে।’ মায়ের তাড়া খেয়ে বাড়ির গেট দিয়ে বের হতে হতে শিশির ভেঙচি কেটেছিল,

–লুনা আপা, তোমার মা’টা এত দজ্জাল না!

লুনা ওর দিকে চোখ রাঙিয়েছিল, ‘যা ভাগ।’

চারপাশে নিপাট অন্ধকার। জনমানবহীন। এবার লুনার একটু ভয় করতে থাকে। ও যখন মাসদাইর গোরস্তানের সামনে বাস থেকে নেমেছিল তখন মাগরিবের আজান হচ্ছিল। অথচ বাড়ির সামনের পথটুকু হেঁটে আসতে আসতে সন্ধেটা কেমন উড়ো মেঘের মতো হারিয়ে গেল। তারপর যেন রাত নেমে আসল ঝটপট। লুনা দ্রুত পা চালায়। অন্ধকারে নিজেকে সামলে চলতে গিয়েও শেষরক্ষা হয় না। রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের আধভাঙা টুকরো পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। লুনা ‘মাগো’ বলে মাটিতে বসে পড়ে আঙুল চেপে ধরে। গলির মাথার ল্যাম্পপোস্টের ঘোলা আলোতে পায়ের ওপর কালচে দাগ দেখা যায়। লুনা হাত দিয়ে টের পায়, নখের চারপাশ ভেজা। রক্ত বের হচ্ছে। আঙুলটা টনটন করছে।

ও কোনওমতে উঠে দাঁড়ায়। বাড়ির গেট এখনও অনেক দূর। এই গলিতে আজ অন্ধকার ভূতের মতো চেপে বসেছে। চেনা পথ ভারি অচেনা লাগে ওর। আজ কেউ নেই কেন এখানে? রোজই তো থাকে। আচমকা একটা শরীর হনহন করে হেঁটে এসে লুনার সামনে দাঁড়ায়। লুনা মুখটা দেখার চেষ্টা করে বলে, কে রে? শফিক না শিশির? কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। আবছায়া অন্ধকারে একটা হাত এগিয়ে আসে ওর বুকের দিকে। তারপর এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে যায়। ওর ডান স্তনে হ্যাঁচকা টান মেরে লোকটা দৌড় দেয়। ‘ওই হারামি, কুত্তার বাচ্চা’ বলে অদৃশ্য শরীরটাকে তেড়ে যেতে গিয়েও লুনা আর এগোতে পারে না। ও আবার রাস্তায় বসে পড়ে। পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে ও প্রচণ্ড গ্লানিতে শব্দহীন কেঁদে ওঠে।

লুনা বাকি পথটুকু কীভাবে হেঁটে বাড়িতে ঢোকে ও নিজেও জানে না। ওর গা গোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর পুরো শরীরে বমি মাখা। এক্ষুনি গোসলে ঢুকতে হবে। বাড়িতে ঢুকেই ও টের পায় মায়ের মেজাজ ভয়ংকর রকম তেতে আছে। আসলে ওর মা নীলুফার আক্তারের মেজাজ বরাবরই উত্তপ্ত হয়ে থাকে। আবার এমনও হতে পারে যে, লুনাকে দেখলেই ওর মায়ের মেজাজ চটে যায়। প্রেসার কুকারের মধ্যে পপকর্ন ফোটার মতো মায়ের মুখে জ্বালাময়ী বাক্য ফুটতে থাকে। রচিত হতে থাকে লুনার নামে নানান দোষযুক্ত বাক্যরচনা। সারাদিন পর বাসায় ফিরে ওর পরিশ্রান্ত শরীর মায়ের কথার ভার নিতে পারে না। তাই আজকাল এসব উস্কানিমূলক বক্তব্য শুনেও ও না শোনার ভান করে। আজও তেমনিভাবে নিজের ঘরে ঢুকে লুনা দরজা বন্ধ করে কাপড় পাল্টাতে থাকে। মা এত উচ্চস্বরে কথা বলছে যে কাঠের দরজা ভেদ করে ওর ঘরেও সেসব কথা ঢুকে যাচ্ছে।

–এতক্ষণে আসছেন নবাবনন্দিনী। বুইড়া মাটা সারাদিনে মরলো না বাঁচলো একবার খবর নেয়ারও প্রয়োজন মনে করে নাই। এমন সন্তান আল্লাহ পেটে দিছে। আমার খবর নিব কখন! কাস্টমারগো খবর নিয়াই তো কূলকিনারা পায় না।

লুনার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। এত পচে গেছে মায়ের ভেতরটা! ও বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। ভয়ানক ক্রোধ আর অপমানে বালিশের ভেতর নিজের মাথা গুঁজে দেয়। মাঝে মাঝে ওর বিশ্বাস হয় না যে ও নীলুফার আক্তারের গর্ভজাত সন্তান। আবার মায়ের সাথে কাটানো পেছনের প্রতিটা দিনের দিকে ফিরে তাকাতে তাকাতে ভাবে, কখনও কি এমন হয়েছে যে ও মায়ের কোনও অপকর্মের সাক্ষী হয়েছে? রাসেলের মতো? রাসেলের কথা মনে হতেই লুনার শরীর আবার গুলিয়ে ওঠে। ওর সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে, রাসেল এই বিছানাতেই গার্মেন্টসের সেই মেয়েটাকে চতুস্পদী জন্তুর মতো আলিঙ্গন করে শুয়েছিল। সেই নীল ফুলের চাদরটা লুনা আর কখনও ব্যবহার করেনি তবে ওই সংসার থেকে লুনার বাবার দেয়া খাটসহ অন্যান্য আসবাব ও ডিভোর্সের পর নিয়ে এসেছিল। একদিন ওর বাবার কাছ থেকে যাদের এসব নিতে বাধেনি, তাদের কাছ থেকে লুনার সেসব ফেরত নিতেও বাধেনি। ওর কান্না পায়। কেন বারবার সেই দৃশ্যটা মনে পড়ছে? ও ঝট করে তাকায়। চারপাশে অন্ধকার। বিদ্যুৎ চলে গেছে।

লুনা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছু একটা খেতে হবে নতুবা সারারাত ছটফট করতে হবে। ক্ষুধার যন্ত্রণা লুনা একদম সহ্য করতে পারে না। মাঝে মাঝে এমন হয়। মায়ের সাথে রাগ করে ও রাতের খাবার খায় না। পরে মাঝরাতে উঠে ওকে খাবার খুঁজতে হয়। মা নির্ঘাৎ খাবার ফ্রিজে তুলে রেখেছে। ও একটু দেরিতে খেতে এলেই মা ফ্রিজে ভাত-তরকারি তুলে রাখে। লুনা ঘর থেকে বের হয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে ঢোকে। চুলার পাশেই ম্যাচের বাকসো রাখা। ম্যাচ বাকসো খুঁজে নিয়ে লুনা চুলা ধরায়। গ্যাসের চুলোর আগুন সাঁই করে জ্বলে ওঠে। ও তড়িঘড়ি চুলোর আঁচ কমাতে গেলে তা আরও বেড়ে যায়। কমলা আর বেগুনি আগুনের হলকায় লুনার ফর্সা মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

বেগুনি রঙা এই আগুনের দারুণ একটা নগ্ন সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যে লুনার চোখ ঝলসে যায়।

২.

‘তুই তো মাইনষের লগে শোস’ কথাটা শুনলে আগে লুনা বিকারগ্রস্তের মতো হয়ে যেত। কিন্তু এখন ওর ভেতরে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হয় না। বারবার এক কথা শুনতে শুনতে, বলতে বলতে কথার ধার-ভার কমে যায়। যে আঘাত দেবার উদ্দেশ্যে কথাটা বলা সেটা আর হয় না। তখন ভাষার ব্যবহারে নতুনত্ব চাই, ঘটনায় আরও চমক চাই। সেজন্যই হয়তো মায়ের কথায় নতুন নতুন তথ্য সংযোজিত হচ্ছে। মায়ের সাথে সকালের কথোপকথন মনে করে লুনার মাথা টলে ওঠে।

–তুই তো ঢাকা যাছ বয়ফ্রেন্ড লইয়া ফূর্তি করতে। বাড়ি ফিরাই তো গোসলে ঢোকস। অসময়ে গোসলের মানে আমি বুঝি না মনে করছস? সব বুঝি। পেটে ভাত দেওনের টাকা নাই, ইন্টারনেটে জামাকাপড় কিনোস! বুঝি না মনে করছোস? চুল কি আমার বাতাসে পাকছে? তর নামে অত কুরিয়ার আসে, কারা দেয়? অরাই দেয়। তর বেতন।

মায়ের তথ্যসমৃদ্ধ নোংরা কথাগুলো শুনে আজ কিছুক্ষণ লুনার মাথা ঝিমঝিম করেছে। ও পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, মায়ের এইসব তথ্যের যোগানদাতা বাইরের কেউ।

–তোমার বিবিসি তোমারে কয় নাই, দেশে শইল বেইচা সুখ নাই, অহন বিদেশ যামু?

–কওন লাগব ক্যান, নিজের চোখেই তো দেহি, ঠুলি পইরা তো আর থাকি না।

–আর কী কয়? আমি খালি ফূর্তি করি? ট্যাকাটুকা কামাই সেই কথা কয় না?

–শয়তান ছেড়ি আবার মুখ করে! আল্লাহ্ যে তরে কী দিয়া বানাইসে! আমার ঘরে বিজাত পয়দা করসে। বিয়া বইয়া যাগা বাড়ি থেইকা। আর জ্বালাইস না।

–বিয়া আনো।

–বিয়া আনলে করবি? করবি তো না, তোর তো রুচি খারাপ। ঘরের পুরুষরে ভালা লাগে না তোর।

–আনো, আইনা দেহো, গত পাঁচ বছরে তুমি আর তোমার বিবিসিরা কয়ডা পোলা আনছো?

–তুই তো দিন দিন বস্তির মাগী হইয়া যাইতাছস। গলা নামায় কথা ক। মহল্লায় তোর কাহিনীর কারণে এমনিতেই মুখ দেহাইতে পারি না।

–গলা আমি নামায়াই কথা কই। হ, আমি খানকি, আমি মাগী। আমি ভ্যাজাইনা বেইচা চলি, তুমি খুশি?

মা লুনার গালে চড়টা বসানোর সময় ও কাত হয়ে দরজার সাথে বাড়ি খেয়েছিল। ওর কপালের বাম পাশে ফুলে গেছে। তাতে মায়ের কোনও ভ্রূক্ষেপ হয়নি। লুনারও না। ও শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল,

–আমার যা মন চায় করুম, তোমার কী?

–অহনথন যা করবি এই বাড়িথন বাইর হইয়াই করবি।

–হ বাইর হইয়াই করুম। তোমার অত কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তোমার কষ্ট কমাইতেই বাইর হমু।

লুনা বাসা থেকে বের হবার সময় কপালে কিছু লাগায়নি। মোড়ের ডিসপেনসারি থেকে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ কিনেছে। চোট খুব বেশি লাগেনি। তবে কপালের খানিকটা চিরে রক্ত বের হয়েছে। দু’একজন কৌতূহলী মানুষ ওর দিকে তাকাচ্ছে। এসবের চেয়ে অনেক কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি লুনার গায়ে সয়ে গেছে। তবু ভালো আজ নজর টিপের মতো কপালে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজটা থাকায় শরীরের অন্য কোথাও তাদের দৃষ্টি যাচ্ছে না। হঠাৎ ওর বান্ধবী রিফফাতের কথা মনে পড়ে লুনার হাসি পায়। রাস্তাঘাটে এসব দেখে কী রাগই না করে মেয়েটা! প্রতি সপ্তাহে দু’একটাকে মারধর করে ধরাশায়ী করে। পরে রিফফাতকে ‘মা’ ‘মা’ ডাকতে ডাকতে এরা বাড়ি যায়। আজ সকালে ইনবক্সে নক করেছিল রিফফাত। আড়ঙে যাবে। লুনাও সময় দিয়েছে। রিফফাতের সাথে সময় কাটানোর কথা ভাবতে ভাবতে লুনার তেতো সকালটা স্নিগ্ধ হতে থাকে।

পাশের সিটের যাত্রীর দিকে না তাকিয়েও লুনা বুঝতে পারছে লোকটা ওর বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। আহা! যেন দোকানের ক্ষিরসা, মালাই চপ দেখছে! পারলে চেটেপুটে খেত! লুনা নিজের অজান্তেই ওড়না টানে। যদিও জানে, লাভ নেই। লোকটা এবার নিশ্চয়ই ওর কোমরের ভাঁজের দিকে তাকাবে। লুনা এবার লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

–দেখতে অসুবিধা লাগতেছে? আসেন আমার পাশে আইসা বসেন। দুই চোখ ভইরা দেখেন। চাইলে ধইরাও দেখতে পারেন।

লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানালার বাইরে উদাস দৃষ্টিতে তাকায়। লুনার মজা লাগে। আসলেই লুনা খারাপ। আজকাল খালি মানুষ উস্কাতে ভালো লাগে ওর। এই যে সকালে মায়ের কথায় তর্কের বদলে আত্মসমর্পণ করে ফিচফিচ করে কাঁদলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু ও এমন বেয়াড়া যে তা না করে সমানে মায়ের সাথে মুখ করল। লুনা যতক্ষণ বাড়িতে থাকে মা আর ওর মধ্যে এসবই চলে। পাশের বাসার ভাড়াটিয়ারা নিশ্চয়ই ভাবে ওরা সৎ মা, মেয়ে। সকালে বা সন্ধ্যায় যেসব কুৎসিত ভাষায় চিৎকার করে ওরা দুজন, ভাবারই কথা। আগে মা একাই বলত আর নিজের ঘরে ছিটকিনি আটকে বসে লুনা নিজেকে সান্ত্বনা দিত। রিফফাত বলে মেনোপজের পর একরকম মনস্তাত্ত্বিক সংকট আর একাকীত্ব থেকেই মা এই আচরণ করছে। কিন্তু কতকাল আর গা ঘিন ঘিন করা থকথকে কাদার মতো কথার আস্তর শরীরে মাখা যায়? লুনা এখন তাই প্রতিরোধ হিসেবে মায়ের মুখনিঃসৃত শব্দের সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে।

এই মুখই লুনার শত্রু। এই চোখজোড়াও। না হয় রাসেল যেদিন গার্মেন্টসের মেয়ে নিয়ে বিছানায় শুয়েছিল; সেদিনের সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখে কেন লুনা চোখ-মুখ বন্ধ রাখার বদলে আকাশে-বাতাসে কুৎসা রটিয়েছিল! কুৎসাই তো। লুনা শরীর দিয়ে পতিদেবতাকে খুশি রাখতে না পারলে পতিপরমেশ্বর তো বহুগামী হবেই। রাসেলের সেদিনের মুখটা মনে পড়ে লুনার। কান্নাভেজা, নত মুখ। লুনার কোমর-পা চেপে বসে ছিল সেদিন রাসেল। কাঁদছিল অঝোরে। সেই কান্নার কারণ লুনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা ছিল না। কারণ ছিল এই ঘটনাটা লুনা যেন কাউকে না বলে। লুনা লাথি মেরে রাসেলকে নিজের শরীর থেকে আলাদা করেছিল। সেটাই ছিল ওর শরীরে রাসেলের শেষ স্পর্শ।

শরীর বড় আজব জিনিস। নিস্তব্ধ বিশাল রাতগুলো যখন লুনাকে ক্রমাগত কুঁড়ে কুঁড়ে খেত তখন ও বুঝেছে শরীর কী জিনিস। শরীর যখন আপাদমস্তক একটা অবিভাজ্য অঙ্গ তখন শরীরের একটা অংশ জেগে উঠলে নির্ঘুম রাতগুলোতে সারা শরীর-মন জুড়ে একটা চোরা যন্ত্রণার স্রোত থাকে। কবিতার শব্দপোকা মাথার ভেতর ঘুণপোকা হয়ে কাটে, ‘হয়তো পুরুষ নয়, প্রকৃতিই আমাকে বাজায়, আমি তার শখের সেতার।’ এমন দুর্মর রাতে লুনার একাকী শরীর যেন বেজে উঠত বাতাসেরও সান্নিধ্যে। আহ্ গন্তব্যহীন বেজে ওঠার কী যে সেই যাতনা! সে তো সেই নির্ঘুম রাতগুলোই ভালো জানত।

শরীর তৃষ্ণা কী পুরুষ তৃষ্ণা? সেই তৃষ্ণা মেটানোর জন্য রাসেলকে ত্যাগ না করা কি জরুরি ছিল? লুনা উত্তর খুঁজে পায় না। কিন্তু শরীর তো জগতের কাছে বিশাল গুরুত্ব বহন করে। জগতসংসারের মানুষগুলো যতবার লুনাকে ক্ষতবিক্ষত করে ততবার তাদের কাছে ওর শরীরটাই আক্রমণের মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। চার বছর হয়ে গেল রাসেলের সাথে ওর বিচ্ছেদের। অথচ একটিবারের জন্যও ওর আশেপাশের মানুষগুলো রাসেলকে ভুলতে দেয়নি। ‘অয় তো ডিভোর্সি’– কথাটার মজা ফুরোতে না ফুরোতেই ‘অয় তো শরীর দেখায়ে চলে’– কথার আমদানি। এখন এইগুলোও ক্লান্তিকর, বস্তাপচা বিশেষণ। লুনা আর কত সহ্য করবে? তাইতো কথার তোড়ে ফোঁড় দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।

মোবাইলে ফেসবুকের নোটিফিকেশন চেক করতে করতে লুনা বিক্ষিপ্ত ভাবনা থেকে সরে আসে। ফেসবুকের আবহাওয়া গরম। সুশান্ত পালের দেয়া পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার আর গরম গরম স্ট্যাটাসে টাইমলাইন ভর্তি। মানুষের কত যে মুখোশ! লুনারও মুখোশ আছে, মুখশ্রীতে ঢেকে থাকে। তবে এমন ঘ্যাচড়া মুখোশ নাই যে রাস্তার লোক দেখলে যৌনবোধ তাড়া দিয়ে ওঠে। হেহেহে, লুনা হাসে আনমনে। নিজেকে মুখোশের আড়ালে ঢেকে রাখার মজাই আলাদা। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানসিক তৃপ্তিভোগের আনন্দ। এই যে মনের উথালপাতাল বৈপরীত্য ভাষার ঝড়ে তাড়িয়ে বেড়ানো, এর বিনোদন কি কম?

লুনার পাশে বসা মেয়েটি মিটিমিটি হাসছে আর চ্যাটবক্সে বয়ফ্রেন্ডকে রিপ্লাই দিচ্ছে। মোবাইল কভারের আড়ালে মেসেজ পড়া যাচ্ছে না কিন্তু মেয়েটার মুখের হাসি বলে দিচ্ছে বড় রোমান্টিক তার প্রেমিকপ্রবর। বাতাসে মেয়েটার রেশমি চুলের গোছা লুনার নাকে মুখে লাগে। বিব্রত ভঙ্গিতে স্যরি বলে মেয়েটা চুল সরিয়ে নেয়। আহা, মেয়েটার প্রেমিক নিশ্চয়ই ওর চুলের সৌরভে নাক ডুবাতে ভালোবাসে!

বাস ফ্লাইওভারে উঠেছে। এই ফ্লাইওভারের কারণে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার দূরত্ব কমে গেছে। সকালে বাসা বের হলে বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে মতিঝিল পৌঁছানো যায়। অফিসে ঢুকতে ঢুকতে পোনে নয়টা। আজ ওর অফিসে যাবার তাড়া নেই। লুনার চাকরিটা চলে গেছে। লুনা মাকে এ কথা জানায়নি। তবে কথাটা গতকালও লুনা মাকে বলার চেষ্টা করেছে। মামার অফিসের চাকরি ছেড়ে ঢাকায় একটা বায়িং অফিসে সিনিয়র মার্চেনডাইজার হিসেবে যোগদানের মাসখানেকের মাথায় ওর চাকরি চলে গেছে। ওরা এই এক মাসের বেতন না দিয়েই ওকে বিদায় করে দিয়েছে। লুনা বেতন চাইলে ডেনমার্কের সাথে বাংলাদেশের এই লিঁয়াজো অফিসের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইকতেদার উদ্দিন ওর সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছে। চামার টাইপের লোকটা ওর অযোগ্যতার কথা বলে ওকে প্রাপ্য বেতন তো দেয়ইনি বরং এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে লুনাকে দেখে নিবে বলে হুমকি দিয়েছে। সত্যি সত্যি ইকতেদার উদ্দিনের মারমুখী আচরণে ও ভীষণ ভয় পেয়েছিল। তাই নিজের এই নাজুক অবস্থাতে ও বেতন চাইতে আর দ্বিতীয়বার সেই অফিসে যায়নি। অথচ বেশি বেতনের এই চাকরিটা পেয়ে ও আগের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল।

মাকে খবরটা দেয়া হয়নি। লুনার চাকরি নেই এই খবরটা মাকে জানালে মায়ের মুখে কী শুনতে হবে সেটা ভাবতেই কেমন যেন আতঙ্কের দলা গলার কাছে এসে ওর কথা আটকে দেয়। ‘পোলা লইয়া চোখের সামনে তো ফূর্তি করতে পারব না, হের লেইগা ঢাকায় চাকরি নিছে। জামাই কী আর এমনে ছাড়ছে।’ লুনা চাকরি ছাড়ার কোনও শরীরবৃত্তীয় কারণ শুনতে চায় না। এমনিতেই একটা নিষ্ফল ক্রোধে ওর দিন কাটছে। মাথা নত না করে থাকা যায় যদি পকেটে টাকা থাকে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন মাথা তুলে থাকবে ও? প্রতিদিন অফিস আওয়ারে লুনা নিয়ম করে ঢাকায় আসছে আর সন্ধ্যার সময় বাসায় ফিরছে। জমানো টাকা আছে কিছু, হাজার পনেরো। তবু আজ রিফফাতকে টাকা পাঠানোর জন্য লুনা মেসেজ করেছে। মেসেজের প্রতিটা বাক্য টাইপ করতে করতে ও ভিখিরির মতো কেঁদেছে। কারও কাছে হাত পাতবার কী যে কষ্ট! কী যে গ্নানি!

তবু একজন মানুষ এই দুনিয়াতে আছে যার কাছে লুনা হাত পাততে পারে। ‘আমার চল্লিশ হাজার টাকা লোন লাগব। দিতে পারবি? সামনের মাসেই লাগব। এই টাকাটা আমি বাঁইচা থাকলে সামনের বছর ডিসেম্বরে ফেরত দিমু। ডিসেম্বরে আমার ডিপিএসটা ম্যাচিউরড হইব। আমি বিদেশ যামু। দেশে খালি খিদা আর খিদা।’ রিফফাত রিপ্লাই করেছে, ‘তোর বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যাবে আজই। টাকা ফেরত না দিয়া কিন্তু মরিস না। চুম্মা দোস্ত’। রিফফাত এমনই। কানায় কানায় ভরা মেয়ে। স্বামী-সন্তান নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য আর সাফল্যে ভরপুর জীবন ওর। রিফফাত নিশ্চয়ই শরীরেও সুখী। স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে যৌনতৃষ্ণার একটা সম্পর্ক আছে। ওর হাসি পায়। লুনাও আজকাল সব কিছু শরীর দিয়েই বিবেচনা করছে!

৩.

–রিফফাত, তুই আমারে এই ঈদে হিজাব গিফট করবি। সাত রঙের সাতটা। রঙধনুর সাত রঙ, য্যান সব ড্রেসের সাথে ম্যাচিং কইরা পিন্দন যায়।

বলতে বলতে লুনা আয়েস করে আইসক্রিমে কামড় বসায়। লুনা আর রিফফাত যমুনা ফিউচার পার্কের ফুডকোর্টে বসে আছে। দুজন টুকটাক কেনাকাটা শেষে দুপুরের লাঞ্চ সেরে আইসক্রিম খাচ্ছে। আজ রিফফাতের ডে অফ আর লুনার মুড অফ। তাই লুনার আবদারেই দুজনে একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছে। রিফফাত তার প্রিয় স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিমে শেষ কামড় দিয়ে লুনার প্রশ্নের জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে,

–কেন? তুই কি হিজাব পরবি?

–জবাব পরে দিমু। তার আগে বল, তুই এমন ভাতের মতো আইসক্রিম খাস ক্যান? তোর খাওয়া দেইখা আমারই দাঁত শিরশির করতাছে। তোরে দেইখা মনে হইতাছে তোর আইসক্রিম কেউ নিয়া যাইব।

রিফফাত ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে।

–হাসিস না, আরেকটা খাবি তো খা।

–তুই জানিস না, আইসক্রিম আমার কী ভীষণ পছন্দ! দে আরেকটা অর্ডার দে, আর বল, হিজাব কি তুই পরবি?

–হ, মার ধারণা যারা হিজাব পরে হেরা ভালা। আমি বেপর্দা। কালকা রাতে শাম্মির উদাহরণ দিছে। রাত থেইকা আমার শইলটা জ্বলতাছে। শাম্মি, রুমি ভালা, পদ্দা করে আমি ভালা না। আমি বলছি শোনো আমি যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, এটা চোখে পড়ে না তোমার? আমি যে গীবত গাই না, এইটা চোখে পড়ে না?

–খালাম্মা কী বলে?

–কী আর বলব, আমি কোনও উদাহরণ দিলে মুখে ঠুলি পিন্দা বইসা থাকে।

–বসারই কথা। তোর যেই মুখ! অবশ্য খালাম্মারও মাশাআল্লাহ!

–হের মুখে এক কথা, আমি খারাপ। শাম্মি ভালা।

–শাম্মিটা আবার কে?

–শাম্মি ঐ যে লন্ডন থাকে, আমার কাজিন। অয় খুব ভালা। শাম্মি ফুল হাতা ব্লাউজ পরে, হিজাব পরে মাথায়। স্বামীর পাশে দাঁড়াইয়া হাইসা হাইসা ছবি তোলে আর ফেসবুকে ছবি দেয়। খালা বেড়াইতে আসলে সেই ছবি মারে দেখায়।

–হুম।

–আমার খালা-মামা, চাচারা আমারে নিয়া নানান কথা কয়।

–কী বলে?

–আমার বলে বয়স হইসে, তার ওপরে ডিভোর্সি। খাবার খোলা থাকলে মাইনষের জিব লক লক করবই। তাই আমার পদ্দা করা দরকার।

রিফফাত চুপ হয়ে যায়। মা-মেয়ের এই দ্বন্দ্বমুখর জীবন-যাপনের কথা ওর অজানা নয়। হঠাৎ লুনার ভারি কণ্ঠস্বর শুনে অন্যমনস্ক রিফফাত সম্বিত ফিরে পায়।

–বুঝছস রিফফাত মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মা আমার সৎ মা। নইলে হের কোনও অপকর্মের সন্তান আমি।

–তুইও কী খালাম্মার মতো পাগল হয়েছিস! কী বলিস এসব!

–হওয়ার কী বাদ আছে! দিন রাত বস্তির ভাষায় মায়ের সাথে ঝগড়া করতে করতে আমি ক্লান্ত হইয়া গেছিরে।

রিফফাত চুপ করে থাকে। লুনার এসব সমস্যার সমাধান ওর কাছে নেই। ও শুধু শুনতেই পারে।

–আমি ডিভোর্সি তাই আমার পছন্দমতো স্টাইলে চুল কাটতে পারুম না। সাজতে পারুম না। নয়া শাড়িকাপড় পিনতে পারুম না। কোনও পোলার লগে হাইস্যা কথা কইতে পারুম না। আর আমার প্রাক্তন স্বামী দ্বিতীয় বউ লইয়া চোখের সামনে ঘুরলেও আমারে বাহবা দিতে হইব কিন্তু নিজে বিয়া করতে পারুম না।

–বিয়ে তো করতেই পারতি। তুই নিজেই তো করলি না।

–ঘিন্না লাগে, বিয়ার পর আরেক ব্যাটা শরীরটা চটকাইব ভাবতেই ঘিন্না লাগে। তয় প্রেম করুমরে রিফফাত, একটা প্রেমিক ঠিক কইরা দিস তো। আমার এক্স কলিগ হারুনভাই বুদ্ধি দিছিল, একটা বড়লোক বুইড়া দেইখা বিয়া করতে। বুইড়া কয়দিন পর মইরা গেলে শান্তিমতো সংসার করা যাইব।

একটু থেমে লুনা বলে,

–তোরা ভরপুর সুখী মানুষ। আমার কষ্ট কী বুঝবি! এই তো বাড়ি ফিরলেই স্বামী-সংসারে হুমড়ি খাইয়া পড়বি। রাইতে স্বামীরে জড়ায় ধইরা ঘুমাবি। এই দুই পয়সার লুনারে তোর মনেও থাকব না।

লুনা টের পায় রিফফাতের চোখে পানি। লুনার করা ফাজলামো ও আর নিতে পারছে না। কতটা নিগূঢ় বেদনা থেকে লুনা এসব এলোমেলো কথা বলে তা ও নিজেও জানে না। রিফফাতকে চমকে দিয়ে হঠাৎ লুনা বলে,

–আমার কথা নিয়া মন খারাপ করিস না। হাতে টাকা পয়সা নাই। মেজাজ মর্জি ভালা না।

–জানি তো। থাক বাদ দে।

–সবই তো বাদ দিলাম। তবু ইকতেদার ব্যাটারে এক হাত দেইখা নিতে মন চায়।

–ইকতেদার কে?

–আমার এক্স বস। বেশি বেতনের লোভে নতুন চাকরিতে ঢুকলাম। লাভের লাভ কিছুই হইল না। চাকরি তো গেলই। হারামিটা মাসের বেতনও দিল না। মাথার ঠিক থাকে না। তাই তোরে হাবিজাবি বইলা কষ্ট দিয়া ফেলি।

কে কাকে কষ্ট দিয়েছে ব্যস্ত নগরের ভিড়ে দূর থেকে তা বোঝা যায় না। তবে অগুনতি মানুষের মাঝেও এই দুজন নারীর ভেজা চোখে হাতে হাত রেখে মুখোমুখি বসে থাকার দৃশ্যটা দেখে ঠিকই আন্দাজ করা যায়, এদের মধ্যকার বোঝাপড়ার জায়গাটা অনেকখানি দৃঢ়।

৪.

মতিঝিল বাস কাউন্টারের সামনে বাস থেকে নামতে গিয়ে লুনা জুতায় পা বেঁধে পড়ে যায়। বাসের হেল্পার হৈহৈ করে ওঠে,

–আরেট্টু হইলেই তো চাক্কার তলে হান্দাইছিলেন। কইতাছি বাম পা দেন, বাম পা দেন, হালার কে হোনে কার কথা!

নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই লুনা টের পায় জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেছে। নিউমার্কেটের বাইরের দোকানঘর থেকে দেড়শো টাকায় জুতোজোড়া কিনেছিল। কালো রঙের হাফ ইঞ্চি হিলের আর্টিফিসিয়াল লেদারের আরামদায়ক জুতোজোড়া খুব প্রিয় ছিল ওর। সকালে বের হবার সময় একবার বুড়ো আঙুলের কাছে একটা জুতোর বাঁধুনি দুর্বল লাগছিল, ভেবেছিল পরবে না। কিন্তু হঠাৎ মায়ের মুখ খুলতে শুরু করায় তড়িঘড়ি সেই নড়বড়ে জুতো পরেই বের হয়েছিল।

গতকাল রাতের জেরে আজ সাত সকালেও মায়ের মুড খারাপ। পাশের বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়া রিদওয়ানের মায়ের আনা ভালো একটা বিয়ের সম্বন্ধ লুনা গতকাল ফিরিয়ে দিয়েছে। রিদওয়ানের মা বাড়াবাড়ি রকমের পরোপকারী। মহল্লার আট-দশ বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত। এদের সবার ঘরকন্নার তেলজলের হিসেবও মহিলার জানা। লুনার মায়ের সাথে তার বাড়াবাড়ি রকমের ভালো সম্পর্ক। সেই হিসেবে লুনার চিন্তায় রিদওয়ানের মা অস্থির থাকে। লুনার সাথে দেখা হলেই আফসোসের গলায় বলে, ‘এইভাবে কী আর একটা মাইয়ামানুষ বাঁচতে পারে! স্বামী-সন্তান নাই! স্বামী ছাড়া নারীজীবন অচল। তোমার কষ্টডা আমি বুঝিগো।’

এমন আপন গলায় মহিলা কথা বলে যে নিজের দুঃখের ফিরিস্তি শুনে লুনা স্থির থাকতে পারে না। গদগদ গলায় বলে, ‘ভাবী, একটা পোলা দ্যাহেন না আমার লাইগা।’ লুনার নখরামি টের পেয়ে রিদওয়ানের মা প্রতিউত্তর না দিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে এবার রিদওয়ানের মা সত্যিই লুনার জন্য পাত্রের খোঁজ এনেছেন। ভদ্রলোক বিপত্নীক, দুটো বাচ্চা আছে। মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে আর ছেলে কলেজে পড়ে। পাত্রের বৃত্তান্ত শুনে লুনার করা প্রথম প্রশ্নই ওর মায়ের মেজাজ খচে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। তখন লুনা ভাত খাচ্ছিল। জগতের যত জরুরি কথা ওর মা নীলুফার আক্তারের রাতের খাবার খেতে বসলেই সারতে হয়। গতকালও লুনার মা তাই করছিল। লুনা নিজের প্লেট ধুতে ধুতে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,

–কার লগে বিয়া? বেটার লগে? না বেটার পোলার লগে?

–তুই মনে হয় ফিডার খাস? শইলের গরমে বাঁচস না! তরে এই বয়সে বুইড়া ব্যাডা ছাড়া কে বিয়া করব? কচি পোলারাতো বইসা আছে তর লাইগা!

–ক্যান? তোমার কাছে না খবর থাকে আমি হাঁটুর বয়সী পোলাগো লগে ঢলাঢলি করি, তয় আমার লেইগ্যা বউ মরা বুইড়া ব্যাডার সম্বন্ধ আনবা ক্যা?

–খবরদার মুখ খারাপ করাবি না। পারস না তো একটারও গলাত ধরতে। এতদিনে একটারে ধরতি তাইলে বুঝতাম তর শইলের তেজ। অসভ্য মাইয়া পেটে ধরছি।

–বারবার নিজের পেটের দোষ দাও ক্যা? আমার জন্মে তো আমার বাপেরও হাত আছে।

–অই নিজের বাপের নাম তুলবি না। হেয় তো মইরা গিয়া বাঁচছে। আমি যে কবে মরুম।

অনেকদিন পর ঝগড়া শেষে গতকাল মা কেঁদেছে। লুনা এই কান্নার রহস্য জানে। অত বাদানুবাদের পরেও রাতে শোবার পর মা ওর ঘরে এসে নরম গলায় বলেছে, ‘সম্বন্ধডা ভালা। ব্যাডার বিশাল ফ্লাট আছে, গাড়িও আছে। ছেলে তো হোস্টেলে থাকে, মেয়ে শুধু বাপের সাথে থাকে। তোর জীবনডা নিয়া একবার ভাববি না? আর কত ফেলাফেলা করবি?’

মায়ের গলায় আপোষের সুর শুনে লুনা বুঝতে পেরেছিল মা আসলেই চাচ্ছে যে ওর বিয়ে হোক। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেয়া খুব কঠিন লুনার জন্য। রাসেলের সাথে সংসারজীবনের অভিজ্ঞতা আর রাসেলের নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতা ওর মনের মধ্যে বরাবর দ্বিধার কুণ্ডলি পাকিয়ে রাখে। লুনার বুক ঠেলে কান্না আসে। খুব অসহায় লাগে। ওর যেন কেউ নেই, কিচ্ছু নেই! লুনা ভাবে, সৃষ্টিকর্তার হিসেব বরাবর হয় না কেন? দাঁড়িপাল্লার মাপ এক দিকেই কেন বেশি ঝোঁকে? কারও দিকে সুখের ভার, কারও দিকে দুঃখের ভার কেন বেশি থাকে?

লুনা হাঁটছে। কর্মব্যস্ত ঢাকা নিজের চেহারায় ফিরছে। সবারই একটা গন্তব্য আছে। কেবল লুনা জানে না ও আজ কোথায় যাবে। গত দুদিন শপিং মল আর নীলখেতে ঘুরেছে। আজ শ্যামলের অফিসে যাবে নাকি বুঝতে পারছে না। শ্যামলের সাথে ওর কলেজ লাইফ থেকে বন্ধুত্ব। লুনার জন্য শ্যামল নিজের অফিসে চাকরির চেষ্টা করছে। ওদের অফিসে খুব দ্রুত কিছু লোক নিবে। এক সপ্তাহ শ্যামলের অফিসে বসেছে ও। কাজকর্মহীন শ্যামলের রুম বা রিসেপশনে বসে থেকেছে। লাঞ্চের সময় বের হয়ে এসেছে। বিব্রত যে লাগেনি তা না। লুনা উপায়হীনের মতো অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে সময় কাটিয়েছে। সেদিন অবশ্য রিসেপশনিস্ট মেয়েটার হাসির কটাক্ষে পালিয়ে বেঁচেছে। শ্যামলকে না জানিয়ে চলে এসেছিল। শ্যামল ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ করেছে। লুনা সিন করেনি। ফোন করেছে, লুনা ধরেনি। মায়ের কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে, ‘কত ব্যাটা বন্ধু লাগেরে তোর? দিনরাইত খালি ব্যাটারা ফোনে খোঁজে?’

কী করবে লুনা? মরবে? মৃত্যুর কথাও ভেবে লাভ নেই। হাতে রিলিজ লেটার নিয়ে দ্রুতযানের নিচে শরীর পেতে দিলেও নির্ঘাত এই শরীরই ওর সাথে প্রতারণা করবে। ‘কপালে মরণ নাই, উলটা আধা মরা হইয়া ফাইসা যামু’ লুনা হাসে। মৃত্যুকেই সব অপ্রাপ্তির সমাধান মনে করার মতো মানসিক দৈন্যতা নেই লুনার। বরং রিদওয়ানের মার আনা বড়লোক বিপত্নীক পাত্রকে বিয়ে করলে মন্দ হয় না। অর্থযোগ ঘটলে মানসিক পরিতৃপ্তি ঘটবে কি? কিন্তু একটা অচেনা লোক এই বয়সে লুনার শরীরে হাত রাখছে ভাবতেই ওর শরীর রি রি করে ওঠে। উফ! বারবার কেন শরীরসর্বস্ব হয়ে ওঠে লুনার ভাবনা? লুনা রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে নিজেকে সামলায়। কোথায় যাবে ও? নিজের গন্তব্য জানা না থাকলে সময়টা খুব বিচ্ছিন্ন লাগে।

লুনা হাতব্যাগ থেকে টিস্যুপেপার বের করার সময় রিলিজ লেটারটায় চোখ পড়ে। সাদা খামটার ওপরে হলুদ আঙুলের ছোপ ছোপ ছাপ। মায়ের আঙুল! তা হলে মা কি ওর ব্যাগ চেক করেছে? এই কয়টা দিনে মায়ের অতিরিক্ত মুখ খারাপ করার অন্তর্নিহিত কারণ কি এটাই? কিন্তু ইংরেজিতে লেখা রিলিজ লেটার তো মায়ের পড়ে বোঝার কথা না। হয়তো পাশের বাড়ির প্লাবন ছেলেটা পড়ে শুনিয়েছে। এবার একটু হালকা লাগে লুনার। মাকে মুখোমুখি জানালে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ঝড় সামলানো কঠিন হত। তার চেয়ে এটাই ভালো হল। আসলে লুনার জন্য ভালোর মাপকাঠিটা হয়তো বড় ভেবে ভেবে বড় সযতনে তৈরি করেছেন বিধাতা। প্রতি ইঞ্চি ভালোর হিসেব তিনি একেবারে কড়াগণ্ডায় মেপে মেপে করেন।

কী মনে হতে লুনা ব্যাগ থেকে রিলিজ লেটারটা বের করে হাতে নিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়তে থাকে। কাগজের সাদা-হলুদ টুকরোগুলো রাস্তাতে ছড়াতে ছড়াতে খানিক আগের আবেগ বড় তুচ্ছাতিতুচ্ছ লাগে ওর। ভয় পেয়ে জীবন থেকে আর কত পালিয়ে বেড়াবে ও? অনেক হয়েছে, অনেক। আর না।

বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ানোর মতো বেপরোয়া ভঙ্গিতে লুনা সামনে তাকায়। কত মানুষ ছুটছে। যে যার মতো ছুটছে। লুনার হঠাৎ কী হয়, ও ছুটতে শুরু করে। দ্রুত পায়ে। মুহূর্তের মধ্যে ও নিজের গন্তব্য ঠিক করে ফেলে। হ্যাঁ, আজ লুনা ওর পুরনো অফিসের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ ইকতেদার উদ্দিনের মুখোমুখি হবে। নিজের পাওনা টাকা আদায় করেই ছাড়বে, সাথে ওকে ছাঁটাই করার ক্ষতিপূরণও। রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তার লোকজনের নজরে লুনার এই আকস্মিক পরিবর্তন কোনও পৃথক অর্থ বহন করে না। লুনা আবার ছুটতে শুরু করে। সাদামাটা মেয়েটার ছুটে চলা দেখে এই ব্যস্ত নগরের কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায় না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4656 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...