পাগলি

প্রতিভা সরকার

 

কী ঝড়ের দাপট! যেন লণ্ডভণ্ড করে দেবে বলে খ্যাপা ষাঁড় ছুটোছুটি করছে আকাশের এ কোণ থেকে ওই কোণা। টব ওল্টানোর আওয়াজ না পেলে সুতপা বারান্দায় যেতই না। কিন্তু গাছগুলো বড় প্রিয়, তাই ভয়ার্ত পুষির কান্না অগ্রাহ্য করে দরজা খুলতেই হল। হাওয়ার দমক কমে তখনই বৃষ্টির ফোঁটা তেরছা হয়ে তেড়ে এল সুতপার দিকে। তবু সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, চশমার কাচ গলে তার চোখ ভিজিয়ে দেয় বৃষ্টি, নতুন হয়ে ওঠে চোখজোড়া। রেলিংঘেঁষা দেবদারু ডাল এত সজীব দেখায়, যেন সদ্য জন্মাল পাতাগুলো। এত টাটকা আর নির্মল!

তখনই চোখে পড়ল অল্পবয়েসি পাগলিটাকে। শ্যামলা হিন্দিভাষী তরুণী একটা। সারাদিন আপনমনে বকবক করেই চলেছে। বাজারে যেতে, ব্যাংকে যেতে কতবার দেখা দিল সুতপাকে। চারতলার ওপর থেকে এখন ওর কথা কিছু শোনা না গেলেও, দেখা যাচ্ছে অনর্গল ঠোঁট নড়ছে। ওর দেহাতি হিন্দি সে কখনওই বোঝেনি সবটা, কিন্তু নজরে পড়েছে ওর দুহাত ভর্তি লাল সবুজ চুড়ি, যেমনটা পরে নববিবাহিতারা। কালো কোঁকড়ানো একঢাল চুল মাথায়। পরণে আধময়লা সালোয়ার কামিজ। বৃষ্টি ধুইয়ে দিচ্ছে ওর গা থেকে রাস্তার যত নোংরা, ফুটে উঠছে ঢলঢল লাবণ্য, রাস্তা যা এখনও কেড়ে নিতে পারেনি। একবার একঝলক মনে হল ওকে দেখতে যেন হিন্দি সিনেমার কোন ভুলে যাওয়া নায়িকার মতো। এত সরল মুখ, ফুলো ঠোঁট আর বঁড়শির ডগার মতো বাঁকানো কালো চোখের পাতা! প্রথমদিন ব্যাগ খুলে টাকা দিতে গেলে ও নেয়নি। হাতদুটো কনুই থেকে ভেঙে নমস্কার করে বলেছিল, হমরা না চাইও। দুদিন পরে অবশ্য নিয়েছে। নিয়েই ছুট লাগিয়েছে চায়ের দোকানে। সুতপা বোঝে ওর চায়ের নেশা আছে তারই মতো।

তবে কি গায়ের রঙ কালো বলে ওকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল! সুমন খচে বোম ওর প্রশ্ন শুনে।

–আমি জানব কী করে! তাজ্জব বাত। অফিস থেকে ফিরে এই তো লিংকগুলো দেখছি, এখন পাগলির ঠিকুজিকুষ্ঠী নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে!

মুখঝামটা খেয়ে সুতপার আরও মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু এইরকম সম্ভাবনার কথা সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না কিছুতেই। মাকে ছোটমাসির সঙ্গে বলাবলি করতে শুনেছিল একবার। গ্রামে গঞ্জে নাকি রেওয়াজ আছে বৌ পছন্দ না হলে, বা দেনাপাওনা মনের মতো না হলে, জড়িবুটি খাইয়ে পাগল বানিয়ে দেয়। তারপর পাগল বৌ কোথায় গেল, কী করল, সে আর কেইই বা দেখতে যায়! এখনও মনে পড়ে কী ভয় পেয়েছিল সুতপা একথা শুনে। বড় বড় চোখ করে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,

–সত্যি মা, এইরকম করে! কী নিষ্ঠুর! আমাকে কখনও বিয়ে দিও না মা।

ছোটমাসি ওমনি ঝামড়ে উঠেছিল,

–ছোড়দি, তোর মেয়েটা বড্ড পেকে গেছে। এই তুই যা তো যা এখান থেকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে বড়দের কথা শোনা হচ্ছে!

আজ অনেক দিন পরে ঝড়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুতপার ছোটমাসিকে মনে পড়ল, কারণ গত মাসে ক্যান্সারে মারা গেল ছোটমাসি। খবরটা শুনে চুপি চুপি অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সুতপা। অবশ্যই সুমন ফেরবার আগে। এইসব দুঃখ বড় ব্যক্তিগত বলে মনে হয় এখন। মা বাবা ছোটমাসি ঠাম্মা আরও অনেককে নিয়ে সেই ছোট্ট সুতপা আর এই সুমনের বৌ সুতপা দুজনে যেন একেবারে অন্য মানুষ। কোথাও কোনওকালে তাদের মধ্যে একটা লঝঝড়ে বাঁশের সাঁকোও ছিল না যেন।

কিন্তু উথালপাথাল ঝড়ের মধ্যে লালসবুজ চুড়ি পরা পাগল মেয়ে কালো ঢেউখেলানো মেঘের পাহাড় মাথার পেছনে নিয়ে ধুলো, কুটো, পাতা আর ছেঁড়া কাগজের ঘূর্ণির ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি নামল, তবু দাঁড়িয়ে! কী করছে ও ওখানে! সুতপা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। একটা গরু খানিক দূরে উদভ্রান্তের মতো ভয়-পাওয়া গলায় ডাক ছাড়ছে। ঝড়ের আওয়াজ ভেদ করে যতবারই গম্ভীর গর্জন উঠছে– হাম্বা, ততবারই পাগলি ডাকছে, আঃ আ যা।

সুতপা বুঝল এই মেয়ে সত্যিই কোন দেহাতি সংসার থেকে বোঁটাছেঁড়া ফুলের মতো ঝোড়ো হাওয়ায় আছাড়িপিছাড়ি খেতে খেতে ভেসে উঠেছে তাদের এই আপাতসম্ভ্রান্ত এলাকায়। আকাশে মেঘ করলে ভীত পোষ্যকে আশ্বাস দেওয়া আর কিই বা প্রমাণ করে। ওলটানো টবের সামনে দাঁড়িয়ে ভাঙা পাতা আর ফুল দেখতে দেখতে সুতপার মন অভাগা মেয়েটার জন্য মায়ায় ভরে উঠল।

আহা রে!

সুমন অফিসে চলে গেলে আজ সুতপা বাজার যাবে ঠিক করল। মেথি ফুরিয়ে গেছে। আর তেজপাতা। মেথির সঙ্গে সর্ষে ফোঁড়ন দেওয়া শুক্তো সুমনের দারুণ পছন্দ। আদা দিতে হবে আর নামানোর আগে একটু দুধ। গরমে এই স্বাস্থ্যকর তরকারিটি সুমন প্রায়ই বানাতে বলে। সুতপা বানায়, কারণ বিয়ের পাঁচ বছর বাদেও ছেলেপুলে না হওয়ায় তার কাজ কিছু কম। এই তল্লাটে লোকে প্রতিবেশী কাকে বলে তা জানে না, তাই সুতপার কিছু সুবিধে হয়েছে। তাদের টাউনে এতদিন বহু লোক জিজ্ঞাসা করত বাচ্চা হচ্ছে না কেন।

কিন্তু প্রথম প্রথম এই কাউকে না চেনা পরিবেশে তার অসুবিধে হত। কী করে যে সবাই এক পাড়ায় থাকে, বিয়েশাদিতে অনেক লোকজন গাড়ি করে আসে, কিন্তু পাশের বাড়ির লোক কিছু জানতে পারে না! আশ্চর্য হওয়া কিছু বাকি ছিল, তাই হাউজিং কমপ্লেক্সে শববাহী গাড়ি এসে দাঁড়াতে সে কৌতূহলী হয়ে তার চারতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। দেখে তার ঠিক মাথার ওপরের ফ্ল্যাটের যে বৃদ্ধ রোজ মর্নিং ওয়াকে যেতেন, তার মৃতদেহ সাদা চাদরে জড়িয়ে গাড়িতে তুলছে সম্পূর্ণ অচেনা কিছু লোক। পাকা চুল ভর্তি মাথাটা দোল খাচ্ছে, যেন চলে যেতে খুব অনিচ্ছা ওর।

–ওনার কি কেউ ছিল না সুমন?

–আমি জানি না। এই পাঁচ বছর এখানে এসেছি, একবারের জন্যও কথা হয়নি, জানিও না কিছু।

–কী আশ্চর্য! এখানে পাশের বাড়ি ব্যাপারটা নেই। আপদে বিপদে পাশে দাঁড়াবে কে!

–এ কি তোমার মফস্বল পেয়েছ? এখানে সব ব্যবস্থা থাকে। তবু আত্মীয়স্বজন খবর দেবার কেউ না থাকলে মড়া ঘরে পড়ে থাকে, গন্ধ বেরুলে পুলিশ আসে। আবার কী!

গা গুলিয়ে উঠেছিল সুতপার। বিয়ের আগেই যখন মা চলে গেল তখন পুরো পাড়া ভেঙে পড়েছিল তাদের বাড়িতে। পায়ের পাতার নিচ আলতা দিয়ে লাল টুকটুকে করে দিয়েছিল পাশের বাড়ির মিনু কাকিমা। পাড়ার কাকুরাই বাবাকে আগলে রেখেছিল। কতবার এসে সবাই খবর নিয়ে গেছে। এখন যে বাবা একা থাকে সেও তো ওই পড়শিদের ভরসায়।

–যাই বলো বাপু, আমার মফস্বলই ভালো তবে।

–কীসে ভালো? রাস্তাঘাটের যা ছিরি। কলকাতার সঙ্গে কানেক্টিভিটির কী অবস্থা! একটা ভালো স্কুল নেই, সিনেমা হল নেই। শুধু পাড়া থাকলেই হল। আর তোমার কলেজটা! প্রত্যেকদিন কী আনরেস্ট! ছাত্র টিচারকে কেলাচ্ছে, টিচার ছাত্রনেতার নামে শিক্ষামন্ত্রীকে নালিশ করছে। সব ঢপের চপ একেবারে।

–আর তোমার কলকাতার কলেজগুলো? সব ধোয়া তুলসীপাতা বুঝি?

সুতপা একটুও না রেগে সহজভাবে জিজ্ঞাসা করে। এই চার বছরে সুমন সম্বন্ধে তার একটা ধারণা হয়ে গেছে। বদরাগী, ক্যাটক্যাট করে কথা বলে, কিন্তু মানুষ খারাপ নয়। সরল, ভোজনরসিক তার বর অফিস আর বাড়ি ছাড়া কিছু বোঝে না। নিজেই ইউ টিউব থেকে সালমাজ কিচেন নামে এক রান্নার লিঙ্ক নামিয়েছে। সেই রেসিপি অনুযায়ী রান্না ভালো হলেই সে মহা খুশি। আর কাঁচা ঘুম ভাঙালে বা খেলা দেখার সময় টিভির রিমোট চাইলে তুলকালাম বাঁধাবে। এছাড়া আর কোনও বায়নাক্কা নেই তেমন।

বরং সুতপার অনেক ছিল। কলকাতায় শিক্ষিত সুচাকুরে বরের সঙ্গে থাকবে জেনে কী খুশিই না হয়েছিল সে। প্রথমেই দেবশংকর হালদারের সব নাটকগুলো দেখবে ভেবে নাচানাচি করে নিল মনে মনে। তারপর উইকএন্ডে বেরিয়ে পড়া, ভালো সিনেমা, কলেজ স্ট্রিট ভর্তি বইয়ের গন্ধ, এইসবের মধ্যে তার মন থেকে এই চিন্তা উধাও হয়ে গেছিল যে বাবা একা একা থাকবে। বাসিবিয়ের দিন সকাল থেকে বাবাকে শুকনো মুখে ঘুরতে দেখে বুকের ভেতরটা যেন মুচড়ে মুচড়ে উঠেছিল। ভেবেছিল কিছুদিন বাদে বাবাকে বলবে এখানকার পাট তুলে চলে যেতে তার কাছে। এখন বোঝে তা হয় না। বাবা সাকুল্যে দুবার এসে যাবার জন্য ছটফট করেছে, তারপর আর আসতে চায়নি। সুমনের আনমনা উদাসীন ভাব দেখেই কি, নাকি বাগানের গাছ, ভুলি কুকুর আর খাঁচার টিয়ার জন্য তা সুতপা জানে না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে বাবা হা হা করে হেসেছে আর বলেছে,

–ওই ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে এই মফস্বলীদের মানায় না মণিমা। তাছাড়া আমারও দম বন্ধ হয়ে আসে রে, তোদের ওখানে সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠল দেখতে পাই না। আর এই পুষ্যিগুলি! মা যে আমার ওপর সব ছেড়ে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে কেটে পড়ল!

এইসব ভাবতে ভাবতে সুতপা ব্যাগটা হাতে নেয়। চুলটা অল্প ঠিক করে দরজার ল্যাচ কি টেনে দেয়। গেটে দারোয়ান থাকে চব্বিশঘণ্টাই। রাতে চেয়ারে বসে ঢোলে ঠিকই বন্ধ গেটের ওপাশে, কিন্তু সারারাতই থাকে।

গভীর রাতে মরে গেলেও অচেনা মুখকে গেট খুলে না দেবার হুকুম আছে ওদের ওপর।

এখন গেট দিয়ে বেরিয়ে সুতপা সামনের রাস্তা ক্রস করল, তারপর ডিভাইডার। অতটা ঘুরতে চায় না বলে ডিভাইডারে ওপর অবলীলায় উঠে পড়ে ত্রিশের ছিপছিপে সুতপা, দেখে মনে হয় যেন চব্বিশ পঁচিশের কোনও তরুণী। গরম হাওয়ায় তার টকটকে ফর্সা মুখ লালচে হয়ে ওঠে। এপাশের রাস্তা পেরোলেই গোল চাতালঘেরা বাজার। ঢোকার মুখে পানের দোকানের নিচের চাতালে বসে শালপাতার মোড়কে কিছু খাচ্ছে পাগলিটা। সুতপাকে দেখেই একগাল হাসে। মেজাজ বহোত খুশ মালুম হোতা হ্যায়, সুতপা ভাবে ওকে বলবে, কিঁউ কি, আজ জলদি জলদি খানা মিল গ্যয়া।

–দিদি…

চোখে চোখ পড়তেই পাগলি এঁটো হাত তুলে ডাকে সুতপাকে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বলে,

–আবো আবো ইঁহা। হমরা সাথমা খায় লা।

অবলীলায় শালপাতা থেকে ডালমাখানো পুরীর টুকরো তুলে ধরে মেয়েটা। পানওয়ালা ওর কাণ্ড দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে। কিই বা করেছে সুতপা ওর জন্য! মাঝে মধ্যে দু দশ টাকা দিয়ে বলেছে, চায়ে পি লেনা। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে পুরনো সালোয়ার কুর্তা দিয়েছে দু একবার, ওর দাগ লাগা জামার পেছন দেখে। বিশেষ করে যেদিন চায়ের দোকানের ছেলেদুটো আঙুল দিয়ে ওর পেছনটা দেখিয়ে অশালীন ইঙ্গিত করছিল।

যুবতী মেয়ে, ঘরছাড়া হলেও এই ল্যাঠাগুলো তো মিটে যায় না। প্যাকেটটা পেয়ে মেয়েটা ভারি খুশি হয়েছিল। অনেককিছু বকবক করল নিজের মনেই, যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছিল সুতপা তাতে বুঝেছিল ও এসেছে বহোত দূর গাঁওসে। আর এখানে ওর খেয়াল রাখবে এমন কেউ নেই।

সেই কৃতজ্ঞতাতেই এমন এঁটো খাওয়াবার চেষ্টা কিনা বুঝবার ফাঁকেই পাগলি উঠে এল সুতপার কাছে। কুকুরগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল শালপাতাটার ওপর। সুতপা হাঁ হাঁ করে উঠতেই, রানির মতো তাচ্ছিল্যভরে হাত নেড়ে পাগলি বলল,

–ছোড়ো ছোড়ো। দিদি শুন। বাজারমা দেখিশুনি যাইও। চায়ে কা দুকানমা যে দুগো ছোঁড়া ছায় উ দোনো বড়া খারাব ছে। কাল পুরা রাত হামর পিছু পিছু ঘুমলছে। হাম্মা খেতারি খেত মা লুকাইকে বচ লিয়ো। খেতারি, খেতারি– দুসরা নাম গন্না।

সুতপাকে হাত পা নেড়ে খেতারি কথাটার মানে বোঝায় মেয়েটা।

এই না হলে পাগলি! কোথায় কোন গ্রামের মেঘলা আকাশ অব্দি ছড়ানো ঢ্যাঙা গন্না বা খেতারি বা আখের খেত, হাওয়ায় দুলতে থাকে ঘোমটা পরা মেয়েদের মতো, আর কোথায় বিশাল বিশাল অট্টালিকাময় এ পাষাণপুরী।

কিন্তু হাঁসের মতো জল থেকে দুধটুকু ছেঁকে নিলে যা দাঁড়ায় তাতে দুশ্চিন্তা হল সুতপার। শেয়াল কুকুর লেগেছে পিছে।

লাগবেই। এ তো অবধারিত। প্রথম যেদিন দেখে, সেদিনই সুতপা ওর কী হবে ভেবে আঁতকে উঠেছিল। এই রাস্তাটায় মাঝেমাঝেই বড় বড় ট্রাক এসে দাঁড়ায়, পাশের খালি জমিটায় বিরাট সরকারি বাড়ি উঠছে। তারই সব মালমশলা বোঝাই করে। সারা রাত ট্রাকগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। মর্নিং ওয়াকে গিয়ে সুতপা ড্রাইভারদের চায়ের দোকানে দেখেছে। আবার যাত্রা শুরুর আগে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া। কিন্তু প্রত্যেক ট্রাকেই কেবিন থাকে। দরজা বন্ধ করে সেখানে মস্তি করে অনেকে, রাস্তা খালি থাকলে বর্শার ফলার মতো ছুটে আসা সিটি অভিজাত এলাকার নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয় কাচ ভাঙার মতো, এ সুতপার নিজস্ব অভিজ্ঞতা। সেইখানে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে এই রূপবতী পাগলি!

মাঝের দুচারদিন বেরনো হয়নি সুতপার। সর্দিজ্বর মতো হয়ে বেজায় কাহিল সে। তাছাড়া বেরনো হয় কালেভদ্রে। একা ঠেঙিয়ে রবীন্দ্র সদনে নাটক দেখে আসা সম্ভব নয়। তবে কলেজ স্ট্রিটে মাঝেমধ্যেই যায় সুতপা। প্রাণ ভরে বই কেনে। ওই তো তার একমাত্র আনন্দ। অনেক শনি রোববারেও সুমন অনেকদিন ব্যস্ত থাকে। ফলে বিয়ের পর সিমলা আর বছরে দু একবার পুরী, মন্দারমণি ছাড়া বাইরেও তেমন যাওয়া হয়নি সুতপার। শহরে একা কোথাও যাওয়াতে কোনও বিধিনিষেধ নেই তার ওপর। আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি– গুনগুন করতে করতে একটু বিষণ্ণ হাসে সুতপা।

হঠাত সেদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধেয় সুমন বলল,

–কাল জরুরি কাজে দার্জিলিং যাচ্ছি। সি এম হঠাৎ যাবেন ঠিক করেছেন। টেম্পারেচারটা চেক করে সুটকেস গুছিও। মনে হয় না এখন খুব বেশি গরম জামা দরকার হবে।

কাজকাম সেরে সুতপা শোবার ঘরে ঢুকে দেখল সুমন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাইরের ঘরের সোফায় তেমনি গোল হয়ে ঘুমোচ্ছে তার পুষি। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা কাকের ঠোকর খাওয়া একটা রক্তাক্ত বেড়াল বাচ্চা। এখন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। এত জরুরি কাজ, যে তিনমাস আগে থেকে ঠিক করা আছে কাল ওরা ডাক্তার দেখাতে যাবে সেটাও ভুলে মেরে দেওয়া যায়! এই ডাক্তারবাবু আই ভি এফ স্পেশালিস্ট। আবার ডেট পেতে পেতে কম করেও তিন চার মাস। দারুণ অভিমান হয়, তার অভিমানের মূল্য দেবার কেউ নেই জেনেও। শুধু আজ রাতে ঘুম আসবে না এটা সে বুঝে যায়। তাই খুব সাবধানে সুতপা দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রাতের ঠান্ডা হাওয়া তাকে খুব আদর করতে থাকে। সব দুঃখ একাকীত্ব ভুলবে বলে সুতপা কোমর অব্দি ঝুঁকে পড়ে রেলিঙের ওপর। আরও হাওয়া এসে বিলি কাটে কপালের ওপর তার ঘর্মাক্ত খুচরো চুলে। মাথার ওপর লতানে গাছের আড়ালে মৃদু আলো দেয় শখ করে লাগানো অল্প পাওয়ারের নীল বাতি। বাইরেটা শান্ত, রাস্তার ওপারে একটা বিরাট ডুমুর গাছের গায়ে গা লাগিয়ে উঠে গেছে লম্বা বাতিদান। তিনটে সাদা আলোর গায়ে পোকার ওড়াউড়ি, তবে পাতার ফাঁকে চুইয়ে নেমেছে বলে আলো আর অন্ধকার বেশ বন্ধুর মতো গলাগলি করে রয়েছে। হাউজিংয়ের গেটের দুপাশে দুটো সাদা গোল আলো। তালা পড়ে গেছে বহু আগেই। গার্ডরুম থেকে হালকা আলো পড়েছে গেটের গায়ে।

শান্ত আরামের একটা ভাব সুতপাকে লতানে গাছের মতো জড়িয়ে ধরছিল, হঠাত যেন কানে এল আর্তচিৎকার, অথচ চিৎকার নয় এইরকম একটা দম চাপা আওয়াজ,

–দিদি…

প্রথমে সুতপা ভাবল কানে ভুল শুনেছে সে। চারপাশে ভালো করে খুঁজে দেখল। প্রথমে তো চোখেই পড়েনি, ডুমুর গাছটার গায়ে টিকটিকির মতো সেঁটে রয়েছে পাগলি। কোঁকড়া চুল উড়ছে হাওয়ায়, কালো শরীরে ছায়া ছায়া আলো। দূর থেকে বোঝাই যাচ্ছে না ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এত উঁচু থেকে কথা বললে চেঁচাতে হয়। পিঠের পেছনে আবজানো দরজা, তার ওপাশে নাক ডাকছে যে মানুষটি তাকে কাল ভোর পাঁচটার ফ্লাইট ধরতে হবে। তাই দুটো আঙুল নিচে আর তিনটে ওপরে তুলে সুতপা নিঃশব্দে জিজ্ঞাসা করল,

ক্যা হুয়া?

উত্তরে পাগলি কিছু হাতের মুদ্রায়, কিছু শরীরের ভঙ্গিতে, কিছু চাপা শব্দে যা বলল তার বাংলা করলে এই দাঁড়ায় যে চায়ের দোকানের দুটো ছেলে আজও তার পিছু নিয়েছে। হাতদুটোতে স্টিয়ারিং চালাবার ভঙ্গি করায় বোঝা গেল ট্রাক ড্রাইভারও দু একজন যোগ দিয়ে থাকতে পারে এই শিকার খেলায়। কিন্তু সেদিনের মতো আজ আর পাগলি খেতারি বা গন্না খেত খুঁজে পাচ্ছে না। তাই সুতপার কাছে তার আকুল আর্তি খেতারি খেত হমে দিখলাও দিদি। বলতে বলতে পাগলি বার বার রাস্তার মুখের দিকে ফিরে তাকাচ্ছিল।

সুতপা বুঝতে পারছিল ওর সারা শরীর কাঁপছে, যেমন ঝড়ে কাঁপে পাখির বাসা। কী করবে ঠিক করে উঠতে পারার আগেই মোড়ের মুখে পায়ের আওয়াজ, যেন একাধিক লোক দৌড়ে এদিকেই আসছে। পাগলিও শুনেছে। তার সারা শরীর মুহূর্তে টান টান হয়ে গেল একটা মরিয়া শেষ দৌড় শুরু করবার জন্য। কিন্তু তার আগেই উড়ে এল শিসের আওয়াজ, গুলতি থেকে ছোঁড়া পাথর উড়ে এসে আলো ভেঙে দিল খানখান। স্প্রিন্ট্রারের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল পাগলি। যাবার আগে চিল চিৎকারে বলল,

–দিদি, লুকাইবে কাঁহা? হামরো খেতারি কা খেত ঘুমাই দো।

সে চিৎকার সুতপা শুনল। রাতজাগা পাখিরা বাসায় নড়েচড়ে বসল। ঘুমন্ত গার্ডও শুনেছে। কারণ এই প্রথম তার গলাখাঁকারির শব্দ শোনা গেল। কথাগুলো পেছনে ছোটা হন্তারকেরাও শুনল। শুনে সুতপার দিকে অশ্লীল হাসি ছিটিয়ে গেল গুটখামাখা গোলাপি থুথুর মতো। কিন্তু আখের খেতের ধারঘেঁষা মাটির দাওয়া যেখানে ঘর্মাক্ত বর গামছার হাওয়া খেতে খেতে বসবে, দজ্জাল শাশুড়িকে এড়িয়ে নজর মেলাবে নববধূটির সঙ্গে বা তিরছিয়া নজরের আড়ালে বিষ মিশিয়ে রেখে ফন্দি আঁটবে কালো বৌকে হারানোর উদ্দেশে ট্রেনে তুলে দেবার– এর কোনওটিই ফিরিয়ে দেবার সাধ্য এদের কারওই ছিল না।

ঘরে এসে কাঁপা হাতে ১০০ ডায়াল করতে করতে সুতপা টের পেল কখন কান্না শুকিয়ে তার সমস্ত শিরা উপশিরায় চলাচল করতে শুরু করেছে গলানো লাভার মতো ঘেন্নার আগুন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...