যা কিছু শোভন — শোভন মুখার্জির কথা

শোভন মুখার্জি

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

শোভন মুখার্জি।

বছর বাইশ বয়স। কলেজে পড়া, আড্ডা মারা, হাসিমাখা একটা মুখ। অনর্গল কথা বলে যাওয়ার অভ্যেস। এ বয়েসের ছেলেদের যেমন থাকে। তবু এই ছেলেটা অন্যরকম। হাসি, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, আড্ডার মধ্যে এই ছেলেটা এমন একটা কিছু করে ফেলেছে যা বড় বড়দের অনুপ্রাণিত করতে পারে, জেগে উঠতে বাধ্য করতে পারে, লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।

 

পড়াশোনার চাপে নাটকের জগৎ ছাড়তে হল যখন, চঞ্চল এই ছেলে ভিন্ন স্বাদের গল্প-তথ্য নিয়ে একটি পত্রিকা তৈরি করার কাজে নামল। সেই পত্রিকার কাজে নেমে তার পরিচয় হল কলকাতার তৃতীয় লিঙ্গ পরিবারের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে শোভন জানতে পারে, রাস্তাঘাটে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো উপায় নেই তাদের। কোনও সুলভ শৌচালয়ে নেই তাদের জন্য কোনও সুবিধা। কাজে নামে শোভন। না, প্রত্যেকটি সুলভ শৌচালয়ের পাশে আরেকটি করে আলাদা শৌচাগার তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি তার। প্রথমত, তাতে খরচা বেশি। দ্বিতীয়ত, আলাদা শৌচাগার মানেই সমাজ থেকে সরিয়ে রাখার আরেকটি উপায়। শোভন নিজের পত্রিকা বিক্রি করে, স্টিকার ছাপতে শুরু করে। কাউন্সিলারদের সঙ্গে কথা বলে বলে প্রত্যেকটি সুলভ শৌচাগারের ছেলেদের এবং মেয়েদের অংশে একটি করে কিউবিকেলে একটি করে স্টিকার লাগাতে শুরু করে। মাত্র ১০ টাকায় সমস্যার সমাধান। আস্তে আস্তে একটি একটি করে শহরের কয়েকটি শৌচাগার হয়ে ওঠে “gender inclusive”– সর্ব লিঙ্গের জন্য খুলে যায় দ্বার। এই উদ্যোগের নাম রাখা হয় ত্রিধারা।

সেই পত্রিকার কাজ করতে করতেই একদিন এমন একটি ঘটনা ঘটে, যাতে শোভনের কাজে আরও একটি মাত্রা যোগ হয়ে যায়। দলের একটিমাত্র মেয়েটি ‘শরীর খারাপ’ বলে একটি মিটিংয়ে আসতে পারেনি। শোভন বুঝতে পারে আসল কারণ। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অন্য চিন্তা। ঋতুস্রাবের সময়টা অধিকাংশ মেয়ের জন্য কষ্টকর সেটা বুঝতে পারে সে। রাস্তাঘাটে কারও দরকার পড়লে কী হতে পারে, যাদের স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার পয়সা নেই, তারাই বা কী করে এই ভাবতে ভাবতে নতুন কাজের দায়িত্ব নেয় শোভন। না, কেউ বলে দেয়নি তাকে। এই শহরের প্রত্যেকটি সুলভ শৌচাগারে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখতে হবে। সেগুলি পাওয়া যেতে হবে যতটা সম্ভব কম দামে– এটাই লক্ষ্য।

আগেরবারের মতোই, ১১২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে শুরু হয় কাজ। তারপর দেখতে দেখতে শহরের তিরিশটি সুলভ শৌচাগারে প্রত্যেক সপ্তাহে ৫০টি করে স্যানিটারি ন্যাপকিন রেখে আসা শুরু করে শোভন। পাইকারি দামে কিনে, মাত্র দুটাকায় এক একটি করে ন্যাপকিন বিক্রি করা হয়। বলাই বাহুল্য, বাকি পয়সা যায় পত্রিকা বিক্রির টাকা এবং শোভনের হাত খরচ থেকে।

“প্রথমে কলকাতার ১৫০টি সুলভ শৌচালয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বাক্স বসানো তারপর কলকাতার বস্তি এলাকায় এমন একটা জায়গা বানানো যেখান থেকে মেয়েরা সহজে স্বল্প মূল্যে ন্যাপকিন নিতে পারবে… গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ব্যবস্থা এবং ‘periods book’ (মাসিক পত্র) রাখা যাতে মেয়েদের কাছে সময়মতো ন্যাপকিন পৌঁছে যায়… শুধু ন্যাপকিন ব্যবহার নয় তাদেরকে ঋতুস্রাব বিষয় সঠিকভাবে পথ দেখাতে হবে। আমার অনেক কাজ বাকি।” বলছে শোভন। “মা বাড়িতে সাহায্য করে, বাবা অফিসের ব্যাগে ন্যাপকিন নিয়ে গিয়ে অফিসের রাস্তায় পড়া শৌচাগারগুলিতে দিয়ে দেয়। প্রথম যেদিন বাড়িতে এই কাজের কথা বলি, সত্যি বলছি দ্বিধা ছিল। ঋতুস্রাব নিয়ে ছেলে হয়ে মা-বাবার কাছে কী বলব ভাবছিলাম। মা খুশি হল, বাবা বলল আগে বললে খানিক টাকা আমিই দিতাম! ওদের ছাড়া এগোতে পারতাম না।”

এবার বোধহয় আমাদের পালা। শোভনের হাত ধরে ওর কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। যদি আপনারা কেউ ওর পাশে দাঁড়াতে চান, ওর কাজে সাহায্য করতে চান, এই লিংকটিতে গিয়ে তা করতে পারেন।

ওর ফেসবুক পেজ-ও দেওয়া থাকল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4657 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...