“জীবনের জন্য, ভালোবাসার জন্য আমাদের এ গান গাওয়া…”

কৌশিক দত্ত

 

গানটা বহু পুরনো, কিন্তু আঠারো না পেরিয়ে আমার শোনা হয়নি। আড়াই দশক আগে প্রথম গাইতে শুনেছিলাম দাদা-দিদিদের। প্রত্যাশা ছিল লাশকাটা ঘরে ফর্ম্যালিনের ঝাঁঝালো গন্ধের, বিপুল পাঠক্রম, অচেনা শহুরে পরিবেশে অপরিচিত মানুষজনের উন্নাসিক ব্যবহার, প্রতিযোগিতা, অসহযোগিতা, খবরদারি, এমনকি র‍্যাগিং-এর। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে ঢুকে দেখলাম অন্য মানুষের দেশে এসে পড়েছি। তারা জোট বাঁধে, হাসে, গান গায়, হাত ধরে টেনে তোলে, কাছে টেনে নেয়। তারা বাঁচে এবং বাঁচতে শেখায়, বাঁচাতে শেখায়। গিয়েছিলাম পড়তে, কিন্তু বিধিবদ্ধ ক্লাস শুরু হবার আগেই পরিচয় হয়ে গেল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে, জীবনের পাঠ শুরু হল এক অভিনব পাঠশালায়। রাজনীতি পেশা হয়ে ওঠেনি, সমাজ বদলের নিষ্ঠ সৈনিকও হতে পারিনি। ডাক্তারি পড়াতেই ব্যয় হয়েছে ছাত্রজীবনের অধিকাংশ সময় ও শক্তি, পরবর্তী জীবন গেছে “রেস্কিউ ফ্যান্টাসির” পিছনে তাড়া করে মানুষ বাঁচানোর খেলায়। কিন্তু শিক্ষার এক মূল্যবান অংশ পেয়েছি ক্লাসের বাইরে। মানুষ বাঁচানোর টুকিটাকি টোটকা শিখিয়েছে প্রথাগত পাঠক্রম, আর বাঁচা বা বাঁচানোর অর্থ, টোটকার সীমাবদ্ধতা শিখিয়েছে সেই গাইয়ের দল। রাজনীতি সম্বন্ধে তাত্ত্বিকভাবেও বিশেষ কিছুই শিখে উঠতে পারিনি, কিন্তু রাজনীতিবোধ বাঁধা হয়ে গেছে সেই সুরে, দু’জোড়া শব্দে… “জীবনের জন্যে, ভালোবাসার জন্যে”।

আমার মতো অসংখ্য ছেলেমেয়ে, যারা অতি সাধারণ হবে জীবনে, বড় মাপের তেমন কিছু করতে বা ভাবতে পারবে না, তাদের মনেও এই সুরটুকু সঞ্চারিত হওয়া প্রয়োজন, যদি আগামী পৃথিবী মানুষের হতে হয়। ছাত্রজীবনেই এই জীবনপাঠ অন্তত শুরু হওয়া দরকার, যাতে খারাপ হতে হতেও খুব খারাপ হবার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলে। এর বিপ্রতীপে থাকে, “আত্মমগ্ন বিমুখ যেজন বৃহৎ জগত হতে, সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে।” ছাত্র রাজনীতি সম্বন্ধে মাত্র এইটুকু কথাই আমি জানি।

এই মুহূর্তে এই লেখাটির প্রেক্ষিত দুই বিশ্ববিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ে ঘটে চলা দুটি ছাত্র আন্দোলন। একটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার মৃত্যু পরোয়ানার বিরুদ্ধে, অন্যটি কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভরা বর্ষায় কিছু ছাত্রের আশ্রয়ের দাবিতে। প্রথমটি বহু আলোচিত প্রত্যাশিতভাবেই। বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক বর্তমানের ক্ষেত্রে যাদবপুর গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভবিষ্যতের মানচিত্রে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তুল্য রাজনৈতিক গুরুত্ব যাদবপুরের, জ্ঞানের চর্চাতেও এরা তুলনীয়। এখানকার আজকের ছাত্রছাত্রীরা আগামী দিনের মনন-চিন্তনের অগ্রপথিক, ওপিনিয়ন লিডার। সুতরাং সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষ, সকলের দৃষ্টি যাদবপুরে নিবদ্ধ থাকাই স্বাভাবিক। একে আমি সুলক্ষণই বলব, কারণ যাদবপুর নিয়ে সংবাদমাধ্যম আর সোশাল মিডিয়ায় অন্তত কিছুদিনের জন্য এই প্রবল আলোচনা আধাঘুমন্ত জনমানসে খানিক (হয়ত ক্ষণিক) চেতনার সঞ্চারে সহায়ক হবে। উপরন্তু যাদবপুরের আন্দোলনের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চশিক্ষার অধিকার, মেধা, পরীক্ষা, নম্বর, আশাপূরণ বা আশাভঙ্গ, সুযোগ পাওয়া বা না পাওয়া, ইত্যাদি নিয়ে অজস্র মানুষের কিছু ভাবনা বা অভিজ্ঞতা আছে। তাঁরা কিছু বলতে চাইছেন এবং বলছেন। এই চলমানতা, এই বহুস্বর, অতি শুভ।

মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনের কারণটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘রোটি, কাপড়া ঔর মওকান’-এর মৌলিক গুরুত্ব এমনকি রূপকথার ব্যবসায়ী বলিউডও স্বীকার করেছে। দূরের জেলাগুলি থেকে আসা সাধারণ পরিবারের কিছু ছাত্র এই মহানগরে ডাক্তারি পড়তে এসে দুই বছরেও মাথা গোঁজার জন্য একটি সরকারি জায়গা পায়নি। এমবিবিএস পাঠক্রমের সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা নির্দ্বিধায় মানবেন যে করিমপুর বা মহিষাদল থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে ডাক্তারি পড়া সম্ভব নয়। অপরিচিত (এবং অনেকের কাছে মহার্ঘ) শহরে দুই বছরের বেশি সময় তারা কীভাবে কাটাল, পড়াশুনার সুযোগ পেল কিনা, বাসার ভাড়া গুনতে পরিবারকে জমি-বাড়ি বন্ধক দিতে হল কিনা, তার খোঁজ রাখার দায়িত্ব কলেজ, রাজ্য বা দেশের প্রশাসকদের নেই বা ছিল না। এতদিন পরে একটি বৃহদাকার নতুন হস্টেল বাড়ি চালু হচ্ছে এবং সেখানে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জায়গা দেবার পরেও বিপুল সংখ্যক শয্যা খালি পড়ে থাকবে বলে, সেখানে ঠাঁই চাইছিল তারা। হস্টেল মানে হিন্দি সিনেমার ঝকঝকে সেট নয়। আমাদের দেওয়া হয়েছিল একটি ঘরের এক কোণে আনুমানিক ত্রিশ বর্গফুট জায়গায় একটি কাঠের চৌকি এবং একটি টেবিল। ব্যস! এটুকুই চাহিদা।

বিষয়টা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যত মানুষের পরিচয়, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে বাসস্থানের সংকট নিয়ে। অথচ সাধারণ মানুষ এই ঘটনার সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারলেন না, আগ্রহ দেখালেন না। কলেজের অধ্যক্ষ আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পুলিশ ডাকলেন, জনা চল্লিশেক ছাত্রছাত্রীর শান্তিপূর্ণ অবস্থান হঠানোর জন্য তার দ্বিগুণ সংখ্যক পুলিশের বাহিনী এল, শারীরিক বলপ্রয়োগে ছাত্রদের “শাসন” করা হল, যার পরিণতিতে ভাঙা অথবা বেঁকে যাওয়া পা নিয়ে, অন্ত্র বা যকৃতে আঘাত নিয়ে ছাত্রদের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হতে হল, অথচ ২০১৪ সালে এরকম কিছু ঘটনা যাদবপুরে ঘটার পর যে প্রবল স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ লক্ষ করা গিয়েছিল, তার ছিটেফোঁটাও এবার দেখা গেল না। এর প্রতিবাদে কলেজের প্রাক্তনী চিকিৎসকেরা মিছিল আয়োজন করলেন, বৃষ্টির মধ্যে নিজেরাই হাঁটলেন, কিন্তু “সাধারণ মানুষ” তাতে পা মেলালেন না, যদিও চিকিৎসকদের সাথেই সাধারণ মানুষের মেলামেশা সবচেয়ে বেশি। এই লক্ষণীয় পার্থক্যকে কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানি না। আমি একে চিকিৎসকদের সামগ্রিক ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছি। স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে আমরা মানুষের মনের দরজায় কড়া নাড়তে পারিনি, আশা-স্বপ্ন-সমস্যা-আতঙ্ক ভাগাভাগি করে নিয়ে সকলের সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারিনি। সমাজে চিকিৎসকদের ভাবমূর্তি নির্মিত হয়েছে এক এলিট “অপর” হিসেবে, যে নির্মাণে গরিষ্ঠসংখ্যক চিকিৎসকের প্রশ্রয় বা অংশগ্রহণ ছিল এবং আছে। অতএব মেডিকেল কলেজের ডাকে লক্ষ মানুষের স্রোত রাস্তায় নামবে না। ২০১৮ সালে আরেকটা “হোককলরব” সংগঠিত করার ক্ষমতা চিকিৎসকদের নেই। সমষ্টি হিসেবে চিকিৎসকদের এই জনবিচ্ছিন্নতার কথা স্পষ্ট জানা আছে বলেই শাসকেরা (দল নির্বিশেষে) বারবার চিকিৎসক এবং ডাক্তারি ছাত্রদের ওপর যথেচ্ছ আক্রমণ শানাতে সাহস পান।

ফেসবুকীয় আলোচনায় দ্বিতীয় আন্দোলনটির অনুপস্থিতির অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। মেডিকেল কলেজের আন্দোলনের ইস্যুটা সরল, তা নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্কের সুযোগ কম। “হস্টেল না পেলে রাজভবনে থাক” বলার মতো মেরি আঁতোয়ানিয়েত বোধহয় কেউ নেই। যাদবপুরের বিষয়টি তুলনায় জটিল, বহুস্তরীয় এবং এর আলোচনা থেকে সমাজতত্ত্ব ও দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষায় সবার অধিকার, তা স্বীকৃত। সেই স্তরে কাউকে ফেরানো চলবে না, এই নীতিও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। কিন্তু প্রথাগত উচ্চশিক্ষায় সকলের প্রয়োজন আছে কিনা, কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে কে কোন মহাবিদ্যালয়ে কোন পাঠক্রমে ভর্তি হবেন, কীভাবে সেই নির্বাচনকে যথাসম্ভব বৈজ্ঞানিক এবং গণতান্ত্রিক করে তোলা যায়, সেসব অতি গুরুতর এবং জটিল প্রশ্ন। এসবের একটিমাত্র সঠিক উত্তর বাতলে দেবার স্পর্ধা আমার নেই। তবে এড়িয়ে না গিয়ে দুএকটি বিষয়ে নিজের মতটুকু দিতে পারি, যদিও সব ব্যপারে আমার নিজের ভাবনা নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়।

খেয়াল রাখতে হবে, যাদবপুরের এই সংঘাতের মুহূর্তে অন্যান্য কলেজেও ভর্তির প্রক্রিয়া চলছে, যেখানে আরও অনেক বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করবেন। সেইসব জায়গার ভর্তি প্রক্রিয়া কিছু দাদার জুলুমবাজি, স্বজনপোষণ, টাকা আদায়, এমনকি টাকা নিয়েও প্রতারণা, ইত্যাদির দ্বারা কলঙ্কিত। এই ভয়াবহ অরাজকতায় রাশ টানার জন্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কাউন্সেলিং ব্যবস্থাটাই তুলে দিয়ে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ অনলাইন ভর্তির ব্যবস্থা বলবৎ করে ঘোষণা করেছেন, একমাত্র মেধার ভিত্তিতেই কলেজে ভর্তি নেওয়া হবে। অর্থবল এবং রাজনৈতিক সংযোগ নেই, কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পর পকেটে কিছু নম্বর আছে, এমন “মেধাবী” ছাত্রছাত্রীরা এই ঘোষণাকে সানন্দে স্বাগত জানাবেন বলেই আশা করি। যাদবপুরে উঠেছে এর পরের ধাপের দুটি প্রশ্ন। মেধার বিচার হবে কী করে? “মেধা” বলে কি আদৌ কিছু হয়? যেহেতু মনোবিদ্যা এবং নিউরোসায়েন্স পড়তে গিয়ে “মেধা” বিষয়টির সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছে এবং আমার পেশার কর্মী তথা ডাক্তারি ছাত্রদের এলিটিজমের ভিত্তি হল একটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় যাচাই হওয়া “মেধা”, তাই এই বিষয়টিকে একেবারে এড়িয়ে যেতে পারছি না।

মেধা বা অন্য যেকোনও প্রতিভা, এমনকি শারীরিক সৌন্দর্য বা শক্তিকে ক্ষমতা বা ক্ষমতার চাবি হিসেবে ব্যবহার করলে, প্রচার করলে, মান্যতা দিলে, তা কালক্রমে একধরণের শ্রেণিবিভাগের জন্ম দেবেই, যার বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। মূলত এই “কালচারাল ক্যাপিটাল”, ক্ষমতার স্তরভেদ, এলিটিজম, ইত্যাদির কারণে বামপন্থী ভাবনা থেকে উঠে এসেছে একটি প্রতর্ক যে মেধা বলে আদৌ কিছু হয় না। এই কথা বলার সময় তাঁরা সাধারণত মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বা জয়েন্ট এন্ট্রান্স জাতীয় পরীক্ষার নম্বরভিত্তিক মেধার অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ করেন। অন্যান্য ধরনের প্রতিভা বা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত শারীরিক-মানসিক ক্ষমতা (যেমন কায়িক শক্তি, কণ্ঠস্বর, কবিত্ব, শিল্পপ্রতিভা) ইত্যাদির সম্বন্ধে কিছু বলেন না, যদিও এগুলো প্রায়শ নম্বরের মতোই সুবিধা (অ্যাডভান্টেজ) দেয় এবং ক্ষমতার চাবি হয়ে ওঠে। অনেকেই কবি, শিল্পী বা নাট্যপরিচালক হিসেবে নিজের প্রতিভা এবং জনপ্রিয়তাকে মহিলাদের লাঞ্ছনা করার বা স্ত্রীকে পেটানোর লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। যাঁরা এজাতীয় অকর্তব্য করেন না, সার্বিকভাবে নীতিনিষ্ঠ থাকেন, তাঁরাও নিজেদের অজ্ঞাতেই সংগঠনের মধ্যে, বিতর্কসভায়, ময়দানে বা ফেসবুকের ফোরামে নিজেদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন নানা প্রতিরোধ ও প্রশ্নকে অতিক্রম করতে, এমনকি অবদমন করতে। সুতরাং নলেজ ক্যাপিটাল বা কালচারাল ক্যাপিটালের প্রভাবমুক্ত হওয়া যায়নি বর্তমান ব্যবস্থায়। আবার এঁদের যদি বলি, সামাজিক ন্যায়বিচার থাকলে আমিও সাড়ে ছয় ফুট লম্বা হতাম এবং আমার মা সেরেনা উইলিয়ামসের মতো খেলোয়াড় হতেন, তখন তাঁরা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেন। অর্থাৎ এঁরা অনেকেই বিশ্বাস করেন যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো জৈবিক নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু বৌদ্ধিক বা মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পূর্ণ সামাজিক নির্মাণ। এই বিশ্বাস দেহমনের বিচ্ছিন্নতার কার্তেজীয় বিভাজনের ভিত্তিতে নির্মিত এবং বিশ্বাসটি সৎ হলেও অংশত সঠিক, একশো ভাগ সঠিক নয়। খুব প্রিয় এক বয়োজ্যেষ্ঠ তাত্ত্বিককে প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছিলাম যে অপুষ্টির কারণে মানুষের উচ্চতা কমে যায়। অর্থাৎ শারীরিক গঠনের ওপর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রভাব আছে। তেমনি মানসিক গঠনের ওপরেও জৈবিক প্রভাব আছে। অবশ্যই জৈবিক মানে শুদ্ধ “জেনেটিক” নয়, অনেক প্রভাবের মিলিত ফলের কথা বলা হচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সব মানুষের মাথাকে একটি সমসত্ত্ব দ্রবণ ভাবা ঠিক নয় এবং জোর করে তেমন ভাবার প্রয়োজনও নেই।

তবে কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা বিলকুল ঠিক আছে? তবে কি মেধাকে অবদমনের হাতিয়ার করা জায়েজ? আদৌ না। অনেকগুলো সমস্যা আছে।

প্রথমত, “মেধা” মানুষের সমগ্রের একটা অংশমাত্র, মানুষ মেধার চেয়ে অনেক বড়। সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিটি সবচেয়ে নিন্দনীয় মানুষ হতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, মেধার অস্তিত্ব মেনে নিলাম মানে এই নয় যে মেধা ব্যাপারটা আমরা বুঝি। বস্তুত বুঝি না। না বুঝেও অতিরিক্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে একটা ব্যাপারের এত কদর যখন আমরা করে চলেছি সামাজিক স্তরে সমষ্টিগতভাবে, তখন সেই আস্ফালন সমস্যাদীর্ণ হতে বাধ্য।

তৃতীয়ত, মেধার পরিমাপ হবে কীভাবে? যে বিষয়টা আমরা সম্পূর্ণ বুঝি না, তার সঠিক পরিমাপ কি আমরা করে ফেলতে পারি? উত্তর হল, “না।” প্রচলিত যে আইকিউ পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু আছে, তা বেশ মোটা দাগের এবং অসম্পূর্ণ। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরীক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধেও ঠিক এই দুটি বিশেষণ ব্যবহার করা যায়।

চতুর্থত, “মেধা” বা “ইন্টেলিজেন্স” কি আদৌ একবচন নাকি বহুবচন? এ নিয়েও বিস্তর তর্ক। অঙ্কে যার মাথা দারুণ, ভাষা বা সাহিত্যে সে নিদারুণ নাকাল হতে পারে। পড়াশুনায় যে কিছুই করতে পারল না, সে হয়ত গোলকিপার হিসেবে অসাধারণ, শরীর নয়, মগজের জোরেই, অর্থাৎ অনুমান ক্ষমতা, মনোসংযোগ, প্রতিবর্ত স্নায়বিক ক্রিয়া, ইত্যাদির সৌজন্যে। সুতরাং মেধাকে একটি সামগ্রিক ক্ষমতা না ভেবে অনেক রকমের মেধাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করাই হয়ত যুক্তিযুক্ত। একেকজন একেকরকমে মেধাবী। অবশ্য বিভিন্ন গবেষণায় এরকমও বলা হয়েছে যে এই বিভিন্নরকম মেধার তলায় গালিচার মতো বিছানো থাকে সামগ্রিক এক মেধা, যার তারতম্য হতেই পারে মানুষে মানুষে। এ নিয়ে বিতর্ক চলছে, চলবে। কিন্তু বিতর্কের ঊর্ধ্বে একথা বলা যেতেই পারে, ঠিক যেমন জন্মসূত্রে পাওয়া লিঙ্গ, গাত্রবর্ণ, জাতীয়তা, পারিবারিক ধর্মপরিচয় বা জাতের ভিত্তিতে কোনও মানুষের অপমান, অবদমন বা বঞ্চনার শিকার হওয়া উচিত নয়, তেমনি জন্মসূত্রে পাওয়া শারীরিক বা মানসিক ক্ষমতার তারতম্যের কারণেও মানুষকে অপরায়িত বা বঞ্চিত করা অনুচিত।

এই জায়গায় দাঁড়িয়ে যাদবপুরের সমস্যাটির অংশবিশেষ বোঝা যায়। মেধা যাচাই হবে কীভাবে? উচ্চমাধ্যমিকের ফল অনুসারে? পরীক্ষাটি যেভাবে নেওয়া হয় এবং যেভাবে খাতা দেখা হয়, তাতে মেধার অনেক অংশেরই পরীক্ষা সম্ভব নয়। একটিমাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষায় তার সঠিক যাচাই সম্ভব, তাও অবশ্য জোর দিয়ে বলা যায় না। আবার উচ্চমাধ্যমিকে একজনের নম্বর খারাপ হলে তাঁর সামনে নামজাদা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। প্রবেশিকা পরীক্ষা থাকলে তিনি আরেকটি সুযোগ পাবেন নিজেকে প্রমাণ করার। অবশ্য উচ্চমাধ্যমিক ভালো হয়ে প্রবেশিকা খারাপ হতে পারে। সেটাও একটা প্রতিযুক্তি। সেক্ষেত্রে অবশ্য পরের বছর আবার পরীক্ষা দেবার সুযোগ থাকে, যদি ইচ্ছা তীব্র হয়।

যদি সামগ্রিক মেধার বদলে নানারকম মেধার তত্ত্ব মেনে নিই, তাহলে ভিন্ন প্রবেশিকার গুরুত্ব বেড়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিকে একজন বেশি নম্বর পেয়েছেন হয়ত গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে প্রাপ্ত নম্বরের ফলে। তিনি সমাজতত্ত্ব পাঠের প্রেক্ষিতে আদৌ মেধাবী কিনা, তা উচ্চমাধ্যমিকের নম্বর থেকে কী করে বোঝা যাবে? তার জন্য আলাদা পরীক্ষা প্রয়োজন। আর “চিন্তাশক্তি” ইত্যাদি যাচাই করার জন্য উচ্চমাধ্যমিক সত্যি যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে অবশ্য দুটো প্রশ্ন থাকে।

এক: একটি লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে চিন্তাশক্তি বা নির্দিষ্ট বিষয়ে একজনের মেধা বা প্রবণতার (অ্যাপ্টিচুড) সঠিক পরীক্ষা হয় কি? বিকল্প পথটাই বা কী? যেকোনও স্ট্রাকচারড পরীক্ষাব্যবস্থা, যাতে নম্বর দেওয়া হয়, তা রিজিড এবং সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। সত্যিকারের মেধা আর অ্যাপ্টিচুডের বিচার তাতে হবে না। দীর্ঘ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, প্রোজেক্ট, ইত্যাদি নন-স্ট্রাকচারড পরীক্ষা পদ্ধতিতে হয়ত সঠিকতর যাচাই সম্ভব, কিন্তু আমাদের দেশের আদ্যন্ত পচে যাওয়া আর্থসামাজিক তথা প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এই পদ্ধতির প্রয়োগ মিথ্যাচার, স্বজনপোষণ, দলবাজি, উৎকোচপ্রদানের বাধ্যবাধকতা, ইত্যাদি অভিশাপকেই ডেকে আনবে। সুতরাং কাল্পনিক আদর্শের বদলে বাস্তবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে।

দুই: মহাবিদ্যালয়ের কাজ কী? চিন্তাশীল অগ্রণী ছাত্রীছাত্রদের বেছে নিয়ে চিন্তনগোষ্ঠী গঠন করা, নাকি বিভিন্ন ধরনের, নানারকম মেধার, নানা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ছাত্রীছাত্রদের সকলকে তাদের নিজের নিজের মতো করে যথাসম্ভব ভাবতে শেখানো? এই বিতর্কটা জারি থাকুক।

যেটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে, সেটা হল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষকদের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা চাপিয়ে দেবার অনৌচিত্য। একমাত্র এই কারণেই সবকিছু না বুঝেও যাদবপুরের আন্দোলনকে সমর্থন না করে গণতান্ত্রিক মানুষের উপায় থাকে না। শোনা যাচ্ছে মেডিকেল কলেজের আন্দোলনকারী ছাত্রদের বর্তমান অধ্যক্ষ বলেছেন, “আমি অথরিটি, আমার যা ইচ্ছে আমি করতে পারি।” যাদবপুরেও যেন সরকার নিরুচ্চারে এই একই কথা বলতে চেয়েছিলেন। উভয় ক্ষেত্রেই প্রশাসকের এই দম্ভ, আলোচনাকে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করা, একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে অসমঞ্জস। (এই লেখাটি লিখতে লিখতেই খবর পেলাম, আন্দোলনরত ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়েছেন যাদবপুর কর্তৃপক্ষ। শুভম। আমি বলছি না যে প্রবেশিকা বজায় রাখার দাবিই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। এ নিয়ে বিতর্ক চলুক, উন্নততর সিন্থেসিসের জন্ম হোক, কিন্তু বিতর্কটুকুও বাদ দিয়ে, ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে বাইরে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া থেকে পিছিয়ে এসেছেন কর্তৃপক্ষ, এটা ভালো।)

মেডিক্যাল কলেজের সাদামাটা ব্যাপারটা নিয়ে এবার দু-এক কথা। জানানো যাক, হস্টেলের অভাবজনিত সমস্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হস্টেলে ঢুকতে না দেওয়া বা হস্টেল থেকে বের করে দেবার ঘটনা আগেও ঘটেছে। ঠিক পরীক্ষার আগে বেঘর হবার অভিজ্ঞতা আমাদেরও হয়েছিল দুই দশক আগে। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দেখে যাঁরা অবাক হচ্ছেন বা ভাবছেন প্রফেসর উচ্ছল কুমার ভদ্র একজন বিরল দায়িতজ্ঞানহীন প্রিন্সিপাল, তাঁদের জানাই, এই পরিস্থিতি নতুন নয়। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন অধ্যক্ষ ডঃ পি বি পাঠককে আমরা একটি কেঁচো উপহার দিয়েছিলাম। সেটা আমাদের খাবার ঘরের কল দিয়ে বেরিয়েছিল, সেই কলের জল আমরা খেতাম। জন্ডিস, টাইফয়েডে হস্টেলে প্রায় মড়ক লাগার পরিস্থিতি হবার পরেও ওয়াটার পিউরিফায়ার দূরস্থান, ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ট্যাঙ্কটুকু পরিষ্কার করানোর অনুমতি পাওয়া যাচ্ছিল না। এমন সময় এক শনিবার রাতে এক সহপাঠীর খাবার জলের গ্লাসে টুপ করে পড়ল সেই কেঁচো। তাকে আমরা একটা কাচের বিকারে সযত্নে সংরক্ষণ করলাম এবং সোমবার প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে তাঁকে উপহার দিলাম। “স্যার, এটা আপনার কলেজের হস্টেলের কল থেকে বেরিয়েছে। তাই এটা আপনারই সম্পত্তি। আপনাকে আমরা এটা উপহার দিচ্ছি।” প্রিন্সিপাল উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত বাড়িয়ে বিকারটি নিলেন, সবাই মিলে হাততালি দেওয়া হল। এবং এই অনুষ্ঠানটির পরেও তিনি নির্বিকার থাকলেন। কিছুই করলেন না। শেষে আরও বড় মাপের প্রথাগত আন্দোলন করে আমাদের “মেইন হস্টেল” সহ কলেজের সবকটি ছাত্রাবাসে পরিশোধিত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। যাঁরা মনে করেন যে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে সংস্রবহীন থেকে নিরিবিলিতে পড়াশুনা করা উচিত, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন যে পড়াশুনা করার জন্য বেঁচে থাকা আবশ্যক এবং শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য ছাত্রদের সংগঠিত হয়, কারণ বিক্ষোভ শুরু না করা পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ অভিভাবক হয়ে ওঠেন না, অনায়াসে বিষ খাইয়ে চলেন সন্তানতুল্য ছাত্রদের। সরকারে বামফ্রন্ট না তৃণমূল, তাতে কোনও পার্থক্য হয় না।

কোনও দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষ কতটা দায়িত্বশীল বা দায়িত্বজ্ঞানহীন, তার উপর বেশ খানিকটা নির্ভর করে সেই দেশের ছাত্র ইউনিয়নগুলির চরিত্র এবং কর্মকাণ্ড। কিছু দেশে “স্টুডেন্টস ইউনিয়ন” বা “স্টুডেন্টস অ্যাক্টিভিটি সেন্টার” আদতে একটা বাড়ি, যেখানে ছাত্রেরা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য দলবদ্ধ গঠনমূলক কাজ করে থাকে। সেখানে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে নিত্য ঘেরাও, ধর্মঘট হয় না, কারণ তার প্রয়োজন হয় না। সেখানে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ বেশি এবং ঘেরাও না করেও আলোচনার টেবিলে বসতে পারার পরিসর আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই দায়িত্বশীল প্রশাসন এবং গণতান্ত্রিক পরিসর নির্মাণের পিছনে আছে সেসব দেশের ছাত্রদের, নাগরিকদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। তাঁদের পেরিয়ে আসা পথ আমরা এখন অতিক্রম করছি খানিক এলোমেলো পদক্ষেপে। ভারতের মতো যেসব দেশে অধস্তনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত নয়, সেসব দেশে আধিকারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন খানিক উগ্র হতে বাধ্য।

ছাত্রজীবনে আমরা অঙ্ক বা রসায়ন শিখেছি স্রেফ পরীক্ষায় নম্বর পাবার জন্য নয়, পরবর্তী জীবনে তার বাস্তব প্রয়োগের লক্ষ্যেই মূলত। আজকের ছাত্র আগামীদিনের সচেতন শিক্ষিত নাগরিক। সুতরাং সুনাগরিক হয়ে ওঠার পথে একজন বিজ্ঞানের ছাত্র সমাজ বা ইতিহাসের কিছুই জানবেন না, তাঁর মধ্যে রাজনীতি বোধটুকুরও জন্ম হবে না, ফাইনাল পরীক্ষা পাস করা পর্যন্ত তিনি দেশ-কাল-সমাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকবেন আর ঠিক তার পরের দিন থেকে হঠাৎ সংবেদনশীল দেশপ্রেমী মানুষ হয়ে উঠবেন, এমন অচানক মেটামর্ফোসিস কাফকার গল্পেও হয় না। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রকে একসময় জীবনবিজ্ঞান পড়তে হয়েছে, তাহলে সমাজ-রাজনীতি সম্বন্ধে মৌলিক শিক্ষাটুকু নিয়ে এত আপত্তি কেন? যেসব অভিভাবক সন্তানদের রাজনীতিবিমুখ কেরিয়ারসর্বস্ব করে তোলার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁরা বার্ধক্যে সেই সন্তানের দ্বারা পরিত্যক্ত ও প্রতারিত হবার জন্য প্রস্তুত হতে থাকুন। আজ যে বন্ধুর পাশে দাঁড়ায়নি, কাল সে বাপের পাশেও দাঁড়াবে না।

ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় ছাত্ররা অরাজনৈতিক ছিলেন না। ভারতে ছাত্র আন্দোলনের সূচনা কিন্তু ছাত্র হিসেবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের লক্ষে নয়, বরং কলেজের বাইরের সমাজের সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক এবং চেতনার দ্বন্দ্ব থেকেই। উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু কলেজ এবং পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাস মনে করুন। ১৮২৭-২৮ সালের ডিরোজিও সাহেবকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সংগঠিত হওয়া বা ১৮২৯-এ তাঁদের “পার্থেনন” পত্রিকা প্রকাশ, অথবা ১৮৫৭ সালে আনন্দমোহন বসুর উদ্যোগে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা, অথবা জালিয়ানওয়ালাবাগ উত্তর পঞ্জাবে ব্রিটিশ মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের নিরন্তর লড়াই, সর্বত্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছে স্থবির হিন্দু সমাজের জগদ্দল পাথর সরানো বা ব্রিটিশ রাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো বৃহৎ রাজনৈতিক বোধ থেকে।

আদতে অরাজনৈতিক হওয়া প্রায় অসম্ভব নাগরিক মানুষের পক্ষে। নিজের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝাতে “নিউট্রাল” শব্দটা অনেককেই ব্যবহার করতে শুনেছি। বাস্তব জীবনের অভিঘাতের মুহূর্তে আসলে নিউট্রাল অবস্থান কিছুই হয় না। মনে করুন, আপনার বাড়ির পাশের গলিতে কয়েকজন যুবক মিলে একজন মহিলার উপর অত্যাচারে প্রবৃত্ত। আপনি কী করবেন? আপনার সামনে বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে। আপনি ছুটে গিয়ে বাধা দিতে পারেন, চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারেন, আত্মপরিচয় গোপন করে পুলিশে খবর দিতে পারেন, ইষ্টনাম জপ করে মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করতে পারেন, জানালাটা বন্ধ করে দিতে পারেন, অথবা জানালা খুলে তারিয়ে তারিয়ে দৃশ্যটি উপভোগ করতে পারেন, নিজে গিয়ে ছেলেগুলির সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, মিউজিক সিস্টেমে বিথোফেনের সিম্ফনি চালিয়ে জীবনানন্দ সমগ্র হাতে নিয়ে বসে নিজেকে বোঝাতে পারেন যে আসলে কিছুই ঘটেনি। এর যেকোনও পথেই আপনি যেতে পারেন, কিন্তু যে পথেই যান না কেন, সেটা আপনার সচেতন পছন্দ, সেটাই আপনার রাজনীতি। নিউট্রাল আপনি হতে পারবেন না, এমনকি জানালা বন্ধ করেও।

সমাজে এবং রাষ্ট্রে ব্যক্তির অবস্থান, অতএব, রাজনৈতিক, এমনকি ছাত্রাবস্থাতেও। অবশ্যই ছাত্র রাজনীতির নিজস্ব চরিত্র এবং নিজস্ব কিছু দাবি আছে, যা তাকে পৃথক পরিচয় দেয়। ছাত্রদের সমস্যাগুলো দেখা, ক্যাম্পাসে সুস্থ পরিবেশ এবং পঠনপাঠনের সুব্যবস্থা বজায় রাখা, মহিলা, সংখ্যালঘু, তৃতীয় লিঙ্গ, বিদেশি, প্রভৃতি সব ছাত্রের অধিকার সুরক্ষিত করা, ইত্যাদি ছাত্র সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা সংগঠনের পক্ষে সেসব সঠিকভাবে করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সংশয় থাকবেই। তাঁদের অভিভাবক রাজনৈতিক দলটির স্বার্থের সাথে যদি ছাত্রস্বার্থের বিরোধ বাধে, তবে তাঁরা কোন দিকে যাবেন? অধিকাংশ সময়ে দেখা যায় শাসকের তাঁবেদারিতেই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন এবং শাসক দলগুলো এইসব শাখা সংগঠনকে ব্যবহার করে ছাত্রদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা, ভয় দেখানো এবং সরকারের ইচ্ছাসমূহ জোর করে ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দেবার এজেন্ট হিসেবে। ফলে ছাত্রদের স্বার্থরক্ষায় তাঁরা সাধারণত ব্যর্থ, বোমাবাজিতে তুলনায় অনেক বেশি সফল এবং ছাত্ররাজনীতির প্রতি সমাজের বিতৃষ্ণা তৈরির কাজে সেনাপতি। এক্ষেত্রেও কোনও নির্দিষ্ট দলের কথা অন্যদের থেকে আলাদা করে বলতে পারছি না। মূলধারার দলগুলির প্রতি আস্থাহীনতা এবং একইসঙ্গে নকশাল আন্দোলনের কারও ভীতি, কারও মোহভঙ্গের ফলে বিগত শতাব্দীর সাতের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে বিভিন্ন কলেজের পরিসরে গড়ে উঠতে থাকে কিছু স্বাধীন ছাত্র সংগঠন। কোলকাতা তথা বাংলার ছাত্র আন্দোলনে এই মোড়টা গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবাসের দাবিতে যে সংগঠনটি লড়ছে, বহুবছর ধরে একাধিক শাসকের হাতে ক্রমান্বয়ে মার খেয়েও যে দলটি বিলুপ্ত হচ্ছে না কিছুতেই, সেই এমসিডিএস-এর জন্ম সেই সময়েই। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর “জরুরি অবস্থা” ঘোষণা এবং দমননীতি ছাত্রদের তরফে প্রতিরোধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। ২১-এ মার্চ ১৯৭৭, মেডিকেল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম। সামান্য ইতিহাসবোধ বলে দেবে যে এটা কাকতালীয় নয় যে সেই একই বছরে যাদবপুরে ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস ফ্রন্টের জন্ম এবং ১৪ই জুনের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের ক্ষমতায় আরোহন।

তারপর সময় এগিয়েছে। সত্তরের বিপ্লবী বামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়ে ক্রমশ শাসকের চরিত্র নিজেদের আত্মায় মেখে নিয়েছেন, কালক্রমে অনেকের চোখে ত্রাস হয়ে উঠেছেন, সিংহাসন হারিয়েছেন, পরিবর্তনের কাণ্ডারীরা সেই সিংহাসনে আরূঢ় হয়ে অতি সত্বর ক্ষমতার আস্ফালন শুরু করেছেন, যার আওতা থেকে বাদ যায়নি শিক্ষাঙ্গন। আসলে কোনও ব্যক্তি বা দলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যাঁরা “বত্রিশ সিংহাসনের” গল্প পড়েছেন, তাঁরা জানেন, তখতে আরূঢ় মানুষটিকে রাজা ভোজ খাইয়ে তোলে সিংহাসন স্বয়ং, ক্ষমতাই নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তি ও দলের চরিত্র, যদি না তার নৈতিক গঠন হয় অতি মজবুত।

পাশাপাশি সেদিনের প্রতিশ্রুতিময় “ইন্ডিপেন্ডেন্ট” ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যেও এসেছে অনেক পরিবর্তন, কিন্তু চার দশক পেরিয়েও তারা প্রাসঙ্গিক থাকতে পেরেছে, এখনও কোথাও তারা নির্বাচন জিতছে আর কোথাও তাদের অবজ্ঞা করতে না পেরে নিয়মিত পেটাতে হচ্ছে, কলেজের নির্বাচনে তাদের আঠারোজন অগ্রণী নেতার ভোটাধিকার বাতিল করে দিতে হচ্ছে প্রতাপান্বিত শাসকদের, এটা লক্ষণীয় ব্যাপার। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে গেলে এসব সংগঠনকে জড়িয়ে থাকতে হবে মানুষের সাথে, সম্পৃক্ত থাকতে হবে জনস্বার্থের সঙ্গে। ভেবে দেখতে হবে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট মানে কী? স্বাধীন সংগঠন মানে অরাজনৈতিক, মূল্যবোধহীন ক্লাব নয় যার একমাত্র কাজ কলেজ ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা। বরং স্বাধীন মঞ্চ এক সমাজসচেতন, নীতিবোধসম্পন্ন, সংবেদনশীল বহুস্বর, যা নানা স্তরের বিভিন্ন ধরনের মানুষের কথা শোনে, সবাইকে মর্যাদা দেয়, সবার সঙ্গে কথা বলে, সচেতনতার জাদুকাঠিতে পরস্পরকে ছুঁয়ে দেয়।

ঠিক এখানেই, বহুস্বরের গুরুত্বের প্রশ্নেই, এসব অগ্রণী প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দুমিনিট নীরবে ভাবতে হবে। ‘এলিটিজম’কে জনবিচ্ছিন্নতার রেসিপি হিসেবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নিজেদের পাশে কাউকে না পাওয়ার পর চিকিৎসকেরা দয়া করে পেডেস্টাল থেকে নেমে দাঁড়াবেন কি? আরেকটু আত্মবিশ্লেষণ করবে কি যাদবপুরও? ডাক্তারি ছাত্রদের যখন বলতে শুনি, “আমরা জয়েন্টে চান্স পেয়েছি, ওরা পায়নি বলে ঈর্ষায় জ্বলে আমাদের সমালোচনা করে,” তখন ভয় হয়, এই অহংকার নিয়ে এরা সেইসব জয়েন্টে না পাওয়া “অপর”দের চিকিৎসা করবে কী করে? মানুষের পাশে কী করে দাঁড়াবে আর নিজেদের পাশে কী করে পাবে মানুষকে? যাদবপুরে প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে যখন সেখানকার কোনও উদ্ধত ছাত্র বলেন, “আমাদের ইউনিভার্সিটিতে গরুছাগল ঢুকতে দেব না,” তখনও একইরকম সংশয় জাগে সুস্থ ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

২০১৪। হোককলরব। যাদবপুরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নগরীর রাজপথে হেঁটেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু তার পরে যখন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন কলেজে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্কট উপস্থিত হয়েছে, সেই জনসমর্থনের কতটুকু চোখে পড়েছে? ভিসি বদল ছাড়া হোককলরব আন্দোলনের দাবি সনদের আর কোন কোনগুলো পূর্ণ হয়েছে? ছাত্রেরা কতটা জেন্ডার সেন্সিটিভ হয়েছেন? রোজ এত ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে এত ছাত্রীর তরফে অভিযোগ আসে কেন তবে? সেগুলোকে ধামাচাপা দেবার এত উদ্যোগই বা কেন? এই বিপুল জনসমর্থন এবং ভালোবাসা পেয়ে যাদবপুরের দায় এবং দায়িত্ব আরও বাড়ার কথা ছিল। অবশ্যই তাঁরা পরবর্তী কালে কিছু আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছেন, যা প্রশংসার্হ, কিন্তু রাজপথের পাশের অযত্নে পড়ে থাকা নালা বেয়ে বহতা সমাজের সাথে আরও বেশি সম্পৃক্ত হবার প্রত্যাশা ছিল তাঁদের কাছে। সেই প্রত্যাশা কিছুটা ভেঙেও গিয়েছিল, যখন দেখেছিলাম বিপুল জনসমর্থন মূলত আত্মশ্লাঘাকেই বাড়িয়েছে অনেকের মনে। সেই মহামিছিলের কয়েক সপ্তাহ পরেই সোশাল মিডিয়ার একটি ওপেন ফোরামে দেখি আলোচনা হচ্ছে ক্যাম্পাসে ক্যামেরা লাগানোর ভালোমন্দ সহ যাদবপুরের কিছু বিষয়ে। নদীয়ার একটি কলেজের একজন ছাত্র তা নিয়ে মন্তব্য করতেই তাঁকে চেপে ধরা হল, “ভাই তুমি কি জেইউ?” ছাত্রটি জানালেন যে তিনি হোককলরবের মিছিলে হেঁটেছিলেন। এই সলিডারিটির প্রতি শ্রদ্ধা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তাঁকে অপমান করে জানানো হল, প্রেসিডেন্সি যাদবপুরের না হলে এসব ইন্সটিটিউট নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা জন্মায় না। আবার সেই মেধা, নলেজ ক্যাপিটাল, কালচারাল ক্যাপিটাল… উবুন্টু, ইত্যাদি। সংক্ষিপ্ত বার্তা এই যে পরবর্তী মিছিলে সেই ছেলেটিকে আর পাবেন না বন্ধু, তাঁর বন্ধুদের কাউকে পাবেন না।

তবু প্রত্যাশা বেঁচে আছে, থাকবে। কারণ জগতটা ফেসবুক নয় আর সকলেই উন্নাসিক নন। অনেক দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ছাত্রছাত্রী আছেন এসব কলেজে, যে কোনও শুভ আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা তাঁদের। তাঁরা নিশ্চয় মনে রাখবেন যে গ্যালিলিও বলেছিলেন, সূর্য যাদবপুরের চারপাশে ঘোরে না, মেডিকেল কলেজ বা প্রেসিডেন্সির চারপাশেও নয়। জেইউ, জেএনইউ-এর মতো সেন্টার অব এক্সেলেন্সের গুরুত্ব অনেক। এসব শিক্ষায়তনের ছাত্র-শিক্ষক দেশের সম্পদ, ভালোবাসা ও ভরসার স্থল। আজকের মতো আগামীদিনেও তাঁরা আমাদের ভাবনাকে প্রভাবিত এবং পরিচালিত করবেন, আমাদের পথ দেখাবেন। কিন্তু যাঁদেরকে পথ দেখাবেন, তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আরও বেশি করে সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে। জয়পুরিয়া কলেজ হোক, বা বালুরঘাট কি গুসকরার ছাত্রদের সমস্যা বা মতামত, সবগুলোকেই গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। তবেই তো “বহুস্বর”, “কলরব”, জনকণ্ঠ।

চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের স্বৈরাচারী চরিত্রটির বিরুদ্ধে অবশ্যই আন্দোলন চলবে স্বাধিকারের প্রশ্নে, কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রের সমস্যাটিকে বৃহৎ প্রেক্ষিতেও ভাবতে হবে। প্রবেশিকা পরীক্ষা নিতে হচ্ছে মানেই এই সত্য প্রতিষ্ঠিত যে উচ্চশিক্ষা পেতে ইচ্ছুক সকলের জন্য দরজা খোলা সম্ভব নয়, কারণ আসনসংখ্যা সীমিত, সুযোগ অপ্রতুল। অর্থাৎ সবচেয়ে সঠিক “নির্বাচন” পদ্ধতি অবলম্বন করলেও বহু ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীকে বঞ্চিত করতে হবে। যাঁরা বহুস্বরে বিশ্বাসী, তাঁরা নিশ্চয় এঁদের ব্যর্থতার ব্যথায় কাতর হবেন। তাহলে কী করা যায়? শিক্ষাকে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য সরকার, শিক্ষাজীবী এবং ছাত্রসমাজ কী ভূমিকা নিতে পারেন? মেধা, শিক্ষা ও ভাবনার নানারকম মানসম্পন্ন ছাত্রীছাত্রেরা পড়াশুনা করবেন কোলকাতা থেকে রায়গঞ্জ, পুরুলিয়া থেকে কোচবিহারের মহাবিদ্যালয়ে এবং এঁরা সকলেই পাবেন উন্নত শিক্ষার সুযোগ, চিন্তারপ্রেরণা… এমন হওয়া কি সম্ভব? কলেজ এবং আসনের সংখ্যা বাড়াতে হবে, কিন্তু সাথে বাড়াতে হবে শিক্ষাদানের মানও। সকলেরই কি প্রথাগত বিএ, বিএসসি, মাস্টার্স, পিএইচডি প্রয়োজন? মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের পরেই যদি কেউ প্রায়োগিক কর্মমুখী শিক্ষার পথ বেছে নিতে চান, তবে তিনি স্বল্পশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে, সমাজে নিজের সম্মান বজায় রেখে নিজের পছন্দের পথে কেন এগিয়ে যেতে পারবেন না? কত আসন যথেষ্ট হবে? তা কি ঠিক হবে কর্মসংস্থানের দ্বারা? চাকরিমুখী কোর্সগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্র‍্যাজুয়েট তৈরি করলে সেই শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের জীবনের পেশাগত সংকট কেমন হতে পারে, তা আমরা জানি। নারায়ণ সান্যালের “নাগচম্পা” উপন্যাসের বেকার ইঞ্জিনিয়ার কৌশিক মিত্রকে মনে পড়ে? তাহলে সঠিক পথটা কী? আমাদের মতো আর্থিক সংকটে থাকা রাজ্যে বা দেশে সরকারের পক্ষে গুণমানের ক্ষেত্রে আপোষ না করে কতগুলো আসন বাড়ানো বাস্তবে সম্ভব? কম খরচে, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে, পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেও শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং মানোন্নয়ন কি সম্ভব? তার জন্য আমরা কী করতে পারি?

সবচেয়ে সহজে যেটা পারি, তা হল জোট বাঁধতে। সব মানুষের হাত ধরতে। ময়নাগুড়ি থেকে রায়গঞ্জে বাংলা পড়তে আসা ছাত্রীটির কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনতে, তাঁকে তাঁর ভাষায় কথা বলার সুযোগ দিতে, শহরের তুখোড় ছাত্রের সমান মর্যাদা দিতে, স্বপ্ন দেখাতে, স্বপ্নে সামিল করতে। আমরা সবাই যদি সব সহনাগরিককে সম্মান দিই, তবে শাসকেরাও সকলকে সম্মান দিতে বাধ্য হবেন, কারণ অগ্রাহ্য করার, দমন করার সংস্কৃতিটাই থাকবে না। এই পথে এগোতে আর্থিক বিনিয়োগটুকুও লাগে না।

ডাক্তারদের তো সমগ্র কাজকর্মই অসহায় মানুষকে নিয়ে। তাঁদের তো মঞ্চ থেকে জমিতে নামতে হবেই, আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতেই হবে। আশার কথা, এমসিডিএস-এর মতো কিছু সংগঠনে এখনও এই মূল্যবোধটুকু টিকে আছে। গ্যাস দুর্ঘটনা পরবর্তী ভুপাল, দল্লী রাজহরার শহীদ হাসপাতালে পরিষেবা দানের ইতিহাস থেকে শুরু করে বহু বন্যাত্রাণ, মেডিক্যাল ক্যাম্প পেরিয়ে আজকের জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে এঁদের অংশগ্রহণ অব্যাহত আছে। এই মুহূর্তে মেডিকেল কলেজে যে লড়াইটা তাঁরা চালাচ্ছেন দূরবর্তী গ্রাম-মফস্বলের সাধারণ পরিবার থেকে আসা ছাত্রীছাত্রদের জন্য হস্টেলের দাবিতে, তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি নির্দিষ্ট কারণে।

প্রায় দুই দশক ধরে চিকিৎসা পরিষেবার দায় ক্রমশ নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলছে ভারত এবং তার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সরকার। এমনকি সরকারি হাসপাতালের অনেক কিছু আজ চলে পিপিপি মডেলে। চিকিৎসা শিক্ষার বেসরকারিকরণও চলছে লাগাতার। সাম্প্রতিক ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন বিল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বেলাগাম বাণিজ্যের ছাড়পত্র দিতে ভারত সরকার উদ্যোগী। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জেলা থেকে সাধারণ পরিবারের ছাত্রদের রাজ্যের রাজধানীতে নিরাশ্রয় এবং বিপন্ন করে তোলার পন্থাকে একটি দীর্ঘমেয়াদী বিভাজন ও বিতাড়নের রাজনীতির সূচনা হিসেবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। এই প্রচেষ্টাকে গোড়ায় না আটকালে সম্ভবত ভবিষ্যতে চালু হবে দ্বিস্তরী এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে কোলকাতার মেডিকেল কলেজগুলোতে পিপিপি মডেলে মোটামুটি আধুনিক ব্যবস্থা এবং শিক্ষালাভের সুযোগ পাওয়া যাবে মোটা অঙ্কের দক্ষিণার বিনিময়ে, যা দিতে পারবেন কিছু সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা। এত টাকার বিনিময়ে ডাক্তারি পাশ করে জনমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ তাঁরা হবেন না, ধরেই নেওয়া যায়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য থাকবে জেলাস্তরে কিছু হাসপাতালে প্রশিক্ষণের সুযোগ (যদি তাও কর্পোরেট গ্রাসে না চলে যায়), যেখানে গুণমানের উন্নয়ন নিয়ে ভাবা হবে না। হয়ত এই সরকারের আমলে নয়, আরেক প্রস্থ “পরিবর্তনের” পর অন্য এক রাজার রাজত্বে এটা হবে, কিন্তু যাত্রাপথের অভিমুখ সেদিকেই। এমসিডিএস-এর মতো বাধাগুলোকে সরিয়ে দিতে পারলে সেই যাত্রাপথ নিষ্কণ্টক হবে। প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরের মতো একটি দুটি সেন্টার অব এক্সেলেন্স আর বাদবাকি অব্যবস্থিত মেডিকেল কলেজের মডেল চিকিৎসা শিক্ষাতে চালু হলে তার পরিণতি কী হবে ভেবে দেখেছেন? যদি আতঙ্কিত বোধ করেন সাধারণ মানুষ হিসেবে, তাহলে ভেবে দেখবেন ডাক্তারি ছাত্রদের আজকের এই আপাত গুরুত্বহীন আন্দোলন আদতে আপনার আন্দোলন কিনা, অতি গুরুত্বপূর্ণ কিনা, আপনিও এতে সামিল হতে চান কিনা।

অনেক কথা বলা হয়ে গেল। আসল কথাটা খুব ছোট্ট। গানের ভেতরেই ছিল। গানের সব লাইনও তো একইভাবে দাগ কাটে না, একই তীব্রতায় মনেও থাকে না। তিনটে লাইন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, যার মধ্যে সুর পেয়েছিল ছাত্র রাজনীতির মূল্যবোধের সারাংশটুকু।

… পিছনের সাথীকে সামনে টেনে নাও।
দুয়ার বন্ধ করে যারা কাঁদছে,
তাদের একবার ডেকে নাও।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...