বৃষ্টিঋণ

রিমি মুৎসুদ্দি

 

১৫ নম্বর বাসটা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে তার যাত্রাশুরুর ঘোষণা করতে করতে গুমটি থেকে রওনা দিচ্ছে। উল্টোডাঙ্গা, হাতিবাগান, জোড়াবাগান পেরিয়ে পোস্তা হয়ে অনেক বস্তাবোঝাই মশলা নিয়ে রথযাত্রার মতোই পরিভ্রমণ করবে একচিলতে উত্তর। গন্তব্য হাওড়া স্টেশন। হাওড়া ব্রিজের তলা দিয়ে গঙ্গা আর উপরে ছুটবে ঘামপ্যাচপ্যাচে যাত্রীবোঝাই বাসটা। বাইরে বৃষ্টি স্বস্তি দিতে পারে না। কারণ, জানলা দিয়ে ছাট এসে পড়লে বাসের জানলা বন্ধ করে দিতে হয়। ভেতরে ভাপা মানুষ তাদের আধসেদ্ধ জীবন নিয়ে খুব একটা ভাবিত নয়। যতটা ভাবনা ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়ার ফুটবল ম্যাচ নিয়ে। লেডিস সিটের একটা মেয়েকে দেখেও কি ক্রোয়াশিয়ার সুন্দরী প্রেসিডেন্টকে ভোলা যায়? বৃষ্টি নয়, মিছিল নয়, কোনও নিজস্ব দাবিদাওয়া নয়, দীর্ঘজীবী বিপ্লব তো নয়ই, ইস্তাহারও নয়। ফুটবলই কি তাহলে একমাত্র প্রেম শহরটার?

না-বোঝা ভাষার মধ্যে দিয়ে বাচ্চাগুলোর মধ্যে পাপ ঢুকছে।
এই ছেলেবেলা থেকেই দৃশ্য থেকে পাপ ঢোকে
স্বপ্ন থেকে পাপ ঢোকে

ভাষা থেকে পাপ ঢোকে।
বৃষ্টিতে সে পাপ ধুয়ে যায় না বরং আরও সতেজ হয়ে ওঠে।

মণীন্দ্র গুপ্ত

বৃষ্টি শুনলেই কী যেন ধুয়ে যেতে চায়। পাপ, অপমান, কান্না, ব্যর্থতা, সাফল্য সব। বৃষ্টি শেষে সাময়িক ধুয়ে যাওয়া বালিধুলোর মতো যা কিছু নিশ্চিহ্ন হয়, তা আসলে আপেক্ষিক বিলুপ্তি। যেমন বৃষ্টি শেষে ভরা পুকুরে ক্রমাগত একটানা ব্যাঙের ডাক আর ‘কায়ক্লেশে গর্ভবতী’ হওয়া কোনও এক গাভির ঘরে ফেরার সুখপাপ, উভয়ের স্থায়িত্ব কোনও ভরসা না দিলেও ক্ষণিকের শান্তি দিয়ে যায়।

In what language does rain fall
over tormented cities?

Pablo Neruda

তামিলনাড়ুর চেট্টিনাদি গ্রামে ভাগ্যলক্ষ্মীর উঠোনে বেঁটে কলাগাছগুলোর সাথে আপেলের আচারের শিশিটাও ভিজে যাচ্ছে। কেরালা থেকে আনা আপেল। সেই কবে থেকে ভাগু আচারের শিশিটা রোদ খাইয়ে খাইয়ে টিকিয়ে রেখেছে। ইউক্যালিপটাসের বন জঙ্গলও ভিজল সেদিন।

–ভাগু, কফি কুর (কফি এনেছি)…

ভাগ্যলক্ষ্মীর বাড়িতে সবাই ওকে ভাগু বলেই ডাকে। কফির কাপ হাতে ক্যুরিয়ান এসে বসে পাশে। জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে দুজনেই আচারের শিশিটাকে দেখতে পায়। তবু কেউ উঠে গিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসে না।

বৃষ্টি এলে এসব তুচ্ছ বিষয় ভুলে যাওয়া যেতেই পারে। দাঙ্গাহাঙ্গামার মতো হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি যখন ভিজিয়ে দেয়, গার্হস্থ্য মন শুধু একটা পরকীয়া খুঁজে মরে। ভাগু-ক্যুরিয়ানের গল্পটা আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতেই পারত। ওদের মধ্যে সম্পর্কের রসায়ন, নাম এগুলো নিয়ে কথা এগোনোর আগেই একটা নাম না জানা গাছে পাখির বাসাটা ভেঙে পড়েছে। বাড়ির জানলা দিয়ে হিচককের ‘রিয়ার উইন্ডো’-র মতো ওদের দুজনের সাথে পাঠক মনও চলে যাক, ভাঙা বাসাটার দিকে।

বুঝি ডিম ছিল বাসায়। কাছাকাছি কোথাও ঝোপে বা উঁচু গাছের ডালে বসে আছে পাখিটা। তাকে দেখা যাচ্ছে না। ডিমগুলো পড়ে রইল উঠোনজুড়ে। ডিমের ভেঙে যাওয়া কুসুম থেকে এক আশ্চর্য দুপুর উঁকি দিচ্ছে। যে দুপুরের ভাষা ভারতের মতো বহুভাষী দেশেও চিত্রকল্পে এক করে দেয়। চেট্টিনাদের দুপুর আর ইয়ালু ফুলের বাগানে দুই কিন্নর যুবতীর খুনসুটি মিলে যায়।

ছাতা হারিয়ে এক লম্বা টাকমাথা পণ্ডিত তার বউয়ের কাছে কিছুটা সিমপ্যাথি আদায়ের উদ্দেশ্যেই ঝুপ্পুস ভিজে বাড়ি ফেরে। পণ্ডিতের মাথার ভেতর জমা হওয়া শব্দব্রহ্মেরা গুগুল চ্যাটে অজস্র বন্ধু খোঁজে। শব্দদের ফেরার তাড়ায় অথবা পৌঁছানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষায় অসম্ভব দ্রুততায় অনেকগুলো উড়োজাহাজও কিনে ফেলে সে। আটলান্টা, আইওয়া, হিউস্টন, হলদিয়া সব জায়গায় ছড়াতে ছড়াতে একদিন হারিয়ে ফেলে তার স্থায়ী ঠিকানা। ‘কমফর্ট’ পাবে বলে যে ঠিকানায় একদিন নিজেই এসে বসেছিল। বিনা অনুমতিতে। স্বাধিকারের দাবিতে। অধিকার হারানোর যন্ত্রণাটুকুও ধুয়ে যায় পাহাড়ি সুরের মতো অচেনা বৃষ্টিতে।

ইউক্যালিপটাসের বনজঙ্গল সাফ করে এক এক করে হোটেল রিসর্ট, ট্যুরিস্ট মনোগ্রাহী বাংলো হয়ে চলেছে। ঘরের জানলা থেকে দেখা বৃষ্টিতে কতটুকু পরিবেশ সচেতনতা হয় তার উত্তর খুঁজতে কুদানকুলাম, নর্মদা, শতদ্রুতীরে অথবা কালাহান্ডি মরুতে যাওয়ার আজ আর প্রয়োজন নেই। কলোনিয়াল হ্যাংওভারের মতো উন্নয়নের ছিটেফোঁটা সুখস্মৃতি ধীরে ধীরে বৃষ্টিকেও গিলে ফেলবে। যেমন করে ধীরে ধীরে গিলেছে কোরাল, ফ্লোরা, ফনা সমেত আস্ত একটা বদ্বীপ।

গিলে নেওয়ার কথায় অনেককিছুই অনুষঙ্গ চলে আসে। প্রতিদিন কতকিছু গিলে নিতে নিতেই এগোয় সময়। প্রেম, যৌনতা, খিদে আর কান্না গিলে নেওয়া কতটা দৃষ্টিনন্দন সে প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষ করে কান্না গিলে নেওয়া কেউ দেখতে চায় না। কান্না আর বৃষ্টি– এই দুই ধারাপাতে বড়ই অমিল। নোনা স্বাদ আর তীব্রতায় যেমন। বৃষ্টি ভেজায় যে রোম্যান্টিসিজম আছে কান্নার ফোঁটায় তার তিলমাত্র নেই। তবু কবিতায়, প্রার্থনায় আর প্রতিদিন ‘পেতে চাই’ রবে অনেক অনেক কান্না জমা থাকে। যে কান্না থেকে শব্দ আসে না অথচ চারপাশের হাসি খেলা ভুবন ভোলায় নয়, শুধু ব্যক্তিমানুষের শরীর জুড়েই তার বাস। যাকে বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে আঁকতে গেলে পুরনো অপমান আর সমস্ত ক্ষতগুলো ক্যানভাসে ফুটে ওঠে। দলা পাকানো সে অবয়ব যেন মানুষের মুখের মতোই হতে চেয়ে কোনও এক পশুর মুখ হয়ে গেছে।

কান্না আর বৃষ্টির প্রবল ধারাপাতে অন্তিম স্বাদ খুঁজে পেতে গিয়ে কত শহর, বাড়ি আর জীবন শেষপর্যন্ত মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। পরিসংখ্যানে ভুল হলেও সমস্ত হিসাব জমা আছে প্রতিটা বৃষ্টিঋণে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...