বর্ষার বিকেল, তার দুইপ্রান্ত টেনে ধরে আছি

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

সে সময়ে তার বসার বিকেল বা বিকেলের বসা ছিল ছাতে। বিশাল একটা ভবানীপুরিয়া ছাত। পুরনো ঘষাটে ময়লা মেঝের ছাত। এদিকে ওদিকে ছাতলা পড়া ছাত। প্রবলভাবে নিরর্থক এটা ওটা ফেলে রাখার ছাত।

প্রতিদিন সে সেই ছাতের ওপর বানানো সিমেন্টের ধাপিতে বসত। আর আকাশের রং দেখত। সবচেয়ে বেশি রং তো বর্ষায়। বর্ষার আকাশ খুব নাটুকে। পুরো আকাশ স্টেজ যেন। আর মেঘেদের আকার আকৃতিতে কেউ রাজা কেউ গজা। কেউ অসুর কেউ পাখি কেউ জন্তু।

সেসব তো শৈশব কৈশোরে। তারপর বড় হতে থাকা, আর নাটক পালটাতে পালটাতে যাওয়া। হেমন্তের সন্ধ্যায় কঁক কঁক বালিহাসেদের কথোপকথন শোনা। পূর্ণিমার রাতে চাঁদের ফিনিক ফোটা। আর বর্ষায় ছাউনির ধারে বসে বৃষ্টি দেখা, জামমাখা খাওয়া। অন্যথা, বিকেলের রং ঢং দেখা। লিখতে লিখতে লেখাশেখার দিন।

বর্ষার বিকেল, তার দুইপ্রান্ত টেনে ধরে আছি। যতক্ষণ মেঘস্তূপে শৈশব ছোটানো যায় ছুটিয়ে তারপর…

তারপর কী? ভুলে গেছি!

বর্ষায় গলিতে জল জমত। জল জমে জমে থাকত। নিকাশি নালাদের উন্নতি হবে আরও পরে। নয়া টেকনোলজি আসবে, লন্ডনের নাকি শুনি। আরও পরে। যন্ত্রপাতি দিয়ে ময়লা তোলা হবে, গঙ্গা অব্দি পুরো সিউয়ারেজ সাফসুতরো। কলকাতা করপোরেশনের লাল বাড়ির কোন কোণায় নাকি হারিয়ে গেসল বৃটিশদের নগরপত্তনকালীন সিউয়ারেজ ম্যাপ। নালানর্দমারও ম্যাপ থাকে সেটা সে সেইবার প্রথম জানল। পরে তো ইংরেজি ছবিতে খুব জনপ্রিয় দৃশ্য দেখবে, সিউয়ারেজের ভেতরে মারপিট। রাস্তার তলা দিয়ে আরও যে রাস্তা, রিয়ালিটির তলদেশে যেমন হাইপার রিয়ালিটি অথবা মননের তলায় যেমন সাবকনশাস… সেই ধাঁচে… এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা…। মধ্যে না, নিচে। তলদেশে।

সে লিখবে, গঙ্গাজল আর নর্দমার সুড়ঙ্গলালিত সম্পর্কের কথা, তার কবিতায়।

এসবও বর্ষার সঙ্গেই যুক্ত। গভীর যোগাযোগে গ্রথিত। নিরবচ্ছিন্ন ও নিবিড় নর্দমাপথ, নর্দমাসরণি ও বর্ষায় হাঁটুজলে ছপ ছপ করে কলেজ থেকে ফেরা… শাড়ি চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে যেন প্রিন্সেস ডায়ানার গাউন… ছাতায় শানাচ্ছে না, আপাদমস্তক ভিজছে।

অথবা প্রতি বছর ২ জুলাই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গোড়ালি ডোবা জলে বাড়ি এসেছে সে। অথবা তার বান্ধবীরা। প্রায়ই দুজনে। এই দ্বিতীয়জন শুধু এক দোসরা জুলাই থেকে অন্য দোসরা জুলাইতে পালটে গেছে। এক একেলা ছত্রী মেঁ যো আধে আধে ভিগ রহে থে… আধে শুখে আধে গিলে… সেই দুজনের প্রীতিময় ভেজাভিজির কনটেক্সট পালটে পালটে গেছে শুধু। এও কি কম বিষণ্ণতা, কম বিপন্নতা ওদের? অথচ ব্রেকাপ থেকে ব্রেকাপে না গেলেও যে জীবন জানা হয় না, কবিতা লেখাও হয় না, হয়তো!!!

তার কাছে বর্ষা মানে সেই মেয়েটি, যার বিয়ের পর পরই তাকে ছেড়ে চলে গেছে স্বামী। দূর বিদেশে গিয়েছে হয়তো কাজে, হয়তো উপায়ান্তর ছিল না কোনও। কোনও না কোনও ভয়ানক রুজিরুটির টান তাকে সরিয়ে দিয়েছে এ অবসর থেকে। যেভাবে যক্ষকে নির্বাসিত করেছিলেন কুবের। বর্ষা মানে সেই মেয়েটি, যার শরীরের ভেতরে একটা ছোট্ট মটরদানার মতো ভ্রূণ কিন্তু রেখে গেছে তার প্রিয়তম। আর সেই ভ্রূণ বেড়ে উঠছে ক্রমে। আর সে, ক্রমাগতই ভারি হয়ে উঠছে, শ্রাবণ আকাশের মতো। তার দুই বুক ভরে উঠেছে অনাগতর জন্য দুধে, আর সেই বুকদুটি তার অচেনা লেগেছে, ভারি লেগেছে… ক্রমাগতই। যেন পাঁজা পাঁজা মেঘ তার চারিদিকে। কালো, ঘন, ভারি মেঘ সব। চাপ বেঁধে আছে। ঝুলছে, আকাশ থেকে, একটা পুরনো, থমথমে বাড়ির ওপরটায়। তার বাপের বাড়ি। বর তাকে যে বাড়িতে রেখে চলে গেছে। বাতাসে ঝুলছে জলকণা। অসংখ্য ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটারা শূন্যপথে নিরালম্ব বায়ুভূত অবস্থায় আছে। আর সেই বায়ুভূত অবস্থাটা অসহ্য। জামাকাপড় সপসপে হয়ে উঠছে ঘামে, মুহূর্তের মধ্যে। আজকাল তার গরমও বেশিই লাগে। জামাকাপড়ও গায়ে হয় না। সেই উষ্ণতায় যোগ হয় এই ভ্যাপসা, চাপা, মেঘের লেপ গায়ে দেওয়া পৃথিবীর অদ্ভুত থমথমে উষ্ণতা। এখুনি বৃষ্টি নামবে। এখুনি বৃষ্টি নামুক। পাখিদের মতো বাতাসের গন্ধ শুঁকেই সে বলবে। অথচ হবে না, প্রথমটা। এমনিতে তো গত কদিন ধরেই বৃষ্টি হয়েই চলেছিল। সমস্ত গাছপালাগুলো ফেঁপে ফুলে উঠেছে যেন সেই বৃষ্টিতে। গাঢ়, গাঢ়তম সবুজ হয়ে উঠেছে। সরস মাতৃস্তনের মতো নিটোল ও থমথমে সেই সবুজ, কালো মেঘের ছায়া পড়েছে তার ওপরে। ফলে সে সবুজ আরও গাঢ়, আরও অসহ্য গভীর, প্রায় দমবন্ধ হয়ে আসার মতো। হাওয়া নেই, এক বিন্দু হাওয়া নেই। হাওয়ার জায়গা নিয়েছে জলকণা, জলীয় বাষ্প। যেন কেৎলির ওপরে ভাপ জমাট বেঁধে আছে। অসম্ভব ঘাম হচ্ছে, ঘাড়গলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। জামার ভেতরে, ব্রায়ের ভেতরে কুলকুল করে বইছে। সমস্তদিক ধরে চেপে ধরেছে গরম ভেজা তোয়ালের মতন। অন্ধকার আর সবুজ একটা তোয়ালে। এক ইঞ্চিও বাকি না রেখে মাটিতে উপচে উঠছে আগাছারা, তৃষ্ণার্ত সমস্ত ফুটোয় রন্ধ্রে জল ভরতে ভরতে এত ফুলে উঠেছে পাতাগুলো, এত নধর আর অসভ্যের মত ফনফনে হয়ে উঠেছে, যে, যেন একটা সবুজ ভেজা ভেজা জীবন্ত গরম কার্পেট তলা থেকে তার দিকে উঠে আসছে, গা বেয়ে, পা বেয়ে, ওপরে উঠতে শুরু করছে। মেঘ সেই পোয়াতি রমণী। ফুলে ওঠা বুক থেকে যেন এখনি গড়িয়ে পড়বে কলোস্ট্রাম, তারপর ঘন ক্ষীরালো দুধ। মেঘ ছিঁড়ে সব জল নেমে গিয়ে স্থির হবে পৃথিবীটা কবে! ভারাক্রান্ত মেঘের জল ভাঙবে কবে। কবে ঝপঝপ করে জল নেমে গিয়ে থাকবে শুধু অন্তহীন নীল আকাশ। আসবে কথা ভাবা, কাজ করার মতো হিম্মত।

বর্ষা মানে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যাঁর নাম ভীম। ভীমসেন যোশি। চিরদিন ভাবতাম অর্জুনের মতো বীর চাই পুরুষ হিসেবে। কিন্তু ভীমের মতো জোরালো মানুষ ভাবিনি। অথচ পুত্রের নাম ভীমসেন দিয়েছিলেন যে বাবা মা, তাঁরা কি ভেবেছিলেন, এমন তানকর্তবে, এমন জোয়ারি ভরাট কণ্ঠে, এমন উদার বিশাল আকাশের মতো ধারণা করায়, ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে একূল ওকূল ভাসিয়ে দেবেন ভীমসেন যোশি? সুর মল্লার শুনতে শুনতে পাগল হয়ে যাই। গলার ভেতর তিনি যেন মেঘ ধারণ করে আছেন। চোখ বুজে শুনলে মনে হয় এক আকাশ মেঘে ফাটোফাটো হয়ে আছে চরাচর। কালো স্তম্ভের মতো অথচ ঝুলন্ত, সে এক অদ্ভুত দৃশ্য মেঘ জড়ো হবার। আর সেই মেঘ চিরে চিরে বেরিয়ে আসছে মেঘের ডাক, গম্ভীর অথচ তীব্র, ভয়াল অথচ সুন্দর। কাফি ঠাটের রাগ সুরমল্লার। এরই নাম কি সুরদাসি মল্লারও? ইনিই সেই বাদী স্বর মা আর সম্বাদী স্বর সা নিয়ে, রাজার মতো বর্ষাকে বিবরণ করতে বিরাজমান? সেই ভদ্রলোকের কণ্ঠ থেকে তাই ঝরে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ছাঁট। বৃষ্টি আসার আগের গঙ্গার ঘোলাটে জলে মুখ দেখছেন নীল মেঘ। যে মেঘের দল এক অসহ্য পথ অতিক্রম করে বঙ্গোপোসাগরে জমা হয়েছেন, আর ভ্রমণ করবেন গোটা ভারতবর্ষ।

তাই তো, বর্ষাকাল মানেই কালিদাসের কাল। বর্ষাকাল মানেই মেঘদূতম। যে মেঘদূতম ভারতের ভূগোল ইতিহাস, পরিবেশ, নদীমাতৃকতা, মানবসমাজের সঙ্গে বর্ষার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, এমনকি প্রতিটি গাছগাছালি, পাখপাখালির সঙ্গে ভারতীয় বর্ষাকে যুক্ত করে রেখেছেন তাঁর পূর্ব মেঘ আর উত্তর মেঘে। এ এক চলচ্ছবি। এক সিনেমা যেন। প্রতিটি অঞ্চল পেরিয়ে পেরিয়ে মেঘের চলে যাবার কী অপরূপ বিবরণ! আর, যে কবিটি, আমাদের বাঙালিদের কাছে, বর্ষাকে করে তুললেন একেবারে অনিবার্য, একেবারে চূড়ান্ত আত্মমথনের কাল?

বর্ষা মানেই রবীন্দ্রনাথ যাদের কাছে, সেই শ্বেত শ্মশ্রু সাধকমূর্তির পরেও, আরও অনেক কিছুই। কবীর সুমন বলেছিলেন, কারও কাছে মেঘ মানেই নোংরা জল… আবার বাংলাদেশের কবি কুলদা রায় “বৃষ্টি ঠাকুর’ কবিতায় লিখলেন তাই, “বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখব না। ঠাকুর লিখেছেন। বৃষ্টির চেয়েও বেশি। নিয়মিত জল ও পাতায়। ঠাকুরের পিতৃদেব জানে, বালিশের নিচে বৃষ্টিচিহ্ন রেখে দিলে বৃষ্টিফুল ফোটে। অথচ ঠাকুর একা একা ঘোরে। জলে। হাওয়ায়। অথবা দূর সমুদ্রের পিছে।” আর, বর্ষায় আর কী কী হয়, সে কথা জানে যাদের ফুটো ছাত, ভাঙা ঘর। যাদের ঘরে বিপিএলের চাল বাড়ন্ত। তারা। তাদের হয়েই এক অন্য বর্ষার গল্প বলেন মন্থন মোদক।

আমাদের রান্নাঘরের টালির ফাঁক বেয়ে/একফোঁটা দু ফোঁটা তিনফোঁটা করতে করতে/ঝমঝমিয়ে উঠছে সুরধ্বনি।/গৃহকর্ত্রী পিঁড়ি উলটে দেয় পবনদেবতাকে/দু ঠোঁটে ভয় জমাট বেঁধে আছে, আমার পাশে আমার ছোটবোন/জাপটে ধরে আছে বাঁশের খুঁটি।/তখনো রান্না হয়নি। জল ঢুকছে উনুনে।/বুভুক্ষু দু চোখে তিন্নি দাঁড়িয়ে আছে মেঝেতে।/হাঁসগুলি প্যাকপ্যাক করে জষ্টির প্রথম জলে। (সংস্কৃতি, মন্থন মোদক)

তার কাছে বর্ষা মানে ওই মেয়েটি। যার অক্ষর পরিচয়ের খাতা বৃষ্টির জলে ডুবে গেছে। চালের বাতায় রাখা মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট উইয়ে কেটে দিয়েছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...