হুল বিদ্রোহর উত্তরাধিকার : নিশানা হোক মেকি দরদ আর প্রকাশ্য দমন

সৌভিক ঘোষাল

 

কিছু মুহূর্ত নতুন ইতিহাস তৈরি করে দেয়। যদিও সেই মুহূর্তের প্রস্তুতি চলতে থাকে দীর্ঘ দিন ধরে। কিছু মানুষ ইতিহাসের পাতায় নায়ক হিসেবে সামনে আসেন। কিন্তু ইতিহাসের সেই নায়কদের নির্মাণে ভূমিকা রাখে আরও অসংখ্য জানা অজানা মানুষের ছোট বড় কীর্তিকাহিনী। আষাঢ়ের শুরুতে এখন প্রতি বছর আমাদের আলাপ আলোচনায়, সংবাদপত্রের পাতায়, নেতা মন্ত্রীদের বক্তৃতায়, সভাসমিতিতে উঠে আসতে দেখি নির্দিষ্ট একটি তারিখ, ৩০ জুনকে। দিনটিকে ‘পালন’ করা হয় ‘হুল দিবস’ হিসেবে। উঠে আসে সিধু কানুর মতো এই আন্দোলনের অগ্রগণ্য নেতাদের নাম। কেউ কেউ নামগুলির সঠিক উচ্চারণের তাগিদে বানান একটু বদলে নেন — সিধো কানহু-তে। তাদের নামে দেওয়া হয় রাস্তার নাম। তবে সরণী না বলে তাকে সাঁওতাল ভাষা অনুযায়ী বলা হয় ডহর। এতে অবশ্য ‘দিবস পালক’ ক্ষমতাসীনদের কারও কারও অসুবিধেও তৈরি হয়ে যায়। ভোট ব্যাঙ্ক বাড়ানোর নিরন্তর তাগিদে মত্ত কোনও মূর্খ মন্ত্রী মঞ্চ থেকে জানতে চান ‘ডহর বাবু’র পরিবারের কেউ তার সামনে অনুগ্রহভাজন কিনা। দিবস পালনের আড়ালে শুধু শাসকের ইতিহাস অজ্ঞতাই সামনে আসে না, আসে ঔদ্ধত্যও। বঞ্চনার দীর্ঘ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আদিবাসীদের বিদ্রোহকে পুলিশী সন্ত্রাস দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, কখনও বা সেই আন্দোলনের নেতাদের খুন করা হয়, শোনানো হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা। সময় বদলায়, পরিবর্তনের স্লোগান তুলে ক্ষমতা বদল হয়, কিন্তু একশো ষাট বছর আগের আদিবাসী বিদ্রোহকে যেরম বুলেটে আর বেয়নেটে দমন করার মানসিকতা ছিল, তা পালটায় না। দু টাকা কেজি দরে চালের বদান্যতার বিনিময়ে কিনে নিতে চাওয়া হয় তার সব মর্যাদা আর গণতান্ত্রিক অধিকার, বিরুদ্ধতার শাস্তি সেখানে শুধুই হনন আর আজীবন কারাবরণ।

এই তো কদিন আগে লালগড় আন্দোলনের মানুষদের, আদিবাসী আন্দোলনের নেতাদের শোনানো হল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নিদান। এবারের এই ৩০ জুন হুল উৎসবের কদিন আগেই এই অদ্ভুত বিচার শুনলাম আমরা। আগেই অবশ্য আন্দোলনের নেতাদের একাংশকে বশংবদ করে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, যাদের পারা যায়নি তাদের খুন করা হয়েছে। শাসক বারবার চেষ্টা করে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের উপেক্ষা করার, শোষণ করার। এটাই তার শাসনের কায়দা। কেবল বিপদ বুঝলেই সে তার একাংশকে আত্তীকরণ করে বিপদ সামলাতে চায় বা সামান্য কিছু দানধ্যানের অভিনয় করে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রয়ণের চেষ্টা করে। সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসের পাতা খুললে যেমন, তেমনি আমাদের চারপাশে চোখ কান খোলা রাখলেও আমরা একই অভিনয় পুনরাবৃত্ত হতে দেখি।

কী হয়েছিল সেই উনিশ শতকের মধ্যপর্বে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে? কেন ১৮৫৫-র ৩০ জুন এক দাবানল জ্বলে উঠল ছোটনাগপুর অঞ্চলে? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর তো জানা। বঞ্চনা।

উনিশ শতকের সেই মধ্যপর্বে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী নানাভাবে ব্যবহৃত ও শোষিত হতে থাকে। বাণিজ্যের দিক থেকে, ক্ষেতের মাঠে আর ফসল বিক্রিতে আবার অন্যদিকে রেল পত্তনে কুলিশ্রমিক হিসেবে। তাদের প্রাথমিক ক্ষোভ কোম্পানির প্রতি ততটা ছিল না, যতটা ছিল প্রত্যক্ষ শোষক হিন্দুবাবুদের প্রতি। তারা সাঁওতালদের কীভাবে ঠকাতেন তার বর্ণনা পাওয়া যাবে হান্টার রচিত ‘অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল’ বইতে। হান্টার লিখছেন, “হিন্দু মহাজনেরা গরীব সাঁওতালদের যে কোনও কায়দায় ঠকাত। জংলিরা [ভাষা হান্টারের] পরিষ্কার মাখন নিয়ে আসত। হিন্দু ব্যবসায়ীরা নকল তলা লাগানো কৌটোয় মাখন মেপে তাদের ঠকাত। নুন, তেল, কাপড় ও বারুদের বিনিময়ে সাঁওতালেরা তাদের উৎপন্ন চাল দিত। হিন্দুরা নেওয়ার সময় যে ওজন নিত, দেয়ার সময় তাদের বাটখারা ছিল অনেক হাল্কা ওজনের। যদি কোনও সাঁওতাল মৃদু প্রতিবাদ করত, মহাজনেরা তাকে বোঝাত নুন হল আবগারি দ্রব্য, তাই এর ওজন অন্যরকম পদ্ধতিতে করতে হবে।

জিনিসপত্র কেনাবেচায় যেটুকু লাভ হত তার সঙ্গে যুক্ত হত দাদনের উৎপাদন। সাঁওতালরা যখন জঙ্গল কেটে আবাদ বানাত কিঞ্চিৎ শস্য ঋণ দিয়ে মহাজনেরা তাদের ফাঁদে জড়িয়ে নিত। কিছু পরে নিজেদের কাটা জঙ্গল থেকে পরিশ্রমে উদ্ধার করা জমি থেকে সাঁওতালরা বিতাড়িত হত, জমি চলে যেত মহাজনদের হাতে।

ঋণ শোধ হোক এটা মহাজন চাইতেন না এবং ঋণজালে আবদ্ধ করে সাঁওতালদের ক্রীতদাস বানিয়ে ফেলার আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছিল। ক্রীতদাস সাঁওতাল কাজ করতে অরাজি হলে মালিক তার খাবার বন্ধ করে দিত। অন্যত্র কাজ করতে গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা রজু করত এবং জেলের শাস্তির ভয় দেখিয়ে ক্রীতদাস হিসেবে আবদ্ধ রাখত। সাঁওতাল অঞ্চলের খাজনাও কোম্পানির নির্দেশে ৬৬৮ পাউন্ড থেকে বেড়ে ১৮৫৪ সালে দাঁড়ায় ৬৮০ পাউন্ডে। এই প্রেক্ষাপটেই সাঁওতালরা সিধু কানুর নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয় এবং ৩০ জুন ১৮৫৫ তে তাদের এক বিশাল জমায়েত অনির্দিষ্ট প্রতিকারের সন্ধানে কোলকাতা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।

এই বিদ্রোহের বিবরণ যারা লিখেছেন সেই হান্টার, বুকল্যান্ডদের লেখা বা বিভিন্ন সরকারি নথি চিঠিপত্র থেকে দেখা যায় এই লং মার্চ বা জাঠা প্রথমদিকে সুশৃঙ্খল ছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর খাবারে টান পড়তে যাত্রাপথের আশেপাশের গ্রামগুলিতে লুঠপাট শুরু হয়। ইংরেজ সেনা ও প্রশাসকদের ওপর বিদ্রোহ দমনের জন্য চাপ আসে। পুলিশ যায় এবং বিদ্রোহের মুখে পড়ে। কয়েকজন পুলিশকে হত্যা করা হয়। এরপর কোম্পানির শাসকেরা বিদ্রোহ দমনে বিরাট সেনাবাহিনী নামায়। সাঁওতালদের নানাদিক থেকে সেনারা ঘিরে ফেলতে থাকে। বাধ্য হয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে সাঁওতালেরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। বর্ষাকালে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমনে সাফল্য না পেলেও শীতকাল আসলে পরিস্থিতি তাদের পক্ষে অনুকুল হয়ে আসে। দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে ওই বছরের শেষের দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। অসংখ্য সাঁওতাল আত্মসমর্পণ করেন, মারা যান। সরকার আত্মসমর্পণকারী সাঁওতালদের জন্য সাধারণ ক্ষমার নীতি ঘোষণা করলেও আন্দোলনের নেতাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডই বহাল থাকে। সিধু কানু ছাড়াও আন্দোলনে শহীদ হন অজস্র বীর। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন সিং রে মাঝি, নফর পাল, শ্যাম মাল, পরান মানঝি, সিংরয় মানঝি, মানঝি (পিতা কুম্ভীর), লাকুন মানঝি, কালু মানঝি, ধুনিয়া মানঝি, রুরু মানঝি, মোথা মানঝি, বাগড়ু মানঝি, বিশু মানঝি, কান মানঝি, রাজ মানঝি, দোয়েল মানঝি, শীতল মানঝি, বীর সিং, কুত্তোর মানঝি, রামণ মানঝি।

চলচ্চিত্রের টেকনিক ব্যবহার করে, জাম্পকাট করে যদি চলে আসা যায় আমাদের এই সময়ে তাহলে আমাদের চোখের সামনে এই হুল উৎসব পালনের মুহূর্তে ভেসে উঠবে লালমোহন টুডুর লাস, কারাবন্দী ছত্রধরের মুখ। ‘জঙ্গলমহল হাসছে’ এই সরকারি বিজ্ঞাপনকে সামনে রেখেই আমাদের রাজ্যে এবং দেশের আদিবাসী অঞ্চলে শোনা যায় ভারি বুটের শব্দ। মাওবাদী দমনের বাহানায় অপারেশন গ্রিন হান্ট। জল জমি জঙ্গলকে মানুষের হাত থেকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেবার চক্রান্ত এবং তার সামরিক কুচকাওয়াজ এই সময়ের অন্যতম বাস্তবতা। আদিবাসী বনবাসী কৃষিজীবী মানুষেরা কলিঙ্গনগর লালগড় পসকো দাদড়ি নিয়মগিরি যেখানেই প্রাকৃতিক সম্পদকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেবার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে নামছেন, সেখানেই নেমে আসছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। কর্পোরেটের মুক্তাঞ্চল তৈরি করার জন্য কোবরা গ্রে হাউন্ড যেমন প্রস্তুত, তেমনি প্রস্তুত জমি বিল, খনি বিল। দেশের খনিগুলিকে ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য নিলাম করে দেওয়া হচ্ছে, চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে সংবিধানের পঞ্চম সিডিউলে বর্ণিত বনবাসী মানুষের অধিকার। লুঠের সেই জমানায় শাসন ছিল কোম্পানির হাতে, আর এখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জায়গায় এসেছে আধুনিক কর্পোরেটরা। বকলমে তারাই চালাচ্ছে দেশ। আম্বানি আদানির হাত আজ প্রধানমন্ত্রীর পিঠে, মুখে ভরসার হাসি। দেশ ছাড়িয়ে বাইরেও কর্পোরেটের এজেন্ট হয়ে স্বার্থরক্ষাকারী চুক্তিতে সামিল হচ্ছেন কর্ণধার।

এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় স্বস্তির সময় নয়। লুঠ আর দমনের বিরুদ্ধে, মানুষের অধিকারের সপক্ষে এই সময়ের হুল দিবসকে, সাঁওতাল বিদ্রোহ, আদিবাসী বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহকে, তার গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতে হবে। ‘ডহর বাবু’কে খোঁজা ভণ্ড শাসকেরা যখন হুল দিবস ও আদিবাসী বিদ্রোহকে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর অপচেষ্টায় সীমায়িত করতে চায়, তখন শাসকের চির চেনা সেই লোকদেখানো আত্তীকরণ কৌশলের আসল চেহারাটা আমাদের স্পষ্ট করে দিতেই হবে। শাসককে উন্মোচন করে জনতার সংগ্রামকে নানা নতুন আঙ্গিকে প্রেরণায় নিয়ত পুনরাবিষ্কার করার মধ্যে দিয়েই পালিত হোক আমাদের ‘হুল উৎসব’।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...