গৃহবন্দি গণতন্ত্র

কৌশিক দত্ত

 

সভাকবি আর স্বভাবকবির পার্থক্য চিরকালই ছিল। সভাকবি রাজার পোষ্য, রাজবন্দনা তাঁর কর্তব্য, স্বর্ণমুদ্রা তাঁর প্রাপ্য। স্বভাবকবি বাস করেন অভাবে, গান করেন স্ব-ভাবে। তাঁর বিদ্যা ও বুদ্ধি অবিক্রীত বলেই অবিকৃত। কখন যে রাজাকে ন্যাংটো বলে ফেলেন, তার ঠিক নেই। রাজন্যবর্গ এঁদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না কোনোকালেই। তবু তাঁরা স্বাধীন পণ্ডিত আর কবিদের সাধারণত হত্যা করতেন না, হয়ত সমাজের বিবেকটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন খানিক অনুভব করতেন বলেই। হীরক রাজার দেশে অবশ্য পাঠশালা বন্ধ করে পণ্ডিত মশাইকে দেশদ্রোহী চিহ্নিত করা হত। কথা ছিল, রাজতন্ত্র গিয়ে গণতন্ত্র এলে বুদ্ধি হবে স্বাধীন, জ্ঞান হবে মুক্ত, বিচার হবে সত্যনিষ্ঠ। হল বিপরীত। “সদা মিথ্যা কথা বলিব” মন্ত্রটি যারা “সকালে উঠিয়া” মনে মনে পাঠ করল না, তাদের জন্য বরাদ্দ হল পঞ্চাশ ঘা বেত। পাশের সিটের দরিদ্র ছাত্রটিকে অভুক্ত দেখে টিফিন ভাগ করে খাবার অপরাধে ভালো ছেলে রামকে পাঠানো হল বনবাসে। অন্ধকারকে রোজ আরো ঘন, আরো কালো করে লেপে দেওয়া হচ্ছে আকাশে।

রাষ্ট্র নামক ব্যবস্থাটি আবশ্যিকভাবে ক্ষমতাকে ব্যবহার করেই একটি অঞ্চলকে শাসন করে। ক্ষমতার উৎস বা চরিত্র আলাদা হতে পারে, শাসনের পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যেরও ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু বিষয়গুলো থাকেই। শাসনকে শুধুমাত্র অত্যাচার হিসেবেই চিহ্নিত করা যায় না। রাজ্যশাসন রাষ্ট্রের দায় এবং দায়িত্বও বটে। অ্যানার্কিস্ট ছাড়া সকলেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় কিছু শৃঙ্খলার কথা বলেন। শৃঙ্খলা বা আইনের শাসন বজায় রাখতে গেলে সংবিধান ও প্রশাসন প্রজাসাধারণের কাছ থেকে কিছু মান্যতা আশা করে। এই অব্দি সহজবোধ্য। কিন্তু কিছু সমস্যা দেখা দেয় এর প্রয়োগে। সংক্ষেপে কয়েকটা বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন।

১) রাষ্ট্র পরিচালনা করেন কিছু ব্যক্তি বা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী। সকলেই জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে কিছু ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের ঝুলি কাঁধে বয়ে বেড়ান। ক্ষমতাধর, ক্ষমতালিপ্সু, ক্ষমতাবঞ্চিত এবং প্রতিস্পর্ধী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে, অতএব, অনিবার্য স্বার্থের সংঘাত। রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় এই সব সংঘাতের ছাপ পড়বেই। গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য এই সংঘাত ও তার নিরসনকে যথাসম্ভব নিয়মানুবর্তী করা এবং সব গোষ্ঠীকে নিজের স্বার্থ তুলে ধরার সমান সুযোগ দেওয়া।

২) সংবিধান বা প্রশাসন যে মান্যতা প্রত্যাশা করে, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তা প্রশাসক ও প্রজাসাধারণের ওপর সমানভাবে লাগু হবার কথা। শাসক স্বাধিকারপ্রমত্ততায় সংবিধান লঙ্ঘন করতে পারেন না। সংবিধান ধর্মগ্রন্থের মতো অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। পরিশোধিত এবং উন্নততর হতে থাকা আধুনিক সংবিধানগুলির সম্মাননীয় বৈশিষ্ট্য। তা সত্ত্বেও, সংবিধান যখন যে অবস্থায় আছে, তখন সেই রূপে যথাসম্ভব মান্য। সংশোধনের দাবি ও আলোচনা, এবং এখনকার মতো নিয়ম মেনে চলা, দুটোই পাশাপাশি চলতে পারে। অন্যরকম হলে গণতন্ত্র আহত হয়। বিশেষত শাসক স্বয়ং যদি অসাংবিধানিক কাজ করতে থাকেন, তবে তার ফল ভয়াবহ।

৩) শৃঙ্খলা কখন শৃঙ্খল হয়ে ওঠে, তা বুঝতে গেলে রাজনীতিবোধ আর সংবেদনশীলতা প্রয়োজন সকল তরফে। গণতন্ত্র সভ্যতার শৈশবের রূপকথা নয়, পরিণত বয়সের অর্জন। পরিণত ও সুস্থ মানসিকতা নিয়েই তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গণতন্ত্রে প্রশ্ন, বিতর্ক, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ইত্যাদির সম্মান অতি উচ্চ। এগুলো করার ব্যাপারে দায়িত্ববোধ প্রত্যাশিত, কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি এগুলোকে সম্মান দেবার ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া।

বাস্তবে রাষ্ট্র তার আচরণে কতটা গণতান্ত্রিক হবে বা কতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে, তা নির্ভর করে বহু বিষয় মিলে গড়ে ওঠা সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর। মোটের ওপর রাষ্ট্রের আচরণে শাসকের রাজনৈতিক মনোভাবের পাশাপাশি আত্মপ্রত্যয়ের আভাসও পাওয়া যায়। ব্যক্তি হিসেবে আমরা যখন প্রত্যয়ী হতে পারি না, কথা রাখতে পারি না, ব্যর্থ হতে থাকি, ধরা পড়ে যাবার ভয়ে থাকি, তখন অসহিষ্ণু হয়ে উঠি, সমালোচনা সহ্য করতে পারি না, প্রতিবাদীর দিকে হাত-পা ছুঁড়ি। রাষ্ট্রও তাই করে। ব্যর্থতাকে চাপা দিয়ে ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। এটা খানিকটা রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র, সুতরাং দলমতনির্বিশেষে প্রযোজ্য, কিন্তু এই ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্র কত দূর পর্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠবে, তা নির্ভর করে শাসকের নীতি ও ন্যায়বোধের ওপর। ইতিহাসে এরকম মরিয়া প্রশাসনিক অবদমনের নজির বহু আছে। ভারতেও অতীতে দেখা গেছে। আবার দেখা যাচ্ছে, অন্য চেহারায়, অনন্য রূপে।

নাগরিকদের মধ্যে বিভাজনের রাজনীতি আমাদের দেশে বিভিন্ন দল বিভিন্নভাবে করে থাকেন। জাত, ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, পেশা, সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ, ভাষা, ইত্যাদি যা কিছু অবলম্বন করে মানুষের পরিচয় বা আইডেন্টিটি গড়ে উঠতে পারে, তার প্রত্যেকটির ভিত্তিতেই মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। লড়িয়ে দেওয়া চলতেই থাকে। বর্তমান শাসকদের বিভাজনের হাতিয়ার ছিল মূলত ধর্ম, যদিও ধর্ম প্রকৃতপক্ষে তাঁদের কাছে রাজনৈতিক তাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু কখনো ছিল বলে মনে হয়নি। বর্তমানে বিভাজন প্রক্রিয়া ক্রমশ আরো জটিল এবং আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। বিভক্ত গোষ্ঠীগুলির বিবদমানতাও ক্রমশ উগ্র হতে হতে দাঙ্গার দিকে চলেছে। সবই যেন এক সাজানো নাটকের দৃশ্য, যার মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নগুলো থেকে মানুষের চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা।

এসব তাও রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী, সরাসরি সরকারের নয়। সাম্প্রতিক যে ঘটনার প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সকলে বিশেষ চিন্তিত এবং যা একেবারেই সরকারের নিজস্ব কাজ, তা হল একই দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তারি। তল্লাশি চালানোর বা গ্রেপ্তার করার ধরন, নিয়মহীনতা, ইত্যাদি সকলকে সচকিত করে তুলেছে। জানুয়ারি মাসে একটি মিছিলে ঘটে যাওয়া গণ্ডগোলে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হল না, অথচ অভিযুক্তদের এক অনুচরের এফআইআর-এর ভিত্তিতে আট মাস পরে হঠাৎ একদিনে অভিযান চালিয়ে দুর্ধর্ষ দুশমন ধরার কায়দায় প্রখর রুদ্রের দল বন্দি করলেন কবি, আইনজীবী, সমাজকর্মীদের, তছনছ করলেন প্রবীণ অধ্যাপকের ঘর… এ বড় শুভ ইঙ্গিত নয়। দেশ জুড়ে সমালোচকদের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া, প্রতিস্পর্ধাকে পদানত করা আর একই সাথে প্রধানমন্ত্রী হত্যার ষড়যন্ত্রের রটনাকে কাজে লাগিয়ে টাকার দাম কমে যাওয়া থেকে এরোপ্লেন ক্রয়ের আইনগত দিক নিয়ে ওঠা যাবতীয় আলোচনাকে চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা খুব বেশি রকম স্পষ্ট। এই বিষয়টি নিয়েই তো মধ্যে বিদগ্ধজনেরা অনেক কিছু বলেছেন ও লিখেছেন। পুনরাবৃত্তি অপ্রয়োজনীয়। সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে বহুস্তরীয় দীর্ঘ আলোচনার পরিসরও এ নয়। বরং এই প্রেক্ষিতে খানিক বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি কথা বলি।

১) প্রধানমন্ত্রী হত্যার চক্রান্ত অতি গুরুতর একটি বিষয়। তা নিয়ে গুজব রটিয়ে ভুল মানুষকে গ্রেপ্তার করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে চেষ্টা করলে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে দীর্ঘমেয়াদে লঘু করে দেওয়া হয়, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।

২) বিশাল অভিযান চালিয়ে দেশের গণ্যমান্য নাগরিকদের গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ নিজেদের অভিযোগগুলো সম্বন্ধেই নিশ্চিত নয়, এটা প্রশাসনের পক্ষে খুব খারাপ বিজ্ঞাপন। পুণে পুলিশ বড়ই অগোছালো কাজ করেছেন। ভবিষ্যতে পুলিশ ও প্রশাসনকে আরো গুছিয়ে নিজেদের ভার্শন নির্মাণ করা শিখতে হবে। এমনকি মিথ্যা বলারও একটা আর্ট আছে।

৩) “ফ্যাসিস্ট” শব্দটি একটি রাজনৈতিক গালি বলে জানতাম। পুলিশ এবং সরকারি আইনজীবী নিজেরাই আদালতে দাঁড়িয়ে দেশের সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলছেন শুনে হতভম্ব হয়েছি আমরা সকলেই। তবে কি সরকার নিজেদের এই নামে অভিহিত করতে চান? ফ্যাসিবাদী কর্মসূচি নিয়ে কি আর কোনো রাখঢাক থাকবে না এবার থেকে?

৪) বাড়িতে ভীমরাও আম্বেদকরের ছবি রাখা নিয়ে পুলিশ প্রশ্ন তুলেছে শুনে হতবাক হয়েছি। আম্বেদকর কবে থেকে সরকারের চোখে সন্দেহজনক হলেন? সংবিধান রচয়িতার ছবি যিনি বাড়ির দেওয়ালে টাঙান, তাঁকে প্রথমেই দেশের সংবিধান ও আইনে আস্থাশীল একজন সৎ দেশপ্রেমিক বলে ধরে নেব। কোনো উগ্রপন্থী গোষ্ঠী বরং সংবিধানে বিশ্বাসী মানুষকে আক্রমণ করতে পারে, সরকার কীভাবে তা করেন? তবে কি সরকার সংবিধানবিরোধী?

৫) বাড়িতে প্রচুর বইপত্র রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে শুনলাম। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জ্ঞানচর্চাকেও রুদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। এ তো বেদবিরুদ্ধ অবস্থান! পুরাণ এবং বিষ্ণুরদশাবতার সম্বন্ধে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা নিশ্চয় হয়গ্রীবের কথা জানেন। তিনি বেদ চুরি করে মানুষের কাছ থেকে জ্ঞানকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিষ্ণুর প্রথম অবতার তাঁকে বধ করে মানুষের হাতে বেদ ফিরিয়ে দেন। অর্থাৎ ভারতীয় সনাতন ঐতিহ্যে মানবজীবনে জ্ঞানের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এর অন্যথা যাঁরা করবেন, তাঁরা নিজ দায়িত্বে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করবেন।

৬) পুরাণের কথা যখন উঠলই, তখন রামায়ণ আর মহাভারত বা ভাগবতের শিক্ষাটুকুও অন্তরে থাকুক।

৬ক) আদিকবি বাল্মীকির মন্দির দেখেছি দিল্লিতে এবং পরিচয় হয়েছে বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে। এই সম্প্রদায়ের কবির হাতেই আদিতে রামায়ণ প্রণীত, তা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। বাল্মীকিরা দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত। বনবাসী শ্রীরাম যে ভক্ত বৃদ্ধার এঁটো ফলগুলি ভালোবেসে খেয়েছিলেন, তিনি ছিলেন শবরী। দলিতদের অবদমন করলে এবং দলিতদের স্বার্থে কথা বলা মানুষদের দেশদ্রোহী সাজালে শ্রীরামচন্দ্রকে অপমান করা হয়।

৬খ) রাবণ ছিলেন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ এবং শিব ও দুর্গার পূজারী। এত বড় পণ্ডিত ও ভক্ত ছিলেন যে অকালবোধনের দুর্গাপূজা তাঁকে দিয়েই করাতে হয়েছিল। তবু তাঁকে বধ করে বিশ্বকে ভারমুক্ত করেছিলেন রামরূপী নারায়ণ, কারণ রাবণ যাবতীয় প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে নিজের অধীন করে ফেলছিলেন এবং পৃথিবীর পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠেছিলেন। অর্থাৎ সনাতন ধর্মে ভক্তিমান হওয়ার চেয়েও ভালো মানুষ হওয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সকল সম্পদ ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে অশুভ বলা হয়েছে।

৬গ) কংস ছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রের বন্ধুস্থানীয়। কিন্তু তিনি অত্যাচারী ছিলেন বলে স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁকে শাস্তি দেন। আবারও সেই রামায়ণের শিক্ষা। কৃষ্ণ গোবর্ধন পাহাড় ধারণ করে সাধারণ কৃষিজীবী এবং গোপালক মানুষকে দেবরাজের রোষ থেকে বাঁচিয়ে স্বয়ং দেবরাজের দম্ভ চূর্ণ করেছিলেন। কৃষ্ণ আদি প্রতিস্পর্ধী। যে রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা গঠনমূলকভাবে দরিদ্র প্রজাসাধারণের পক্ষ অবলম্বন করে তাঁদের রাজরোষ ও অত্যাচার থেকে রক্ষা করে, তাকে অসম্মান করা মানে কৃষ্ণকে অস্বীকার করা।

অথচ এসব করা হয়েই চলেছে। যাঁরা করছেন, তাঁরা সনাতন ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল বলে মনে হয় না।

৭) ডঃ বিনায়ক সেন গ্রেপ্তার হবার সময় থেকেই একটি কথা বারবার বলছি, আবার বলি। বন্দুকের রাজনীতি থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখতে চাইলে তাঁদের কথা বলতে দিতে হবে। যাঁরা অত্যাচারিতের পক্ষ নিয়ে আইনগত পদ্ধতিতে কথা বলছেন, আলোচনা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে মানবাধিকার আদায়ের চেষ্টা করছেন, তাঁদের বারবার জোর করে থামিয়ে দিলে, বন্দি করলে, হত্যা করলে বন্দুকধারীদের জন্য মুক্তাঙ্গন তৈরি করে দেওয়া হয়। শাসক যখন আলোচনার দরজা সজোরে বন্ধ করে দেন, তখনি বন্দুকের নলকে ক্ষমতার উৎস বলার উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। গণতন্ত্রে শ্রদ্ধাশীল বামপন্থী সমাজকর্মী আর সমাজসচেতন লিবারেল বুদ্ধিজীবীদের সকলকে জেলবন্দি করলে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বিশ্বাসীরাই বিরোধী রাজনীতিতে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠবেন।

৮) সবশেষে আরেকটি আশঙ্কার কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রাণের জন্য সত্যিই চিন্তিত বোধ করছি। সাম্প্রতিক অস্থিরতা প্রমাণ করছে, বর্তমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত সরকার (ক্ষমতাসীন দল) বিশেষ স্বস্তিতে নেই। বিভিন্ন সমীক্ষাও ক্রমহ্রাসমান জনসমর্থনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দল ও সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে তাঁরা সব কিছু করতে পারেন। সেই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার চক্রান্তের গল্প। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস স্মরণ করে তৈরি হচ্ছে এক অন্য সন্দেহ। এই ষড়যন্ত্রের কথা বলতে বলতে বাস্তবেই নরেন্দ্র মোদীকে হত্যা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে না তো? ২০১৯-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে যদি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের জনপ্রিয়তা ভালো অবস্থায় না থাকে, যদি ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মায় নির্বাচনী বৈতরণী পার করে দেবার ক্ষমতা হারান প্রধানমন্ত্রী, তবে নরেন্দ্র মোদীর নিজের দল ও সংঘ রাজনৈতিক স্বার্থে শেষ মুহূর্তে তাঁকেই বলি দিয়ে দেবে না তো? নির্বাচনের কদিন আগে সহসা আততায়ীর হাতে মোদীজির মৃত্যু, তার প্রেক্ষিতে প্রবল আবেগের বন্যা, দাঙ্গা এবং মসনদে বিজেপির পুনর্বহাল হওয়া… এই ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী চিত্রনাট্যটি কল্পনা করতেই শিউরে উঠছি, কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরিস্থিতি এমনই যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবিশ্বাস করতেও পারছি না। আশা করি প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই সম্ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন এবং নিজস্ব বিচক্ষণতা কাজে লাগিয়ে তিনি আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হবেন। নরেন্দ্র মোদীকে ব্যক্তি হিসেবে পছন্দ করি বা না করি, গণতান্ত্রিক দেশের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অন্তর্ঘাতের শিকার না হলে খুশি হব।

প্রতিদিন সকলেই বুঝতে পারছেন, দেশ ভালো নেই। আসলে পৃথিবীই ভালো নেই। সিরিয়া থেকে মায়ানমার, আমেরিকা থেকে কোরিয়া, কোথায় বা ভালো আছে মানুষ? একদিকে বাজার নিজের নিয়মে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। অন্যদিকে বেড়ে যাচ্ছে মানুষের চাহিদা আর অসন্তোষ। বাজার বাড়ানোর প্রয়োজনেই মানুষের চাহিদা বাড়ানো হয়েছে, আবার বাজারের মুনাফা বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে সম্পদ বণ্টনের অসাম্য। এমতাবস্থায় অশান্তি অনিবার্য। যাঁরা নিজেদের বহুযুগ ধরে বঞ্চিত মনে করছেন, তাঁদের কাছ থেকে নমনীয় সহিষ্ণুতা আশা করা কঠিন। আবার সম্পদ ও ক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁরাও ক্ষমতার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন যে ইতিহাস ও রাজনীতির শিক্ষা সত্ত্বেও তাঁরা গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে ক্রমাগত বিচ্যুত হচ্ছেন। দুনিয়া জুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমশ গণতন্ত্রে আস্থাহীন দমনশীল লৌহমুষ্টিতে বদ্ধ হচ্ছে। ক্ষমতার ধর্মই তাই; টিকে থাকার জন্য হিংস্র হয়ে ওঠা। কিন্তু শাসক চাইলে নিজেকে ক্ষমতার এই অমোঘ নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখতে পারেন ইতিহাসকে মনে রেখে। জার্মানি, স্পেন, চিলি, আর্জেন্টিনা, সর্বত্র লৌহমুষ্টির দমননীতি সাফল্যের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়েছে, কিন্তু বড়ই স্বল্প সময়ের জন্য। পদার্থবিজ্ঞানও বলে, চরম অসাম্য সমেত একটি সুস্থিত অবস্থা তৈরি হতে পারে না, ব্যবস্থাটির ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় প্রতি মুহূর্তে।

রাত গভীর হচ্ছে। অন্ধকার গাঢ়তর হবে বলেই মনে হয়। কিন্তু অন্ধকার চিরস্থায়ী হয় না। সবার চোখ বেঁধে রাখলেও সূর্যের উদয় রোখা যায় না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4646 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অসাধারণ বিশ্লেষণী প্রবন্ধ। এই ঘটনার পর পড়া প্রবন্ধগুলোর মধ্যে সেরা।

Leave a Reply to Aranya Mukhopadhyay Cancel reply