শারদসংখ্যা : সেকাল একাল

প্রতিভা সরকার

 

যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কী সেই বস্তু যা আছে অথচ নেই, উত্তর হতে পারে পূজাবার্ষিকী। যদি প্রশ্ন হয় অমাবস্যার চন্দ্রকলার মতো কি ক্রমাগত ক্ষীণতনু ধারণ করছে, উত্তর হতে পারে পূজাসংখ্যা সাহিত্যপত্রিকা। কারণ আজকাল পূজাসংখ্যার সেই রমরমা নেই, পড়ার জন্য সেই আকুলিবিকুলিই বা কই! স্বাভাবিক, ডিমভরা কইমাছের মতো পূজাবার্ষিকীর সেই ঠাসা চেহারা শুধরে এখন সে শহুরে ললনার মতো দিব্যি স্লিম।

কিন্তু এমন দিন চিরকাল ছিল না। শহরে মফস্বলে বাচ্চাবুড়ো সবাই মহালয়ার সময় পেয়ে যেত সচিত্র পূজাবার্ষিকী, সূচিপত্রে চোখ বুলিয়েই দিল খুশ হয়ে যেত, চারদিক ম’ ম’ করত পুজোর গন্ধে। শিউলি ফুল, নদীর চরে মাথা দোলানো কাশের গুচ্ছ, হাতে একখানি পূজাসংখ্যা — এই ছিল আমাদের দুর্গাপূজার দিব্য অনুষঙ্গ।

যদিও কলকাতায় প্রথম পূজাসংখ্যার জন্ম প্রায় দেড়শ বছর আগে, ১৮৭৩ সালে, কিন্তু ধারণাটি তখন এত সর্বজনীন হয়ে উঠতে সময় লেগেছিল। ব্রাহ্ম কুলপতি কেশব সেন সুলভ সমাচার নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১২৮০ বঙ্গাব্দের দুর্গাপুজোর সময় এই পত্রিকা সঙ্গে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। এটির নাম ছিল ছুটির সুলভ। এই পত্রিকা বাংলার প্রথম পূজাবার্ষিকী। এর বিনিময় মূল্য ছিল মাত্র ১ পয়সা।

বিশেষ সংখ্যার ভাবনাটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে আরও চল্লিশ বছর। ১৯১৩ সালে বার হয় প্রথম পুরোমাত্রার শারদীয়া সংখ্যা। সৌজন্যে সাময়িক পত্রিকা ভারতবর্ষ। পৃষ্ঠাসংখ্যা ২০০ আর লেখকসূচিতে সেকালের সব দিকপালেরা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপিনবিহারী গুপ্ত, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার দুদিন পরেই আত্মপ্রকাশ যে দৈনিকের, সেই বসুমতী পত্রিকা ১৯২৫ থেকে ১৯২৭ পর পর তিনবছর পূজাসংখ্যা হিসেবে বার্ষিক বসুমতী প্রকাশ করে। সম্পাদক ছিলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও সত্যেন্দ্রকুমার বসু।

এইখানে একটু ব্যক্তিগত দুঃখের কথা না বললেই নয়। এই অধম যখন ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ে তখন থেকেই সে এঁচোড়ে পাকা বইপোকা। মাতামহের কাঠের আলমারিতে নিমপাতা দেওয়া সার সার পুরুষ্টু বইয়ের সারি তাকে পাগল করে দিত। রাতদিন হুমড়ি খেয়ে সে ওল্টাত কালো শক্ত বাঁধাই-এর স্বাস্থ্যবান বইগুলিকে, মলাটের ওপর সোনালি জলে লেখা প্রবাসী, ভারতবর্ষ অথবা বার্ষিক বসুমতী। কালো মোটা বাঁকা রেখায় অলংকরণ প্রত্যেক আইটেমের শেষে আর কিছু পাতা বাদে বাদে মোটা কাগজে বহুবর্ণের ছবি। অদ্ভুত গন্ধ নাকে আসত বইগুলো ওল্টালে। প্রাচীন এবং অভিজাত সেই গন্ধ মস্তিষ্কের কোষে কোষে এমন বাসা বেঁধে আছে যেন মনে হয় এই তো সেদিন। সত্যি যখন ওদের মূল্য বুঝতে শিখলাম তখন বহুদিন হয়েছে মাতামহের সস্ত্রীক প্রয়াণ। বংশধররা বাহুল্য বিবেচনায় আধুনিক ফ্ল্যাট থেকে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করেছেন। হয়তো বা কেজি দরেই। এখন হাত কামড়ানো ছাড়া গতি কী! আসলে প্রথাগত শিক্ষায় শেকড়ের মূল্য, প্রাচীনের মর্যাদা বোঝা খুব দুরূহ।

১৯২৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী পুজোসংখ্যা বার করে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৪, দাম ২ আনা। তারপর থেকে বহুদিন চালু থাকে পূজাবার্ষিকীর অপ্রতিহত প্রতাপ। বহু বিদগ্ধ লেখা, তীব্র মননশীল চর্চার প্রকাশস্থল হিসেবে বঙ্গহৃদয়ে বরাবরই আলাদা জায়গা অধিকার করে রাখে। আনন্দবাজারের ব্যবস্থাপনায় প্রথম পূজা উপন্যাস ছাপা হয় — ১৯৩৯ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শহরতলী। ভারতীর পূজা সংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করে শরৎচন্দ্রের সম্পূর্ণ নাটক ষোড়শী। অনেকদিন বাদে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ ছাপা হয় শারদ সাহিত্য হিসেবেই দেশ পত্রিকায়। কাকাবাবু সিরিজের প্রথম উপন্যাস ভয়ংকর সুন্দর শারদীয়া আনন্দমেলায় ছাপা হয় ১৯৭৯ সালে।

এই উদাহরণগুলি দেবার কারণ একটাই। শারদসাহিত্য তখন প্রতিভাবান স্রষ্টাকে আত্মপ্রকাশের সু্যোগ তো দিতই, উপরন্তু জহুরির জহর চিনবার ক্ষমতা ছিল ষোল আনার ওপর আঠেরো আনা। নিজের পত্রিকার সাহিত্যমান ধরে রাখবার কাজে সম্পাদকেরা ছিলেন বিশেষভাবে দড়। এই ব্যাপারগুলি কিন্তু হারিয়ে গেছে অনেকাংশে। আর হারিয়ে গেছে বলেই শারদ সাহিত্যের উচ্চতার অবনমন হয়েছে, যেমন হয় উষ্ণায়নের ফলে পর্বত শিখরের। এখানে উষ্ণায়নের সঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়তার তুলনা দিব্যি খেটে যায়। কারণ শুধু জনপ্রিয়তার কারণে অনেক ওঁচা লেখাও পাঠক আজকাল গলাধঃকরণে বাধ্য হন।

নিজের  শারদসাহিত্যের জন্য আগ্রহ ঘুচে গেছে এইরকম একটি কারণে। আমার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোগোপাধ্যায় তখন খুব অসুস্থ। কিন্তু আনন্দবাজারী শারদসম্ভার তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাই একটি অসম্পূর্ণ আধখ্যাঁচড়া লেখা উপন্যাস অপ্রকাশিত বলে ছাপা হয় সম্ভবত দেশ অথবা আনন্দবাজার পত্রিকায়। আজ তার নাম চরিত্র কিছুই মনে নেই, শুধু মনে আছে সেটিতে অকারণ যৌনতার কাঁচা মাংসের বিকট গন্ধ। সম্ভবত প্রতাপ নামে এক অভিযানপ্রিয় যুবকের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাত্রার কাহিনী। ওটিই খুব সম্ভব সুনীলের শেষ লেখা। কারণ তার কিছুদিনের মধ্যেই লেখকের মৃত্যু হয়।

প্রিয় লেখকের জীবনাবসানের সঙ্গে যার শারদসংখ্যার সঙ্গে আড়ি হয়ে যায়, আজ এতদিন পরে সেই পাঠকের হাতে শারদসংখ্যা এলে প্রথমেই নজর টানে বিজ্ঞাপনের বাড়াবাড়ি। একেবারে বিজ্ঞাপনে মুখঢাকা আগাগোড়া। গাড়ি থেকে শুরু করে জ্যোতিষীর খাঁটি রত্ন, সোনা, প্রসাধনী, টুথপেস্ট, ভোজ্য তেলমশলা, হেলথ ড্রিংক, বেনারসি শাড়ি, চুলের রং… কী নেই সেখানে। নতুন ট্রেন্ড নিজের পয়সায় বই প্রকাশ করুন বলে প্রকাশকের ঠিকানা আর পুরনো ধারাবাহিকতায় দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি। এর সঙ্গে সেকালের বিজ্ঞাপনের প্রচুর তফাত, নিবিড়তায় এবং আড়েবহরে। যেমন ১৮৯৬ সালের বাহারি শাড়ির শারদ বিজ্ঞাপনে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় চল্লিশরকম বিভিন্ন পাড়ের শাড়ির তালিকা দিয়েছিলেন। তার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করা যাক — মুচকি হাসি মুন্সেফ পেড়ে, ব্রিফ শূন্য ব্যারিস্টার পেড়ে, চুলোর ছাই পেড়ে চুলোচুলি পাছা, যমালয়ে যাও পেড়ে জুবিলি পাছা, কেলে হাড়ি ধাক্কা কাব্যি পাছা ইত্যাদি।

মোদ্দা কথা, আজকের শারদসংখ্যা পুরোপুরি কেজো বিজ্ঞাপনে ভরা, রসিয়ে আলাপ করবার, আড্ডা বসাবার সময় তার নেই।

শারদ সংখ্যার জন্য এখন কোনও অপেক্ষা থাকে না। মহালয়ার অনেক আগেই ভাদ্রের পচা গরমে সে হানা দেয় স্টলে স্টলে। অপেক্ষা করবার লোকও খুব কম। টিভি চ্যানেল, সোশাল মিডিয়া আমাদের চটজলদি আমোদ দেয়, নিউজ লিংক পড়িয়ে জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়। আমাদের সমসাময়িক সাহিত্যচর্চা বহুলাংশে শারদসাহিত্য নির্ভর ছিল এ কথা মনে রাখবার কোনও কারণ আজ নেই। ফলে আক্ষেপের জায়গা নেই বিষয়বৈচিত্র সংকোচন নিয়েও। যদিও প্রবাসীতে প্রকাশিত বিষয়ের বৈচিত্র নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে সূর্যের নিচে থাকা সমস্ত কিছু নিয়েই আগ্রহ সেখানে সুস্পষ্ট। ৬৩ বছরের প্রকাশনায় সেখানে শুধু ভাষা নিয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা ২০০। শিল্পকলা নিয়ে ৭০ বছরে প্রকাশিত প্রবন্ধ ৪০৬।

আগে চমক থাকত লিটল ম্যাগাজিনেও। সারা বছর না করতে পারলেও তাদের পুজোসংখ্যা ছিল দেখবার মতো। এখন সেসবও গেছে, অভিজাত কিছু লিটল ম্যাগাজিন পুজোসংখ্যার জন্য অর্ধসহস্রাধিক মুদ্রা দাবি করে। সে কৌলীন্য রক্ষা সব সাহিত্যপিপাসুর পক্ষে সম্ভব নয়।

তবে পূজাবার্ষিকীর আদর হারিয়ে যাবার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হল আমাদের বই পড়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলা। আমরা এখন দেখি বেশি, পড়ি কম। বাংলা হরফে তুমুল বিবমিষা হয় বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগের। হয়তো সভ্যতা ও যন্ত্রের বিবর্তন এই ভবিতব্যই নির্দিষ্ট করে রেখেছে আমাদের জন্য।

তবু এখনও নস্ট্যালজি্য়ায় কাতর হবার কোনও কারণ নেই। অন্তর্জালে আবদ্ধ পাঠকের জন্য প্রকাশিত হচ্ছে নানা ওয়েবজিনের শারদসংখ্যা। নানা রিসার্চ করে, জনরুচির সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রকাশ হচ্ছে তাদের বিভিন্ন ইস্যু। তবু এখনও পূজাসংখ্যা বললে মনে আসে মুদ্রিত চতুষ্কোণের কথাই যার মলাটটি ঝলমলে আর দুই মলাটের মাঝখানে রয়েছে বাংলাভাষার সেরা চিন্তকদের গল্প কবিতা প্রবন্ধ। দূর মফস্বলে আজও তার জন্য প্রতীক্ষা করে দুই বিনুনির যে কিশোরী তার সঙ্গে আমার চিরকালের মিল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. খুব ভাল লাগল এই লেখাটি। চমৎকার ভাষা আর খুবই সুখপাঠ্য। একদম ছোটবেলা আর কৈশোরে ফিরে গেছিলাম, খুব নস্টালজিক করা লেখা আর সেইসঙ্গে তথ্যবহুলও।
    লেখিকাকে অভিনন্দন।

Leave a Reply to শামীম আহমেদ লস্কর Cancel reply