Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চিরবসন্তের খসড়া : একটি অকিঞ্চিৎকর পুনর্বীক্ষণ

অবন্তিকা পাল  

 

তোমার লেখা পড়তে গিয়ে বুঝেছি এইটুকু
গোটা একটা দশক ধরে লিখেছি ছাইপাঁশ
অর্থবিহীন সুরকি বালি কথার পরে কথা

দুয়োর জুড়ে হেলায় বাড়ে নরম মুথোঘাস
শব্দ তোমার সিকনি ঝরা ন্যাংটাপুটো ছেলে
দুই বিনুনি কিশোরী গ্রাম শান্ত, অবনতা।

তোমার লেখা পড়ব বলে একলা ভিড়ে হাঁটি
শহরতলির চাঁদ নেমেছে ভাতের থালা জুড়ে
ঠিকে শ্রমিক, লক্ষ্মীভাঁড়ে আধুলি আর সিকি

মায়ায় মোড়া জীবন ঘুমোয় একফালি চৌপায়া
ঋণ ছিল না চিনিপুকুর গ্রামের পথে পথে
আবার যেন সব কবিতা প্রথম থেকে লিখি…

“একটা লাইন, খুব কাঁচা কবিতার লাইন, মনে পড়ছে: যাকে সর্বনাশী বলে ধুপ জ্বেলে পুজো করা যায়। কাকে? কে জানে? সে কি এসেছিল? চিঠিতে লিখেছিল, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’? কিনে দিয়েছিল, ‘বন্দি জেগে আছো’, ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ আর দস্তয়েভস্কির পেপারব্যাক?”

প্রায় আত্মকথনের মতো করেই ‘চিরবসন্তের খসড়া’ লেখাটিতে প্রথম-নব্বইয়ের কবি পিনাকী ঠাকুর যে কাঁচা লেখার কথা বলেছেন, তাকে তাঁর অনুর্ধ্ব চল্লিশ সময়কালের লেখা বলে ধরে নেওয়া যায়। এই পর্যায়ে তাঁর তিনটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ- ‘একদিন, অশরীরী’, ‘আমরা রইলাম’, ‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’। পিনাকী ঠিক কবে থেকে কবিতাযাপন শুরু করেছেন? বোধ হয় সাতের দশকের শেষদিক। কেননা এ সময় একটি সংকলনে আরও পাঁচজন কবির সঙ্গে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। এ যাপনচরিতের সূচনা নির্ধারণ কেবল কবিতা ‘লেখার’ নিরিখেই। কেননা কবিতা পড়া আর শোনার অভ্যাস তার বহু আগে থেকে, বাল্যকালে যেভাবে কবিতাবীজ বোনা হয় বেশিরভাগ কবির মগজের ভেতর, পিনাকীর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল তেমনটাই। পরিবার, মূলত একনিষ্ঠ বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী পিতা অমল ঠাকুর, কাব্যচেতনায় তাঁর প্রথম বটচ্ছায়া। পিনাকী তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘একদিন, অশরীরী’-র দীর্ঘ গুচ্ছকবিতায় লিখছেন : “বাবার ভরাট কণ্ঠে ঈশানের পুঞ্জমেঘ, না-বুঝেও শেষের কবিতা!”

‘একদিন, অশরীরী’ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ১৯৯৪-এর বইমেলায়। অর্থাৎ জানুয়ারি মাস। কবির বয়স তখন প্রায়-পঁয়ত্রিশ। প্রকাশক স্বর্ণাক্ষর। এ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত বসন্তের টুকরো কবিতায় তিনি লিখছেন : “হেমন্ত মণ্ডল যত খিস্তি দিক, মাইনে কেটে দিক/ পুকুরে চাঁদের থালা ভেঙে তোকে আবার হাসাব”। কবিতায় কথক এক যুবক যে হেমন্ত মণ্ডল নামে জনৈক ব্যক্তির দোকানে কাজ করে। এ লেখার শুরুর অংশ : “‘আদালতে গৃহলক্ষ্মী’ পর-পর তিন নাইট”। অর্থাৎ কথক ছেলেটি কোনও মেয়েকে দেখছে নাইট শো-এর শেষে পরপর তিন রাত একইসময়ে বাড়ি ফিরতে। সে মেয়ের চোখ কথককে দেখে লাস্যে ভরে ওঠে। মেয়ে ঘুম-ঘুম চোখ মোছে নীল ওড়নায়। ওদিকে কথক ছেলেটি মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, ফলে তার হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায় ছ’টি ঘুগনির প্লেট। এ হেন আকস্মিকতায় পথচলতি মেয়ের হাসি মিলিয়ে যায়। ফুটপাথের দোকানের মালিকের কোপ তখন কর্মচারীর ওপর এসে পড়ে। কথক তবু ওই হাসি ফিরে পেতে বদ্ধপরিকর। সে আকাঙ্ক্ষা করে, মাঝরাতে কোনও এক পুকুরপাড়ে বসে মেয়েটিকে জলের ওপর চাঁদের ছায়া দেখাবে। তারপর হাওয়া লেগে জলের ঢেউয়ে যখন চাঁদের ছবি ভেঙে যাবে, মেয়েটিও নুয়ে পড়বে হাসিতে। এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত ফিরে পেতে গিয়ে যদি মালিক হেমন্ত মণ্ডলের গালিগালাজ সহ্য করতে হয়, গ্রহণ করতে হয় কম পারিশ্রমিক, সে সহ্য করে নেবে তা-ও।

এইসব কাঁচা সময়ের, কাঁচা আবেগের চিত্রকল্প— কৈশোর, যৌবন জুড়ে মফস্বলের এক লাজুক কবিকে যা ঘিরে থাকে, আগলে রাখে।

মিল কাঁচা তবু হাতানিয়া-দোয়ানিয়া
পেরোইনি যাকে এ সেই নদীর নাম
তোমার হুকুমে মেঘ ওঠে? ঝড় বসে?
তাহলে নামটি মধুমতী রাখিলাম।

প্রথম বইয়ের পুনঃপ্রকাশ ঘটছে ২০০৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। এবারের প্রকাশক পরম্পরা। ’০৬ সালের ভ্যালেনটাইনস ডে-তে পিনাকী এই দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখছেন। “মনে পড়ে, হাওড়া বঙ্কিম সেতুর ওপর দিয়ে বিজয় পাণ্ডুলিপি আঁকড়ে দ্রুত প্রেসে যাচ্ছে, যদি আমি আবার ছিঁড়ে ফেলি!” এক সফল কবির ছ-ছ’টি অপূর্ব কবিতাবই প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পরেও, মধ্য-চল্লিশ পেরোনো এই কবির মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলো, কুণ্ঠাগুলো, অতৃপ্তিগুলো যাচ্ছে না। পুরনো পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু কবিতা বাদ দিচ্ছেন তিনি, সংযোজন করছেন চারটি নতুন লেখা। এইভাবে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে আর গড়তে গড়তেই তো একজন কবি প্রতিনিয়ত এক ভিন্নতর আমি-কে আবিষ্কার করতে সক্ষম হন! প্রত্যেক কবির কষ্টিপাথর তো কবিতা নিজেই!

“সেই অকালবসন্তও একদিন চলে যায়। জীবনে পড়ে থাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, লোহালক্কড়ের আওয়াজ, কারখানার চাকরি। রাতে ক্লান্ত শরীরে কলেজ, বন্ধুদের হাত। লোডশেডিং আর মোমের আলো। অসুখ। অ্যাক্সিডেন্ট। পার্টটাইমে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই চাকরি ছেড়ে চলে আসা একদিন।”

চার বছর অতিবাহিত করে পিনাকী লিখলেন তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ— ‘আমরা রইলাম’। প্রকাশ করল বিজল্প, ১৯৯৮-এর বইমেলায়। চার বছরের ব্যবধানে স্বভাবতই কবি নিজের রিকনস্ট্রাকশন করেছেন কিছুটা। লেখাগুলোর শিরোনাম তাই বইয়ের নামের মতোই অনেক বেশি সোজাসাপটা। এক্সপ্লিসিট নয়, কিন্তু স্ট্রেট। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা কবিতার শেষদিকে পিনাকী বলছেন— “…তবু আজ/ ঠাকুর, আপনার হার, বাইশে শ্রাবণ মিথ্যে করে/ ‘দোলনা’ ইস্কুলে পড়া ক্লাস থ্রির পাজি দেবত্রীটা/ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ বাঁধে, সুর দিয়ে বর্ষাকে শোনায়।” সুপ্রাচীন এক কবির পর্বতপ্রমাণ অস্তিত্ব অবনত হয় বছর আষ্টেকের ছোট্ট নতুনের ভাষায়, ভাবনায়, সুরারোপে। রবি ঠাকুরের গানকে সে খেলনাবাটির সংসারের মতোই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পছন্দসই গড়ে নেয়। এ লেখার নাম ‘হে নূতন’ ছাড়া আর কীই বা হতে পারত।

‘হান্টারওয়ালি’, ‘যথেচ্ছচারিণী’ কিংবা ‘লক্ষ্মীপক্ষী’ কবিতায় ধারালো আর বেপরোয়া তাঁর প্রেম-নিবেদন। আদিপর্ব থেকেই পিনাকীর কবিতা এক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক স্বর। অমুক ‘বাদ’ ভালো আর তমুকটি খারাপ— ঠিক এইরকম জাজমেন্টাল রাজনীতি নয়। যৌনকর্মী খুনের পর যে কবিতা উঠে আসে তাঁর কলম থেকে, সেই লেখার প্রতিটি অনুপুঙ্খ রাজনৈতিকভাবে বাঙ্ময়। বারো লাইনের গোটা গদ্যকবিতায় দশম পংক্তির মাঝে লিডার, একাদশতম পংক্তির শেষে আবার লিডার, আর দ্বাদশতম লাইনে একটি বিস্ময়বোধকচিহ্ন। সমগ্র কবিতা একটিই বাক্য, বারোতম লাইনে এসে শেষ হচ্ছে যে বাক্যটি। নিহত শ্যামলী সরকারের জনৈক বোন একটি কাল্পনিক চিঠি লিখছেন সংবাদমাধ্যমকে, বা পড়ছেন উচ্চারণ করে করে। সমাজে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো যেসব লোক তাদের তুলে এনে যৌনকর্মী বানায়, অথবা যারা খবরকাগজে তাদের নিয়ে চিঠি লিখে, সম্পাদকীয় লিখে ‘নাম’ করে, ‘রুপেয়া’ করে, শ্যামলীর বোনের ক্ষোভ, বিষোদ্গার তাদের সকলের বিরুদ্ধেই। কিন্তু এ প্রতিবাদী স্বর যে একান্তভাবে তার নিজের নয়, সে কথা পাঠক অনুধাবন করেন একাদশ লাইনে এসে, যেখানে একটা প্রথম বন্ধনীর মধ্যে কেবল দুটি মাত্র শব্দ একটি জিজ্ঞাসাচিহ্ন সমেত।

… জেনে রাখো, শ্যামলীদি খুন হয়েছে, কিন্তু আমরা
তার বোন সবাই এই মাটিতে পুঁতে রাখছি (কী যেন?) মারণবীজ…
এ-সো রাঙাবাবু!

সমাজের তথাকথিত এলিটদের এই ভাষা শ্যামলীর বোনেদের শিখিয়ে পড়িয়ে, একপ্রকার জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের মুখে। শেষ পংক্তিটিই তাদের নিজেদের ভাষা কিনা এই ধন্দ কাটিয়ে ওঠার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে কবিতা। এখানে রাঙাবাবু একজন এলিটদের প্রতিনিধি যাকে ডাকছে শ্যামলীর বোন, অর্থাৎ সে নিজেও যৌনকর্মী। শেষমেষ এইসব প্রান্তবাসীদের চোখে রাঙাবাবু-মাত্রই এলিট, রাঙাবাবু-মাত্রই খদ্দের, যারা কোনও না কোনও স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশে প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে চলেছে যৌনকর্মীদের। প্রান্তিকের ভাষার, প্রান্তিকের ভাবনার রাজনীতির এ হেন দ্যোতনা বাংলা কবিতায় বিরল তো বটেই। এক্ষণে ‘এ-সো’ শব্দের মধ্যেকার হাইফেনটুকু বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একটি পরিপাটি বেশ্যা যেন শরীরে আদর মেখে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে তার খদ্দেরকে।

“মা তো জানে তার অপদার্থ ছেলে আর কিছু পারে না তাই হিজিবিজি লেখে। বন্ধুরা চাঁদা তুলে বই ছাপে। মাঝরাতে কড়া নাড়লে দেয় আশ্রয় আর গাড়ি ভাড়া। সেই সুরের ডায়েরি হারিয়ে ফেলেছি, পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে দু’চারটে কবিতা – তিনটে রোগা বই বেরিয়েছে – কী আশ্চর্য। আমি তো জানি, এসব লেখা আসলে খসড়া – যে লেখাটা আমি লিখতে চাই তার কাটাকুটি। জীবন আর শব্দ – এই দুটো জগৎ, এদের অস্তিত্ব বিনিময়ের নেট প্র্যাকটিস। চিরবসন্তের দিনলিপি।”

চল্লিশের খুব সন্নিকটে এলে স্মৃতিরা চাপ-চাপ— বাসা বাঁধে বুকে। মেলায় বরফগোলা, প্রাইজ পাওয়া বই, স্কুলের টিফিনটাইমে ঝগড়া মারপিঠ, কিশোরবেলার ক্রাশ— যারা নিরাপদে এতকাল ছিল কুলুঙ্গিতেই, কীভাবে যেন বাইরে বেরিয়ে আসে।

হঠাৎ পাওয়া ছুটির মতো খরচাপাতি
ফুরিয়ে ফেলে
জীবন, আমি তোমার কাছে হাত পেতেছি,
ভরদুপুরে পাত পেতেছি, ফিরিয়ে দাও
ফিরিয়ে দাও এক জীবনে অঙ্কে যত শূন্য পেলে।

তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অঙ্কে যত শূন্য পেলে’-র প্রথম লেখা ‘এক জীবনে’। তার শেষ লাইনগুলো এমনই স্মৃতিমেদুর। যতবারই পাঠ করা হোক, মনে হয়, বসন্তের হা-হুতাশ দুপুরে কে যেন ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে আদ্যোপান্ত। দ্বিতীয় বইয়ের ঠিক এক বছর পরেই এই বইটি, সন ১৯৯৯। এবং ততদিনে কবি জেনে গিয়েছেন, রেললাইন ট্র্যাকের মতো সুনির্দিষ্ট স্রোত-অভিমুখে বহমান হবে না তাঁর জীবন। দ্বিতীয় লেখাতেও নিরবিচ্ছিন্ন সেই বিষাদ।

তুমি খুঁজে নাও তার চুল থেকে রবারের গন্ধ, নিঃশ্বাস
থেকে পরিবেশ দূষণ, তার বাংলা ভাষা থেকে ‘লেবার ক্লাস’ রুচিবিকৃতি
খোঁজো লোহা, স্টিম, অপমান, সাবধান ৪৪০ ভোল্ট, ঘাম
ঝরানো, ডি.এ. বৃদ্ধির মিছিল আর
ওয়ার্কশপের ডেসিবেল ডেসিবেল বধিরতা থেকে দু’চার মিনিট পালিয়ে
বর-বউ শালিখ দেখবার আনন্দ
তাই পুরনো যক্ষ্মার কেস হিস্ট্রি, সতেরো বছর তিন মাস থেকে
সাতাশ বছর

যে শরীর, বেঁচে থাকলে, তোমাকে ভালবাসতে পারত।

পিনাকীর সমস্ত বই যদি কালানুক্রমে সাজিয়ে পড়া যায়, তবে শুধুমাত্র তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক চেতনা নিয়েই একটি পৃথক গ্রন্থ লেখা হতে পারে। আবারও বলছি, সাদাকালো, ডানবাম, সমাজতন্ত্র-ধনতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র-নারীবাদের পরস্পর বিপরীতমুখী রাজনীতি নয় কেবল। প্রতিটা কাব্যগ্রন্থের একাধিক লেখায়, প্রতিটি লেখার নানান পংক্তিতে তিনি ফেলে রেখে গিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সমাজচেতনা, আত্মবীক্ষণ। নানান দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের অনুসন্ধান তাই সার্থকভাবেই এক ও একাধিক রাজনৈতিক বোধের জন্ম দেয়। আর সেটাই পিনাকীর সিগনেচার। তৃতীয় বইয়ে একটা কবিতা পাই, নাম ‘প্রিয়বান্ধবী’। তার ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ লাইন এইরকম:

তোমার পৃথিবীতে ছিনিয়ে খেতে হয়। গায়ের জোর মানে পুরুষকার।
একুশে পা দিলেই চোয়াল ভেঙে গেছে। মারের বদলায় পালটা মার।

এক পুরুষ তাঁর বান্ধবীকে বলছেন এ কথা। পৌরুষ বলতে এ বিশ্ব যে স্ট্রাকচারকে বোঝে, সেই তথাকথিত ধারণার এক বিরুদ্ধস্বর এই লেখা। একুশ বছর বয়স মানে এক কিশোরের পুরুষ হয়ে ওঠা, তার যৌবনে পদার্পণ, তার ভোটাধিকার, তার বিবাহের অধিকার। একজন পুরুষকেও এইভাবে দেগে দিই সকলে, বলি, ‘যুবক’ হয়ে উঠলে তাকে দায়িত্বপালনে সক্ষম হতে হবে কেউ মারলে কান্না নয়, ঘুরে দাঁড়িয়ে মারতে হবে তাকে, তবেই যথার্থ পৌরুষ। আর যে ছেলে এসব কিছুই পারে না, তাকে আঙুল তুলে বলা হয়, ‘তুমি চুড়ি পরে থাকো’। অর্থাৎ তার পৌরুষ বিষয়ে সন্দিগ্ধ হয় সমাজ। আদর্শগত ফারাক সত্ত্বেও এ কবিতায় এই রমণীই হলেন গোটা শহরে কবির একমাত্র কাছের মানুষ। কবি তাঁকে ভালোবাসেন, প্রত্যাশা করেন। কিন্তু এই রমণী কবিকে চুম্বন করেননি কখনও। অন্তর্মুখী কবিটিও আপন পৌরুষবলে কখনও ছিনিয়ে নিতে পারেননি তাঁর অধিকার। তাই বলে কি তিনি পুরুষ নন? প্রেমিক নন ওই নারীর? পনেরো আর ষোলোতম লাইনে, অর্থাৎ শেষ দুই লাইনে কবির চূড়ান্ত রাজনৈতিক কষাঘাত:

গায়ের জোর মানে পুরুষকার
গায়ের জোর মানে, পুরুষকার?

অন্তিম প্রশ্নচিহ্ন আসলে প্রিয়তম মানুষটির কাছে নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই, যে বিশ্ব প্রতিটি জেন্ডারকে কোনও না কোনও খোপে ফেলে দেওয়ায় বিশ্বাসী।

লিখে কী হবে? কিছুই ‘হবে’ না। আমার নির্জন দ্বীপে আসলে কেউ নেই, চারপাশে মানুষ, যুদ্ধ, সংঘাত, শক্তি, প্রতিযোগিতা, মিডিয়া-বিস্ফোরণ – এরা আমার ভালো করে মুখ আটকে ভাসিয়ে দেবে অজানা সমুদ্রে

যদি কেউ, কখনও, তরঙ্গে ভাসতে থাকা বোতলটা হাতে পায়, খোলে, খুলে পড়ে আমার এস.ও.এস. – পড়ে বুঝতে পারে – বুঝে…

তাই, বসন্ত আমার শেষ হয় না।

কোনও বাঙালি মাতাপিতা কি পিনাকীর মতো সন্তান চান? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন অথচ পরীক্ষা শেষ না করে চলে আসেন; ঘাড় গুঁজে কবিতা লেখেন অথচ লাইমলাইট থেকে দূরে নিরাপদ বোধ করেন; প্রিয় নারীকে ভালোবাসেন আপ্রাণ তবু প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে সে প্রেম ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হন বারবার। কোনও রমণী কি এমন প্রেমিক প্রত্যাশা করে? চেনা গণ্ডির মানদণ্ডে প্রতিটি সার্থক কবিই হয়তো আদতে অ-সফল। কে যেন বলেছিলেন, কবিরা ক্রান্তদর্শী। একটি লাজুক শবদেহ বাংলা একাডেমি ছাড়িয়ে, বাঁশবেড়িয়ার উঠোন ছাড়িয়ে ত্রিবেণী শ্মশান অভিমুখে রওনা হয়।

নিভৃতে, এক ক্রান্তদর্শীর পুনর্পাঠ শুরু করে আরও দু’চারটি অ-সফল মানুষ…

 

সূত্র:

কবিতা সমগ্র/  পিনাকী ঠাকুর (সিগনেট প্রেস)

চিরবসন্তের খসড়া/ পিনাকী ঠাকুর (ঋণ- শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)