অনুরাধা কুণ্ডা
একটা ছড়া। সবাই বোধহয় পড়েছেন। “ওখানে কে রে? আমি খোকা। মাথায় কী রে? আমের ঝাঁকা। খাসনে কেন? দাঁতে পোকা। বিলোস নে কেন? ওরে বাবা!”
আমাদের দাঁতে, কানে, গলায় সর্বত্র ভণ্ডামির পোকা। মাথায় রাখা আম পচে গেলেও আমরা বিলোতে শিখিনি। মাথায় আমের ঝোঁকা নিয়ে আদিম পিতৃতন্ত্র চলেছেন এঁকিয়ে বেঁকিয়ে পেটমোটা অজগরের মতো। কাউকে গিলছেন। কাউকে পিষে ফেলছেন ওজনের ভারে। কেউ তাঁকে দেখেই মুচ্ছো যাচ্ছে নয় হার্ট ফেইল করছে। মাথার ওপর ফলের ঝুড়ি। খাবেনও না। বিলোবেনও না।
ধর্মকে যাঁরা মাথায় রেখে চলেন তাঁরা নারীকে নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভণ্ডামি করে চলেন। এর সঙ্গে যোগ করে নেন রাষ্ট্রনীতি। কাজেই ধর্ম+রাষ্ট্রনীতির প্যাঁচালো রাজনীতি মেয়েদের পিষেও মারে। গিলেও খায়।
সন্তানাকাঙ্খা যা মূলত পুত্রাকাঙ্খা, মেয়েদের গর্ভ বলেই চিহ্নিত করে এসেছে। নারী নামক সিগনিফায়ারের পিতৃতান্ত্রিক সিগনিফায়েড হল গর্ভধারণ। সেই লিঙ্গ রাজনীতির মারাত্মক রসায়ন মাতৃত্বকে নারীত্বর সঙ্গে একাকার করে দিয়েছে। “মাতৃত্ব মেয়েকে সম্পূর্ণ করে” ইত্যাদি বুলি যুগ যুগ ধরে ইনজেক্ট করে নারীত্ব আর মাতৃত্ব, দুইয়েরই সর্বনাশ করেছে। ভণ্ডামি এবং ধ্যাষ্টামি হল এই যে “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা” নামক ধর্মবুলি যাঁরা আওড়ান, তাঁরাই ঋতুমতী মেয়েকে অস্পৃশ্য করে রাখেন। অথচ ঐ ঋতুস্রাব ছাড়া নারী সন্তানধারণে অক্ষম। অর্থাৎ যে শারীরিক নিষ্ক্রমণ, নারীর সন্তান ধারণ ক্ষমতার উৎস, তাকে সমাজ অচ্ছুত, ঘৃণিত, লজ্জার বিষয় বানিয়ে রাখল। রজোনিবৃত্ত হওয়া নারীকে বানাল করুণার পাত্রী। সম্প্রতি ফরাসি ঔপন্যাসিক বললেন, ঋতু শুরু হবার আগের মেয়ে আর রজোনিবৃত্তি হবার পরের মেয়েকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। তর্ক হল খুব। কিন্তু তিনি বোধকরি পিতৃতান্ত্রিক একটা চিরকালীন মতকেই পাব্লিক করলেন। ঋতু শুরু না হওয়া মেয়ের তবু একটা ভবিষ্যত আছে। কিন্তু ঋতু বন্ধ হলে মেয়ে তার আকর্ষণ হারায়, এই মিথের পেছনেও সন্তানধারণের রাজনীতি আছে।
দ্রৌপদী রজস্বলা বলে তাঁকে চুল ধরে সভাতে টেনে আনতে দুঃশাসনের কোনও অসুবিধা হয় না। তিনি যে একবস্ত্রা রজস্বলা, মহাভারতকার তা বারবার উল্লেখ করেন। রজস্বলা হলে তাকে ধর্ষণ করা যায়, তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করা যায়, এবং তারপরেও তাকে অচ্ছুৎ করা যায় এবং মন্দিরে তো কোনওমতেই প্রবেশ করতে দেওয়া যায় না। অজগরের ওমনি খেয়ালখুশির চলন। মেয়েদের সে পাকে পাকে জড়িয়ে হাড় ভেঙে ভেঙে গেলে।
অনেক পরিবারে এখনও ঋতুকালীন সময়ে মেয়েরা রান্নাঘরে ঢোকেন না। ঋতুশেষে স্নান ও মাথাঘষার পরে রন্ধনমন্দিরে প্রবেশের অনুমতি মেলে।
শবরীমালা মন্দির এই ব্যাপারে সরব। বাকি মন্দির সমূহও তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলে। ফলে এমনি হয়েছে যে মেয়েরা নিজেরা নিজেদেরকে ঘৃণা করতে শিখেছে। ঋতুকে ভয় পেতে শিখেছে। ঋতুকালীন যন্ত্রণাকে হাইলাইট করা যেন প্রজন্মগত। অথচ এই যন্ত্রণা হয় পুষ্টির অভাবে। বা খেলাধুলা না করার ফলে। ঋতুকালীন সমস্যাকেও নারীত্বের সঙ্গে একাকার করা এক ভুল রাজনীতি।
শবরীমালা মন্দিরের দেবতা আয়াপ্পন হলেন ব্রহ্মচারী। শিব আর মোহিনীর পরিত্যক্ত সন্তান। দেবতাদের বিবাহবহির্ভুত ছেলেপিলেরাও কেমন মন্দিরটন্দির পেয়ে যান। বিয়েথাও করেন আর করেই বউকে বলে দেন, আমি বাপু ব্রহ্মচারী। আমার কাছে কিছু আশাটাশা কোরো না। অতএব এ মন্দিরে হাইকোর্ট মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করল। মানে ঋতুমতী যাঁরা হতে পারেন সেই বয়সী মেয়েদের প্রবেশ বন্ধ হল। ধ্যাষ্টামি একেই বলে। এদিকে সন্তান না হলে বাঁজা বলে বউকে ত্যাগ করবে। ওদিকে পিরিয়ডকে করে রাখবে অশুচির সিগনিফায়ার। সুপ্রিম কোর্ট দু’হাজার আঠারোতে এই নিষেধ তুললেন আইনের দুটি ধারার ভিত্তিতে। ধর্মে সবার সমান অধিকার। লিঙ্গবৈষম্যের সংস্কার। দুজন মেয়ে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিলেন। এর আগে বহু মেয়ে অনেক চেষ্টা করেও ঐ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। মন্দির বন্ধ হল। যাগযজ্ঞ করে শুদ্ধিকরণ করে তবে আয়াপ্পন আবার দর্শন দিলেন।
এই পোড়া দেশে আইআইটি থেকে পাশ করা মেয়ে পণের দাবিতে আত্মহত্যা করে। রোজ মরছে। গলায় দড়ি। বিষ। আগুন। রেপড হচ্ছে। নির্ভয়া নিয়ে ছবি বানিয়ে লুটে খাচ্ছে বলিউড। তিনমাসের শিশু থেকে সত্তরের সন্ন্যাসিনী। সবাই রেপযোগ্য। আবার বারো বছরের কম বয়সী মেয়ে রেপড হলে ধর্ষণকারীর শাস্তি মৃত্যু। আহারে বারো বছর এক মাস। সে তো মেয়ে নয়! কাজেই কেস বিচারাধীন। ছেলেসন্তান জন্ম না দিতে পারার অপরাধে তিলে তিলে মরছে মা। মেয়েসন্তান ফেলে যাচ্ছে হাসপাতালে। মেয়েশিশু সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার। অশিক্ষার বলি। তাদের রক্তে প্রতিনিয়ত ঢুকে যাচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক কুসংস্কার। সে নিজেকে ভালোবাসছে না। চাইছে পিতৃতন্ত্র ঘোষিত রোলমডেল হতে।
শবরীমালা একটা দৃষ্টান্তমাত্র।
মেয়েরা একে বয়কট করতে পারেন। প্রবেশ করবেন না মন্দিরে। প্রয়োজন নেই আমার দেবতাকে। অনেক বড় বড় সমস্যা আছে। দৃষ্টি সেদিকে যাক। মন্দির থাকল কি না থাকল, কী এসে যায়।
আর যদি মন্দিরে প্রবেশ অধিকারের লড়াই ভাবেন তাহলে জটিলতা আছে। আপনি কি পিতৃতান্ত্রিক ধর্মাচরণকে রিফর্ম করতে চাইছেন? কেন? আপনি ধর্ম মানেন? কেন? পুত্রকামনায়? সংসারের মঙ্গলে? তবে আপনি আবার অজগরের পেটে ঢুকে গেলেন।
আর ঋতুর স্টিগমা দূরীকরণে মন্দিরপ্রবেশ যদি একটি সিগনিফায়ার হয়, তবে আপনি সেটা করতেই পারেন। তবে এটা একটা পদ্ধতি। লাগাতার চালিয়ে যেতে হবে। তা দিয়ে মেয়ে পুরুষের সামাজিক বৈষম্যঘটিত সমস্যা দূর হবার সম্ভাবনা নেই। একটাও পণ নেওয়া বন্ধ হবে না। একটাও ধর্ষণ থামবে না। কন্যাভ্রূণ হত্যার লিস্ট কমবে না। মন্দির প্রবেশের জিহাদ আরও এক পদের ধর্মান্ধতা শেষপর্যন্ত। “পূজিব না সেই দেবতারে” বলে ধর্মোন্মাদের অহংকারকে বেপাত্তা করা বরং ছিল ভালো। কেরালার বামপন্থী সরকার যেটা করেছেন সেটা আইনসম্মত। কিন্তু আইন কাউকে ধর্মস্থানে যেতে যেমন না করে না, তেমন বাধ্যও করে না। অতএব কেরলের মতো শিক্ষিত একটি প্রদেশে সম্ভাবনা ছিল। সুযোগ ছিল গোটা সিস্টেমটাকে অগ্রাহ্য করে মৌলিক সমস্যার দিকে নজর দেবার। পরিবর্তে ধর্মের নামে জিরাফ ঢুকে গেল কানাগলিতে। কোনও লাভ নেই।
অজগরের ক্ষমতা অনেক। ক্ষুধা প্রকাণ্ড। চলন প্যাঁচানো। মারার পদ্ধতি বিচিত্র। হিপনোটাইজ করতে পারে যদিও আদতে সেটা ভয়। একটা সিস্টেমের বিরোধিতা করতে গেলে সেটার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করতে হয়। ধর্ম মেয়েদের কোনওভাবেই সম্মান দেয়নি। এবং সেটা খাওয়াও যায় না। গায়ে মাখাও যায় না। মন্দিরে প্রবেশাধিকার পেলে যদি প্রতিটি মেয়েমানুষের সম্মান, মানুষের অধিকার পেত, তবে না হয় একটা দিক ছিল। সেই তো উপোস করে ছেলের চাকরি আর মেয়ের বিয়ের আশা নিয়ে দেহি দেহি করতে করতে মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ।
পিরিয়ডের সময় ঘরে ঘরে যে ছুৎমার্গ, আদৌ কাটবে সেসব? প্যারাডক্সিক্যালি, এখানে ‘ডিয়ার জিন্দগি’, বা ‘কুইন’ অথবা স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে ছবি তৈরি হয়। স্যানিটারি ন্যাপকিনের মেশিন বসছে প্রান্তিক স্কুল কলেজে। মেয়েদের ক্যারাটে শেখানো হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে গুড টাচ আর ব্যাড টাচ। নিজের শরীরকে ভালোবাসুন মেয়েরা। সেলিব্রেট করুন প্রতিটি পর্যায়। ঋতু আরম্ভ বা নিবৃত্তি। বৈষম্য রাখবেন না। শরীর সর্বদা শুদ্ধ। যদি মন শুদ্ধ থাকে। এদেশে ঋতুকালীন উৎসবও তো হয়। যদিও সেটাও মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করার একটা পুরনো পদ্ধতি। ভ্যাজাইনোপ্ল্যাস্টি মহাভারতের আমলেও ছিল। মাধবী বা পাঞ্চালি বিভিন্ন পতিদের কাছে যাবার আগে কুমারী হয়ে যেতেন প্রতিবার। কিছু পাল্টেছে! শবরীমালা প্রবেশাধিকার এসব আটকাতে পারবে কি?
একটা শবরীমালা মন্দিরে প্রবেশের চেয়ে এইসব বিষয় অনেক অনেক জরুরি।