Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘কিছু স্মৃতি, দুঃখবোধ’; আমার দিব্যেন্দু পালিত…

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

‘… এই সময়ের নৈঃশব্দ্য কানে লাগে বেশি।’

সময়। কোন সময়? পরিচয়? কথা, কথা, তারপরও কথা। প্রচারমুখী, সপারিষদ। বাস্তবতা? বিষয় গভীরতা? সাহিত্যবোধ? থাকে হয়ত। খড়ের গাদায় পড়ে থাকা ছুঁচ। খোঁজা। এসমস্তর মাঝেই একটার পর একটা সময় চলে যাওয়া। যুগ, যুগের ধর্ম, ছোট্ট ছোট্ট করে যাকে বলে ‘জেইটগেইস্ট’, নিভে যাওয়া। একজন মানুষ। লেখায়, জীবনে রিয়েলিটি, স্মার্টনেস, সাবলীলতা, কাহিনীবিন্যাস এবং মধ্যবিত্ত প্যাথোসের নির্মাণ। অসুস্থতা, প্রয়াণ শব্দ মাত্র। মানুষ অনেক বড়। মৃত্যু নেই। দিব্যেন্দু পালিত। এই শব্দের কোনও প্রয়াণ নেই।

কীভাবে বড় হওয়া এই মানুষটির সঙ্গে? আলাপ ছিল না। অবশ্য ব্যক্তি একদিকে। লেখা অন্যদিকে। পাঠকের কাছে তার দুইয়ের নির্মাণ দুরকম। তাই যা কিছু আলাপ, ঘর করা সবকিছুই ওই লেখার সূত্রে। জানতাম না ভাগলপুর। জানতাম না ফুয়েল ইউজের সারভেয়ার থেকে অডিট ফার্মের অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে একজন তরুণকে কতটা লড়তে হয়, যেখানে মাঝে চলে আসে কলকাতা, চলে আসে পিতৃবিয়োগ। সাংবাদিকতা। নৈর্ব্যক্তিকতা, তীক্ষ্ণতা, জীবনকে সামনে থেকে ফোকাস করা সেই সময় থেকেই। যদিও এসবই বইয়ের মলাটের ডানদিকের ওপর থেকে পাওয়া। আসল কাহিনী অন্য কোথাও।

তখন এইচ এস। তখন ঝকঝকে ফিউচার ক্রমশ গড়পড়তায় বদলে যাওয়ার মাঝের সময়। মফঃস্বলের লাইব্রেরি। ‘আড়াল’। নারী। বয়সের দোষে যে শব্দকে মা, আত্মীয়াদের বাইরে এক শারীরিক পরিচয়ে পাওয়া। প্রেমও। দিব্যেন্দু আস্তে আস্তে চেনালেন নারীর ডেফিনেশন। দুই সন্তানের মা রুচি। দীপঙ্কর, সোমেন। দাম্পত্য এবং দাম্পত্যের ঠুনকো বোধ। “সম্পর্ক একটা ধারণা মাত্র— শর্তাধীন, চুক্তিবদ্ধ। মেনে না নিলেই দাগ পড়ে সেখানে, অপরিচ্ছন্নতায় ঢুকে পড়ে রাগ, বিদ্বেষ, গ্লানি। মিলিতভাবে এগুলোই চিনিয়ে দেয় অসহায়তা।” একজন স্কুল-শেষ করা ছেলের সামনে ক্রুড রিয়েল দাম্পত্যের চেহারা। সম্পর্কের চেহারা। পরে, অনেক পরে বাণী বসুর কথাগুলো জানতে পারি, “দিব্যেন্দু যতটা মেয়েদের কথা বলেছেন, ততটা বোধহয় আমরাও পারিনি।” এখানেই রিয়েলিটি। আমাকে ক্রমশ বড় করল উপন্যাসেরা। ‘ঢেউ’, ‘বৃষ্টির পরে’, ‘মধ্যরাত’, ‘যখন বৃষ্টি’, ‘হঠাৎ একদিন’, ‘বহুদূর অভিমান’, উড়োচিঠি’, ‘অহঙ্কার’, ‘সবুজ গন্ধ’, ‘অনুভব’, ‘গৃহবন্দী’, ‘সোহিনী এখন কোথায়’। ‘মধ্যরাত’ প্রথমদিকের লেখা। পড়েছিলাম অনেকটা পরে। নষ্টনীড় মেসবাড়ি। সুরমা দেবী গার্লস কলেজের তপতী। দিব্যেন্দুরই কি অল্টার ইগো? শব্দহীনতার দ্যোতক। পাশাপাশি অঞ্জলি, বাসন্তীদি, রত্না, নীলা, সাবিত্রী। নীতীশবাবু। “এই অন্তরঙ্গতা দীর্ঘস্থায়ী হোক।” আসলে যা হওয়ার না। ‘মধ্যরাত’ আমার বয়ঃসন্ধির কান্নাবোধ। নারীত্বকে চেনার শুরুটা। ‘উড়োচিঠি’র টুপুর। অপরাধবোধ, পুরুষতন্ত্র, লড়াই করা এক তরুণী। অথবা শিল্পসত্তা। ‘সংঘাত’-এর ঋতুপর্ণা। ‘মৌনমুখর’-এর ব্রততী। কিছু নুয়ান্সেস। তার মধ্যেই জীবনের ছোঁয়াচ। ‘অনুভব’। আত্রেয়ীর ভেতর দিয়ে আরশির মতো জীবন। “যা পূর্বাভাস দেয় না, কিন্তু বদলে যায়।” নিজের দাদা হঠাৎ তুই থেকে তুমি করে কথা বলে। দূরত্ব জন্ম নেয়। ভুল। সবুজ গন্ধের মানসী। রক্তহীন আঙুল, অসম্ভব ফ্যাকাসে ঠোঁটের চুম্বন, আর তার উল্টোদিকে বোন তাপসী। যে একা ঘরে দিদির স্বামীকে দেখতে এসে বলে বসে, “দিদির অসুখ, কয়েকদিন থেকেই মনে হচ্ছিল আপনি একটু একা হয়ে গেছেন, তাই ভাবলাম।” দাম্পত্যবোধ, একাকিত্বের সংজ্ঞা দিব্যেন্দুর গল্পে। ‘ঢেউ’। সীতা। স্লিভলেস ব্লাউজ, সরানো আঁচল। “সীতা হাসলে ওর শরীরও হাসে।” আমার বয়ঃসন্ধির ভিড়ে ছোট্ট করে বসে থাকা আত্মহনন। প্লট টুইস্ট। শিখলাম কীভাবে কাঁদতে পারে পুরুষ। হয়ত নারীর চেয়েও বেশি। কনজুগাল এক অন্ধকার গল্পকথার পৃথিবী। কী অসম্ভব নির্মম। ‘বহুদূর অভিমান’। বাবা-মায়ের ঝগড়ার ভেতর হাতে ফল কাটার ছুরি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া সন্তান— “ঝগড়া থামাবে, না খুন করব?” অনেকটা একইরকম, ‘যখন বৃষ্টি’র রিয়া, হোস্টেলে পাঠানোর খবরে আপাত তৃপ্ত মেয়ে রিয়া, বাবা মায়ের কাছে যার কনফেশন “অন্তত তোমাদের এই জন্তুর মতো ঝগড়া, চিৎকার, চ্যাঁচামেচির হাত থেকে বাচব।” নারী। দাম্পত্য। পুরুষ। কোথাও সুস্পষ্ট রাজনীতি, সময়। ‘সহযোদ্ধা’র আদিত্যের ভেতর দিয়ে শ্রেণিশত্রুর সংজ্ঞা। আয়রনি। সেই ‘সহযোদ্ধা’। ‘অমৃত’ পত্রিকার জন্য পাঠানো লেখার শেষে ‘উপন্যাসের খসড়া’ শব্দটি দেখে সমরেশ বসু বলেছিলেন, “খসড়া কেন? এর সঙ্গে একটিও শব্দ জুড়বে না, একটি শব্দও বাদ দেবে না।” অথবা ‘একা’র শিশির রায়। অহঙ্কার। স্ত্রীর মৃত্যুতে অফিসকলিগ নারী দুঃখ পাওয়াতে যার সলিলকি— “আমি তোমার শরীরে মুগ্ধ হতে পারি, দুঃখে নয়।” অথবা ‘বিনিদ্র’র দীপ্ত। হিন্দুস্থান ফরস্টার কোম্পানির দীপ্তের ঝকঝকে স্মার্টনেস, সঙ্কট, এবং বুকের বাঁদিকের চিনচিনে ব্যথা। আসলে এক ভোগ্যপণ্যবোধে নারীকে দেখা অহঙ্কারী, আসলে ভীষণভাবে একা এক মধ্যবিত্তের জীবনসংকট। আসলে কে ‘একা’? কে ‘বিনিদ্র’? সমস্যাগুলো কার? শুধুই শিশিরের? দীপ্তর? আমার না? আমাদের না? ‘বৃষ্টির পরে’। আজীবন চলচ্চিত্রপ্রেমী দিব্যেন্দুর এক ‘রিয়ার উইন্ডো’। ঝোপঝাড়ে পড়ে থাকা নিথর নারী শরীর, আসলে একটি হত্যার ভেতর, রেপের ভেতর তৈরি হওয়া এক পারস্পরিক সম্পর্কগাথা। অশোক, প্রতাপ, টুসি, মিশিরজি, রাজবালা, শিখা, গায়ত্রী। বৃষ্টিকে কতদিন ভয়ে পেয়েছি এ লেখা পড়ে, কমার পরে চোখ মেলে দেখেছি সব ঠিক আছে তো?

ছোটগল্পের অল্প পরিসরেও একইরকম দিব্যেন্দু। ‘মাছ’, সোনার ঘড়ি’, ‘ব্রাজিল’, ‘গাভাস্কার’, ‘সিগারেট’, ‘মাড়িয়ে যাওয়া’, ‘পেট,’ ‘জানলার ধারে একা’, ‘সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে সাতটা’, ‘চিলেকোঠা’, ‘জেটল্যাগ’, ‘মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ’, ‘উটকো কেউ’। প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপতার মতো এক নিভৃত জগত। ‘জানলার ধারে একা’ এক নারী। কোথাও ফুটবল কিভাবে স্রেফ একটি খেলা থেকে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বেঁচে থাকাকে আঁকড়ে ধরতে শেখায়। মধ্যবিত্ত মন, যে ফুটবলে ব্রাজিলকে চায়, ক্রিকেটে গাভাস্করকে। দাম্পত্য, দাম্পত্যকলহ, যে ততটা শব্দমুখর নয়, বরং অনেকটাই স্থির, সন্দেহবাতিক, পার্টিতে মদের গ্লাস হাত থেকে পড়ে যাওয়ার মতোই কখনো আকস্মিক। এসবই দিব্যেন্দুর পৃথিবী। কখনও ঔপন্যাসিক দিব্যেন্দুকে ছাড়িয়ে যান গল্পকার দিব্যেন্দু। কখনও মিশে যান। তাই, অনেক সময়েই অনেক ছোটগল্পের প্লট পরে তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন লেখক। কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে না করলেও হয়ত পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে, এক একটা গল্প যেন মিলেমিশে কোনও বড় উপন্যাসের অধ্যায় হিসেবে পড়ছি। পাড়ার মস্তানের মতো ত্রস্ত কন্যাপিতার ঘরে কড়া নাড়ছে গল্পগুলো। এক করে দরজার ছিটকিনি খুলছি আমি, পাঠক।

কবিতার সঙ্গে আলাপ অনেক পরে। ‘রাজার বাড়ি অনেক দূরে’, ‘আহত অর্জুন’, ‘শব্দ চাই, দাও’। যে মানুষটির কবিতা লিখতে সবচেয়ে ভাললাগত, খেদ ছিল পাঠক তাঁকে সেভাবে কখনও কবি হিসেবে চিনল না। এসবই বাহ্য। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দিব্যেন্দুর অনুরাগী পাঠক ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতায় দিব্যেন্দুকে একসঙ্গেই পেয়েছেন। পড়েছেন। ‘আমার ছোট ছেলে জানে/ কার হাত ধরে সে/এগিয়ে যাচ্ছে কোনদিকে।/ তার খিদে পায় না,/ তার রাতগুলোও/ সাজানো মঞ্চের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকে/ বোতাম টেপা আলোয়’। অথবা ‘এক এক জায়গায়/ মৃত্যু থেকে জীবন/ আর জীবন থেকে মৃত্যুকে/ আলাদা করা যায় না’। আসলে কি ‘এখন কিছুই নেই?’ বিষাদ, অসম্ভব এক নৈঃশব্দ্য। ঈশ্বর থাকা এবং না থাকার মাঝে কখনও বাদুড়বাগান, কখনও কসবার ভেতরে হেঁটে যান। শৈশব, যৌবন আসলে কিছু ডার্ক স্টেজের ধারাবাহিক আত্মপ্রকাশ। ‘শিশুর  ভেতরে আছে সে প্রেমিক/ যার চোখের ভেতরে বাড়ে নখ’। তাহলে পরিণতি? কবি তো দ্রষ্টা। আলোর কথা? আশা? হয়ত সমাধানেও তাঁর কবিতা— ‘একাকী, নিঃসঙ্গ, এই আত্মঘাতী শোকের ভিতর/ থেকো, শুধু অপেক্ষায় থেকো’। প্রায় সমস্ত দিব্যেন্দু আত্মস্থ করার পর, মনে আছে, পড়েছিলাম, ‘সঙ্গ ও প্রসঙ্গ’। কবিতার ভেতর আত্মলীন দিব্যেন্দু পালিতের কিছু নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথন। কবিতা পত্রিকার গ্রাহক তরুণ দিব্যেন্দুর মুখোমুখি বুদ্ধদেব বসু। সেই বুদ্ধদেব, যার ‘কপালের ওপর ঝুঁকে পড়েছে চুল, পরনে পাজামা আর বোতামমুক্ত পাঞ্জাবি— দুই আঙুলের ফাঁকে পুড়ে যাচ্ছে নীল কৌটোর ‘মেপোল’। লিখেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়েও। ‘নীরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় কবি, জনপ্রিয়তার কবি নন’। খুব সামান্য কয়েকটি ঘণ্টার ব্যবধানে যে মানুষটিও নেই-জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছিলেন দিব্যেন্দুর কয়েকদিন আগেই।

এসবের মাঝেই আমার দিব্যেন্দু-জীবন। তাঁর সঙ্গেই সহবাস করা আমারও ‘কিছু স্মৃতি, দুঃখবোধ, কিছু অপমান’। অতিকথন, বাক্যের যথেচ্ছ যাত্রা, ক্লান্তিকর অভিব্যক্তি থেকে ভাষাকে বের করে আনার সঙ্গে সঙ্গে যে বাস্তবতাকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন দিব্যেন্দু, সম্ভবত এখনও তা অবিরত। মফঃস্বল, শহর এসবের মাঝে নিয়মিত হাঁটাচলার মধ্যে কোথাও এখনও দেখতে পাই চশমা পড়া স্বল্পভাষী এক প্রাজ্ঞের টেবিল, লেখার খাতা, ক্যালেন্ডার, ছোট্ট একটা ঘর। তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপ করতে ইচ্ছে হয়, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, কেন লেখেন? কেন লিখতেন? আগেভাগে তাঁর উত্তরটিও যেন জেনে গেছি আমি,– “লিখতে ভালো লাগে, তাই। এইমাত্র, আর কিছু নয়।”