অভিজিৎ কুণ্ডু
সেডিশন বা দেশদ্রোহিতা দমনের যে কথা আমরা মাঝেমাঝেই শুনতে পাই সেটা পাওয়া যাবে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২৪এ ধারায়। সাংবিধানিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোনও রকম উস্কানিমূলক বক্তব্য, ইঙ্গিত বা ক্রিয়াকলাপে এই আইনের আওতায় পড়তে হবে অভিযুক্তকে। বেশিরভাগ আইন আমরা এদেশে পেয়েছি ব্রিটিশ আমলের উপহার হিসেবে। সেই মেকলে সাহেবের ড্রাফট ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১৮৩৭-এর ১২৩ নম্বর ধারার উত্তরসূরি আজকের এই ধারা। ১৮৭০ সালে লাগু হয় এই ধারা। মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী ধারাকে বাগে আনতে চালু হয় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড-এর সংশোধিত ১২৪এ ধারা।
রাষ্ট্রদ্রোহিতা সন্দেহহীনভাবে ভয়ঙ্কর অভিযোগ। স্বাধীন ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে এই ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী আওয়াজ উঠলে সুযোগসুবিধা মতো সেইসবের বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইন লাগু করা। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বিদ্রোহ করেছে এমনও নয়। সরকারি নীতিকে কড়া সমালোচনার সামনে এনেছে এমন নানা রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মীকে ফেলে দেওয়া হয়েছে এই আইনের কবলে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বলছে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ বেড়েই চলেছে, অথচ আদালতে দোষী সাব্যস্তের হার খুবই নগণ্য।
দুটো জিনিস পরিষ্কার এর থেকে। সরকার বা কোনও ক্ষমতাশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করলেই রাজপেয়াদা ধরে আনবে বিরুদ্ধ মতের নাগরিককে। লাগু হবে সেডিশন অ্যাক্ট। সরকার বিরোধিতা বা কোনও রাজনৈতিক মতের পরিপন্থী হলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় আনার প্রবণতা বেড়েছে স্বাধীন ভারতবর্ষে। দুই, ভারতীয় বিচারব্যবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহ্য করেনি সরকারের আনা এই অভিযোগ। সরকারবিরোধিতা আর রাষ্ট্রবিরোধিতা এক জিনিস নয়। এটা গুলিয়ে ফেললে মুশকিল। বিভিন্ন রায়দানের সময়ে সর্বোচ্চ আদালত বারবার ধরিয়ে দিয়েছে— কোনও আদর্শে (সে আদর্শ বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোর বিরোধী হলেও কারও বিশ্বাস থাকলেই সরাসরি তাকে দেশদ্রোহী বলে সাজা দেওয়া যাবে না। এমনকি কোনও বক্তব্য বা মতপ্রকাশের ভিত্তিতে এই আইন প্রযোজ্য নয়, যতক্ষণ না তা সরাসরি কোনও দেশবিরোধী রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে।
তাহলে কেন ২০১৬ সালের গোড়ার জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নিয়ে প্রায় তিন বছরের মাথায় চার্জশিট এল রাষ্ট্রদ্রোহিতার? এত ভয়ঙ্কর অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে তারা প্রায় তিন বছর ঘুরে বেড়াল প্রাথমিক জামিন পেয়ে! এমন ডেঞ্জারাস ছেলেপুলে এই সময়কালে চুটিয়ে নানা গণ বা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের কথা বলতেই থাকল। জনপ্রিয় জাতীয় বা আঞ্চলিক টেলিভিশন চ্যানেলে বা নানা বিতর্কসভায় এদের দেখা গেল। এদের মধ্যে অন্যতম কানহাইয়া কুমার। রাষ্ট্রকাঠামোয় কিন্তু বিন্দুমাত্র আঁচড় পড়েনি কানহাইয়া কুমারের অবিরাম চাঁছাছোলা ভাষার বয়ানে। রাষ্ট্র আর সরকারকে এক করে দেখার যে কৌশল, তাতে ঘি ঢেলেছে কিছু গণমাধ্যম, বিশেষ করে বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলি আর কিছু সাংবাদিক আর সংবাদ উপস্থাপক।
এই ঢক্কানিনাদ চলছিল বছরখানেক। পাঠ পড়ানো শুরু হয়েছিল জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের, নতুন করে কীভাবে সর্বাত্মক করে তোলা যায় রাষ্ট্রবাদ, দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদ এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক আধারে। এই সাম্প্রদায়িক ন্যারেটিভের প্রধান শত্রু দেশের সক্রিয় মননশীল নানা উচ্চশিক্ষা প্রাঙ্গণ। জেএনইউ তাদের মধ্যে অন্যতম। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাগিয়ে দাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারখানা বলে। শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে কলঙ্কিত করার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্র যেভাবে আস্তে আস্তে অনুদান কমিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিয়েছে, তার সমর্থনে একটা গণ পরিসর/সমর্থন তৈরি করার ফন্দি।
সুতরাং, এক নম্বর উদ্দেশ্য— আমার বিরোধিতা করলেই ধরিয়ে দেব সেডিশন মামলা। ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে যদি দাবিয়ে রাখা যায় বিরোধী মতপ্রকাশ। দুই, সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে আবার চাগিয়ে তোলা জাতীয়তাবাদের গেরুয়া শিক্ষা। স্রেফ রাম নাম জপলেই নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনো তো দূর অস্ত্। তিন, বিকাশ মন্ত্রের ধাপ্পাবাজি দিন কে দিন পরিষ্কার যুবসমাজের কাছে। রাজপথে, জনপথে মিছিল নামছে একের পর এক। সফল কৃষক মিছিল, শ্রমিক ধর্মঘটের পর ফেব্রুয়ারির গোড়ায় রাজধানী কাঁপাতে নামছে সর্বভারতীয় ছাত্র-যুব মিছিল। সমান্তরাল ন্যারেটিভ আসবে যুবসমাজ থেকেই— হাত ধরাধরি করা পরস্পর অবিশ্বাসী দুর্নীতিগ্রস্ত নেতানেত্রীদের জমায়েত থেকে নয়। তাই, চার্জশিট, বারোশো পাতার, দশ ছাত্রের বিরুদ্ধে, নির্বাচনের ঠিক কয়েক মাস আগেই।
শুরুই হল আদালতের ধমক খেয়ে। এতই তাড়াহুড়ো যে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে আবশ্যিক অনুমতি না নিয়েই পেশ করা হল চার্জশিট। দিল্লি রাজ্য সরকার কি অনুমতি দেবে? তাদেরই গড়া ‘ম্যাজেসট্রিয়াল’ তদন্ত প্রমাণ পেয়েছে যে, সেই ‘টুকড়ে টুকড়ে’ অধ্যায়ের বেশিরভাগ ভিডিও জাল। শুধু কিছু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে কালো কাপড়ে ঢাকা কিছু মুখ আপত্তিকর শ্লোগান দিচ্ছে। ওদিকে প্রাক্তন/বহিষ্কৃত কিছু এবিভিপি সদস্য সরাসরি বলে বসেছে, এসবই ছিল একটা প্লট।
এ এক নতুন শতাব্দী। ভীতিপ্রদর্শন, প্লট, ‘লিঞ্চিং‘ অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত ছাত্রনেতাদের মুখে অন্য সুর। গণমাধ্যমেই কানহাইয়া কুমার দাবি করেছে— সে গান্ধী নয় যে গুলি খেয়ে মরবে। ভগৎ সিং নয় যে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া যাবে তাকে৷ এই দুজনকে একসাথে নিয়েই সে এগিয়ে যাবে। উল্লেখযোগ্যভাবে দাবি করেছে আরও এক অভিযুক্ত, উমর খালিদ। ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, উমর চাইছে আদালতে দাঁড়াতে, এক তরফা অনেক মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে। এবার তার পালা আদালতে সব কিছু তুলে ধরার। চ্যালেঞ্জ নিয়ে উমর বলছে, এই আদালত প্রক্রিয়ার পর সেও আদালতের দ্বারস্থ হবে। কেন তাদের মানহানি, এমনকি প্রাণহানির মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এই ‘টুকড়ে টুকড়ে’ প্রচার-বিভ্রমে?