Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মহাজোট-মহাগাটবন্ধন-মহাপুরুষ — শীতের অলস সকালে কিছু মহাচর্চা

মহাজোট

বিষাণ বসু

 

বাজারের বেসিক নিয়ম, ক্রেতার পছন্দের স্বাধীনতা। বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা।

কিন্তু, দুটিমাত্র দোকান। দুজনেই পচা মাল বেচছে। আপনি কী করবেন?

না কিনে বাড়ি ফিরে আসবেন, এই তো?

কিন্তু, গণতন্ত্র মাঝেমধ্যে কিছু এমন বেয়াড়া পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়, যেখানে এই দুই দোকানদারের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হয়, নিতেই হয়।

না, যতই নোটা থাকুক, আপনি মুক্তি পাচ্ছেন না। কেননা, এমনকি নব্বই শতাংশ মানুষ নোটায় ছাপ দিলেও পাঁচ কি ছয় শতাংশের পছন্দের প্রার্থীই শেষমেশ নির্বাচিত হবেন, দেশ চালাবেন।

কাজেই, বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা নয়, এই বেছে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়েই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন।

এই যেমন ধরুন, ব্রিগেডে, তেইশ জোড়া হাত মিলিত হয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিল চ্যালেঞ্জ, আর উপস্থিত কয়েক লক্ষ জনতার বজ্রনির্ঘোষ— বাকি কথা পরে হবে, আপাতত গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার ব্যাপারটা আশু কর্তব্য। আর, ফেসবুকে এই একজোট হওয়ার বিরুদ্ধে ভেসে এল তির্যক মিম— দল বেঁধে ঘোরে শুয়োর, প্রকৃত বাঘের বাচ্চা একা শিকার করে। সাথের ছবিতে, অনিবার্যভাবেই, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি গেরুয়া পাঞ্জাবিতে ঢাকা পরিচিত মানুষটি।

কিন্তু, সমস্যা হল, এই ঢক্কানিনাদে যত না উত্তর পাওয়া গেল, তার চাইতে বেশি এল প্রশ্ন।

যেমন, বাঘ না হয় একা শিকার করে, কিন্তু, আগামী নির্বাচনে বিজেপি তো জোট করেই লড়বে শুনেছি। দলের সমর্থকেরা, বা আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে আইটি সেলের দক্ষ কর্মীরা কি সেই সাথীদের শুয়োরের বাচ্চা বলতে চাইছেন?

আবার আরেকদিকে, মোদিজির সাফল্য দেখে হিংসে হয়। এমনভাবে “বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান” সংঘটিত হওয়ানোর কৃতিত্ব এক এবং একমাত্র তাঁরই।

ভাবতেও ভালো লাগে, গণতন্ত্র রক্ষার মহান দায়িত্বটি বুক ফুলিয়ে গ্রহণ করছেন যাঁরা, তাঁদের বেশ কয়েকজনেরই দলে গণতন্ত্র এমন চমকপ্রদ, যে, নেত্রী বাদে সকলেই ল্যাম্পপোস্ট।

একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশেরই নিজ নিজ দলে দুনম্বর নেতার নাম কী, সেইটার উত্তর ক্যুইজমাস্টার ভিন্ন দ্বিতীয় কারও জানা সম্ভব নয়।

একনায়কের ঢঙে সর্বত্র মোদিজির ছবি ছাপানোর বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে এক নেত্রী প্রথম সুযোগেই রাজ্য ভরিয়ে তুলেছিলেন ভ্যানিটি ব্যাগ সহকারে তাঁর নিজের মূর্তি দিয়ে। আর, অপরজনের রাজত্বে, এমনকি সুলভ শৌচালয়ের উদ্বোধনেও, তাঁর অনুপ্রেরণার সচিত্র উল্লেখ অবশ্যম্ভাবী।

দুর্নীতির বিরুদ্ধেও এনারা খুব সরব। লালুপ্রসাদ যাদবকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার কথাও উঠেছে। মহাজোটের প্রায় অধিকাংশ দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। মহানেত্রীর মন্ত্রীসভার গুণে, একের পর এক হেভিওয়েট নেতা দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ছেন, জেলে যাচ্ছেন, অন-ক্যামেরা ঘুষ নিচ্ছেন, এমন চমকপ্রদ বসন্ত তো গোবলয়ের রাজ্য পার হয়ে, এখন এই রাজ্যেও এসে গেছে।

মোদিজির অনেক কৃতিত্বের মধ্যে অন্যতম, তিনি সিবিআই নামক প্রতিষ্ঠানটিকে একেবারে হাস্যকর করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। হ্যাঁ, সিবিআই ইতোপূর্বেও সরকারি দলের তোতাপাখিই ছিল। কিন্তু, প্রায় ব্যক্তিগত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে সিবিআইকে এমনভাবে ব্যবহার করা নজিরবিহীন। অতএব, চিটিংবাজির দায়ে গ্রেফতার হওয়া নেতামন্ত্রী (এবং সেই ক্ষমতার সহচরেরাও) প্রায় শহীদের মর্যাদা পেয়ে যান। আরও লজ্জার বিষয়, বিপজ্জনকও বটে, ঘুষখোর দুর্নীতিপরায়ণ নেতার গ্রেফতারি আর যথার্থই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা রাষ্ট্রের আক্রোশের শিকার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের গ্রেফতারি আমজনতার চোখে সমান হয়ে যায়।

আচ্ছা, লালুপ্রসাদের মুক্তির দাবিতে সরব যিনি, ঠিক তাঁরই মন্ত্রীসভায় তো ছিলেন লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে তদানীন্তন মুখ্য তদন্তকারী সিবিআই অফিসার উপেন বিশ্বাস!! তখন, দোর্দণ্ডপ্রতাপ লালুপ্রসাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সৎ অফিসারের ইমেজটি ভাঙিয়ে ভোটলাভের চেষ্টার কমতি দেখিনি!!! তাহলে?

যাক, সেসব অপ্রিয় প্রসঙ্গ।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রেই মানবেন, এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ হল সাম্প্রদায়িকতা, এবং ক্ষমতাসীন দলের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। কিন্তু, এর বিরুদ্ধে যাঁরা জোট বাঁধছেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু?

সংখ্যালঘুর উন্নয়নের দিকে বিন্দুমাত্র নজর না দিয়েও এই রাজ্যে যেমনভাবে সংখ্যালঘু তোষণ চলেছে, এবং চলছে, তা দেশের মধ্যে মডেল হিসেবে গৃহীত হতে পারে। একদিকে, এই আশ্চর্য নীতির ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অংশ, তাঁরাই সংখ্যালঘুর মুখ ও কণ্ঠ হয়ে উঠেছেন। আরেকদিকে, এই নীতির ফলে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সংখ্যাগুরু সমাজের যে বৃহৎ অংশের হৃদয়ে মুসলিম-বিদ্বেষটি অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বহমান ছিল, তা প্রকাশ্যে দাঁতনখ বের করতে শুরু করেছে। এই রাজ্যে, বিজেপির বাড়বাড়ন্তের জন্যে প্রধান কৃতিত্বটি কার, সেই প্রশ্নের উত্তরটি একেবারেই স্বতঃসিদ্ধ।

আবার, হিন্দুত্বের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দলের দিশেহারা মধ্যবয়স্ক যুব নেতা মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ান। নির্বাচনী ইশতেহার জুড়ে থাকে গোরক্ষার বিষয়ে তাঁদের সুগভীর ভাবনা।

এনারা সবাই মিলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, ধর্মনিরপেক্ষতার জয়ধ্বজাটি উড়িয়ে দেবেন— ভাবলে স্রেফ গায়ে কাঁটা দেয়।

সমস্যা এইটাই— আগামী নির্বাচনে মোদি-শাহ পরাস্ত হলেও, তাঁরা ইতোমধ্যেই জিতে গিয়েছেন। আদর্শগত জয়। তাঁদের বিপজ্জনক আদর্শটি জিতে গিয়েছে। ধর্মের সুড়সুড়ি এখন দেশের ক্ষমতাদখলের লড়াইয়ে একেবারে কেন্দ্রীয় ইস্যু হয়ে গিয়েছে— হয়ে থাকবেও আগামী বেশ কিছু বছর— হয়তো কয়েক দশকও, আপনি-আমি সজাগ না হলে।

না, আমি একটিবারের জন্যেও এই জোটের বিরুদ্ধে নই। বর্তমান পরিস্থিতিতে মোদি-শাহ জুটিকে পরাস্ত করা আশু কর্তব্য বা বাকি সব কথা পরে হবে; এখন জোট বেঁধে মোদি-শাহ-কে হারান; এই অবিশ্বাস আর ঘৃণার বাতাবরণটা সরান তো প্রথমে, তারপর দেখা যাবে— এর কোনওটির সাথেই আমি দ্বিমত নই।

কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা এই আহ্বান জানাচ্ছেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছু নেই। এহ বাহ্য, কোনও গঠনমূলক অ্যাজেন্ডা ছাড়া হঠাৎ এই জোট বাঁধার প্রয়াসের ফলে, যাঁর ছবিটি প্রকৃত-অর্থেই লার্জার দ্যান লাইফ হয়ে উঠল, তিনি নরেন্দ্র মোদি। এতখানি প্রচার বা সম্মান বা গুরুত্ব, এর কোনওটাই, বোধ হয়, তাঁর প্রাপ্য ছিল না।

সমাবেশ থেকে ঘোষণা হয়েছে, জোটের কোনও নেতা নেই। এইখানে সবাই নেতা। ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে। বেশ কথা। শুনলেও মন ভরে যায়। আর কুটিল প্রশ্ন জাগে মনে, প্রধানমন্ত্রীর নাম আগেভাগে ঘোষণা হলে জোটটি আদপেই হতে পারত কি??

এক ক্ষমতামত্ত ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে একঝাঁক ক্ষমতালোভীর সুবিধেবাদী জোট হিসেবে এই মহাজোটকে যদি কেউ বিচার করেন, খুব ভুল হবে কি? বিশেষ করে, মোদিকে ক্ষমতাচ্যুত করা ভিন্ন দ্বিতীয় কোনও অ্যাজেন্ডার অনুপস্থিতিতে এমন প্রশ্ন ওঠা অযৌক্তিক কি?

এই পরিস্থিতিতে, যথার্থই দিশারীর ভূমিকাটি পালন করতে পারতেন বামপন্থীরা। অন্তত, প্রথম সারির বামনেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে তাঁদের দায়বদ্ধতাও প্রশ্নাতীত। কিন্তু, দীর্ঘ প্রয়াসে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন বামেরা। এতদসত্ত্বেও, সঙ্ঘ-পরিবার বামেদেরই প্রধান শত্রু ভেবে থাকেন— এবং সেকথাটি গোপনও করেন না— এই নিয়েই বামেদের আপাত সান্ত্বনা। তাত্ত্বিক রাজনীতি বনাম ফলিত রাজনীতির দ্বন্দ্বে আশ্লিষ্ট হয়ে বামেরা ঘরেও নহে পারেও নহে যেজন আছে মাঝখানে হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

সম্মান পুনরুদ্ধার করতে হলে, এখন ফ্ল্যাশবালবের ঝলকানির লোভ এড়িয়ে মাঠেময়দানে পড়ে থাকার সময়। এবং, অন্তত একশ্রেণির বামনেতা তা করছেনও। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাল পতাকা হাতে কৃষকদের পদযাত্রা তারই সাক্ষ্য বহন করে। তবে, প্রকাশ কারাতের সুদীর্ঘ ছায়া অতিক্রম করে আলোর দিন আসতে ঢের বাকি।

এরই মাঝে প্রিয়াঙ্কা গান্ধির রাজনীতিতে পদার্পণ নিয়ে মূলধারার মিডিয়া থেকে সোশ্যাল মিডিয়া— সর্বত্র যেরকম হইচই পড়ে গেল— যেমন করে প্রায় সমস্বরে ধ্বনি উঠল “আরে দিওয়ানো, মুঝে পয়চানো, কাঁহাসে আয়া, ম্যায় হুঁ কন”— আর, আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, একশ্রেণির বাম সমর্থক যেমনভাবে এই পদার্পণকে প্রায় কল্কি অবতারের ধরায় অবতীর্ণ হওয়ার সাথে গুলিয়ে ফেললেন— এসবের মধ্যে ভারতীয় রাজনীতির সামগ্রিক দেউলিয়াপনা, আইকন-আঁকড়ে বৈতরণী পার হওয়ার প্রবণতা সবই খুব স্পষ্ট— আর, সর্বোপরি, বামেদের এই ভগ্ন দশার কারণ ও প্রতিফল, যুগপৎ প্রতিভাত।

যাক সেসব কথা।

শুরুর কথায় ফিরি।

এই অবিশ্বাস-ঘৃণায় ভরা সময়ে দাঁড়িয়ে— এই ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে— এই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতিরোধে সরব হয়ে— বিজ্ঞাপনী চটকদারির প্রলোভন এড়িয়ে— আপনি যদি সত্যিই আপনার ভারতবর্ষকে ছিনিয়ে আনতে চান— আর দেখেন যে, না, আপনার সামনে বেছে নেওয়ার চয়েস নেই, তাহলে?

আরে, সবকিছু কি রেডিমেড রেডি-টু-ইট পাওয়া যায়? চয়েস তৈরি করে নেওয়াটাও কি আপনার দায়িত্ব নয়?

অন্তত, চয়েসের দাবিতে সরব যদি না হন— কোন অ্যাজেন্ডা নিয়ে ভোটের লড়াই হবে, সেইটা যদি আপনি বেছে না নেন— সেইটা বেছে নেওয়ার অধিকারটুকুর দাবিতে যদি এখনও সোচ্চার না হন— তাহলে, আর যাই হোক, থলে খুলে পচা আলু দেখে গজগজ করা আপনার সাজে না।