Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফেলে আসা অক্ষর-আলাপনের প্রহরগুলি

শান্তনু ভট্টাচার্য

 

তখনও মধ্য জানুয়ারিতে শহর কলকাতা জুবুথুবু হয়ে যেত কনকনে শীতে। একটা নতুন বছরের প্রথম মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেই কুয়াশা-জড়ানো শীতে রপ্ত হয়ে উঠত পশ্চিমবঙ্গের অগণিত লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক, কর্মী, লেখক-কবিরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ ও পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পাঁচদিনব্যাপী লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অংশগ্রহণের প্রাক্কালে তাদের কর্মব্যস্ততা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছত। দিনরাত এক করে একটা নতুন সংখ্যা সঙ্গে নিয়ে বাংলা আকাদেমি-নন্দন চত্বরে পা দেবার কামনায় তারা অনেকেই কার্যত প্রাণপাত করতেন! সদ্য প্রকাশিত সংখ্যার একটা বড়ো অংশ সেই মেলায় গ্রাহক ও নতুন পাঠকদের হাতে সবাই না হলেও, অনেক সম্পাদকই তুলে দিতে পারতেন। সেই ট্র্যাডিশন তো আজও চলছে।

চরিত্রগতভাবে আজকের লিটল ম্যাগাজিন মেলার সঙ্গে প্রথম দিককার মেলার সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, সে মেলার সঙ্গে ‘সাহিত্য-উৎসব’ বিষয়টি যুক্ত ছিল না। সেটা ছিল বিভিন্ন মানের ও চরিত্রের লিটল ম্যাগাজিন দিয়ে সাজানো একটি নিপাটই ‘লিটল ম্যাগাজিন মেলা’। কমবেশি ৬০০টি পত্রিকা সে-মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পেত। শেষ প্রকাশিত দুটি সংখ্যা নিয়ে সম্পাদককে মেলায় অংশগ্রহণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির কাছে আবেদন রাখতে  হত।  একবার সুযোগ পেলে, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী বছরগুলোতে সে-পত্রিকাকে বাংলা-আকাদেমি পত্র মারফত আমন্ত্রণ জানাতেন।

প্রথম দিকে মেলা নির্দিষ্টভাবে ১১-১৫ জানুয়ারি অবধি হত না, আজ যেমন হয়। এক-দুদিন এপাশ-ওপাশ হত। বাংলা আকাদেমি কর্তৃপক্ষ যে আমন্ত্রণপত্র পাঠাত, তাতে সম্পূর্ণ নিয়মাবলি লেখা থাকত। সেই নিয়ম অনুযায়ী ‘আগেই এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে টেবিল বণ্টন করা হত। টেবিল নম্বর ও বাংলা আকাদেমি লোগো ছাপানো চটের  ব্যাগ পত্রিকা সম্পাদক বা কোনও পত্রিকা-কর্মীর হাতে তুলে দেওয়া হত। একজন সর্বাধিক দুটি টেবিল বুঝে নিতে পারতেন, এবং তা তাঁর  নিজের পছন্দেই। কোনও এক-দুই বছরে প্রত্যেক সম্পাদককে এক-একটি করে ছোট ধাতব ব্যাচ দেওয়া হয়েছিল। অনেককেই দেখতাম খুব গর্বের সঙ্গে সে-ব্যাচ বুকে ঝুলিয়ে ঘুরছেন।

আমি সে সময়ে ‘বর্ণিক’ প্রকাশ করতাম। আবেদনের ভিত্তিতেই টেবিল পেয়েছিলাম। প্রথমবার আমাকে টেবিল দেওয়া হয়েছিল প্রায় সন্ধের মুখে, সকলের হয়ে যাওয়ার পর। পরের বছর থেকে অবশ্য বাংলা আকাদেমি চত্বরে পৌঁছে দেখতাম বহু লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক, কর্মীরা অনেক আগেই সেখানে এসে কুপন সংগ্রহ করেছেন। জেলা থেকে অনেকেই দিনের প্রথম ট্রেন ধরে আসতেন। এগারোটা থেকে সংগৃহিত কুপনের বিনিময়ে স্টল বণ্টন শুরু হত। মাইকে কুপন সংখ্যা ধরে পরপর দশজনকে লাইনে দাঁড়াতে বলা হত।

সকাল থেকে বাংলা আকাদেমি প্রাঙ্গন মেলার চেহারা নিত। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলত আড্ডা, নতুনদের সঙ্গে পরিচয়, কথাবার্তা, চা খাওয়া। আমার ওদিন দুপুরে ভাত খাওয়া হত না। যা হোক খেয়ে পেট ভরাতাম। শুধু আমি নয়, অনেকেই। দল বেঁধে বারবার গিয়ে দাঁড়াতাম হরিদার চায়ের দোকানে। দুপুরে টেবিল সাজিয়ে, ব্যানার ঝুলিয়ে, চেনা কাউকে টেবিলে বসিয়ে ‘আমন্ত্রণ’ থেকে রুমালি রুটি, আলুরদম কিনে খেতাম।

মেলার উদ্বোধনের পর থেকে মুক্তমঞ্চ, বাংলা আকাদেমি ও জীবনানন্দ সভাঘরে চলত বিভিন্ন আলোচনা, গল্প-কবিতা পাঠ। গল্প-কবিতা পাঠ করলে খুব সম্ভব দেড়শো টাকা পাওয়া যেত। নামীরা কত পেতেন, তা অবশ্য জানি না। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি-গবেষণা কেন্দ্রের সন্দীপ দত্ত প্রতি বছর নন্দন প্রদর্শশালায় একটি লিটিল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনী সাজাতেন। রবীন্দ্রসদনের গেট থেকে শুরু করে পুরো বাংলা আকাদেমি-নন্দন চত্বর, পরপর নীল রঙে নম্বর লেখা সাদা টেবিল সাজানো থাকত। এখন যেখানে ‘একতারা মঞ্চ’, সে-মাঠেও জায়গা পেত অনেক পত্রিকা। তবে অনেকেই ও-মাঠে জায়গা নিতে চাইত না, ও-দিকে লোক যাবে না এ-ভয়ে। এক নামী কবি সম্পাদিত হৃষ্টপুষ্ট কবিতার কাগজকে দেখতাম প্রতি বছর একই জায়গায় টেবিল পেত। কী করে পেত, জানি না। আমি রবীন্দ্রসদনের পাশে বসার চেষ্টা করতাম। চলতি পথ বলে অনেকের সঙ্গে দেখা হত, পত্রিকা বিক্রি হত বেশি। অণুগল্পের একটি সংকলন করেছিলাম মিনিবুক আকারে। ‘অত্যল্প’ নামের সেই ১০ টাকা দামের সংকলনটি ফুরিয়ে গিয়েছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। প্রতি বছরই মেলায় একদিন আসতেন কবি শঙ্খ ঘোষ। ঘুরতেন প্রায় প্রত্যেকটি টেবিল। দূর থেকে আসা পত্রিকাগুলির সঙ্গে আমি যেচে আলাপ করতাম। সুদূর আন্দামান থেকে আসত ‘তীরভূমি’ কাগজ। দিল্লি, মুম্বই, ভূপালের লিটল ম্যাগাজিনগুলি আসত নিয়মিত ভাবে। ছড়াকার অলোক দত্ত ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন তাঁর হাসির ছড়ার সংকলন ও ‘স্বয়ংনিযুক্তি’ কাগজটি। তবে প্রথম বছর থেকেই ‘অনুষ্টুপ’ ‘কবিতীর্থ’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলিকে মেলায় অংশ নিতে দেখিনি। বাংলা অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ একদিন সমস্ত সম্পাদকদের চা-চক্রে আমন্ত্রণ জানাতেন।

পাঁচ দিনই অ্যাকাডেমি ও জীবনানন্দ সভাঘরে বিভিন্ন পত্রিকা সময় মেপে তাদের পছন্দমতো অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেত। আগে থেকে আবেদনের ভিত্তিতে স্লট পেত তারা।

প্রতি বছর একাধিক পত্রিকাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হত মুক্তমঞ্চে। দেওয়া হত লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার ও বাংলা অ্যাকাডেমি-মধুপর্ণী পুরস্কার। মেলা উপলক্ষে মিনিবুক আকারে প্রকাশিত হত পাঁচদিনের সমগ্র অনুষ্ঠানসূচীটি। এই মেলার আরেকটি আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা লিটল ম্যাগাজিন। বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক সম্পাদক-লেখকের সঙ্গে আলাপ হত, আড্ডা হত।

ব্যক্তিগতভাবে এই মেলা আর একটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার কাছে, তা হল নতুনের সঙ্গে পরিচয়, কথা-বিনিময়। আমরা গল্পকারেরা গল্পকারদের সঙ্গে কথা জমাতাম, কবিরা কবিদের সঙ্গে কথায় মেতে উঠতেন। কথা-হাসি-আড্ডায় কেটে যেত পাঁচটা দিন, দুপুর থেকে রাত। শেষ দিনে মন খারাপ হত খুব। বইমেলায় আবার দেখা হবে, বলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলতাম সকলে।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চের উদ্যোগে প্রথম বছর লিটল ম্যাগাজিন মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ মাঠে। সে-মেলাতেও বহু পত্রিকা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। পরে সে-মেলা স্থানান্তরিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। পরিসরে ছোট হলেও সে-মেলাও ক্রমশ বর্ণময় হয়ে উঠেছে।

সরকারি মেলার স্থানবদলের প্রতিবাদে গড়ে উঠেছে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ফোরাম। তারাও একটি মেলার আয়োজন করেছে পরপর দু-বছর। প্রথম বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভারতসভা হলে। দোতালার ঘেরা পরিসরে সে-মেলায় লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তখনই বোঝা গিয়েছিল, এ-মেলা আরও বড় পরিসর দাবি করছে। তারই ফলস্বরূপ এ-বছর (২০১৯) মেলার আসর বসছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুন্দর, সাজানো একটি মেলা। আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ। বহু পত্রিকা এসেছে তাদের সদ্যপ্রকাশিত সংখ্যা নিয়ে। সরকারি মেলার পাশাপাশি ক্রমশ উজ্জ্বলতা পাচ্ছে এ-মেলাও।

এখন সরকারি মেলার স্থান বদল হয়েছে। দু-বছর মেলা হল লবন হ্রদের রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে। শুনেছি এ-মেলা সুন্দর, সাজানো। গত বছর কলকাতার বাইরে থাকার জন্য, এ বছর কাজের চাপে আমি এ মেলা এখনও দেখে উঠতে পারিনি। আগামী বছর যাবার চেষ্টা করব। না-গিয়ে থাকি কী করে! লিটল ম্যাগাজিনই যে আমার শমীবৃক্ষ!