Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আয় আর্ট, হায় হার্ট!

প্রকল্প ভট্টাচার্য

 

আজকাল এটা কোনও খবরই নয়। না আছে কোনও নতুনত্ব, না কোনও মুখরোচক চটপটে চাটনির উপকরণ। শিল্পসংস্কৃতিতে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর খাঁড়ার ঘা এই মুহূর্তে আমাদের দেশে বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। রাজ্যবিশেষে নিজের পছন্দমতো খাওয়াদাওয়ার করারই স্বাধীনতা নেই, সেখানে শিল্পীর স্বাধীনতা তো দূর কি বাত! সাম্প্রতিক ঘটনাটি তামিলনাড়ুর। চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজের এক প্রদর্শনীতে চিত্রশিল্পী এম মুহিলনের কিছু শিল্পকর্মে হিন্দুত্ববাদী কিছু ‘শুভবুদ্ধিসম্পন্ন’ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তাই তাঁরা প্রতিবাদ এবং বিরোধিতা করে প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, কলেজ কর্তৃপক্ষ এই মর্মে ক্ষমাও চেয়েছেন যে তাঁদের কলেজের সুনাম এবং সুযোগ অপব্যবহার করেছে এই প্রদর্শনীটি। মুহিলন ফোনে ও মেসেজে হুমকি পাওয়া শুরু করেন। এরপর স্বাভাবিকভাবেই, শ্রী মুহিলন বলতে বাধ্য হয়েছেন তাঁর শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য কখনওই কাউকে আঘাত দেওয়া নয়। অবশ্য পাশাপাশি এই প্রদর্শনীর আয়োজক কালীশ্বরণ আবার এটাও বলছেন, এই একই ছবিগুলিই ২০১৬ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে প্রদর্শিত হয়েছিল, তখন কারও কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগেনি! এখন যেহেতু লয়োলা একটি খৃষ্টান সংখ্যালঘুদের প্রতিষ্ঠান, তাই তাঁদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন অতি-অনুভূতিশীল জনতা!

কী ছিল মুহিলন-এর ছবিতে? বিজেপি সদস্য ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বলছে ছবিতে নাকি হিন্দু দেবদেবী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকেও অপমানজনকভাবে দেখানো হয়েছে। কী ধরনের অপমান? মুহিলনের একটি ছবিতে ভারতমাতা হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে। আরেকটি ছবি বর্তমান সরকারের রাফালে চুক্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে, হিন্দুত্ববাদীদের অসম্মানজনক বলে মনে হয়েছে। এইসব রাজনৈতিক দলদাসদের শিল্পবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা, তবে প্রধানমন্ত্রী ও আরএসএস-ও কোনও সমালোচনা না নিন্দার উর্দ্ধে উঠে গেছেন এবং দেবদেবী বা ভারতমাতার সমপর্যায়ে পূজিত হচ্ছেন, এটা অবশ্যই একটি নতুন ঘটনা।

এইবার কি ভুরু কোঁচকাচ্ছেন, পাঠক? আচ্ছা, তাহলে আর একটু বলি। গত নভেম্বরে তিরুচিরাপল্লীর সেইন্ট জোসেফ কলেজে ‘তামিল সাহিত্যে উল্লিখিত মহিলাদের উপর নিগ্রহ’ এই বিষয়ের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বন্ধ করে দেওয়া হয়, বন্ধ করে দেওয়ার কারণ দেখানো হয় যে ওটি ছিল ‘শহুরে নক্সাল’ এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের পরিকল্পিত গোলমাল বাঁধাবার মঞ্চ। তাহলে কী আসল কারণ সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুম, সংখ্যালঘুর অন্যমত প্রকাশের অধিকারের কণ্ঠরোধ? শিল্প সাহিত্যের স্বাধীনতা কি ক্রমেই লোপ পেতে চলেছে? কন্নড লেখক কালবুর্গী, বামপন্থী চিন্তক পানসারে, অথবা সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের হত্যা কি আসলে কেবল এই মুখ বন্ধ করবার রাজনীতি?

জীবনের অনেকগুলো বছর তামিলনাডুতে কাটাবার ফলে আমি তামিল সংস্কৃতি এবং মানসিকতা কিছুটা বুঝতে পারি। আমি জানি, যে নির্ঝঞ্ঝাট নিরুপদ্রব এইসব মানুষদের কেবল জাত-পাতের নামে কত সহজে তাতিয়ে দেওয়া যায়! এবং সেই তাতাবার কাজটা সুনিপুণভাবে করেন মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্বেষী। ক্ষমতাশালীরা নিজেদের আখের গোছাবার জন্যই এই বর্ণভেদ, জাতবিচার এবং অবশ্যই প্রথাগত ধর্মভেদ জিইয়ে রাখার রাজনীতি করে থাকেন, কারণ জনতা ঐক্যবদ্ধ হলে ওঁদের ক্ষমতা চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

অনেক বছর ধরেই এই খেলাটা চলে আসছে। সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘পদ্মাবতী’ সিনেমার নাম বদলে ‘পদ্মাবত’ করতে হয়েছিল ঐ অনুভুতিতে আঘাত লাগার কারণেই। ২০০৪ সালে কমল হাসানকে এইরকম অনুভুতি বাঁচাতেই বাধ্য হয়ে তাঁর ‘সাণ্ডিয়ার’ চলচ্চিত্রটির নাম বদলে ‘ভিরুমাণ্ডি’ করতে হয়েছিল। ২০১৫ সালে তামিল লেখক শ্রী পেরুমল মুরুগন ‘মধুরুবগান’ (ইংরেজিতে ‘ওয়ান পার্ট ওম্যান’) লিখে এমন অনুভূতির চাপ থেকে বাঁচতেই ঘোষণা করতে বাধ্য হন যে তাঁর লেখক সত্ত্বার মৃত্যু হল, আর কোনওদিন কিছুই লিখবেন না তিনি! কিন্তু এইসবের পিছনেও কি শুধুমাত্র রাজনৈতিক চাল ছিল? ছিল কি যেনতেনপ্রকারেণ শিল্পীদের ইচ্ছামতো প্রকাশ পেতে না দেওয়ার দলবদ্ধ প্রচেষ্টা? নাকি আমাদের সমাজের ভিত্তি এতটাই অসহিষ্ণু যে সামান্যতম প্ররোচনায় সহনাগরিকদের গলার আওয়াজ বন্ধ করে দিতে চাই?

যদি তাই হয়, তবে আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর দুর্দিন অবশ্যম্ভাবী। শিল্প যদি স্বাধীনতা না পায়, মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারাতে বাধ্য। ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা হল শিল্পসৃষ্টির অপরিহার্য এবং বিশিষ্ট বেদিকা।

আপনি শিল্পবোদ্ধা না হলেও সমস্যা নেই, প্রতিটি শিল্পকর্ম আপনাকে বুঝতেই হবে ও তা নিয়ে মতামত ব্যক্ত করতে হবে তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু চলতি হাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাবার আগে একবার নিজে ভেবে দেখুন। যদি কয়েকজন ব্যক্তি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে মানুষদের ভুল বুঝিয়ে, গোলমাল সৃষ্টি করেন এবং কেবল স্বার্থসিদ্ধির জন্যই চাপ দিয়ে শিল্পীদের দমিয়ে রাখতে চান, তাতে কেবল শিল্পেরই নয়, সমগ্র সমাজের সর্বনাশ। তাই ভবিষৎ প্রজন্মের খাতিরে, গণতন্ত্র রক্ষার খাতিরে এই ব্যান-সংস্কৃতির বিরোধিতা করুন, এটুকুই অনুরোধ!