সৌভিক ঘোষাল
আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চায় সব্যসাচী ভট্টাচার্য এক উল্লেখযোগ্য নাম। গবেষক লেখক শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে তাঁর অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সবসাচীবাবুর বিদ্যালয় শিক্ষা বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট হাই স্কুলে। তারপর পড়তে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস বিভাগে। সেখানে তখন অধ্যাপনা করছেন প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক সুশোভন সরকার। ইতিহাস কীভাবে পড়তে হয়, কীভাবে প্রশ্ন তুলতে হয়, সমস্যাকে বিশ্লেষণ করতে হয় সুশোভনবাবুর কাছ থেকে যোগ্য ছাত্র হিসেবে তা শিখে নিয়েছিলেন সব্যসাচীবাবু। পরবর্তীকালে দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ চার দশক অধ্যাপনা করার সূত্রে ইতিহাস পড়ার সেই পদ্ধতিকে তিনি জীবন্তভাবে শিখিয়ে গেছেন তাঁর ছাত্রদের। তাঁর বিশিষ্ট ছাত্ররা, যাঁদের অনেকেই আজ যশস্বী ইতিহাসবিদ, অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাঁদের মাস্টারমশাই সব্যসাচীবাবুর শিক্ষক সত্তাকে। প্রেসিডেন্সি কলেজের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশুনো করেছিলেন।
অসামান্য শিক্ষক— এই পরিচয়ের পাশাপাশি অসামান্য গবেষক হিসেবেও তাঁকে উত্তরকাল মনে রাখবে। তাঁর গবেষণার সূত্রপাত আর এক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী মহাশয়ের কাছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সব্যসাচীবাবুর প্রথম গবেষণা ছিল ব্রিটিশরাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়ে। এই অসামান্য গবেষণাটি পরিমার্জিত আকারে বই হিসেবে বেরনোর পর তিনি ইতিহাসচর্চার জগতে নজর কাড়েন। এই কাজটিতে সব্যসাচীবাবু দেখিয়েছেন ব্রিটিশরাজের রাজস্ব তথা করকাঠামো কেমন ছিল, বিনিয়োগের ধরনধারণ কী ছিল, বাজেট কী ধরনের ছিল ইত্যাদি। রজনী পাম দত্তেরা ব্রিটিশ রাজত্বের অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওপর যে গবেষণা শুরু করেছিলেন, সেই ধারাতেই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে পরিগণিত হয় সব্যসাচীবাবুর কাজটি।
গবেষণার কাজ শেষ হবার পর অশোক মিত্র ও বরুণ দের আগ্রহে সব্যসাচী ভট্টাচার্য যুক্ত হন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে। এখানে থাকতে থাকতেই তিনি পড়তে যান প্রথমে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তারপর অক্সফোর্ডে। অক্সফোর্ডে পড়াশুনোর জন্য সব্যসাচীবাবু আগাথা হ্যারিসন ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।
অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসে সব্যসাচীবাবু যোগ দেন নবগঠিত জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। তাঁর খ্যাতনামা সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন বিপান চন্দ্র, রোমিলা থাপার, এস গোপাল প্রমুখরা। এখানে তিনি চার দশক অধ্যাপনা করেছেন এবং দেশের অসংখ্য ইতিহাসবিদ, গবেষক, অধ্যাপকদের কাছে তাঁর সেই অধ্যাপনা অমূল্য স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে পড়ানোর পাশাপাশিই লেখক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন, ইতিহাসচর্চায় যাদের ভূমিকা অপরিসীম। কেম্ব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া এবং টুয়ার্ডস ফ্রিডম সিরিজ-এর বইগুলো তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়, ইতিহাস চর্চায় যেগুলি অসামান্য মূল্যবান আকর বলে পরিগণিত। অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থরাজির পাশাপাশি সাধারণভাবে আগ্রহী পাঠকের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে লেখা তাঁর ‘ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতি’ বইটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বাংলায় ১৯২০-র দশকে এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক ধারার উদ্ভব বিকাশ আমরা লক্ষ্য করি মূলত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে। সব্যসাচী ভট্টাচার্য তাঁর ‘দ্য ডিফাইনিং মোমেন্টস ইন বেঙ্গল (১৯২০-৪৭) নামের বিখ্যাত বইতে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এই বইটির একটি বাংলা অনুবাদও হয়েছে ‘বাংলায় সন্ধিক্ষণ’ নামে। বাংলার রাজনীতিতে সেই সময় এক নতুন প্রাদেশিক আবেগের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। সব্যসাচীবাবু মনে করেছেন তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল না সত্য, কিন্তু সর্বাংশে তার অনুগামী না হয়ে নিজস্ব পথে চলার চেষ্টা করেছিল। এই প্রাদেশিক চেতনার বিকাশ যে শুধু বাংলাতেই হয়েছিল তা নয়, ভারতের অন্যান্য কিছু অঞ্চলেও তা বিকাশ লাভ করেছিল। রাজনীতির আঙিনার বাইরে সাহিত্য সংস্কৃতির দিকপাল লেখকদের মধ্যেও এর প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই সম্পর্কে সে সময়ের প্রভাবশালী সাহিত্যিক, বিখ্যাত সবুজপত্র পত্রিকার সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর লেখালেখির সাক্ষ্য আমরা গ্রহণ করতে পারি।
এই বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ও প্রভাবসঞ্চারীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল অবশ্যই চিত্তরঞ্জন দাশের মাধ্যমে। সেই সময় বাংলায় কংগ্রেসের পুরনো দিনের নেতৃত্ব উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখদের প্রভাব কমেছে এবং চিত্তরঞ্জন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সামনে এসেছেন। নতুন ধরনের এক রাজনীতি চিত্তরঞ্জনের মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। সে সময় নির্বাচনী রাজনীতির আত্মপ্রকাশের কারণে আমজনতাকে প্রভাবিত করার একটা তাগিদ উদ্ভূত হয়েছিল। প্রবীণ কংগ্রেসীদের মতো বিলেতফেরত নামী ব্যারিস্টার হলেও চিত্তরঞ্জন রাজনীতির ভাষা হিসেবে ইংরেজির জায়গায় বাংলাকে স্থান করে দিলেন। পাশাপাশি বাংলার দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু মুসলিমের ঐক্যের জায়গাটিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিলেন। এই বইতে বাঙালি সত্তার পুনঃনির্মাণের পাশাপাশি যে সমস্ত জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে সব্যসাচীবাবু আলোচনা করেছেন তার মধ্যে আছে নতুন ভদ্রমহিলার উদ্ভাবন, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সত্তা, গান্ধিবাদী রাজনীতি ও তার বিকল্প, বিভেদের রাজনীতির দিনগুলি (১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬) এবং আগ্নেয়গিরির মুখে দাঁড়ানো ১৯৪৬-৪৭ এর সময়পর্ব। অবিভক্ত বাংলার শেষ দিনগুলির আলোচনায় তিনি নিয়ে এসেছেন হৃদয়ের বিভাজনের প্রসঙ্গ। দেশভাগ তথা বাংলাভাগ সম্পর্কে শেষতম গবেষণার উপাদানকে প্রৌঢ়ত্বের সীমা পেরিয়ে আসা বইতে যেভাবে তিনি সমন্বিত ও বিশ্লেষণ করেছেন, তা ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর অসামান্যতার পরিচয় বহন করে।
১৯১৫ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যবর্তী পত্রালাপ ও বিতর্কগুলি নিয়ে সব্যসাচী ভট্টাচার্যের সম্পাদিত ও সংকলিত ‘দ্য মহাত্মা অ্যান্ড দ্য পোয়েট’ বইটি এ যুগের অন্যতম প্রধান দুই মনীষীর সম্পর্ক ও চিন্তাভাবনা বুঝতে অত্যন্ত কার্যকরী। বইটির শুরুতে যে অসামান্য ভূমিকা লিখেছেন সব্যসাচীবাবু তা গান্ধি-রবীন্দ্রনাথ চর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ‘বন্দে মাতরম : দ্য বায়োগ্রাফি অফ এ সং’ সব্যসাচীবাবুর একটি ব্যতিক্রমী বই, যেখানে একটি গানকে ধরে ইতিহাসের নানা পরত উন্মোচিত হয়েছে। কিশোরদের জন্য তিনি গৌতম বুদ্ধের একটি জীবনী গ্রন্থও লিখেছেন। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে সব্যসাচীবাবু যে কাজ করেছেন তা ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি রাজনীতি ও ট্রেড ইউনিয়ন জগতের মানুষজনের কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে।
প্রশাসক হিসেবে সব্যসাচীবাবুর দক্ষতার পরিচয় আছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজের মধ্যে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ এবং সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কোলকাতার চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার একটা উজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।