তানভীর মোকাম্মেল
লেখক বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রপরিচালক এবং গ্রন্থপ্রণেতা। ছায়াছবিতে তাঁর অবদানের কারণে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘একুশে’ পদকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে।
কোনও বড় মাপের মানুষ মারা গেলে আমাদের বাঙালিদের একটা প্রবণতা দেখি সেই মানুষটির স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে নিজেরও কিছু আত্মপ্রচারণা, মানুষটির সঙ্গে নিজের একটা ছবিও তুলে ধরা, দেখো, আমি কত গুরুত্বপূর্ণ! কারও মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে এসব করা আমার কাছে খুবই রুচিহীন বলে মনে হয়। ফলে আমি তা থেকে বিরত রইব। মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রায় তিরিশ বছরের। তবে আমার নিজেকে আড়ালে রেখে আমি চেষ্টা করব শিল্পী মৃণাল সেন ও মৃণাল সেনের যে মূল কাজ, ওর সেই ছবিগুলির একটা নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন তুলে ধরার।
আমাদের ফরিদপুরে জন্ম ও বাল্য-কৈশোর কাটানো, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে পড়া মৃণাল সেন গেলেন ১৯৪০-এর দশকের সেই ঘটনাবহুল কলকাতায়। ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’-র চরিত্রটি বলেছিল এ প্রজন্ম “দাঙ্গা দেখেনি, দুর্ভিক্ষ দেখেনি, দেশভাগ দেখেনি।” কিন্তু মৃণাল সেন এ সবই দেখেছিলেন। প্রতিবাদী হয়েছেন তখন থেকেই। যোগ দিয়েছেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-তে, সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, কলিম শরাফী ও অবশ্যই ঋত্বিক কুমার ঘটককে।
অনেক নির্মাতা যেমন প্রথম ছবিতেই পুরস্কার-টুরস্কার জিতে প্রথম ডুবেই শালুক পান, মৃণাল সেনের ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। মৃণাল সেন ওঁর প্রথম দিককার ছবিগুলি— ‘রাতভোর’, ‘নীল আকাশের নিচে’ এসব ছবিগুলির ব্যাপারে পরবর্তী জীবনে তেমন আগ্রহীও ছিলেন না। সহজ কারণ হচ্ছে মৃণাল সেন নিজেকে তখনও যেন ঠিক খুঁজে পাননি। ওর প্রথম উল্লেখযোগ্য ছবি সে অর্থে ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) যে ছবিতে দুর্ভিক্ষের উল্লেখ ছিল, বাংলার যে দুর্ভিক্ষের বিষয়টি ওঁর আরও দু’টি ছবি ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘আকালের সন্ধানে’-তে উনি খুব বড়ভাবেই তুলে ধরেছেন।
তবে যে ছবিটি মৃণাল সেনকে আলাদাভাবে চেনাল তা’ হচ্ছে ওর ‘ভুবন সোম’ ছবিটি। ভারতীয় ফিল্ম ফিন্যান্স কর্পোরেশনের অর্থায়নে অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত এ ছবিটিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের সূচনা বলা চলে। একজন কড়া আমলা হিসেবে উৎপল দত্তের অনন্য অভিনয় ও এক সরল গ্রাম্য তরুণী হিসেবে সুহাসিনী মুলের সাবলীল পর্দা উপস্থিতি ছাড়াও চলনে, বলনে, পোশাকে এদেশের উপনিবেশোত্তর আমলাতান্ত্রিক আত্মম্ভরিতাকে এ ছবিতে এক হাত নিয়েছেন মৃণাল সেন। সরল গ্রাম্য এক তরুণীর কাছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ আমলা ভুবন সোমের পরাজয় কেবল ব্যক্তিবিশেষের অহংয়ের পরাজয় নয়, মানবিক স্নেহের কাছে উচ্চম্মন্যতারও পরাজয়, আমলাতন্ত্রের অমানবিক নির্মমতার পরাজয় সহজিয়া মানবতার কাছে।
‘ভুবন সোম’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘কলকাতা ৭১’ বা ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে মৃণাল সেন আমাদের যে দেওয়ালের সামনে দাঁড় করান তা’ হচ্ছে উপনিবেশ শাসনোত্তর আমাদের বিকৃত এক রাষ্ট্র ও সমাজ; যে শাসনকাঠামো অবধারিতভাবেই সৃষ্টি করে চলেছে দুর্নীতি, অবক্ষয়; দারিদ্র্য যা লালন করে, পোষণ করে অমানবিকতা, শ্রেণিশোষণ। এক সময় সম্পদ ছিল, ঐতিহ্য ছিল, এখন রয়েছে কেবল ভগ্ন প্রাসাদের দৈন্য— ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘খণ্ডহর’। মৃণাল সেনের ছবিতে দারিদ্র্যের করাল রূপটা দেখি আমরা। এ দারিদ্র্য সর্বগুণবিনাশী— ‘ওকা উরি কথা’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘আকালের সন্ধানে’। দারিদ্র্যই যেন ভিলেন যা মানুষের সব মানবিক সম্ভাবনাগুলোকে কুরেকুরে নষ্ট করে দেয়।
গল্প বলার রীতির ক্ষেত্রে বাংলা সিনেমার যে ঐতিহ্য বলবত ছিল, বা এখনও রয়েছে, সে রকম একরৈখিক বয়ানে গল্প বলার সিনেমা বানাতে চাননি মৃণাল সেন। পরিবর্তন চেয়েছেন কেবল বিষয়বস্তুতে নয়, প্রকরণের দিক থেকেও। ভাঙতে চেয়েছেন গল্প-বলার প্রচলিত বয়ানকে যা বিশ্ব চলচ্চিত্রে সেই ফরাসি নিউ ওয়েভ থেকেই প্রচলিত কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে ছিল অনেকটাই নতুন। তাই কেবল বিষয়বস্তু নয়, বিষয়টাকে কীভাবে তুলে ধরা, ফ্রিজশট, মাস্কিং কখনও একাধিক ফ্ল্যাশব্যাক, নেপথ্যে ধারাভাষ্য, অ্যানিমেশন অথবা নিউজপেপার কাটিং দেখিয়ে এক ধরনের কোলাজ চলচ্চিত্র যেন নির্মাণ করে গেছেন মৃণাল সেন।
তবে কী-না যে তাপে অন্ন মিষ্ট, সে তাপে ব্যঞ্জন নষ্ট হতে পারে। ওর এসব প্রকরণ এক ছবিতে ভালোই লাগে, তবে আরেক ছবিতে তার ব্যবহার ক্লিশে লাগতে পারে। গিমিকের অভিযোগও উঠতে পারে। মৃণাল সেনের বিরুদ্ধে উঠেছেও। এবং পুনরাবৃত্তির ঝোঁক, বিশেষ করে, শেষের দিককার ছবিগুলিতে মৃণাল সেন যেন কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
মৃণাল সেনের সিনেমা হচ্ছে সিনেমা অব আইডিয়াজ, গল্পটা মূল নয়। গল্পের পেছনে মৃণাল সেনের বক্তব্যটাই প্রধান। ওর একটার পর একটা ছবিতে মৃণাল সেন আমাদের যে পাথুরে বাস্তবতার কাছে এনে দাঁড় করান সেখানে এই সত্যটাই মূল, যে সমাজ শ্রেণিবিভক্ত। মুন্সি প্রেমচাঁদের “কাফন” গল্পটির ভিন্ন এক দৃশ্যায়ন করলেন মৃণাল সেন তেলেগু ভাষায়— ‘ওকা উরি কথা’। হতদরিদ্র চরিত্রটি বিশ্বাস করে শ্রম বৃথা, কারণ তা সম্পদশালীদের সম্পদ বৃদ্ধি করে মাত্র। ওর প্রথম রঙিন ছবি ‘মৃগয়া’-তে দেখালেন সাঁওতাল বিদ্রোহের ইঙ্গিত ও কারণ। দেখালেন কীভাবে আদিবাসীদের সারল্যকে শোষণ করে ধুরন্ধর নাগরিক সভ্যতা। আর ‘কলকাতা ৭১’-এর তিনটি পর্বেই রয়েছে বঞ্চিতদের বেঁচে থাকার লড়াই ও দ্বন্দ্ব, যেখানে কুড়ি বছরের প্রতিবাদী এক তরুণকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এরকম এক দৃষ্টিতে দেখা মৃণাল সেনের স্বাভাবিকই ছিল। কারণ উনি জীবন শুরুই করেছিলেন একজন মার্কসবাদী হিসেবে। মার্কসীয় দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব, সেই থিসিস-অ্যান্টিথিসিস আর সিন্থেসিসের এক প্রাথমিক পাঠ দেখি ‘জেনেসিস’ ছবিতে যেখানে এক বিরান প্রান্তরে এক কৃষক, এক তাঁতি এবং এক রমণীর প্রতি তাদের অধিকারবোধে জেগে ওঠে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা, ভাগ করো ও শাসন করো-এর চিরন্তন সেই নীতির প্রকাশ।
‘একদিন প্রতিদিন’ হচ্ছে ‘ভুবন সোম’-এর মতোই মৃণাল সেনের আরেকবার মোড় ফেরা। ফিরে এলেন তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে। বরং বলা চলে বাঙালি মধ্যবিত্তের মূল্যবোধের সঙ্কটের কাছে। বাড়ির তরুণী মেয়েটি রাতে বাড়ি ফিরে এল না— সারারাত। টানটান চিত্রনাট্য, গীতা সেন-শ্রীলা মজুমদারের দৃষ্টিকাড়া অভিনয় ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানব-অনুভূতিগুলো তুলে ধরে মৃণাল সেন আমাদের মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের পাশেই যে মুখব্যাদান করা এক বিশাল অন্ধকার খাদ রয়েছে, তার মুখোমুখি করলেন। মেয়েটি সারারাত বাড়ি ফেরেনি। কোথায় ছিল সে? মৃণাল সেন বলেননি। কেবল আমাদের মধ্যবিত্তদের সম্মানের নিরাপত্তার প্রতি এক বিরাট প্রশ্ন ছুঁড়ে মেরেছেন। বিষয়টি আরো সূক্ষ্মতায় ফুটেছে ‘খারিজ’-এ। অর্থনীতির নোংরা সুতোগুলির আড়ালে মধ্যবিত্তের দ্বিচারিতা যেন আরও নগ্নভাবে তুলে ধরলেন মৃণাল সেন। বরং যে মর্যাদাবোধ নিয়ে মৃত কাজের ছেলেটির গ্রাম থেকে আসা বাবা বিদায় নিল, তা যেন মধ্যবিত্তের সকল ঠুনকো মর্যাদাবোধকেই এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে গেল। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ লেকচারে সত্যজিৎ রায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন— “মৃণাল সেন হিটস সেফ টার্গেটস।” বাঙালি মধ্যবিত্তদের নিয়ে মৃণাল সেন কিন্তু এসব ছবিতে খুব সফলভাবেই ওর টার্গেটগুলোর বিবেককে চাবুক মারতে সক্ষম হয়েছেন।
কোনও কোনও ছবিতে মধ্যবিত্ত অস্তিত্বের আরও গভীরে চলে যান মৃণাল সেন, প্রায় আস্তিত্বিক স্তরে। ‘একদিন আচানক’-এ নিরুদ্দেশ হওয়া অধ্যাপকের মেয়েটি ওই যে বলেছিল— “বাবা বুঝতে পেরেছিল বাবা খুব সাধারণ। আর সাধারণ হিসেবে সারা জীবন কাটানো খুব কষ্টকর। বাবা আর ফিরবে না।” মৃণাল সেন যেন বারবারই মধ্যবিত্তকে তাদের লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও উচ্চম্মন্যতার ঠুনকোপনা সম্পর্কে সচেতন করতে চাইছেন, এসব ছেড়ে তাদেরকে সমাজ বদলানোর বিষয়ে সচেতন করতে চাইছেন, লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন।
আঙ্গিক নিয়ে এক বড় নিরীক্ষা করেছেন মৃণাল সেন অনেক ছবিতেই। বিশেষ করে ‘আকালের সন্ধানে’-তে। গল্প বলার এ এক ভিন্নধর্মী বয়ান— এ ফিল্ম উইদিন এ ফিল্ম। বিষয়টাও ওঁর প্রিয় এক বিষয়— পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং বাংলার জনজীবনে এ মন্বন্তরের প্রতিঘাত। সে দিক থেকে ওঁর সবচে অ-মৃণালীয় ছবি হচ্ছে— ‘খণ্ডহর’। শ্রেণির সংঘাত নেই, দারিদ্র্যের নির্মমতা নেই, বড় কোনও দ্বন্দ্বও নেই। তবে সবচে বিষণ্ণ এক ছবি। এক ভগ্নস্তূপে এক বিষাদময়ী নারীর এক করুণ জীবনগাথা। গভীরভাবে মানবিক এক ছবি।
ঠিক প্রত্যক্ষ রাজনীতি নয়, মহাকালই যেন ছবির বিষয়, মৃণাল সেনের শেষের দিককার ওই ছবিটি— ‘মহাপৃথিবী’। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ছে, বদলে যাচ্ছে পূর্ব ইউরোপ। বাড়ির ছেলেটি নকশাল আন্দোলনে মৃত। ছেলেটি, ছেলেটির মা, পরিবারটি, গোটা এক প্রজন্মই তো বিশ্বাস করেছিল সমাজতন্ত্রে, আত্মহত্যার ডায়েরিতে মায়ের অভিমান— “বুলু, তোরা কী সব মিথ্যে হয়ে যাবি?” এ তো শুধু এক মায়ের প্রশ্ন নয়, শোষণহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখা কয়েক প্রজন্মেরই জিজ্ঞাসা ও অভিমান।
‘র্যাডিক্যাল’, ‘মার্কসবাদী’, ‘ডকট্রিনেয়ের’ এরকম নানা বিশেষণই মৃণাল সেন পেয়েছেন ওঁর জীবদ্দশায়। সে সব হয়তো আংশিক সত্যও। তবে সবার উপরে মৃণাল সেন একজন সৃজনশীল শিল্পী, একজন রাগী শিল্পী যিনি দর্শকদের দিকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ভালবাসেন— ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’। আর সচেষ্ট থাকেন দর্শকের আত্মসন্তুষ্টিকে ভেঙে দিয়ে তাদের মানবিক বিবেকবোধকে জাগ্রত করতে। মৃণাল সেনকে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাই সব সময়ই স্মরণ করা হবে। স্মরণ করা হবে সিনেমা শিল্পমাধ্যমটির উপর সুদক্ষ দখলের একজন নির্মাতা হিসেবে যিনি সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন আমাদের বিবেক ওঁ সমাজের কাছে সদাই কিছু তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে।
আর আমাদের দু’পারের বাঙালিদের কাছেই মৃণাল সেন এমন একজন প্রিয় শিল্পী হিসেবে রয়ে যাবেন যিনি যতদিন খেলেছেন উইকেটের চারিধারে পিটিয়ে খেলেছেন, সব ধরনের শট খেলতে জানতেন। দুঃখজনকভাবে নব্বইয়ের ঘরে তিনি আটকে গেলেন। শতায়ু হতে পারলেন না। এ আক্ষেপ তো আমাদের আজীবন রয়েই যাবে!